পাঠক যে ভার নিলে সংগত হয় লেখকের প্রতি সে ভার দেওয়া চলে না। নিজের রচনা উপলক্ষে আত্মবিশ্লেষণ শোভন হয় না। তাকে অন্যায় বলা যায় এইজন্যে যে, নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এ কাজ করা অসম্ভব -- এইজন্য নিষ্কাম বিচারের লাইন ঠিক থাকে না। প্রকাশক জানতে চেয়েছেন নৌকাডুবি লিখতে গেলুম কী জন্যে। এ-সব কথা দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। বাইরের খবরটা দেওয়া যেতে পারে, সে হল প্রকাশকের তাগিদ। উৎসটা গভীর ভিতরে, গোমুখী তো উৎস নয়। প্রকাশকের ফরমাশকে প্রেরণা বললে বেশি বলা হয়। অথচ তা ছাড়া বলব কী? গল্পটায় পেয়ে-বসা আর প্রকাশকে পেয়ে-বসা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। বলা বাহুল্য ভিতরের দিকে গল্পের তাড়া ছিল না। গল্পলেখার পেয়াদা যখন দরজা ছাড়ে না তখন দায়ে পড়ে ভাবতে হল কী লিখি। সময়ের দাবি বদলে গেছে। একালে গল্পের কৌতূহলটা হয়ে উঠেছে মনোবিকলনমূলক। ঘটনা-গ্রন্থন হয়ে পড়েছে গৌণ। তাই অস্বাভাবিক অবস্থায় মনের রহস্য সন্ধান করে নায়ক-নায়িকার জীবনে প্রকাণ্ড একটা ভুলের দম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল -- অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু ঔৎসুক্যজনক। এর চরম সাইকলজির প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, স্বামীর সম্বন্ধের নিত্যতা নিয়ে যে সংস্কার- আমাদের দেশের সাধারণ মেয়েদের মনে আছে তার মূল এত গভীর কি না যাতে অজ্ঞানজনিত প্রথম ভালোবাসার জালকে ধিক্কারের সঙ্গে সে ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু এ-সব প্রশ্নের সর্বজনীন উত্তর সম্ভব নয়। কোনো একজন বিশেষ মেয়ের মনে সমাজের চিরকালীন সংস্কার দুর্নিবাররূপে এমন প্রবল হওয়া অসম্ভব নয় যাতে অপরিচিত স্বামীর সংবাদমাত্রেই সকল বন্ধন ছিঁড়ে তার দিকে ছুটে যেতে পারে। বন্ধনটা এবং সংস্কারটা দুই সমান দৃঢ় হয়ে যদি নারীর মনে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের অস্ত্র-চালাচালি চলত তা হলে গল্পের নাটকীয়তা হতে পারত সুতীব্র, মনে চিরকালের মতো দেগে দিত তার ট্র্যাজিক শোচনীয়তার ক্ষতচিহ্ন। ট্র্যাজেডির সর্বপ্রধান বাহন হয়ে রইল হতভাগ্য রমেশ -- তার দুঃখকরতা প্রতিমুখী মনোভাবের বিরুদ্ধতা নিয়ে তেমন নয় যেমন ঘটনাজালের দুর্মোচ্য জটিলতা নিয়ে। এই কারণে বিচারক যদি রচয়িতাকে অপরাধী করেন আমি উত্তর দেব না। কেবল বলব গল্পের মধ্যে যে অংশে বর্ণনায় এবং বেদনায় কবিত্বের স্পর্শ লেগেছে সেটাতে যদি রসের অপচয় না ঘটে থাকে তা হলে সমস্ত নৌকাডুবি থেকে সেই অংশে হয়তো কবির খ্যাতি কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু এও অসংকোচে বলতে পারি নে, কেননা রুচির দ্রুত পরিবর্তন চলেছে।

Full Novel

1

নৌকা ডুবি - 1

সূচনা পাঠক যে ভার নিলে সংগত হয় লেখকের প্রতি সে ভার দেওয়া চলে না। নিজের রচনা উপলক্ষে আত্মবিশ্লেষণ শোভন না। তাকে অন্যায় বলা যায় এইজন্যে যে, নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এ কাজ করা অসম্ভব -- এইজন্য নিষ্কাম বিচারের লাইন ঠিক থাকে না। প্রকাশক জানতে চেয়েছেন নৌকাডুবি লিখতে গেলুম কী জন্যে। এ-সব কথা দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। বাইরের খবরটা দেওয়া যেতে পারে, সে হল প্রকাশকের তাগিদ। উৎসটা গভীর ভিতরে, গোমুখী তো উৎস নয়। প্রকাশকের ফরমাশকে প্রেরণা বললে বেশি বলা হয়। অথচ তা ছাড়া বলব কী? গল্পটায় পেয়ে-বসা আর প্রকাশকে পেয়ে-বসা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। বলা বাহুল্য ভিতরের দিকে গল্পের তাড়া ছিল ...আরও পড়ুন

2

নৌকা ডুবি - 2

2 বাড়ি গিয়া রমেশ খবর পাইল, তাহার বিবাহের পাত্রী ও দিন স্থির হইয়াছে। তাহার পিতা ব্রজমোহনের বাল্যবন্ধু ঈশান যখন করিতেন, তখন ব্রজমোহনের অবস্থা ভালো ছিল না-- ঈশানের সহায়তাতেই তিনি উন্নতিলাভ করিয়াছেন। সেই ঈশান যখন অকালে মারা পড়িলেন, তখন দেখা গেল তাঁহার সঞ্চয় কিছুই নাই, দেনা আছে। বিধবা স্ত্রী একটি শিশুকন্যাকে লইয়া দারিদ্র৻ের মধ্যে ডুবিয়া পড়িলেন। সেই কন্যাটি আজ বিবাহযোগ্যা হইয়াছে, ব্রজমোহন তাহারই সঙ্গে রমেশের বিবাহ স্থির করিয়াছেন। রমেশের হিতৈষীরা কেহ কেহ আপত্তি করিয়া বলিয়াছিল যে, শুনিয়াছি মেয়েটি দেখিতে তেমন ভালো নয়। ব্রজমোহন কহিলেন, "ও-সকল কথা আমি ভালো বুঝি না-- মানুষ তো ফুল কিংবা প্রজাপতি মাত্র নয় যে, ভালো দেখার ...আরও পড়ুন

3

নৌকা ডুবি - 3

3 ৩ কুহেলিকা কাটিয়া গেছে। বহুদূরব্যাপী মরুময় বালুভূমিকে নির্মল জ্যোৎস্না বিধবার শুভ্রবসনের মতো আচ্ছন্ন করিয়াছে। নদীতে নৌকা ছিল না, ছিল না, রোগযন্ত্রণার পরে মৃত্যু যেরূপ নির্বিকার শান্তি বিকীর্ণ করিয়া দেয়, সেইরূপ শান্তি জলে স্থলে স্তব্ধভাবে বিরাজ করিতেছে। সংজ্ঞালাভ করিয়া রমেশ দেখিল, সে বালির তটে পড়িয়া আছে। কী ঘটিয়াছিল, তাহা মনে করিতে তাহার কিছুক্ষণ সময় গেল-- তাহার পরে দুঃস্বপ্নের মতো সমস্ত ঘটনা তাহার মনে জাগিয়া উঠিল। তাহার পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়গণের কী দশা হইল সন্ধান করিবার জন্য সে উঠিয়া পড়িল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, কোথাও কাহারো কোনো চিহ্ন নাই। বালুতটের তীর বাহিয়া সে খুঁজিতে খুঁজিতে চলিল। পদ্মার দুই শাখাবাহুর মাঝখানে এই ...আরও পড়ুন

4

নৌকা ডুবি - 4

4 ৪ সকালবেলায় জেলেডিঙির সাদা-সাদা পালে নদী খচিত হইয়া উঠিল। রমেশ তাহারই একটিকে ডাকাডাকি করিয়া লইয়া জেলেদের সাহায্যে একখানি পানসি ভাড়া করিল এবং নিরুদ্দেশ আত্মীয়দের সন্ধানের জন্য পুলিস নিযুক্ত করিয়া বধূকে লইয়া গৃহে রওনা হইল। গ্রামের ঘাটের কাছে নৌকা পৌঁছিতেই রমেশ খবর পাইল যে, তাহার পিতার, শাশুড়ির ও আর কয়েকটি আত্মীয়-বন্ধুর মৃতদেহ নদী হইতে পুলিস উদ্ধার করিয়াছে। জনকয়েক মাল্লা ছাড়া আর-যে কেহ বাঁচিয়াছে, এমন আশা আর কাহারো রহিল না। বাড়িতে রমেশের বৃদ্ধা ঠাকুরমা ছিলেন, তিনি বধূসহ রমেশকে ফিরিতে দেখিয়া উচ্চকলরবে কাঁদিতে লাগিলেন। পাড়ার যে-সকল বরযাত্র গিয়াছিল, তাহাদেরও ঘরে ঘরে কান্না পড়িয়া গেল। শাঁখ বাজিল না, হুলুধ্বনি হইল না, কেহ ...আরও পড়ুন

5

নৌকা ডুবি - 5

5 ৫ এইরূপে প্রায় তিনমাস অতীত হইয়া গেল। বৈষয়িক ব্যবস্থা সমস্ত সমাধা হইয়া আসিল। প্রাচীনারা তীর্থবাসের জন্য প্রস্তুত হইলেন। হইতে দুই-একটি সঙ্গিনী নববধূর সহিত পরিচয়স্থাপনের জন্য অগ্রসর হইতে লাগিল। রমেশের সঙ্গে বালিকার প্রণয়ের প্রথম গ্রন্থি অল্পে অল্পে আঁট হইয়া আসিল। এখন সন্ধ্যাবেলায় নির্জন ছাদে খোলা আকাশের তলে দুজনে মাদুর পাতিয়া বসিতে আরম্ভ করিয়াছে। রমেশ পিছন হইতে হঠাৎ বালিকার চোখ টিপিয়া ধরে, তাহার মাথাটা বুকের কাছে টানিয়া আনে, বধূ যখন রাত্রি অধিক না হইতেই না খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে, রমেশ তখন নানাবিধ উপদ্রবে তাহাকে সচেতন করিয়া তাহার বিরক্তি-তিরস্কার লাভ করে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় রমেশ বালিকার খোঁপা ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, "সুশীলা, আজ ...আরও পড়ুন

