Read Story of Mahabharat Part 154 Arjuns anger on Yudhisthirs scolding and advice of Krishna by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 154

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫৪

যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারে অর্জুনের ক্রোধ এবং কৃষ্ণের উপদেশ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যুধিষ্ঠিরের তিরস্কারে অর্জুনের ক্রোধ এবং কৃষ্ণের উপদেশ

যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার শুনে অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তার খড়্গ হাতে তুলে নিলেন। তা দেখে কৃষ্ণ বললেন, তুমি খড়্গ হাতে নিলে কেন? যুদ্ধের যোগ্য কোনও লোককে এখানে দেখছি না, এখন ভীম দুর্যোধনাদিকে আক্রমণ করেছেন, তুমি যুধিষ্ঠিরকে দেখতে এসেছ, তিনিও কুশলে আছেন। এসব দেখে তোমার আনন্দ হওয়া উচিত, তবে ক্রোধ হোলো কেন? তোমার উদ্দেশ্য কি?

ক্রুদ্ধ সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে অর্জুন বললেন, আমার প্রতিজ্ঞা আছে, যে আমাকে অন্য লোককে গাণ্ডীব দিতে বলবে আমি তার শিরচ্ছেদ করবো। কৃষ্ণ, তোমার সামনেই রাজা যুধিষ্ঠির আমাকে তাই বলেছেন। আমি ধর্মভীরু সেজন্য এঁকে বধ কোরে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবো, সত্যের নিকট ঋণমুক্ত হবো। তুমিই বলো এ সময়ে কি কর্তব্য। তুমি ভূত ভবিষ্যৎ সবই জানো, আমাকে যা বলবে তাই আমি করবো। কৃষ্ণ বললেন, ধিক ধিক! অর্জুন, আমি বুঝেছি তুমি বৃদ্ধের নিকট উপদেশ লাভ করনি, তাই অনর্থক ক্রুদ্ধ হয়েছ। তুমি ধর্মভীরু কিন্তু মূর্খ। যাঁরা ধর্মের সকল বিভাগ জানেন তারা এমন করেন না। যে লোক অকর্তব্য করে এবং কর্তব্যে বিরত থাকে সে পুরুষাধম। আমার মতে প্রাণিবধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বরং অসত্য বলবে কিন্তু প্রাণিহিংসা করবে না। যিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা, ধর্মজ্ঞ ও রাজা, নীচ লোকের ন্যায় তুমি তাকে কি করে হত্যা করতে পারো? তুমি বালকের মতো প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এখন মূঢ়তার বশে অধর্ম কাজে উদ্যত হয়েছ। ধর্মের সূক্ষ্ম ও দুরূহ তত্ত্ব না জেনেই তুমি গুরুহত্যা করতে যাচ্ছ। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, বিদুর বা কুন্তী যে ধর্মতত্ত্ব বলতে পারেন, আমি তাই বলছি শোন - “সত্য বলাই ধর্মসংগত, সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছু নেই। কিন্তু জানবে যে সত্য অনুসারে কাজ করা উচিত কিনা তা স্থির করা অতি দুরূহ। যেখানে মিথ্যাই সত্যতুল্য কল্যাণকর এবং সত্য অকল্যাণকর হয়, সেখানে সত্য বলা অনুচিত, মিথ্যাই বলা উচিত। বিবাহকালে, রতিসম্বন্ধে, প্রাণসংশয়ে, সর্বনাশের সম্ভাবনায়, এবং ব্রাহ্মণের উপকারার্থে মিথ্যা বলা যেতে পারে। এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।”

তার পর কৃষ্ণ বললেন, শিক্ষিত জ্ঞানী লোকে নিদারুণ কর্ম করেও মহৎ পুণ্যের অধিকারী হতে পারেন, যেমন বলাক নামক ব্যাধ অন্ধ পশুকে হত্যা করে হয়েছিল। আবার, মূর্খ ধর্মকামীও মহাপাপগ্রস্ত হতে পারে, যেমন কৌশিক হয়েছিলেন - পুরাকালে বলাক নামে এক ব্যাধ ছিল, সে বৃথা পশুবধ করত না, কেবল স্ত্রী পুত্র পিতা মাতা প্রভৃতির জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্যই করত। একদা সে বনে গিয়ে কোনও শিকার পেলো না, অবশেষে সে দেখল একটি শ্বাপদ জলপান করছে। এই পশুর চক্ষু ছিল না, ঘ্রাণশক্তিই তার দৃষ্টির কাজ করত। বলাক সেই অন্ধ পশুকে বধ করলে আকাশ থেকে তার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হোলো। তারপর সেই ব্যাধকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য একটি মনোরম বিমান এলো, তাতে অপ্সরারা গান গাইছিলো। অর্জুন, সেই পশু বহু প্রাণী বিনষ্ট কোরে অভীষ্ট বর পেয়েছিল, কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে অন্ধ কোরে দেন। সেই বহু প্রাণী হত্যাকারী শ্বাপদকে বধ কোরে বলাক স্বর্গে গিয়েছিল।

কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ গ্রামের অদূরে নদীর সংগমস্থলে বাস করতেন। তিনি তপস্বী কিন্তু বিদ্বান ছিলেন না। তার ই ব্রত ছিল যে সর্বদাই সত্য বলবেন, সেজন্য তিনি সত্যবাদী বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন। একদিন কয়েকজন লোক দস্যুর ভয়ে কৌশিকের তপোবনে আশ্রয় নিলে দস্যুরা খুঁজতে খুঁজতে কৌশিকের কাছে এসে বললো, কয়েকজন লোক এদিকে এসেছিল, তারা কোন্ পথে গেছে যদি জনেন তো বলুন। সত্যবাদী কৌশিক বললেন, তারা এই বনে আশ্রয় নিয়েছে। তখন নিষ্ঠুর দস্যুরা সেই লোকদের খুঁজে বার করে হত্যা করলো। মূর্খ কৌশিক ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানতেন না, তিনি তার কাজের জন্য পাপগ্রস্ত হয়ে কষ্টময় নরকে গিয়েছিলেন।

কাহিনি শেষ কোরে কৃষ্ণ বললেন, কেউ কেউ তর্ক দ্বারা পরমজ্ঞান লাভ করবার চেষ্টা করে, আবার অনেকে বলে ধর্মের তত্ত্ব শ্রুতিতেই আছে। আমি এই দুই মতের কোনওটির দোষ ধরছি না, কিন্তু শ্রুতিতে সমস্ত ধর্মের বিধান নেই, সেজন্য প্রাণিগণের কল্যাণের জন্য এই প্রবচন রচিত হয়েছে – “যে কর্মে হিংসা নেই তা নিশ্চয়ই ধর্ম, প্রাণিগণের অহিংসার জন্য ধর্মপ্রবচন রচিত হয়েছে। ধারণ বা রক্ষা করে এজন্যই ‘ধর্ম’ বলা হয়। ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। যা ধারণ করে তা নিশ্চয়ই ধর্ম। যেখানে অবশ্যই কিছু বলা প্রয়োজন, না বলা শঙ্কাজনক, সেখানে মিথ্যাই বলা উচিৎ, সে মিথ্যাকে নির্বিচারে সত্যের সমান গণ্য করতে হবে।”

তারপর কৃষ্ণ বললেন, যদি মিথ্যা শপথ করে দস্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীরা তাতে অধর্ম দেখতে পান না, কারণ উপায় থাকলে দস্যুকে কখনও ধন দেওয়া উচিত নয়। ধর্মের জন্য মিথ্যা বললে পাপ হয় না। অর্জুন, আমি তোমাকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝিয়ে দিলাম, এখন বলো যুধিষ্ঠিরকে বধ করা উচিত কিনা।

অর্জুন বললেন, তোমার কথা মহাপ্রাজ্ঞ মহামতি পুরুষের যোগ্য, আমাদেরও জন্যও কল্যাণকর। আমি বুঝেছি যে ধর্মরাজ আমার অবধ্য। এখন তুমি আমার সংকল্পের বিষয় শুনে অনুগ্রহ কোরে উপদেশ দাও। তুমি আমার এই প্রতিজ্ঞা জানো — কেউ যদি আমাকে বলে, ‘অপর লোক তোমার চেয়ে অস্ত্রবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ, তুমি তাকে গাণ্ডীব দাও’, তবে আমি তাকে বধ করবো। ভীমেরও প্রতিজ্ঞা আছে, যে তাকে উদরসর্বস্ব বলবে তাকে তিনি বধ করবেন। তোমার সামনেই যুধিষ্ঠির একাধিক বার আমাকে বলেছেন, গাণ্ডীব অন্য লোককে দাও। কিন্তু যদি তাকে বধ করি তবে আমি অল্পকালও জীবিত থাকতে পারব না। কৃষ্ণ, তুমি আমাকে এমন বুদ্ধি দাও যাতে আমার সত্যরক্ষা হয় এবং যুধিষ্ঠির ও আমি দুজনেই জীবিত থাকি।

কৃষ্ণ বললেন, কর্ণের সাথে যুদ্ধ কোরে যুধিষ্ঠির শ্রান্ত দুঃখিত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন, সেজন্যই ক্ষোভ ও ক্রোধের বশে তোমাকে তিরস্কার করেছেন। তার এই কথা বলার উদ্দেশ্য যে ক্রুদ্ধ হলে তুমি কর্ণকে বধ করবে। ইনি এও জানেন যে তুমি ভিন্ন আর কেউ কর্ণের বিক্রম সইতে পারে না। যুধিষ্ঠির অবধ্য, তোমার প্রতিজ্ঞাও পালনীয়। যে উপায়ে উনি জীবিত থেকেই মৃত হবেন তা বলছি শোন। লোকে যত কাল সম্মান লাভ করেন তত কালই জীবিত থাকেন। যখন তিনি অপমানিত হন তখন তাকে জীবন্মৃত বলা যায়। রাজা যুধিষ্ঠির তোমাদের সকলের নিকট সর্বদাই সম্মান পেয়েছেন, এখন তুমি তার কিঞ্চিৎ অপমান করো। অগ্রজ যুধিষ্ঠিরকে “তুমি” সম্বোধন করো। যিনি প্রভু ও গুরুজন তাকে “তুমি” বললে অবধেই তার বধ হয়। এই অপমানে যুধিষ্ঠির নিজেকে নিহত মনে করবেন। তার পর তুমি তার বন্দনা কোরে এবং সান্ত্বনা দিয়ে তার প্রতি আগের মতো আচরণ করবে। যুধিষ্ঠির এতে কখনই রাগ করবেন না। সত্যভঙ্গ ও ভাইকে বধের পাপ থেকে এইরূপে মুক্ত হয়ে তুমি কর্ণকে বধ করো।

______________

(ক্রমশ)