ছোটো মালকিন - 1
বেশ কয়েক মাস হল আমি এই শহরে এসেছি। একটা ছোট কোম্পানির বড় ম্যানেজার আমি। বড় ম্যানেজার মানে আর কিছুই না, মানে কোম্পানির মালিকের পরে এই ব্যবসাটা আমারই দায়িত্বে । একটা গালভরা নামও আছে আমার পদের - জেনারেল ম্যানেজার। আসলে মালিক মানে মিস্টার আগরওয়ালের আসল ব্যবসা কাপড়ের। বেশ বড় কারবার, অনেক দিনের। তা উনি একটু অন্য কিছুর ব্যবসায় invest করার প্ল্যান করছিলেন। আজকাল যেরকম বড় ব্যবসায়ীরা diversify করে না, সেরকম। আর সেই সূত্রেই আমার সঙ্গে পরিচয়।
আসলে আমি এর আগে ছিলাম এক বড় কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার। ওই ইংরিজিতে একটা কথা আছে না, 'Small fish in a Big pond', তাই ছিলাম আমি। আমার ওপর এত সিনিয়র লোকেরা ছিলেন, তার ওপর অফিস পলিটিকস, বসের yes-man হওয়া… আমি ওপরে ওঠার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
সেই সময় এই মিস্টার আগারওয়ালের সঙ্গে একটা ট্রেড কনফারেন্সে আলাপ হলো কলকাতার তাজ বেঙ্গলে । উনি আমায় অফার করলেন ওনার এই নতুন ব্যবসার দায়িত্ব নিতে। আমার আগের কোম্পানির Consumer Durables Marketing এর ব্যবসায় ওনার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলনা। অফারটা খুবই ভালো ছিলো। অনেক বড় দায়িত্ব, তার সঙ্গে আর্থিক প্যাকেজটাও যথেষ্টই ভালো।
অসুবিধে দুটো । এক আমায় কলকাতা ছাড়তে হবে, কারণ ওনার ব্যবসা উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর শহরে। সেটার খুব একটা অসুবিধে ছিলনা। আমার বাবা, মা কলকাতায় ছিলেন বটে, কিন্তু আমার বোনের বিয়ে কাছাকাছিই হয়েছিলো। সে দেখাশোনা করে নেবে। আর আমি এমনিতে একটু ইন্ট্রোভার্ট, বন্ধু বান্ধব সেইরকম কিছু নেই, যাদের থেকে দূরে থাকা যায়না।
দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, ওনার এই ব্যবসাটা নতুন। আমায় বড় কোম্পানির সিকিউরিটি ছেড়ে ছোট কোম্পানির অনিশ্চয়তা বেছে নিতে হবে। সেটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। আমার বয়স কম, ২৭ বছর , এখন সময় আছে জীবনে কিংবা ক্যারিয়ারে ঝুঁকি নেওয়ার।
মিস্টার আগরওয়াল একটা আলাদা অফিস খুলেছিলেন এক বছর আগে, এই ব্যবসাটা শুরু করার জন্য। কিন্তু কিছুই হচ্ছিল না। আমি এসে অনেক কিছু পরিবর্তন করলাম, কিছু নতুন ছেলে, মেয়ে আমাদের appliance industry থেকে চাকরিতে নিলাম। উনি আমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। আস্তে আস্তে ব্যবসা বাড়তে লাগলো, আমি কিছু বিজ্ঞাপন দিলাম, বাজারে একটা পরিচিতি হলো । আমি মিস্টার আগারওয়ালের যে পরিচিতি সরকারি আর অন্য ব্যবসায়িক মহলে আছে সেটা কাজে লাগিয়ে কিছু সরকারি আর অন্য বড় সংস্থার ভালো অর্ডারও জোগাড় করে নিলাম।
আমায় কোম্পানির তরফ থেকে ভালো ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল, তাতে সমস্ত আসবাবপত্র, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, গ্যাস আর সব কিছুই ব্যবস্থা করা ছিল। তাছাড়া অফিসের গাড়িটা আমার কাছেই থাকতো। আমি খুব একটা বন্ধুবৎসল নই, তাই আমার একা থাকতে কোনো অসুবিধে হয়না । অফিস থেকে ফিরে, টিভি, মোবাইলেই আমি সময় কাটিয়ে দিতে পারি।