6

নৌকা ডুবি - 6

6 ৬ বালিকা যে রমেশের পরিণীতা স্ত্রী নহে এ কথা রমেশ বুঝিল, কিন্তু সে যে কাহার স্ত্রী তাহা বাহির সহজ হইল না। রমেশ তাহাকে কৌশল করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "বিবাহের সময় তুমি আমাকে যখন প্রথম দেখিলে, তখন তোমার কী মনে হইল?" বালিকা কহিল, "আমি তো তোমাকে দেখি নাই, আমি চোখ নিচু করিয়া ছিলাম।" রমেশ। তুমি আমার নামও শুন নাই? বালিকা। যেদিন শুনিলাম বিবাহ হইবে, তাহার পরের দিনই বিবাহ হইয়া গেল-- তোমার নাম আমি শুনিই নাই। মামী আমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করিয়া বাঁচিয়াছেন। রমেশ। আচ্ছা, তুমি যে লিখিতে-পড়িতে শিখিয়াছ, তোমার নিজের নাম বানান করিয়া লেখো দেখি। রমেশ তাহাকে একটু কাগজ, একটা পেনসিল ...আরও পড়ুন

7

নৌকা ডুবি - 7

7 ৭ এইবার আলিপুরে ওকালতির কাজ শুরু করিয়া দিবে, রমেশের এইরূপ সংকল্প ছিল। কিন্তু তাহার মন ভাঙিয়া গেছে। চিত্ত করিয়া কাজে হাত দিবার এবং প্রথম কার্যারম্ভের নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিবার মতো স্ফূর্তি তাহার ছিল না। সে এখন কিছুদিন গঙ্গার পোলের উপর এবং গোলদিঘিতে অনাবশ্যক ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। একবার মনে করিল "কিছুদিন পশ্চিমে ভ্রমণ করিয়া আসি', এমন সময় অন্নদাবাবুর কাছ হইতে একখানি চিঠি পাইল। অন্নদাবাবু লিখিতেছেন, "গেজেটে দেখিলাম, তুমি পাস হইয়াছ-- কিন্তু সে খবর তোমার নিকট হইতে না পাইয়া দুঃখিত হইলাম। বহুকাল তোমার কোনো সংবাদ পাই নাই। তুমি কেমন আছ এবং কবে কলিকাতায় আসিবে, জানাইয়া আমাকে নিশ্চিন্ত ও সুখী করিবে।" ...আরও পড়ুন

8

নৌকা ডুবি - 8

8 ৮ রমেশ পূর্বের বাসায় আসিতে বিলম্ব করিল না। ইহার আগে হেমনলিনীর সঙ্গে রমেশের যতটুকু দূরভাব ছিল, এবারে তাহা রহিল না। রমেশ যেন একেবারে ঘরের লোক। হাসিকৌতুক নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ খুব জমিয়া উঠিল। অনেক কাল অনেক পড়া মুখস্থ করিয়া ইতিপূর্বে হেমনলিনীর চেহারা একপ্রকার ক্ষণভঙ্গুর গোছের ছিল। মনে হইত, যেন একটু জোরে হাওয়া লাগিলেই শরীরটা কোমর হইতে হেলিয়া ভাঙিয়া পড়িতে পারে। তখন তাহার কথা অল্প ছিল, এবং তাহার সঙ্গে কথা কহিতেই ভয় হইত-- পাছে সামান্য কিছুতেই সে অপরাধ লয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাহার আশ্চর্য পরিবর্তন হইয়াছে। তাহার পাংশুবর্ণ কপোলে লাবণ্যের মসৃণতা দেখা দিল। তাহার চক্ষু এখন কথায় কথায় হাস্যচ্ছটায় নাচিয়া উঠে। ...আরও পড়ুন

9

নৌকা ডুবি - 9

9 ৯ প্রণয়ীদের জন্য কাব্যে যে-সকল আয়োজনের ব্যবস্থা আছে, কলিকাতা শহরে তাহা মেলে না। কোথায় প্রফুল্ল অশোক-বকুলের বীথিকা, কোথায় মাধবীর প্রচ্ছন্ন লতাবিতান, কোথায় চূতকষায়কণ্ঠ কোকিলের কুহুকাকলি? তবু এই শুষ্ককঠিন সৌন্দর্যহীন আধুনিক নগরে ভালোবাসার জাদুবিদ্যা প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া যায় না। এই গাড়িঘোড়ার বিষম ভিড়ে, এই লৌহনিগড়বদ্ধ ট্রামের রাস্তায় একটি চিরকিশোর প্রাচীন দেবতা তাঁহার ধনুকটি গোপন করিয়া লালপাগড়ি প্রহরীদের চক্ষের সম্মুখ দিয়া কত রাত্রে কত দিনে কত বার কত ঠিকানায় যে আনাগোনা করিতেছেন, তাহা কে বলিতে পারে। রমেশ ও হেমনলিনী চামড়ার দোকানের সামনে, মুদির দোকানের পাশে, কলুটোলায় ভাড়াটে বাড়িতে বাস করিতেছিল বলিয়া প্রণয়বিকাশ সম্বন্ধে কুঞ্জকুটিরচারীদের চেয়ে তাহারা যে কিছুমাত্র পিছাইয়া ছিল, ...আরও পড়ুন

10

নৌকা ডুবি - 10

10 ১০ অক্ষয়ের গলা বিশেষ ভালো ছিল না, কিন্তু সে যখন নিজে বেহালা বাজাইয়া গান গাহিত তখন অত্যন্ত কড়া ছাড়া সাধারণ শ্রোতার দল আপত্তি করিত না, এমন-কি, আরো গাহিতে অনুরোধ করিত। অন্নদাবাবুর সংগীতে বিশেষ অনুরক্তি ছিল না, কিন্তু সে কথা তিনি কবুল করিতে পারিতেন না-- তবু তিনি আত্মরক্ষার কথঞ্চিৎ চেষ্টা করিতেন। কেহ অক্ষয়কে গান গাহিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলিতেন, "ঐ তোমাদের দোষ, বেচারা গাহিতে পারে বলিয়াই কি উহার 'পরে অত্যাচার করিতে হইবে?" অক্ষয় বিনয় করিয়া বলিত, "না না অন্নদাবাবু, সেজন্য ভাবিবেন না-- অত্যাচারটা কাহার 'পরে হইবে সেইটেই বিচার্য।" অনুরোধের তরফ হইতে জবাব আসিত, "তবে পরীক্ষা হউক।" সেদিন অপরাহ্নে খুব ...আরও পড়ুন

11

নৌকা ডুবি - 11

11 ১১ প্রায় প্রতিবৎসর শরৎকালে পূজার টিকিট বাহির হইলে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু জব্বলপুরে তাঁহার ভগিনীপতির কর্মস্থানে বেড়াইতে যাইতেন। পরিপাকশক্তির জন্য তাঁহার এই সাংবৎসরিক চেষ্টা। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি হইয়া আসিল, এবারে পূজার ছুটির আর বড়ো বেশি বিলম্ব নাই। অন্নদাবাবু এখন হইতেই তাঁহার যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইয়াছেন। আসন্ন বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় রমেশ আজকাল খুব বেশি করিয়া হারমোনিয়ম শিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। একদিন কথায় কথায় হেমনলিনী কহিল, "রমেশবাবু, আমার বোধ হয়, আপনার অন্তত কিছুদিন বায়ুপরিবর্তন দরকার। না বাবা?" অন্নদাবাবু ভাবিলেন কথাটা সংগত বটে, কারণ ইতিমধ্যে রমেশের উপর দিয়া শোকদুঃখের দুর্যোগ গিয়াছে। কহিলেন, "অন্তত কিছুদিনের জন্য কোথাও বেড়াইয়া আসা ভালো। বুঝিয়াছ রমেশ, পশ্চিমই বল আর ...আরও পড়ুন

12

নৌকা ডুবি - 12

12 ১২ পিল খাওয়ার পর অন্নদাবাবু অক্ষয়কে শীঘ্র ছাড়িতে চাহিলেন না। অক্ষয়ও যাইবার জন্য বিশেষ ত্বরা প্রকাশ না করিয়া মাঝে রমেশের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। রমেশের চোখে সহজে কিছু পড়ে না-- কিন্তু আজ অক্ষয়ের এই কটাক্ষগুলি তাহার চোখ এড়াইল না। ইহাতে তাহাকে বার বার উদ্‌বেজিত করিয়া তুলিতে লাগিল। পশ্চিমে বেড়াইতে যাইবার সময় নিকটবর্তী হইয়া উঠিয়াছে-- মনে মনে তাহারই আলোচনায় হেমনলিনীর চিত্ত আজ বিশেষ প্রফুল্ল ছিল। সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, আজ রমেশবাবু আসিলে ছুটিযাপন সম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে নানাপ্রকার পরামর্শ করিবে। সেখানে নিভৃতে কী কী বই পড়িয়া শেষ করিতে হইবে, দুজনে মিলিয়া তাহার একটা তালিকা করিবার কথা ছিল। স্থির ছিল, ...আরও পড়ুন

13

নৌকা ডুবি - 13

13 ১৩ বিদ্যালয়ের ছুটি নিকটবর্তী। ছুটির সময়ে কমলাকে বিদ্যালয়েই রাখিবার জন্য রমেশ কর্ত্রীর সহিত পূর্বেই ঠিক করিয়াছিল। রমেশ প্রত্যুষে ময়দানের নির্জন রাস্তায় পদচারণা করিতে করিতে স্থির করিল, বিবাহের পর সে কমলা সম্বন্ধে হেমনলিনীকে সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া বিস্তারিত করিয়া বলিবে। তাহার পরে কমলাকেও সমস্ত কথা বলিবার অবকাশ হইবে। এইরূপ সকল পক্ষে বোঝাপড়া হইয়া গেলে কমলা স্বচ্ছন্দে বন্ধুভাবে হেমনলিনীর সঙ্গেই বাস করিতে পারিবে। দেশে ইহা লইয়া নানা কথা উঠিতে পারে, ইহাই মনে করিয়া সে হাজারিবাগে গিয়া প্র৻াক্‌টিস করিবে স্থির করিয়াছে। ময়দান হইতে ফিরিয়া আসিয়া রমেশ অন্নদাবাবুর বাড়ি গেল। সিঁড়িতে হঠাৎ হেমনলিনীর সঙ্গে দেখা হইল। অন্যদিন হইলে এরূপ সাক্ষাতে একটু কিছু আলাপ ...আরও পড়ুন

14

নৌকা ডুবি - 14

14 ১৪ রমেশ অন্নদাবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন অন্নদাবাবু মুখের উপরে খবরের কাগজ চাপা দিয়া কেদারায় পড়িয়া নিদ্রা রমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া কাসিতেই তিনি চকিত হইয়া উঠিয়া খবরের কাগজটা তুলিয়া ধরিয়াই কহিলেন, "দেখিয়াছ রমেশ, এবারে ওলাউঠায় কত লোক মরিয়াছে?" রমেশ কহিল, "বিবাহ এখন কিছুদিন বন্ধ রাখিতে হইবে-- আমার বিশেষ কাজ আছে।" অন্নদাবাবুর মাথা হইতে শহরের মৃত্যুতালিকার বিবরণ একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। ক্ষণকাল রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, "সে কী কথা রমেশ! নিমন্ত্রণ যে হইয়া গেছে।" রমেশ কহিল, "এই রবিবারের পরের রবিবারে দিন পিছাইয়া দিয়া আজই পত্র বিলি করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।" অন্নদা। রমেশ, তুমি আমাকে অবাক করিলে। একি ...আরও পড়ুন

15

নৌকা ডুবি - 15

15 ১৫ অন্নদাবাবু রমেশকে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া উদ্‌বিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। রমেশ কহিল, "নিমন্ত্রণের ফর্দটা যদি হাতে দেন, তবে দিনপরিবর্তনের চিঠিগুলি আজই রওনা করিয়া দিতে পারি।" অন্নদাবাবু কহিলেন, "তবে দিনপরিবর্তনই স্থির রহিল?" রমেশ কহিল, "হাঁ, অন্য উপায় আর কিছুই দেখি না।" অন্নদাবাবু কহিলেন, "দেখো বাপু, তবে আমি ইহার মধ্যে নাই। যাহা-কিছু বন্দোবস্ত করিবার, সে তুমিই করিয়ো। আমি লোক হাসাইতে পারিব না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে যদি নিজের মর্জি অনুসারে ছেলেখেলা করিয়া তোল, তবে আমার মতো বয়সের লোকের ইহার মধ্যে না থাকাই ভালো। এই লও তোমার নিয়ন্ত্রণের ফর্দ। ইতিমধ্যে আমি কতকগুলা টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার অনেকটাই নষ্ট হইবে। এমনি ...আরও পড়ুন

16

নৌকা ডুবি - 16

16 ১৬ চিঠি বিলি করিয়া দিতে রাত হইয়া পড়িল। রমেশ শুইতে গেল, কিন্তু ঘুম হইল না। তাহার মনের ভিতরে মতো সাদা-কালো দুই রঙের চিন্তাধারা প্রবাহিত হইতেছিল। দুইটার কল্লোল একসঙ্গে মিশিয়া তাহার বিশ্রামক্ষণকে মুখর করিয়া তুলিতেছিল। বারকয়েক পাশ ফিরিয়া সে উঠিয়া পড়িল। জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দেখিল তাহাদের জনশূন্য গলির এক পাশে বাড়িগুলির ছায়া, আর-এক পাশে শুভ্র জ্যোৎস্নার রেখা। রমেশ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যাহা নিত্য, যাহা শান্ত, যাহা বিশ্বব্যাপী, যাহার মধ্যে দ্বন্দ্ব নাই, দ্বিধা নাই, রমেশের সমস্ত অন্তঃপ্রকৃতি বিগলিত হইয়া তাহার মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল। যে শব্দবিহীন সীমাবিহীন মহালোকের নেপথ্য হইতে চিরকাল ধরিয়া জন্ম এবং মৃত্যু, কর্ম এবং বিশ্রাম, আরম্ভ ...আরও পড়ুন

17

নৌকা ডুবি - 17

17 ১৭ পরদিন সকালের গাড়িতে যোগেন্দ্র পশ্চিম হইতে ফিরিয়া আসিল। আজ শনিবার, কাল রবিবারে হেমনলিনীর বিবাহের কথা। কিন্তু যোগেন্দ্র বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া উৎসবের স্বাদগন্ধ কিছুই পাইল না। যোগেন্দ্র মনে করিয়া আসিতেছিল এতক্ষণে তাহাদের বাসার বারান্দার উপর দেবদারুপাতার মালা ঝোলানো শুরু হইয়াছে-- কাছে আসিয়া দেখিল, শ্রীহীন মালিন্যে পাশের বাড়ির সঙ্গে তাহাদের বাড়ির কোনো প্রভেদ নাই। ভয় হইল পাছে কাহারো অসুখ-বিসুখ করিয়া থাকে। বাড়িতে প্রবেশ করিয়া দেখিল চায়ের টেবিলে তাহার জন্য আহারাদি প্রস্তুত রহিয়াছে এবং অন্নদাবাবু অর্ধভুক্ত চায়ের পেয়ালা সম্মুখে রাখিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। যোগেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, "হেম কেমন আছে?" অন্নদা। ভালো। যোগেন্দ্র। বিবাহের কী হইল? অন্নদা। কাল ...আরও পড়ুন

18

নৌকা ডুবি - 18

18 ১৮ রমেশ দরজিপাড়ায় যে বাসায় ছিল, সে বাসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হইয়া যায় নাই, তাহা আর-কাহাকেও ভাড়া দেওয়া সম্বন্ধে চিন্তা করিবার অবসর পায় নাই। সে এই কয়েক মাস সংসারের বাহিরে উধাও হইয়া গিয়াছিল, লাভক্ষতিকে বিচারের মধ্যেই আনে নাই। আজ সে প্রত্যুষে সেই বাসায় গিয়া ঘর-দুয়ার সাফ করাইয়া লইয়াছে, তক্তপোশের উপর বিছানা পাতাইয়াছে এবং আহারাদিরও বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছে। আজ ইস্কুলে ছুটির পর কমলাকে আনিতে হইবে। সে এখনো দেরি আছে। ইতিমধ্যে রমেশ তক্তপোশের উপর চিত হইয়া ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে লাগিল। এটোয়া সে কখনো দেখে নাই-- কিন্তু পশ্চিমের দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন নহে। শহরের প্রান্তে তাহার বাড়ি-- তরুশ্রেণীদ্বারা ছায়াখচিত বড়ো রাস্তা তাহার ...আরও পড়ুন

19

নৌকা ডুবি - 19

19 ১৯ যোগেন্দ্র কহিল, "রমেশ, এই মেয়েটি কে?" রমেশ কহিল, "আমার একটি আত্মীয়।" যোগেন্দ্র কহিল, "কী রকমের আত্মীয়? বোধ গুরুজন কেহ হইবেন না, স্নেহের সম্পর্কও বোধ হইল না। তোমার সকল আত্মীয়ের কথাই তো তোমার কাছ হইতে শুনিয়াছি-- এ আত্মীয়ের তো কোনো বিবরণ শুনি নাই।" অক্ষয় কহিল, "যোগেন, এ তোমার অন্যায়-- মানুষের কি এমন কোনো কথা থাকিতে পারে না যাহা বন্ধুর কাছেও গোপনীয়?" যোগেন্দ্র। কী রমেশ, অত্যন্ত গোপনীয় নাকি? রমেশের মুখ লাল হইয়া উঠিল; সে কহিল, "হাঁ গোপনীয়। এই মেয়েটির সম্বন্ধে আমি তোমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি না।" যোগেন্দ্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করিতে বিশেষ ইচ্ছা ...আরও পড়ুন

20

নৌকা ডুবি - 20

20 ২০ অন্নদাবাবু একান্তমনে আশা করিতেছিলেন-- যোগেন্দ্র ভালো খবর লইয়া আসিবে, সমস্ত গোলমাল অতি সহজে পরিষ্কার হইয়া যাইবে। যোগেন্দ্র অক্ষয় যখন ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, অন্নদাবাবু ভীতভাবে তাহাদের মুখের দিকে চাহিলেন। যোগেন্দ্র কহিল, "বাবা, তুমি যে রমেশকে এতদূর পর্যন্ত বাড়াবাড়ি করিতে দিবে, তাহা কে জানিত। এমন জানিলে আমি তোমাদের সঙ্গে তাহার আলাপ করাইয়া দিতাম না।" অন্নদাবাবু। রমেশের সঙ্গে হেমনলিনীর বিবাহ তোমার অভিপ্রেত, এ কথা তুমি তো আমাকে অনেকবার বলিয়াছ। বাধা দিবার ইচ্ছা যদি তোমার ছিল, তবে আমাকে-- যোগেন্দ্র। অবশ্য একেবারে বাধা দিবার কথা আমার মনে আসে নাই, কিন্তু তাই বলিয়া-- অন্নদাবাবু। ঐ দেখো, ওর মধ্যে "তাই বলিয়া' কোথায় থাকিতে ...আরও পড়ুন

21

নৌকা ডুবি - 21

21 ২১ রাত্রি নয়টার সময় রমেশ কমলাকে লইয়া শেয়ালদহ-স্টেশনে যাত্রা করিল। যাইবার সময় একটু ঘুরপথ দিয়া গেল। গাড়োয়ানকে অনাবশ্যক গলি ঘুরাইয়া লইল। কলুটোলায় একটা বাড়ির কাছে আসিয়া আগ্রহসহকারে মুখ বাড়াইয়া দেখিল। পরিচিত বাড়ির তো কোনো পরিবর্তন হয় নাই। রমেশ এমন একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল যে, নিদ্রাবিষ্ট কমলা চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, "তোমার কী হইয়াছে?" রমেশ উত্তর করিল, "কিছুই না।" আর কিছুই বলিল না; গাড়ির অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। দেখিতে দেখিতে গাড়ির কোণে মাথা রাখিয়া কমলা আবার ঘুমাইয়া পড়িল। ক্ষণকালের জন্য কমলার অস্তিত্বকে রমেশের যেন অসহ্য বোধ হইল। গাড়ি যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছিল। একটি সেকেণ্ড্‌-ক্লাস গাড়ি পূর্ব হইতেই রিজার্ভ্‌ ...আরও পড়ুন