আমাদের কোম্পানির মালিক মিস্টার আগরওয়াল থাকেন এক অভিজাত কমপ্লেক্স এর ভিতর একটা ডুপ্লেক্স বাংলোয়। আমি একবারই গেছি ওনার বাড়িতে একটা অফিসের কাজে, এক রবিবার। ওনার স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিলো। ওনারা দুজনেই খুব সাদামাটা, কোনো বড়লোকি নেই। ওনাদের এক মেয়ে আছে শুনেছি, দেখিনি।
কয়েকদিন আগে একটা বড় অর্ডারের ব্যাপারে মুম্বাই গেছি। মিস্টার আগরওয়াল ও সঙ্গে গেছেন। দিনের শেষে আমাদের কাস্টমারের MD আর তাঁর পরিবারকে আমাদের হোটেলে একটা ডিনার পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছি। MD এসেছেন ওনার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে।
ওনারা চলে যাবার পরে, আমি মিস্টার আগারওয়ালার ঘরেই বসে কথা বলছি। উনি দেখলাম রুম সার্ভিসে ফোন করে আরো ড্রিংকের অর্ডার দিলেন। আমি বললাম, "আপনি আর খাবেন না। আপনার এমনিই বেশি নেওয়া হয়ে গেছে।"
উনি বললেন, "আমার মনটা ভালো নেই সুমিত। আমার আরেকটু ড্রিংক দরকার লাগবে।"
আমি বললাম, "কেনো স্যার? কথাবার্তা তো ভালই হলো MD'র সঙ্গে। অর্ডার তো আমরাই পাবো।"
উনি বললেন, "আমি ব্যবসার জন্যে ভাবছি না। আমি জানি, তুমি আছ, সেটা তুমি ঠিক করেই নেবে। আমার অন্য ব্যথা। ওই MD সাহেবের মেয়েকে দেখলে ? কি সুন্দর হাসিখুশি উজ্জ্বল মেয়ে। আমারও ওই বয়সী একটা মেয়ে আছে।" বলে উনি চোখ মুছলেন।
আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, "কেনো স্যার ? কি হয়েছে? আপনার মেয়ে অসুস্থ ?"
উনি গম্ভীর ভাবে বললেন, "না না, স্বাস্থের কোনো অসুবিধে নেই। বরঞ্চ, স্বাস্থ্য খুবই ভালো। তা বলে তুমি ভেবো না মানসিক কোনো ব্যাপার আছে, তাও নেই।"
আমি বললাম, "আমাকে তো আপনি ছেলের মতন স্নেহ করেন, খুবই ব্যক্তিগত না হলে, আমাকে বলতে পারেন। মনটা হালকা হবে।"
উনি বললেন, "ঠিক আছে, তোমার কাছে বলতেই পারি। আসলে আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছিল না। দুজনেই অনেক চিকিৎসা করিয়েছি , কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শেষে আমরা মনস্থ করলাম যে দত্তক নেবো , মানে তোমরা যেটা বলো adopt করা । বাড়িতে বড়দের বেশ আপত্তি উঠেছিলো । কিন্তূ আমরা বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। সেইমত আমরা তিন মাসের একটি বাচ্ছা মেয়ে adopt করি এক নামী Adoption সেন্টার থেকে।
বাচ্ছাটা খুব সুন্দর বড় হতে থাকলো, আমাদের সংসার আনন্দে ভরে উঠলো। একটু বড় হতে ওকে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো।
ওর যখন ৯ বছর বয়েস, মানে ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন থেকে দেখা গেলো যে ওর উচ্চতা সাধারণ বাচ্ছাদের তুলনায় বেশ বেশি রকম বাড়তে আরম্ভ করেছে। আমি আর আমার স্ত্রী মোটামুটি সাধারণ উচ্চতার । আমার ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি আর আমার স্ত্রীর ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। ছোট্ট পূজা মাত্র ৯ বছর বয়সে ওর মায়ের মাথায় মাথায়, এগারো বছর বয়সে আমাকে ছাড়িয়ে গেলো। মুশকিল হলো ওর স্কুলের সহপাঠীদের চেয়ে ও অনেক লম্বা দেখাতে লাগলো। এমনকি বেশির ভাগ শিক্ষক, শিক্ষিকাদের চেয়েও ও ক্লাস সিক্সেই লম্বা হয়ে গেলো।
বাচ্ছারা কিন্তু ছোটো বয়সে যে ইয়ার্কি গুলো করে সেগুলো মাঝে মাঝে খুব নির্মম হয়। পূজার স্কুলের সহপাঠীরা ওকে ক্ষেপাতে লাগলো। বেবি জিরাফ, বেবি অমিতাভ বচ্চন, তাল গাছ এই সব বলতো।
সেখান থেকেই ঝামেলার শুরু। পূজা পড়াশোনা, খেলাধুলায় বেশ ভালো ছিলো। কিন্তূ ও স্কুল যেতেই চাইতো না। আস্তে আস্তে, কামাই করতে করতে ও স্কুল যাওয়াই ছেড়ে দিলো। আমরা স্কুল পাল্টে, একটা সাধারন স্কুলে ভর্তি করলাম। সেখানে এক বছর ও থাকতে পারলো না। তখন ও আরো লম্বা হয়ে গেছে। ক্লাস সেভেনে যখন ওর বারো বছর বয়স, তখন ও ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা আর ৮০ কেজি ওজন।
ওই আরেকটা ব্যাপার ছিলো। ও খুব খেতে ভালো বাসে। তাই ও মোটা হয়ে যেতে থাকলো। খেলা ধুলা বন্ধ, তাই ওর ওজন বাড়তে লাগলো। স্কুল ছেড়ে বাড়িতে বসে গেলো। আমরা ওকে আর জোর করিনি কিছু। প্রায় ছয় মাস পর যখন একটু স্বাভাবিক হচ্ছে, তখন ওকে বুঝিয়ে বাড়িতে পড়ানোর ব্যবস্থা করলাম।
এমনিতে খুব ভালো বুঝদার মেয়ে। সাস্থের ব্যাপারে আগে সচেতনই ছিলো। খাওয়া খুব একটা কন্ট্রোল করেনি, কিন্তু বাড়িতে ব্যায়াম শুরু করে দিলো। এই করে স্কুলের ক্লাস টেনের বোর্ড এর পরীক্ষা দিলো প্রাইভেট এ। মোটামুটি নম্বর পেয়ে পাসও করলো। কিন্তূ কিছুতেই কলেজে ভর্তি হতে চাইলো না। ও নিজেকে নিয়েই থাকতো । গান, টিভি, খেলার প্রোগ্রাম দেখা, এইসব নিয়েই সময় কাটাতো।
ওর যখন উনিশ বছর বয়স, মানে দুবছর আগে, তখন ও অনেকটা ঠিক আছে। সেবার আমরা একটা ছোট অনুষ্ঠান করলাম পূজার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। কিছু কাছের মামা, মাসী, তাদের ছেলে, মেয়েদের বাড়িতে ডাকলাম। সেখানে খুব হইচই করছে ভাই বোনেরা মিলে। সবাই ওর হাইট মাপলো। তখন ও ৬ ফুট আর ৯৭ কেজি ওজন।
এক মাসতুতো ভাই ওকে বললো, "তুই এত লম্বা, চওড়া কি করে হলি? তোর বাবা , মা তো কেউ লম্বা নয়।"
একটি পাকা মেয়ে তাতে উত্তর দিলো, "সেকি, তোরা জানিস না ? ওরা তো ওর নিজের বাবা, মা নয়। ওকে তো দত্তক নেওয়া হয়েছে। ওর আসল বাবা, মা নিশ্চই খুব লম্বা, চওড়া। তাই ও লম্বা হয়েছে।"
এই একটা কথাতে আমাদের জিবনে অন্ধকার নেমে এলো। আমরা এতদিন এই সত্যটা ওর কাছে গোপন রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম একটু বড় হলে বলবো। তারপর ওর স্কুলের ঝামেলায় যে depression এ চলে গেলো। তাই আর বলে উঠতে পারিনি।
সেইদিন থেকে ও আমাদের বাবা, মা বলা ছেড়ে দিলো। কথাই বলে না। একবার শুধু জানতে চেয়েছিল ওর আসল বাবা, মা কোথায় থাকেন, কি নাম। আমরা বলতে পারিনি। কারণ সত্যিই আমাদের জানানো হয়নি। এটাই ওদের নিয়ম ছিলো। পূজা সেটা বিশ্বাস করলো কিনা জানিনা। আর কোনো কথা বলেনি।