22

নৌকা ডুবি - 22

22 ২২ অক্ষয় সমস্তদিন গোয়ালন্দে ছট্‌ফট্‌ করিয়া কাটাইয়া সন্ধ্যার ডাকগাড়িতে উঠিয়া পড়িল। পরদিন ভোরে কলিকাতায় পৌঁছিয়া প্রথমেই সে রমেশের বাসায় আসিয়া দেখিল, তাহার দ্বার বন্ধ; খবর লইয়া জানিল, সেখান কেহই আসে নাই। কলুটোলায় আসিয়া দেখিল, রমেশের বাসা শূন্য। অন্নদাবাবুর বাসায় আসিয়া যোগেন্দ্রকে কহিল, "পালাইয়াছে, ধরিতে পারিলাম না।" যোগেন্দ্র কহিল, "সে কী কথা?" অক্ষয় তাহার ভ্রমণবৃত্তান্ত বিবৃত করিয়া বলিল। অক্ষয়কে দেখিতে পাইয়া রমেশ কমলাকে সুদ্ধ লইয়া পালাইয়াছে, এই খবরে রমেশের বিরুদ্ধে যোগেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হইল। যোগেন্দ্র কহিল, "কিন্তু অক্ষয়, এ-সমস্ত যুক্তি কোনো কাজেই লাগিবে না। শুধু হেমনলিনী কেন, বাবা-সুদ্ধ ঐ এক বুলি ধরিয়াছেন-- তিনি বলেন, রমেশের নিজের ...আরও পড়ুন

23

নৌকা ডুবি - 23

23 ২৩ স্টীমার ছাড়িয়া দিল। প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় কেহই ছিল না। রমেশ একটি কামরা বাছিয়া লইয়া বিছানা পাতিয়া সকালবেলা দুধ খাইয়া সেই কামরার দরজা খুলিয়া কমলা নদী ও নদীতীর দেখিতে লাগিল। রমেশ কহিল, "জান, কমলা, আমরা কোথায় যাইতেছি?" কমলা কহিল, "দেশে যাইতেছি।" রমেশ। দেশ তো তোমার ভালো লাগে না-- আমরা দেশে যাইব না। কমলা। আমার জন্যে তুমি দেশে যাওয়া বন্ধ করিয়াছ? রমেশ। হাঁ, তোমারই জন্যে। কমলা মুখ ভার করিয়া কহিল, "কেন তা করিলে? আমি একদিন কথায় কথায় কী বলিয়াছিলাম, সেটা বুঝি এমন করিয়া মনে লইতে আছে? তুমি কিন্তু ভারি অল্পেতেই রাগ কর।" রমেশ হাসিয়া কহিল, "আমি কিছুমাত্র রাগ ...আরও পড়ুন

24

নৌকা ডুবি - 24

24 ২৪ তখনো বেলা যায় নাই, এমন সময় স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেল। সেদিন অনেক ঠেলাঠেলিতেও স্টীমার ভাসিল না। উঁচু নীচে জলচর পাখিদের পদাঙ্কখচিত এক স্তর বালুকাময় নিম্নতট কিছু দূর হইতে বিস্তীর্ণ হইয়া নদীতে আসিয়া নামিয়াছে। সেইখানে গ্রামবধূরা তখন দিনান্তের শেষ জলসঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য ঘট লইয়া আসিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে কোনো কোনো প্রগল্‌ভা বিনা অবগুণ্ঠনে এবং কোনো কোনো ভীরু ঘোমটার অন্তরাল হইতে স্টীমারের দিকে চাহিয়া কৌতূহল মিটাইতেছিল। উর্ধ্বনাসিক স্পর্ধিত জলযানটার দুর্বিপাকে গ্রামের ছেলেগুলো পাড়ের উপরে দাঁড়াইয়া চীৎকারস্বরে ব্যঙ্গোক্তি করিতে করিতে নৃত্য করিতেছিল। ও পারের জনশূন্য চরের মধ্যে সূর্য অস্ত গেল। রমেশ জাহাজের রেলিং ধরিয়া সন্ধ্যার আভায় দীপ্যমান পশ্চিম দিগন্তের দিকে ...আরও পড়ুন

25

নৌকা ডুবি - 25

25 ২৫ তীরের বনরাজি অবিচ্ছিন্ন মসীলেখায় সন্ধ্যবধূর সোনার অঞ্চলে কালো পাড় টানিয়া দিল। গ্রামান্তরের বিলের মধ্যে সমস্ত দিন চরিয়া দল আকাশের ম্লানায়মান সূর্যাস্তদীপ্তির মধ্য দিয়া ও পারের তরুশূন্য বালুচরে নিভৃত জলাশয়গুলিতে রাত্রিযাপনের জন্য চলিয়াছে। কাকেদের বাসায় আসিবার কলরব থামিয়া গেছে। নদীতে তখন নৌকা ছিল না; একটিমাত্র বড়ো ডিঙি গাঢ় সোনালি-সবুজ নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া আপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চালিয়াছিল। রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবোদিত শুক্লপক্ষের তরুণ চাঁদের আলোকে বেতের কেদারা টানিয়া লইয়া বসিয়া ছিল। পশ্চিম-আকাশ হইতে সন্ধ্যার শেষ স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল; চন্দ্রালোকের ইন্দ্রজালে কঠিন জগৎ যেন বিগলিত হইয়া আসিল। রমেশ আপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল "হেম, হেম!" সেই ...আরও পড়ুন

26

নৌকা ডুবি - 26

26 ২৬ কমলা রুদ্ধনিশ্বাসে একান্ত আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, "তার পরে?" রমেশ কহিল, "এই পর্যন্তই জানি, তার পরে আর না। তুমিই বলো দেখি, তার পরে কী।" কমলা। না না, সে হইবে না, তার পরে কী আমাকে বলো। রমেশ। সত্য বলিতেছি, যে গ্রন্থ হইতে এই গল্প পাইয়াছি তাহা এখনো সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় নাই--শেষের অধ্যায়গুলি কবে বাহির হইবে কে জানে। কমলা অত্যন্ত রাগ করিয়া কহিল, "যাও, তুমি ভারি দুষ্ট! তোমার ভারি অন্যায়।" রমেশ। যিনি বই লিখিতেছেন তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করো। তোমাকে আমি কেবল এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছি, চন্দ্রাকে লইয়া চেৎসিং কী করিবে? কমলা তখন নদীর দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল; অনেকক্ষণ পরে ...আরও পড়ুন

27

নৌকা ডুবি - 27

27 ২৭ পরদিন কমলা যখন ঘুম হইতে জাগিল,তখন ভোর-রাত্রি। চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, ঘরে কেহ নাই। মনে পড়িয়া গেল, জাহাজে আছে। আস্তে আস্তে উঠিয়া দরজা ফাঁক করিয়া দেখিল, নিস্তব্ধ জলের উপর সূক্ষ্ম একটুখানি শুভ্র কুয়াশার আচ্ছাদন পড়িয়াছে, অন্ধকার পাণ্ডুবর্ণ হইয়া আসিয়াছে এবং পূর্বদিকে তরুশ্রেণীর পশ্চাতের আকাশে স্বর্ণচ্ছটা ফুটিয়া উঠিতেছে। দেখিতে দেখিতে নদীর পাণ্ডুর নীলধারা জেলেডিঙির সাদা সাদা পালগুলিতে খচিত হইয়া উঠিল। কমলা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না, তাহার মনের মধ্যে কী একটা গূঢ় বেদনা পীড়ন করিতেছে। শরৎকালের এই শিশিরবাষ্পাম্বরা উষা কেন আজ তাহার আনন্দমূর্তি উদ্‌ঘাটন করিতেছে না? কেন একটা অশ্রুজলের আবেগ বালিকার বুকের ভিতর হইতে কণ্ঠ বাহিয়া চোখের কাছে বার ...আরও পড়ুন

28

নৌকা ডুবি - 28

28 ২৮ শ্রান্তির মধ্যে পরের দিন কমলার দিবসারম্ভ হইল। সেদিন তাহার চক্ষে সূর্যের আলোক ক্লান্ত, নদীর ধারা ক্লান্ত, তীরের বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত। উমেশ যখন তাহার কাজে সহায়তা করিতে আসিল কমলা শ্রান্তকণ্ঠে কহিল, "যা উমেশ, আমাকে আজ আর বিরক্ত করিস নে।" উমেশ অল্পে ক্ষান্ত হইবার ছেলে নহে। সে কহিল, "বিরক্ত করিব কেন মা, বাটনা বাটিতে আসিয়াছি।" সকালবেলা রমেশ কমলার চোখমুখের ভাব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, "কমলা, তোমার কি অসুখ করিয়াছে?" এরূপ প্রশ্ন যে কতখানি অনাবশ্যক ও অসংগত, কমলা কেবল তাহা একবার প্রবল গ্রীবা-আন্দোলনের দ্বারা নিরুত্তরে প্রকাশ করিয়া রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল। রমেশ বুঝিল, সমস্যা ক্রমশ প্রতিদিনই কঠিন হইয়া আসিতেছে। অতিশীঘ্রই ...আরও পড়ুন

29

নৌকা ডুবি - 29

29 ২৯ কমলার এখনো অল্প বয়স-- কোনো সংশয় আশঙ্কা বা বেদনা স্থায়ী হইয়া তাহার মনের মধ্যে টিঁকিয়া থাকিতে পারে রমেশের ব্যবহার সম্বন্ধে এ কয়দিন সে আর-কোনো চিন্তা করিবার অবকাশ পায় নাই। স্রোত যেখানে বাধা পায় সেইখানে যত আবর্জনা আসিয়া জমে-- কমলার চিত্তস্রোতের সহজ প্রবাহ রমেশের আচরণে হঠাৎ একটা জায়গায় বাধা পাইয়াছিল, সেইখানে আবর্ত রচিত হইয়া নানা কথা বারবার একই জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বৃদ্ধ চক্রবর্তীকে লইয়া হাসিয়া, বকিয়া, রাঁধিয়া, খাওয়াইয়া কমলার হৃদয়স্রোত আবার সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল; আবর্ত কাটিয়া গেল; যাহা-কিছু জমিতেছিল এবং ঘুরিতেছিল তাহা সমস্ত ভাসিয়া গেল। সে আপনার কথা আর কিছুই ভাবিল না। আশ্বিনের সুন্দর দিনগুলি ...আরও পড়ুন