এখন ওই রকম ভাবেই আছে। নিজের ঘরে থাকে। খাবার দিলে খায়। গান শোনে, টিভি দেখে। কিন্তূ আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলে না।"
মিস্টার আগরওয়াল থামলেন। জল খেলেন। বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় । সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।
পরের দিন সকালে ফ্লাইট ধরতে হবে। তাই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। মিস্টার আগরওয়াল এত ভালো মানুষ, আমাকে এত স্নেহ করেন। আমি কি কিছুই করতে পারি না ওনাকে এই দুঃখ থেকে মুক্তি দিতে। কিছু তো একটা করতেই হবে।
রাতে ভালো ঘুম হলো না, একটা কিছু উপায় বার করতে হবে। পরের দিন , শনিবার, সকালের ফ্লাইটে আমি আর মিস্টার আগরওয়াল ফিরছি, মুম্বাই থেকে ভুবনেশ্বর। পাশাপাশি সিট পেয়েছি। আমি বললাম, "স্যার, একটা কথা বলবো। আমাকে একটা সুযোগ দেবেন, আমি একটু চেষ্টা করে দেখবো, আপনার মেয়েকে নরমাল করতে পারি কিনা।"
উনি বললেন, "দেখো বাবা, তুমি যদি মনে করে থাকো যে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবে, সেটা সম্ভব নয়। ও তোমার সঙ্গে যাবেই না। পূজা মানসিক ভাবে শক্ত আছে। অনেক পড়াশোনা করে ইন্টারনেটে। ওর নিজের চেহারা নিয়ে ওর যাবতীয় frustration, সেইগুলো সব রাগ, অভিমান হয়ে আমাদের ওপর এসে পড়েছে এখন।"
আমি বললাম, "না স্যার, আমি কোনো ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবো না। আমি শুধু ওনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। সেইজন্যে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই, ওনার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে।"
উনি বললেন, "ও গান শুনতে ভালো বাসে। পুরনো হিন্দি গান। আর তাছাড়া খেলা দেখতে ভালোবাসে। সব খেলাই দেখে, তবে ভালো বাসে, অ্যাথলেটিকস ওই জাভেলিন, ডিসকাস ছোঁড়া। আর কুস্তি, বক্সিং দেখে। এইগুলো আমরা বাইরে থেকে দেখেছি, ও কি করে। আমাদের কিছু বলেনা আর। তবে, আগে যখন এতোসব কিছু হয়নি, তখন বলতো যে ও কম্পিউটার শিখতে চায়। আর, ও খুব তাড়াতাড়ি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল তো, তাই ইংলিশে কথা বলা, মানে Spoken English course করতে চেয়েছিল, বাড়িতে।"
আমি বললাম, "ব্যাস এতেই হবে। এইবারে শুনুন , আরেকটা সাহায্য করতে হবে আপনাকে । কাল রবিবার। একটা সময় বলুন যখন আপনার বাড়িতে কোনো কাজের লোক থাকবে না। সেই সময়, আপনি আর ম্যাডাম একটু অন্য কোথাও চলে যাবেন, কারো বাড়িতে বা অন্য কোনো জায়গায়। এই এক ঘন্টা মতন। আমি সেইসময় যাবো আপনাদের বাড়ি। তাহলে আপনার মেয়েকে দরজা খুলতে আসতে হবে। তারপর আমার কথা বলার ক্ষমতা আর ভাগ্য। "
উনি বললেন, "দুপুর ২টো থেকে ৫টা কোনো কাজের লোক থাকেনা।"
আমি বললাম, "ঠিক আছে। আমি কাছাকাছিই থাকবো। আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমায় একটা ফোন করে দেবেন।"
উনি বললেন, "দেখো বাবা চেষ্টা করে। আমার তো মনে হয় তোমার সঙ্গে কথাই বলবে না। তবু দেখো…."