30

নৌকা ডুবি - 30

30 ৩০ পরদিন প্রাতে ঝড়ের বেগ কিছু কমিয়াছে, কিন্তু একেবারে থামে নাই। নোঙর তুলিবে কি না এখনো তাহা সারেং করিতে পারে নাই, উদ্‌বিগ্নমুখে আকাশের দিকে তাকাইতেছে। সকালেই চক্রবর্তী রমেশের সন্ধানে কমলার পাশের কামরায় প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রমেশ তখনো বিছানায় পড়িয়া আছে, চক্রবর্তীকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল। এই ঘরে রমেশের শয়নাবস্থা দেখিয়া চক্রবর্তী গতরাত্রির ঘটনার সঙ্গে মনে মনে সমস্তটা মিলাইয়া লইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, "কাল রাত্রে বুঝি এই ঘরেই শোওয়া হইয়াছিল?" রমেশ এই প্রশ্নের উত্তর এড়াইয়া কহিল, "এ কী দুর্যোগ আরম্ভ হইয়াছে! কাল রাত্রে খুড়োর ঘুম কেমন হইল?" চক্রবর্তী কহিলেন, "আমাকে নির্বোধের মতো দেখিতে, আমার কথাবার্তাও সেই প্রকারের, তবু এই ...আরও পড়ুন

31

নৌকা ডুবি - 31

31 ৩১ রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, "কী রে, তুই কোথায় চলিয়াছিস?" উমেশ কহিল, "আমি মাঠাকরুনের সঙ্গে যাইতেছি।" রমেশ। আমি যে কাশী পর্যন্ত টিকিট করিয়া দিয়াছি। ও-যে গাজিপুরের ঘাট। আমরা তো কাশী যাইব না। উমেশ। আমিও যাইব না। উমেশ যে তাহাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে পড়িবে এরূপ আশঙ্কা রমেশের মনে ছিল না; কিন্তু ছোঁড়াটার অবিচলিত দৃঢ়তা দেখিয়া রমেশ স্তম্ভিত হইল। কমলাকে জিজ্ঞাসা করিল, "কমলা, উমেশকেও লইতে হইবে নাকি?" কমলা কহিল, "না লইলে ও কোথায় যাইবে?" রমেশ। কেন, কাশীতে ওর আত্মীয় আছে। কমলা। না, ও আমাদেরই সঙ্গে যাইবে বলিয়াছে। উমেশ, দেখিস, তুই খুড়োমশায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকিস, নহিলে বিদেশে ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারাইয়া যাইবি। ...আরও পড়ুন

32

নৌকা ডুবি - 32

32 ৩২ একটু ফাঁকা জায়গায় গঙ্গার ধারে একটা আলাদা বাড়ি লইবার চেষ্টা হইতেছে। রমেশ, গাজিপুর-আদালতের বিধি-অনুসারে প্রবেশ লাভ করিবার ও জিনিসপত্র আনিতে এক বার কলিকাতায় যাইতে হইবে স্থির করিয়াছে, কিন্তু কলিকাতায় যাইতে তাহার সাহস হইতেছে না। কলিকাতার একটা বিশেষ গলির চিত্র মনে উঠিলেই রমেশের বুকের ভিতরটা এখনো যেন কিসে চাপিয়া ধরে। এখনো জাল ছেঁড়ে নাই, অথচ কমলার সহিত স্বামিস্ত্রীর সম্বন্ধ সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করিয়া লইতে বিলম্ব করিলে আর চলে না। এই-সমস্ত দ্বিধায় কলিকাতায় যাত্রার দিন পিছাইয়া যাইতে লাগিল। কমলা চক্রবর্তীর অন্তঃপুরেই থাকে। এ বাংলায় ঘর নিতান্ত কম বলিয়া রমেশকে বাহিরের ঘরেই থাকিতে হয়; কমলার সহিত তাহার সাক্ষাতের সুযোগ হয় না। ...আরও পড়ুন

33

নৌকা ডুবি - 33

33 ৩৩ রমেশ ঠিক করিয়াছিল কলিকাতায় সে কেবল কাজ সারিয়া চলিয়া আসিবে, কলুটোলার সে গলির ধার দিয়াও যাইবে না। দরজিপাড়ার বাসায় আসিয়া উঠিল। দিনের মধ্যে অতি অল্প সময়ই কাজ-কর্মে কাটে, বাকি সময়টা ফুরাইতে চায় না। রমেশ কলিকাতায় যে দলের সহিত মিশিত, এবারে আসিয়া তাহাদের সহিত দেখা করিতে পারিল না। পাছে পথে কাহারো সহিত দৈবাৎ দেখা হইয়া পড়ে, এই ভয়ে সে যথাসাধ্য সাবধানে থাকিত। কিন্তু রমেশ কলিকাতায় আসিতেই একটা পরিবর্তন অনুভব করিল। যে নির্জন অবকাশের মাঝখানে, যে নির্মল শান্তির পরিবেষ্টনে, কমলা তাহার নবকৈশোরের প্রথম আবির্ভাব লইয়া রমেশের কাছে রমণীয় হইয়া দেখা দিয়াছিল কলিকাতায় তাহার মোহ অনেকটা ছুটিয়া গেল। দরজিপাড়ার বাসায় ...আরও পড়ুন

34

নৌকা ডুবি - 34

34 ৩৪ কলিকাতায় রমেশ মাসখানেক কাটাইয়া আসিয়াছে। এই এক মাস কমলার পক্ষে অল্পদিন নহে। কমলার জীবনে একটা পরিণতির স্রোত অত্যন্ত দ্রুতবেগে বহিতেছে। উষার আলো যেমন দেখিতে দেখিতে প্রভাতের রৌদ্রে ফুটিয়া পড়ে, কমলার নারীপ্রকৃতি তেমনি অতি অল্পকালের মধ্যেই সুপ্তি হইতে জাগরণের মধ্যে সচেতন হইয়া উঠিল। শৈলজার সহিত যদি তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় না হইত, শৈলজার জীবন হইতে প্রেমালোকের ছটা ও উত্তাপ যদি প্রতিফলিত হইয়া তাহার হৃদয়ের উপরে না পড়িত,তবে কতকাল তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইতে বলা যায় না। ইতিমধ্যে রমেশের আসিবার দেরি দেখিয়া শৈলজার বিশেষ অনুরোধে খুড়া কলমাদের বাসের জন্য শহরের বাহিরে গঙ্গার ধারে একটি বাংলা ঠিক করিয়াছেন। অল্পস্বল্প আসবাব সংগ্রহ করিয়া ...আরও পড়ুন

35

নৌকা ডুবি - 35

35 ৩৫ পরদিন কমলার নূতন বাসায় শৈলর চড়িভাতির নিমন্ত্রণ হইল। বিপিন-আহারান্তে আপিসে গেলে পর শৈল নিমন্ত্রণরক্ষা করিতে গেল। কমলার খুড়া সেদিন সোমবারের স্কুল কামাই করিয়াছিলেন। দুই জনে মিলিয়া নিমগাছ-তলায় রান্না চড়াইয়া দিয়াছেন, উমেশ সহায়কার্যে ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছে। রান্না ও আহার হইয়া গেলে পর খুড়া ঘরের মধ্যে গিয়া মধ্যাহ্ননিদ্রায় প্রবৃত্ত হইলেন এবং দুই সখীতে নিমগাছের ছায়ায় বসিয়া তাহাদের সেই চিরদিনের আলোচনায় নিবিষ্ট হইল। এই গল্পগুলির সহিত মিশিয়া কমলার কাছে এই নদীর তীর, এই শীতের রৌদ্র, এই গাছের ছায়া বড়ো অপরূপ হইয়া উঠিল; ঐ মেঘশূন্য নীলাকাশের যত সুদূর উচ্চে রেখার মতো হইয়া চিল ভাসিতেছে কমলার বক্ষোবাসী একটা উদ্দেশ্যহারা আকাঙক্ষা তত দূরেই ...আরও পড়ুন

36

নৌকা ডুবি - 36

36 ৩৬ শৈলজা জিজ্ঞাসা করিল, "ভাই, আজ কি তোমার শরীর ভালো নাই? মাথা ধরিয়াছে?" কমলা কহিল, "না। খুড়ামশায়কে দেখিতেছি কেন?" শৈল কহিল, "ইস্কুলে বড়োদিনের ছুটি আছে, দিদিকে দেখিবার জন্য মা তাঁহাকে এলাহাবাদে পাঠাইয়া দিয়াছেন--কিছুদিন হইতে দিদির শরীর ভালো নাই।" কমলা কহিল, "তিনি কবে ফিরিবেন?" শৈল। তাঁর ফিরিতে অন্তত হপ্তা-খানেক দেরি হইবার কথা। তোমাদের বাংলা সাজানো লইয়া তুমি সমস্ত দিন বড়ো বেশি পরিশ্রম কর, আজ তোমাকে বড়ো খারাপ দেখা যাইতেছে। আজ সকাল সকাল খাইয়া শুইতে যাও। শৈলকে কমলা যদি সকল কথা বলিতে পারিত তবে বাঁচিয়া যাইত, কিন্তু বলিবার কথা নয়। "যাহাকে এতকাল আমার স্বামী বলিয়া জানিতাম সে আমার স্বামী নয়', ...আরও পড়ুন

37

নৌকা ডুবি - 37

37 ৩৭ শৈল ম্লান কমলাকে একটুখানি উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য কহিল, "আজ তোমাদের বাংলায় যাইবে না।" কমলা কহিল, "না, দরকার নাই।" শৈল। তোমার ঘর-সাজানো শেষ হইয়া গেল? কমলা। হাঁ ভাই, শেষ হইয়া গেছে। কিছু ক্ষণ পরে আবার শৈল আসিয়া কহিল, "একটা জিনিস যদি দিই তো কী দিবি বল্‌?" কমলা কহিল, "আমার কী আছে দিদি?" শৈল। একেবারে কিছুই নাই? কমলা। কিছুই না। শৈল কমলার কপোলে করাঘাত করিয়া কহিল, "ইস, তাই তো! যা-কিছু ছিল সমস্ত বুঝি একজনকে সমর্পণ করিয়া দিয়াছিস? এটা কী বল্‌ দেখি।" বলিয়া শৈল অঞ্চলের ভিতর হইতে একটা চিঠি বাহির করিল। লেফাফায় রমেশের হস্তাক্ষর দেখিয়া কমলার মুখ তৎক্ষণাৎ পাংশুবর্ণ ...আরও পড়ুন