পরের দিন দুপুর ২টোর একটু পরে মিস্টার অগরওয়ালের ফোন এলো যে উনি আর ওনার স্ত্রী এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বাড়িতে শুধু ওনার মেয়ে একা আছে। আমি আরো ১০ মিনিট পরে ওনাদের বাড়ি পৌঁছলাম।
দরজায় বেল মেরে দাঁড়িয়ে আছি, কেউ খোলেই না। বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজা খুললো।
আমি মোটামুটি তৈরি ছিলাম, তাই মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ হতে দিইনি। কিন্তূ আমি সত্যিই ঘাবড়ে গেছিলাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটি, আমার মাথা ওর কাঁধ ও পৌঁছচ্ছে না। আমি অবশ্য লম্বা নই, মোটে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি মতন। আর ওজন ৬৩ কেজি। সামনে পূজা কে দেখে মনে হলো নিশ্চই ৬ ফুটের একটু বেশিই হবে আর ১০০ কেজির বেশি ওজন।
আমি যে ওর চেহারা দেখে আশ্চর্য হয়েছি, সেটা বুঝতে না দিয়ে, বললাম, "নমস্কার, আমি সুমিত। আমি আপনার বাবার এপ্লায়েন্স কোম্পানিটার জেনারেল ম্যানেজার। আমি ওনার সঙ্গে গতকাল একটা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে মুম্বাই গেছিলাম। সেই ব্যাপারে একটা ইমেইল আমাদের ক্লায়েন্টকে করতে হবে। ওনারা ফোন করেছিলেন এখন। সমস্ত তথ্য সব আপনার বাবার ল্যাপটপে আছে। আমি ওনাকে ফোন করেছিলাম, উনি বললেন, উনি বাড়িতে নেই। বললেন, আপনার কাছ থেকে ওনার ল্যাপটপটা নিয়ে , ইমেইল টা এখুনি করে দিতে। তাই যদি একটু আপনার বাবার ল্যাপটপটা এনে দেন, খুব উপকার হয়।"
পূজা এতক্ষন এক পলকে আমার দিকে চেয়ে ছিলো, মুখে কোনো অভিব্যাক্তি নেই। এবার, পেছনে সরে গিয়ে বললো, "ভেতরে আসুন "। আমি আমার কোম্পানীর ID কার্ড টা ওর হাতে দিলাম। দেখে ফেরত দিলো।
ভেতরে ঢুকে একটা সোফায় বসলাম। কিছু পরে একটা ল্যাপটপ নিয়ে পূজা আবার ঘরে এলো। আমায় দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি বললাম, "আপনি যাবেন না। আমার এক্ষুনি হয়ে যাবে।"
পূজা একটা সোফায় বসলো, একটা ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলো। আমি ল্যাপটপ খুলে কাজ করার ভান করতে করতে আমার কথা আরম্ভ করে দিলাম। আমি বললাম , আমি কি কাজ করি; আমাদের ব্যবসার কি কি ধরনের প্রোডাক্ট আছে; আমি কত দিন ধরে এই শহরে কাজ করছি। আমি বলতে থাকলাম, " আমি একা একাই থাকতে ভালোবাসি। গান শুনি, পুরনো দিনের হিন্দি গান ভালোবাসি। আর খেলা দেখি টিভিতে। সব রকমের খেলা। তবে বেশি দেখি, ফুটবল, আর ডিসকাস, শটপুট, জ্যাভেলিন। তাছাড়া কুস্তি, বক্সিং, জুডো। আরে আমি তো একাই বকে যাচ্ছি । আপনি তো কিছুই বলছেন না। আপনি কি ভালোবাসেন গানের মধ্যে ?"
পূজা বললো, "আমিও পুরনো হিন্দি সিনেমার গান ভালোবাসি।"
আমি নাছোড়বান্দা, "আর খেলা দেখেন না ?"
উনি বললেন, "হ্যাঁ খেলাও ভালোবাসি। আমিও ওই সব খেলাই দেখি.. strength sports যেগুলো আছে।"
আমি বললাম, "বাহ দারুন ব্যপার তো । আমাদের দুজনের পছন্দ সব মিলে যাচ্ছে।"
পূজা একটু মুচকি হাসলো।
আমি বললাম, "ম্যাডাম জানেন তো, আমি না বেশ ইন্ট্রোভার্ট, সবাইর সঙ্গে ঠিক কথা বলতে পারিনা। কিন্তূ কিছু কিছু মানুষের কাছে আমি বন্ধুর মতন কথা বলতে পারি। একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন না তো ?"