38

নৌকা ডুবি - 38

38 ৩৮ একদিন অপরাহ্নে হেমনলিনীর সহিত একত্রে নিভৃতে চা খাইবার প্রত্যাশায় অন্নদাবাবু তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য দোতলায় আসিলেন; দোতলায় ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া পাইলেন না, শুইবার ঘরেও সে নাই। বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, হেমনলিনী বাহিরে কোথাও যায় নাই। তখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া অন্নদা ছাদের উপরে উঠিলেন। তখন কলিকাতা শহরের নানা আকার ও আয়তনের বহুদূরবিস্তৃত ছাদগুলির উপরে হেমন্তের অবসন্ন রৌদ্র ম্লান হইয়া আসিয়াছে, দিনান্তের লঘু হাওয়াটি থাকিয়া থাকিয়া যেমন-ইচ্ছা ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। হেমনলিনী চিলের ছাদের প্রাচীরের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। অন্নদাবাবু কখন তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন তাহা সে টেরও পাইল না। অবশেষে অন্নদাবাবু যখন আস্তে আস্তে তাহার পাশে আসিয়া তাহার ...আরও পড়ুন

39

নৌকা ডুবি - 39

39 ৩৯ পরদিন হেমনলিনী প্রত্যুষে উঠিয়া যখন প্রস্তুত হইয়া বাহির হইল তখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাঁহার শোবার ঘরের জানালার কাছে ক্যাম্‌বিসের কেদারা টানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। ঘরে আসবাব অধিক নাই। একটি খাট আছে, এক কোণে একটি আলমারি, একটি দেয়ালে অন্নদাবাবু পরলোকগতা স্ত্রীর একটি ছায়াপ্রায় বিলীয়মান বাঁধানো ফোটোগ্রাফ-- এবং তাহারই সম্মুখের দেয়ালে সেই তাঁহার পত্নীর স্বহস্তরচিত একখণ্ড পশমের কারুকার্য। স্ত্রীর জীবদ্দশায় আলমারিতে যে-সমস্ত টুকিটাকি শৌখিন জিনিস যেমনভাবে সজ্জিত ছিল আজও তাহারা তেমনি রহিয়াছে। পিতার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া পাকা চুল তুলিবার ছলে মাথায় কোমল অঙ্গুলিগুলি চালনা করিয়া হেম বলিল, "বাবা, চলো আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া লইবে। তার পরে তোমার ঘরে বসিয়া তোমার ...আরও পড়ুন

40

নৌকা ডুবি - 40

40 ৪০ অক্ষয় চলিয়া যাইবামাত্র যোগেন্দ্র দোতলায় উঠিয়া গেল। দেখিল, উপরের বসিবার ঘরে হেমনলিনীকে কাছে বসাইয়া অন্নদাবাবু গল্প করিতেছেন। দেখিয়া অন্নদা একটু লজ্জিত হইলেন। আজ চায়ের টেবিলে তাঁহার স্বাভাবিক শান্তভাব নষ্ট হইয়া হঠাৎ তাঁহার রোষ প্রকাশিত হইয়াছিল, ইহাতেও তাঁহার মনে মনে ক্ষোভ ছিল। তাই তাড়াতাড়ি বিশেষ সমাদরের স্বরে কহিলেন, "এসো যোগেন্দ্র, বোসো।" যোগেন্দ্র কহিল, "বাবা, তোমরা যে কোনোখানে বাহির হওয়া একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছ। দুজনে দিনরাত্রি ঘরে বসিয়া থাকা কি ভালো?" অন্নদা কহিলেন, "ঐ শোনো। আমরা তো চিরকাল এইরকম কোণে বসিয়াই কাটাইয়া দিয়াছি। হেমকে তো কোথাও বাহির করিতে হইলে মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি করিতে হইত।" হেম কহিল, "কেন বাবা আমার দোষ দাও? তুমি ...আরও পড়ুন

41

নৌকা ডুবি - 41

41 ৪১ সভাভঙ্গের পর অন্নদা হেমনলিনীকে লইয়া যখন ঘরে ফিরিলেন তখনো সন্ধ্যা হয় নাই। চা খাইতে বসিয়া অন্নদাবাবু কহিলেন, বড়ো আনন্দলাভ করিয়াছি।" ইহার অধিক আর তিনি কথা কহিলেন না; তাঁহার মনের ভিতরের দিকে একটা ভাবের স্রোত বহিতেছিল। আজ চা খাওয়ার পরেই হেমনলিনী আস্তে আস্তে উপরে চলিয়া গেল, অন্নদাবাবু তাহা লক্ষ্য করিলেন না। আজ সভাস্থলে-- নলিনাক্ষ-- যিনি বক্তৃতা করিয়াছিলেন, তাঁহাকে দেখিতে আশ্চর্য তরুণ এবং সুকুমার; যুবাবয়সেও যেন শৈশবের অম্লান লাবণ্য তাঁহার মুখশ্রীকে পরিত্যাগ করে নাই; অথচ তাঁহার অন্তরাত্মা হইতে যেন একটি ধ্যানপরতার গাম্ভীর্য তাঁহার চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইতেছে। তাঁহার বক্তৃতার বিষয় ছিল "ক্ষতি'। তিনি বলিয়াছিলেন, সংসারে যে ব্যক্তি কিছু হারায় নাই ...আরও পড়ুন

42

নৌকা ডুবি - 42

42 ৪২ পূর্বে যখন তাঁহার শরীর ভালো ছিল তখন অন্নদাবাবু ডাক্তারি ও কবিরাজি নানাপ্রকার বটিকাদি সর্বদাই ব্যবহার করিতেন-- এখন ওষুধ খাইবারও উৎসাহ নাই এবং নিজের অস্বাস্থ্য লইয়া আজকাল তিনি আর আলোচনামাত্রও করেন না, বরঞ্চ তাহা গোপন করিতেই চেষ্টা করেন। আজ তিনি যখন অসময়ে কেদারায় ঘুমাইতেছিলেন তখন সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া হেমনলিনী কোল হইতে সেলাইয়ের সামগ্রী নামাইয়া তাহার দাদাকে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য দ্বারের কাছে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দাদার সঙ্গে সঙ্গে নলিনাক্ষবাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে পালাইবার উপক্রম করিতেই যোগেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া কহিল, "হেম, নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন, ইঁহার সঙ্গে তোমার পরিচয় করাইয়া দিই।" হেম থমকিয়া দাঁড়াইল এবং নলিনাক্ষ তাহার ...আরও পড়ুন

43

নৌকা ডুবি - 43

43 ৪৩ কয়েক দিনের মধ্যেই নলিনাক্ষের সহিত অন্নদাবাবুদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইয়া আসিল। প্রথমে হেমনলিনী মনে করিয়াছিল, নলিনাক্ষের মতো লোকের কেবল বড়ো বড়ো আধ্যাত্মিক বিষয়েই বুঝি উপদেশ পাওয়া যাইবে; এমন মানুষের সঙ্গে যে সাধারণ বিষয়ে সহজ লোকের মতো আলাপ চলিতে পারে তাহা মনেও করিতে পারে নাই। অথচ সমস্ত হাস্যালাপের মধ্যে নলিনাক্ষের একটা কেমন দূরত্বও ছিল। একদিন অন্নদাবাবু ও হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের কথাবার্তা চলিতেছিল, এমন সময়ে যোগেন্দ্র কিছু উত্তেজিত হইয়া আসিয়া কহিল, "জান বাবা, আজকাল আমাদিগকে সমাজের লোকে নলিনাক্ষবাবুর চেলা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাই লইয়া এইমাত্র পরেশের সঙ্গে আমার খুব ঝগড়া হইয়া গেছে।" অন্নদাবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, "ইহাতে আমি তো লজ্জার ...আরও পড়ুন

44

নৌকা ডুবি - 44

44 ৪৪ এ কয়দিন অক্ষয় দেখা দেয় নাই। নলিনাক্ষ কাশীতে চলিয়া গেলে আজ সে যোগেন্দ্রের সঙ্গে অন্নদাবাবুর চায়ের টেবিলে দিয়াছে। অক্ষয় মনে মনে স্থির করিয়াছিল যে, রমেশের স্মৃতি হেমনলিনীর মনে কতখানি জাগিয়া আছে তাহা পরিমাপ করিবার সহজ উপায় অক্ষয়ের প্রতি তাহার বিরাগপ্রকাশ। আজ দেখিল, হেমনলিনীর মুখ প্রশান্ত; অক্ষয়কে দেখিয়া তাহার মুখের ভাব কিছুমাত্র বিকৃত হইল না; সহজ প্রসন্নতার সহিত হেমনলিনী কহিল, "আপনাকে যে এতদিন দেখি নাই?" অক্ষয় কহিল, "আমরা কি প্রত্যহ দেখিবার যোগ্য?" হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, "সে যোগ্যতা না থাকিলে যদি দেখাশোনা বন্ধ করা উচিত বোধ করেন, তবে আমাদের অনেককেই নির্জনবাস অবলম্বন করিতে হয়।" যোগেন্দ্র। অক্ষয় মনে করিয়াছিল একলা ...আরও পড়ুন

45

নৌকা ডুবি - 45

45 ৪৫ রমেশ প্রত্যুষেই এলাহাবাদ হইতে গাজিপুরে ফিরিয়া আসিল। তখন রাস্তায় অধিক লোক ছিল না, এবং শীতের জড়িমায় রাস্তার গাছগুলা যেন পল্লবাবরণের মধ্যে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। পাড়ার বস্তিগুলির উপরে তখনো একখানা করিয়া সাদা কুয়াশা, ডিম্বগুলির উপরে নিস্তব্ধ-আসীন রাজহংসের মতো স্থির হইয়া ছিল। সেই নির্জন পথে গাড়ির মধ্যে একটা মস্ত মোটা ওভারকোটের নীচে রমেশের বক্ষঃস্থল চঞ্চল হৃৎপিণ্ডের আঘাতে কেবলই তরঙ্গিত হইতেছিল। বাংলার বাহিরে গাড়ি দাঁড় করাইয়া রমেশ নামিল। ভাবিল, গাড়ির শব্দ নিশ্চয়ই কমলা শুনিয়াছে, শব্দ শুনিয়া সে হয়তো বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়াছে। স্বহস্তে কমলার গলায় পরাইয়া দিবার জন্য এলাহাবাদ হইতে রমেশ একটি দামি নেকলেস কিনিয়া আনিয়াছে; তাহারই বাক্সটা রমেশ ...আরও পড়ুন

46

নৌকা ডুবি - 46

46 ৪৬ এখন রমেশের সম্মুখে কোনো কাজ রহিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, ইহজীবনে সে যেন কোনো কাজ করিবে কোথাও স্থায়ী হইয়া বসিতে পারিবে না। হেমনলিনীর কথা তাহার মনে একেবারেই যে উঠে নাই তাহা নহে, কিন্তু তাহা সে সরাইয়া দিয়াছে; সে মনে মনে বলিয়াছে, "আমার জীবনে যে নিদারুণ ঘটনা আঘাত করিল তাহাতে আমাকে চিরদিনের জন্য সংসারের অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। বজ্রাহত গাছ প্রফুল্ল উপবনের মধ্যে স্থান পাইবার আশা কেন করিবে?' রমেশ ভ্রমণ করিয়া বেড়াইবার জন্য বাহির হইল। এক জায়গায় কোথাও বেশি দিন রহিল না। সে নৌকায় চড়িয়া কাশীর ঘাটের শোভা দেখিল, সে দিল্লিতে কুতবমিনরের উপরে চড়িল, আগ্রায় জ্যোৎস্না-রাত্রে তাজ দেখিয়া ...আরও পড়ুন

47

নৌকা ডুবি - 47

47 ৪৭ চন্দ্রমোহনের কাছে রমেশের খবর পাইয়া অক্ষয়ের মনে অনেকগুলা চিন্তার উদয় হইল। সে ভাবিতে লাগিল, ব্যাপারখানা কী? রমেশ প্র৻াকটিস করিতেছিল, এতদিন নিজেকে যথেষ্ট গোপনেই রাখিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন কী ঘটিল যাহাতে সে সেখানকার প্র৻াকটিস ছাড়িয়া দিয়া আবার সাহসপূর্বক কলুটোলার গলির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। অন্নদাবাবুরা যে কাশীতে আছেন, কোন্‌দিন রমেশ কোথা হইতে সে খবর পাইবে এবং নিশ্চয়ই সেখানে গিয়া হাজির হইবে। অক্ষয় স্থির করিল, ইতিমধ্যে গাজিপুরে গিয়া সে সমস্ত সংবাদ জানিবে এবং তাহার পর একবার কাশীতে অন্নদাবাবুর সঙ্গে গিয়া দেখা করিয়া আসিবে। একদিন অগ্রহায়ণের অপরাহ্নে অক্ষয় তাহার ব্যাগ হাতে করিয়া গাজিপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমে বাজারে জিজ্ঞাসা ...আরও পড়ুন

48

নৌকা ডুবি - 48

48 ৪৮ শহরের বাহিরে ক্যাণ্টন্‌মেণ্টের অধিকারের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অন্নদাবাবুরা একটি বাংলা ভাড়া করিয়া বাস করিতেছেন। অন্নদাবাবুরা কাশীতে পৌঁছিয়াই পাইলেন, নলিনাক্ষের মাতা ক্ষেমংকরীর সামান্য জ্বরকাসি ক্রমে ন্যুমোনিয়াতে দাঁড়াইয়াছে। জ্বরের উপরেও এই শীতে তিনি নিয়মিত প্রাতঃস্নান বন্ধ করেন নাই বলিয়া তাঁহার অবস্থা এরূপ সংকটাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে। কয়েক দিন অশ্রান্তযত্নে হেম তাঁহার সেবা করার পর ক্ষেমংকরীর সংকটের অবস্থা কাটিয়া গেল। কিন্তু তখনো তাঁহার অতিশয় দুর্বল অবস্থা। শুচিতা লইয়া অত্যন্ত বিচার করাতে পথ্যজল প্রভৃতি সম্বন্ধে হেমনলিনীর সাহায্য তাঁহার কোনো কাজে লাগিল না। ইতিপূর্বে তিনি স্বপাক আহার করিতেন, এখন নলিনাক্ষ স্বয়ং তাঁহার পথ্য প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল এবং আহার সম্বন্ধে মাতার সমস্ত সেবা ...আরও পড়ুন

49

নৌকা ডুবি - 49

49 ৪৯ ক্ষেমংকরী পুনর্বার জ্বরে পড়িলেন। এবারকার জ্বর অল্পের উপর দিয়া কাটিয়া গেল। সকালবেলায় নলিনাক্ষ প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের লইবার সময় বলিল, "মা, তোমাকে কিছুকাল রোগীর নিয়মে থাকিতে হইবে। দুর্বল শরীরের উপর কঠোরতা সহ্য হয় না।" ক্ষেমংকরী কহিলেন, "আমি রোগীর নিয়মে থাকিব, আর তুমিই যোগীর নিয়মে থাকিবে। নলিন, তোমার ও-সমস্ত আর বেশি দিন চলিবে না। আমি আদেশ করিতেছি, তোমাকে এবার বিবাহ করিতেই হইবে।" নলিনাক্ষ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, "দেখো বাছা, আমার এ শরীর আর গড়িবে না; এখন তোমাকে আমি সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে মনের সুখে মরিতে পারিব। আগে মনে করিতাম একটি ছোটো ফুট্‌ফুটে বউ আমার ঘরে আসিবে, ...আরও পড়ুন

50

নৌকা ডুবি - 50

50 ৫০ এ দিকে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, "আমি তোমার পাত্রী ঠিক করিয়াছি।" নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, "একেবারে ঠিক ফেলিয়াছ?" ক্ষেমংকরী। তা নয় তো কী? আমি কি চিরকাল বাঁচিয়া থাকিব? তা শেনো, আমি হেমনলিনীকেই পছন্দ করিয়াছি--অমন মেয়ে আর পাইব না। রঙটা তেমন ফর্সা নয় বটে, কিন্তু-- নলিনাক্ষ। দোহাই মা, আমি রঙ ফর্সার কথা ভাবিতেছি না। কিন্তু হেমনলিনীর সঙ্গে কেমন করিয়া হইবে? সে কি কখনো হয়? ক্ষেমংকরী। ও আবার কী কথা। না হইবার তো কোনো কারণ দেখি না। নলিনাক্ষের পক্ষে ইহার জবাব দেওয়া বড়ো মুশকিল। কিন্তু হেমনলিনী--এতদিন যাহাকে কাছে লইয়া অসংকোচে গুরুর মতো উপদেশ দিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তাহার সঙ্গে বিবাহের ...আরও পড়ুন

51

নৌকা ডুবি - 51

51 ৫১ কমলা যখন গঙ্গাতীরে গিয়া পৌঁছিল, শীতের সূর্য তখন রশ্মিচ্ছটাহীন ম্লান পশ্চিমাকাশের প্রান্তে নামিয়াছেন। কমলা আসন্ন অন্ধকারের সম্মুখীন অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করিল। তাহার পরে মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া নদীর মধ্যে কিছুদূর নামিল এবং জোড়করপুটে গঙ্গায় জলগণ্ডূষ অঞ্জলি দান করিয়া ফুল ভাসাইয়া দিল। তার পর সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিল। প্রণাম করিয়া মাথা তুলিতেই আর একটি প্রণম্য ব্যক্তির কথা সে মনে করিল। কোনোদিন মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের দিকে সে চাহে নাই; যখন একদিন রাত্রে সে তাঁহার পাশে বসিয়াছিল তখন তাঁহার পায়ের দিকেও তাহার চোখ পড়ে নাই, বাসরঘরে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি যে দু-চারিটা কথা কহিয়াছিলেন তাহাও সে যেন ...আরও পড়ুন

52

নৌকা ডুবি - 52

52 ৫২ নবীনকালীর আশ্রয়ে কমলার প্রাণটা যেন অল্পজল এঁদো-পুকুরের মাছের মতো ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। এখান হইতে বাহির হইতে সে বাঁচে, কিন্তু বাহিরে গিয়া দাঁড়াইবে কোথায়? সেদিনকার রাত্রে গৃহহীন বাহিরের পৃথিবীকে সে জানিয়াছে; সেখানে অন্ধভাবে আত্মসমর্পণ করিতে আর তাহার সাহস হয় না। নবীনকালী যে কমলাকে ভালোবাসিতেন না তাহা নহে, কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে রস ছিল না। দুই-এক দিন অসুখ-বিসুখের সময় তিনি কমলাকে যত্নও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে যত্ন কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করা বড়ো কঠিন। বরঞ্চ সে কাজকর্মের মধ্যে থাকিত ভালো, কিন্তু যে-সময়টা নবীনকালীর সখীত্বে তাহাকে যাপন করিতে হইত সেইটেই তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসময়। একদিন সকালবেলা নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া কহিলেন, ...আরও পড়ুন

53

নৌকা ডুবি - 53

53 ৫৩ যেদিন সন্ধ্যার সময় নলিনাক্ষের সহিত বিবাহ লইয়া হেমনলিনীর সঙ্গে অন্নদাবাবুর আলোচনা হইয়াছিল সেইদিন রাত্রেই অন্নদাবাবুর আবার সেই দেখা দিল। রাত্রিটা কষ্টে কাটিয়া গেল। প্রাতঃকালে তাঁহার বেদনার উপশম হইলে তিনি তাঁহার বাড়ির বাগানে রাস্তার নিকটে শীতপ্রভাতের তরুণ সূর্যালোকে সম্মুখে একটি টিপাই লইয়া বসিয়াছেন, হেমনলিনী সেইখানেই তাঁহাকে চা খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিতেছে। গতরাত্রের কষ্টে অন্নদাবাবুর মুখ বিবর্ণ ও শীর্ণ হইয়া গেছে, তাঁহার চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, মনে হইতেছে যেন এক রাত্রির মধ্যেই তাঁহার বয়স অনেক বাড়িয়া গেছে। যখনই অন্নদাবাবুর এই ক্লিষ্ট মুখের প্রতি হেমনলিনীর চোখ পড়িতেছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে যেন ছুরি বিঁধিতেছে। নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে হেমনলিনীর অসম্মতিতেই যে বৃদ্ধ ...আরও পড়ুন