পূজা কিছু বললো না, শুধু চোখ তুলে জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়ে দেখলো।
আমি বললাম, "ম্যাডাম, দেখছেন তো আমি কিরকম বেঁটে। কিন্তূ আমার না এক উদ্ভট খেয়াল আছে, আমি আমার চেয়ে অনেক লম্বা মেয়ে পছন্দ করি। এখনো পর্যন্ত যদিও সেরকম কারো সঙ্গে সাহস করে বন্ধু পাতাতে পারিনি। যদি আমায় ভাগিয়ে দেয়, আমি বেঁটে বলে। আপনি আমার বসের মেয়ে, মানে এক কথায় আপনি আমার ছোটো মালকিন । আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ধৃষ্টতা আমি করতে পারি না। তবে আপনার সঙ্গে যে কথা বলতে পারছি, সেটাই আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। না, আমি আপনার মন রাখতে এ সব কথা বলছি না ম্যাডাম। আমি আমার মায়ের নামে শপথ করে বলতে পারি এই কথা, যে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলছি ।"
পূজা ঘর থেকে উঠে চলে গেলো। যাঃ…
আমি ভাবলাম, আমি বোধহয় কিছুটা বেশিই বলে ফেলেছি। আসলে আমি কিন্তূ আমার মনের কথাই বলে ফেলেছি, তাই এতটা ভাব যুক্ত কথা বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে। আমি সত্যি লম্বা, চওড়া মেয়েই পছন্দ করি। কেনো জানিনা। সেটা এখন থাক, এটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
আমার কাজ তো পণ্ড হয়ে গেলো। ভালো করতে গিয়ে আমি আবার কিছু খারাপ করে ফেলেছি হয়তো। আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে, ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়িয়েছি। ব্যাগটা টেবিলে রেখে আমি দরজার দিকে পা বাড়িয়েছি। এমন সময় পূজা আবার ঘরে ঢুকলো।
এসে আমার একদম সামনে দাঁড়ালো। আমায় মাথাটা অনেক উঁচুতে তুলে ওর মুখের দিকে দেখতে হচ্ছে। দেখি চোখে জল এখনও টলটল করছে। আমার দিকে ওর মুখ নিচু করে বললো, "সরি, আমি ঐরকম ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। আসলে আমার সঙ্গে এইরকম ভাবে কেউ কখনো কথা বলেনি। আমি এত বেঢপ লম্বা বলে সবাই আমাকে বিদ্রুপ করে। আর আপনি আমার এই লম্বা, চওড়া চেহারা দেখেই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছেন। আপনি যদি আমার ব্যবহারে, আমার ওপর রাগ না করে থাকেন, তাহলে আমি আপনার বন্ধু হতে পারি।"
আমার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি বললাম, "বন্ধু যখন, তখন আর আপনি নয়, তুমি।"
পূজা এখন হাসছে, চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি, অদ্ভুত এক দৃশ্য। আমার কাঁধের ওপর দুটো হাত রেখে বললো, "আর এখন থেকে ম্যাডাম নয়, আমি পূজা।"
পূজা আমার হাত ধরে একটা বড় সোফায় পাশাপাশি বসলো। বললো, "তুমি বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।"
আমি বললাম, "একটু বসো না, তোমার সঙ্গে কথা বলি।" আমি ওর হাতের কব্জিটা ধরে ফেলেছি। বাবাহ্, কি চওড়া কব্জি, আমার আঙ্গুল তো পুরোটা জড়িয়ে ধরতেই পারেনি। আমি ওর কব্জিটা আমার দু হাতে ধরে, ওর দিকে মুখ উঁচু করে বললাম, "পূজা তুমি জানোনা তুমি কত সুন্দর।"
পূজা হেঁসে ফেললো, "আর বেশি বোলো না। আমি জানি আমি বেঢপ মোটা আর বিশাল ঢ্যাঙা। তোমার ঐ স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা কি এইরকম বিশ্রী ?"