54

নৌকা ডুবি - 54

54 ৫৪ মুকুন্দবাবু সপরিজনে কাশী ত্যাগ করিয়া মিরাটে যাইবেন, স্থির হইয়া গেছে। জিনিসপত্র বাঁধা হইয়াছে, কাল প্রভাতেই ছাড়িতেই হইবে। নিতান্ত আশা করিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন একটা-কিছু ঘটনা ঘটিবে যাহাতে তাহাদের যাওয়া বন্ধ হইবে। ইহাও সে একান্তমনে আশা করিয়াছিল যে, নলিনাক্ষ ডাক্তার হয়তো, আর দুই-একবার তাঁহার রোগীকে দেখিতে আসিবেন। কিন্তু দুইয়ের কোনোটাই ঘটিল না। পাছে বামুন-ঠাকরুন যাত্রার উদ্‌যোগের গোলেমালে পালাইয়া যাইবার অবকাশ পায়, এই আশঙ্কায় নবীনকালী তাহাকে কয়দিন সর্বদাই কাছে কাছে রাখিয়াছেন, তাহাকে দিয়াই জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদার অনেক কাজ করাইয়া লইয়াছেন। কমলা একান্তমনে কামনা করিতে লাগিল, আজ রাত্রির মধ্যে তাহার এমন একটা কঠিন পীড়া হয় যে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া যাওয়া নবীনকালীর পক্ষে ...আরও পড়ুন

55

নৌকা ডুবি - 55

55 ৫৫ দিনের মধ্যে অক্ষয় এক সময় চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল। তিনি তাহাকে কমলার প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে কোনো কথাই না। রমেশের প্রতি অক্ষয়ের যে বিশেষ বন্ধুভাব নাই, তাহা খুড়া বুঝিতে পারিয়াছেন। কমলা কেন চলিয়া গিয়াছিল, কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, এ সম্বন্ধে বাড়ির কেহ কোনো প্রশ্নই করিল না--কমলা যেন ইঁহাদের সঙ্গেই কাশী বেড়াইতে আসিয়াছে, এমনিভাবে দিন কাটিয়া গেল। উমির দাই লছমনিয়া স্নেহমিশ্রিত ভর্ৎসনার ছলে কিছু বলিতে গিয়াছিল, খুড়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া শাসন করিয়া দিয়াছিলেন। রাত্রে শৈলজা কমলাকে আপনার বিছানায় লইয়া শুইল। তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, এবং দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। ...আরও পড়ুন

56

নৌকা ডুবি - 56

56 ৫৬ হেমনলিনী নলিনাক্ষের সহিত বিবাহে সম্মতি দিয়া মনকে বুঝাইতে লাগিল, "আমার পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয় হইয়াছে।' মনে মনে সহস্রবার বলিল, "আমার পুরাতন বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেছে, আমার জীবনের আকাশকে বেষ্টন করিয়া যে ঝড়ের মেঘ জমিয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারে কাটিয়া গেছে। এখন আমি স্বাধীন, আমার অতীতকালের অবিশ্রাম আক্রমণ হইতে নিরমুক্ত।' এই কথা বারংবার বলিয়া সে একটা বৃহৎ বৈরাগ্যের আনন্দ অনুভব করিল। শ্মশানে দাহকৃত্যের পর এই প্রকাণ্ড সংসার তাহার বিপুল ভার পরিহার করিয়া যখন খেলার মতো হইয়া দেখা দেয় তখন কিছুকালের মতো মন যেমন লঘু হইয়া যায়, হেমনলিনীর ঠিক সেই অবস্থা হইল--সে নিজের জীবনের একাংশের নিঃশেষ অবসান-জনিত শান্তি লাভ করিল। বাড়িতে ...আরও পড়ুন

57

নৌকা ডুবি - 57

57 ৫৭ ক্ষেমংকরী কমলাকে গিয়া কহিলেন, "মা, কাল হেমকে আর তার বাপকে দুপুর-বেলায় এখানে আহার করিতে নিমন্ত্রণ করা গেছে। রকম আয়োজনটা করা যায় বলো দেখি। বেয়াইকে এমন করিয়া খাওয়ানো দরকার যে, তিনি যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন যে এখানে তাঁহার মেয়েটির খাওয়ার কষ্ট হইবে না। কী বল মা? তা, তোমার যেরকম রান্নার হাত, অপযশ হইবে না তা জানি। আমার ছেলে আজ পর্যন্ত কোনো রান্না খাইয়া কোনোদিন ভালোমন্দ কিছুই বলে নাই, কাল তোমার রান্নার প্রশংসা তাহার মুখে ধরে না মা। কিন্তু তোমার মুখখানি আজ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে যে? শরীর কি ভালো নাই?" মলিন মুখে একটুখানি হাসি আনিয়া কমলা কহিল, "বেশ আছি ...আরও পড়ুন

58

নৌকা ডুবি - 58

58 ৫৮ হেমনলিনী রমেশের নিকট হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িল। প্রথম শান্ত হইবামাত্র একটা লজ্জা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। "কেন আমি রমেশবাবুর সঙ্গে সহজভাবে দেখা করিতে পারিলাম না? যাহা আশা করি না, তাহাই হঠাৎ কেন আমার মধ্য হইতে এমন অশোভন ভাবে দেখা দেয়? বিশ্বাস নাই, কিছুই বিশ্বাস নাই। এমন করিয়া টল্‌মল্‌ করিতে আর পারি না।' এই বলিয়া সে জোর করিয়া উঠিয়া পড়িয়া দরজা খুলিয়া দিল, বাহির হইয়া আসিল; মনে মনে কহিল,"আমি পলায়ন করিব না, আমি জয় করিব।' পুনর্বার রমেশবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চলিল। হঠাৎ কী মনে পড়িল। আবার সে ঘরের মধ্যে ...আরও পড়ুন

59

নৌকা ডুবি - 59

59 ৫৯ ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা রমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল। চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে-- তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন, সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করিয়াছ--সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ো না। যদিও আমি এক দিনের জন্য কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া ...আরও পড়ুন

60

নৌকা ডুবি - 60

60 ৬০ শৈলজা এবং তাহার পিতা নলিনাক্ষের বাড়িতে আসিয়াছেন। শৈলজা কমলাকে লইয়া একটা কোণের ঘরে বসিয়া ফিস্‌ফিস্‌ করিতেছিল, চক্রবর্তী সঙ্গে আলাপ করতেছিলেন। চক্রবর্তী। আমার তো ছুটি ফুরাইয়া আসিল, কালই গাজিপুরে যাইতে হইবে। যদি হরিদাসী আপনাদের কোনোরকমে বিরক্ত করিয়া থাকে, বা যদি আপনাদের পক্ষে-- ক্ষেমংকরী। ও আবার কী রকম কথা চক্রবর্তীমশায়? আপনার মনের ভাবটা কী শুনি। আপনি কি কোনো ছুতা করিয়া আপনাদের মেয়েটিকে ফিরাইয়া লইতে চান? চক্রবর্তী। আমাকে তেমন লোক পান নাই। আমি দিয়া ফিরাইয়া লইবার পাত্র নই, কিন্তু যদি আপনার কিছুমাত্র অসুবিধা হয়-- ক্ষেমংকরী। চক্রবর্তীমশায়, ওটা আপনার সরল কথা নয়--মনে মনে বেশ জানেন, হরিদাসীর মতো অমন লক্ষ্মী মেয়েটিকে কাছে ...আরও পড়ুন

61

নৌকা ডুবি - 61

61 ৬১ পরদিন সকালেই কমলা খুড়ামশায়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। যখন নির্জনে একটু অবকাশ পাইল অমনি সে শৈলজাকে জড়াইয়া শৈল কমলার চিবুক ধরিয়া কহিল, "কী বোন, এত খুশি কিসের?" কমলা কহিল, "আমি জানি না দিদি, কিন্তু আমার মনে হইতেছে, যেন আমার জীবনের সমস্ত ভার চলিয়া গেছে।" শৈল। বল্‌-না, সব কথা বল্‌-না আমাকে। এই তো কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছিলাম, তার পরে তোর হইল কী? কমলা। এমন কিছুই হয় নাই, কিন্তু আমার কেবলই মনে হইতেছে, আমি যেন তাঁহাকে পাইয়াছি, ঠাকুর যেন আমার 'পরে সদয় হইয়াছেন। শৈল। তাই হোক বোন, কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকোস নে। কমলা। আমার লুকাইবার কিছুই নাই ...আরও পড়ুন

62

নৌকা ডুবি - 62 - Last Part

62 ৬২ কমলা বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল--অন্নদাবাবু ও হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর কাছে বসিয়া আছে। কমলাকে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, "এই-যে হরিদাসী, বন্ধুকে তোমার ঘরে লইয়া যাও বাছা! আমি অন্নদাবাবুকে চা খাওয়াইতেছি।" কমলার ঘরে প্রবেশ করিয়াই হেমনলিনী কমলার গলা ধরিয়া কহিল, "কমলা!" কমলা খুব বেশি বিস্মিত না হইয়া কহিল, "তুমি কেমন করিয়া জানিলে আমার নাম কমলা।" হেমনলিনী কহিল, "একজনের কাছে আমি তোমার জীবনের ঘটনা সব শুনিয়াছি। যেমনি শুনিলাম অমনি তখনই আমার মনে সন্দেহ রহিল না তুমিই কমলা। কেন যে, তা বলিতে পারি না।" কমলা কহিল, "ভাই, আমার নাম যে কেহ জানে সে আমার ইচ্ছা নয়। আমার নিজের নামে একেবারে ধিক্‌কার জন্মিয়া গেছে।" ...আরও পড়ুন