আমি বললাম, "তুমি শুনেছ তো - 'Beauty lies in the eyes of the beholder'। আমার চোখ দিয়ে দেখলে তুমি অসাধারন সুন্দরী। তোমার এই বিশাল চেহারাতে একটা অদ্ভুত নমনীয়তা আছে। এত সুন্দর লম্বা চওড়া সাস্থ্য, কিন্তু কেমন 'totally feminine'। আর তোমার পাশে দাঁড়ালে, বা বসে থাকলেই মনে কেমন একটা safety, security আসে। তোমার কব্জির হাড় কত চওড়া, আমি এক হাতের মুঠোয় ধরতেই পারছি না। আমি তো মনে হয় আজ তোমাকে পেয়ে পাগলই হয়ে যাবো।"
পূজা ভীষণ হাসছে, বললো, "ব্যাস, ব্যাস, আর বোলো না। এবার আমি তোমার প্রেমেই পড়ে যাবো।"
আমি বললাম, "সে সৌভাগ্য আমার হবে কি না জানি না। তবে তোমার কাছে দুটো জিনিস চাইবো, দেবে ?"
পূজা বললো, "তুমি যা চাইবে , তাই দেবো।"
আমি হেঁসে বললাম, "না, তেমন কিছু নয়, তোমার ফোন নম্বর টা।"
পূজা সঙ্গে সঙ্গে ওর ফোন নম্বর দিয়ে দিলো, আমারটাও দিলাম ওকে। বললো, "আর কি চাই ?"
আমি বললাম, "তোমার সঙ্গে সেলফি।"
পূজা ভীষণ জোরে হেঁসে উঠলো। আমার ফোন বার করে সেলফি নিতে যাচ্ছি, ও আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো। বললো, "আমার হাত লম্বা, আমি তুলছি।"
তারপর বসে, দাঁড়িয়ে অনেক ভাবে বেশ কিছু সেলফি নেওয়া হলো। ও বললো, "এবার আমি একটু আসি, পাঁচ মিনিট।"
ও চলে যেতে, আমি চট করে মিস্টার আগরওয়ালকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম, "স্যার, সব ঠিক হয়ে গেছে , আপনারা চলে আসুন।"
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, "দশ মিনিটে আসছি।"
পূজা ঘরে ঢুকলো একটা মিষ্টির প্লেট হাতে করে, আর জল। আমি বললাম, "এটা কি করেছো? আমি এত কি করে খাবো ? ঠিক আছে, এসো ভাগ করে খাই।"
ও হেঁসে বললো, "তুমি চাও আমি আরো মোটা হই ?"
আমিও হাসলাম, "বললাম না, তুমি যত বেশি বড় হবে আমার থেকে চেহারায়, আমি তত বেশি খুশি হব।"
পূজা বললো, "বাজে কথা ছাড়ো। এবার তোমার কাছে আমি দুটো জিনিস চাই।"
আমি ওর মতনই উত্তর দিলাম, "তুমি যা চাইবে, আমি তাই দেবো।"
ও হেঁসে ফেললো, "এত সব কিছু ছেড়ে দিও না, আমি কিন্তু তাহলে তোমাকেই চেয়ে নেবো।"
আমি বললাম, "সেটা তো আমারই লাভ।"
পূজা বললো, "শোনো না, তুমি আমায় কম্পিউটার আর স্পোকেন ইংলিশ শেখাতে পারবে ?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ নিশ্চই, কবে থেকে শিখবে বলো ?"
ও বললো, "সেটা তোমার যখন সুবিধে, কাজের পর কি ছুটির দিনে।"
আমি বললাম, "রবিবার আর ছুটির দিন তো হতেই পারে। আর তাছাড়া, সপ্তাহে আরো দুটো দিন বার করে নেবো।"
এমন সময় দরজায় বেল বাজলো।
পূজা উঠে গিয়ে দরজা খুললো। ওকে দরজায় দেখে, ওর বাবা, মা ই অবাক। পূজাকে দেখে, হেঁসে, আদর করে ভেতরে এলেন দুজনে।
আমি উঠে গিয়ে প্রণাম করলাম, প্রথমে ম্যাডাম কে। উনি আমার গাল টিপে আদর করলেন। মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করলেন। তারপর মিস্টার আগরওয়াল কে প্রণাম করতে গেছি, উনি আমায় বুকে টেনে নিলেন। বললেন, "তোমার জায়গা এখানে বাবা।"
আমরা সবাই বসলাম, পূজা আগে যেমন বসেছিলো, সেইরকম আমার পাশেই বসলো। ম্যাডাম বললেন, "তোমার স্যার তো তোমার প্রশংসায় একদম পঞ্চমুখ। খুব ভালো কাজ করছ শুনলাম। ব্যবসাটা অনেক ভালো জায়গায় পৌঁছে দিয়েছো।"
আমি বললাম, "স্যার আমার ওপর ভরসা করে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি যা করছি সবই স্যারের দেখানো পথে। ওনার পরিচিতি এত বেশি আর ওনার এত সুনাম, তার জেরেই আমি ব্যবসা করে নিচ্ছি।"
মিস্টার আগরওয়াল বললেন, "দেখলে তো কিরকম বিনয়ী। ওর প্রশংসা করলে, ও ঘুরিয়ে আমার প্রশংসা করে দিলো।" সবাই হাসলো। আমি দেখলাম, পূজা এত খুশি হয়েছে, যেন ওকেই ভালো বলা হয়েছে। ভালো লাগলো দেখে।
আমি বললাম, "স্যার, একটা অনুমতি চাই। আমি আর পূজা একসঙ্গে কিছু কম্পিউটারের কাজ করতে চাই। সপ্তাহে দু তিন দিন আর রবিবার আর ছুটির দিন গুলো। আমি অফিসের পরে চলে আসবো। তারপর কয়েক ঘণ্টা একসঙ্গে কাজ করবো।"
মিস্টার আগরওয়াল বললেন, "এ তো খুব ভালো কথা, এর জন্যে অনুমতির কি আছে ?"
ম্যাডাম বললেন, "আমার একটা শর্ত আছে।" সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে চেয়ে দেখলো ওনার দিকে। কি হলো আবার ?
উনি হেঁসে বললেন, "সুমিত যখনই আসবে, লাঞ্চ কি ডিনার করেই যাবে।" সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো।
স্যার বললেন, "আজ তো রবিবার। আর অনেক সময়ও আছে। সুমিতের যদি অসুবিধে না থাকে তো আজ থেকেই শুরু করে দাও।"
ম্যাডাম বললেন, "হ্যাঁ পূজা, ওকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আর এই মিষ্টির প্লেটটাও নিয়ে যা। কিছুই তো খায়নি, দেখছি।"
আমরা দুজন উঠে দাঁড়ালাম। পূজা মিষ্টির প্লেটটা নিয়ে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমি গেলাম ওর সঙ্গে।
আমরা চলে যাওয়ার পর মিস্টার আগরওয়াল ওনার স্ত্রীর দিকে চেয়ে গর্বের সঙ্গে বললেন, "আমরা যেটা এত বছরে পারলাম না, ছেলেটা এক ঘণ্টারও কম সময়ে করে দিলো। আমি বলি না, ও মানুষের সাইকোলজি খুব ভালো বোঝে। ওর হাতে যদি আমরা পূজা কে তুলে দিতে পারি, তাহলে শান্তি পাই।"
ম্যাডাম বললেন, "আমরা আমাদের স্বার্থের কথাটা দেখছি। কিন্তূ ও কি চাইবে ওর চেয়ে ডবল সাইজের একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। সুমিতের মাথা তো পূজার কাঁধ অবধি ও পৌঁছচ্ছে না। পূজার পাশে তো ওকে একটা বাচ্ছা ছেলে লাগছে। আর তাছাড়া ও রাজি থাকলেও, ওর বাবা, মা কি রাজি হবেন ? সবই আমাদের ভাগ্য।"
স্যার বললেন, "সে তো পরের কথা। ওদের তো এখন অনেক বয়স বাকি আছে। সুমিত ২৭ আর পূজা সবে ২১ । আজ মেয়েকে ফিরে পেয়েছি, আজ কিছু স্পেশাল বানাও।"
দুজনেই খুব খুশি ….