বাড়িতে দেখি পাড়ার সবাই আছে। কি ব্যাপার! ঠাকুমার খবর জানার জন্য এতো সবাই! দিদিকে দেখে ভুল ভাঙে। সবাইকে ঠাকুমার খবর জানালে, দিদি বলে আরও দুটো সুখবর আছে, না না, দুটো না, তিনটে।
কি খবর?
বিল্টু মাধ্যমিকে আমাদের জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে।
এটা তো হবারই ছিল, সুরোজিৎস্যার আগেই বলেছিল।
তুইও পাস করে গেচিস।
এটা সত্যি সুখবর। ফেল করলে আর মুখ দেখানো যেত না। একই সাথে পড়ে একজন ফার্স্ট হয়, আর একজন ফেল করে- স্কুলে এটা, সব স্যারের থেকে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। হ্যাঁ রে দিদি, তিন নম্বরটা কি?
তোদের স্কুলের স্যারেরা বলেছেন, বিল্টুকে একটা সাইকেল কিনে দেবে।
এটা খুব ভালো হবে। ভাব একবার, স্কুলে যেতে দুঘন্টা হাঁটতে হয়, তখন আধঘণ্টাতেই পৌঁছে যাব! আবার একটুও না হেঁটে। দিদি, বাবা কোথায় রে? দেখছি না তো! আর বিল্টু কি স্কুলে গেছে?
হ্যাঁ, বিল্টু স্কুলে গেছে। আর বাপি, নিমাইকাকার সঙ্গে তোদের সবার খাবার নিয়ে হাসপাতালে গেছে।
এই রে! আমরা এখানে চলে এলাম, আর বাবা এতটা হেঁটে যাবে!
না, না, বাপি আর নিমাইকাকা গরুর গাড়ি করে গেছে। আর তোদের খাবার নিয়ে গেছে তো কি হয়েছে, বাড়িতে এখনও আছে, একটু পরিষ্কার হয়ে নে, খেতে দিচ্ছি। তোর সঙ্গে কি লক্ষ্মী ফিরেছে?
হ্যাঁ।
তাহলে তাকে এখানে নিয়ে এলি না কেন? ওই মেয়েটাও খাবে তো। আচ্ছা দাঁড়া, আমি দেখছি।
এই বলে দিদি উঠে গেল। আমিও দড়া থেকে একটা গামছা টেনে নিয়ে, পুকুরের দিকে যাই। এই পুকুরটাই এখন আমাদের পাড়ার একমাত্র জলের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পুকুরটা ছাড়া অন্য সব পুকুর গুলো প্রায় শুকনো হয়ে গেছে। কয়েকটিতে এখনও পাঁক আছে, কতকগুলির আবার পাঁকও শুকনো হয়ে ফেটে গেছে। এই রকম অবস্থায় এই পুকুরে এখনও প্রায় এক কোমড় জল আছে। যদিও সব সময় পুকুরে ভিড় লেগেই থাকে।
আমি যখন পুকুরের পাশে পৌঁছালাম, তখনও কয়েকটা বাচ্ছা জলে খেলে চলেছে। আর তাতেই পুকুরের জল প্রায় গুলিয়ে আছে। একটা দিকে ফাঁকা দেখে নেমে পড়লাম। ডুব দিয়ে শরীর ঠান্ডা করতে চাইলে কি হবে! পুকুরের জল গরম হয়ে আছে। স্নান সেরে উঠে আসি। বাড়িতে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে নিলাম। দেখি, দিদি রান্নাঘরে ডাকছে। রান্নাঘরেই দুটো থালায় খাবার দেওয়া হয়েছে। একপাশে লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার খাওয়া না হলে, খেতে বসবে না। তাই আমি খেতে শুরু করি। দিদি পাশে বসে একটা পাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে।
খাওয়া শেষ করার আগেই গ্লাস থেকে একটু জল খাই। এই গরমে কুঁজোর ঠান্ডা জল যেন অমৃতের মতো লাগে। তবুও তা সরিয়ে রেখে খাওয়া শেষ করি। এবারে পেট ভরে ঠান্ডা জল খাই। উঠে পরি।
দিদিকে বলে শিবমন্দিরের কাছে গিয়ে বসি। এখানে ছায়ায় বসে থাকলে শরীর জুড়িয়ে যায়। এই ছায়ায় বসে পাখিদের ডাক শুনতে ভালো লাগে। চোখ বুজে আসে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। সবদিক থেকে সব সমস্যা কেটে যেতে চলেছে। কিন্তু আজকে যা হল, তাতে নতুন একটি সমস্যা তৈরী করে দিল। হঠাৎ লক্ষ্মী আমাকে প্রণাম করল কেন!
তবে কি লক্ষ্মী আমাকে অন্য ভাবে চায়! কিন্তু তা কি করে সম্ভব! ওর সাথে আমার যা সম্পর্ক, তাতে কিছুতেই যে অন্য কিছু সম্ভব নয়। আর না, এবার থেকে সাবধান হতে হবে। হে ঈশ্বর, এই সমস্যা থেকেও উদ্ধার কোরো।
বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারব না, উঠে পরতে হবে। মানিকপাড়া যেতে হবে, আমি গেলে তবে বাবা ফিরবে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরি।
ঘুম ভাঙলো লক্ষ্মীর ডাকে। বলে, ওঠো, হাসপাতালে যেতে হবে না!
আমিও উঠে পরি।
বাড়িতে একটু জল খেয়ে দিদিকে বলে বেরোতে যাব, এমন সময় দিদি বলে, একটু দাঁড়া, লক্ষ্মীও যাবে। দিদি ভিতরে ঢুকে যায়। আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকি। না'ও বলতে পারি না, আবার হ্যাঁ বলারও সাহস নেই। কি যে করি! এখন বিল্টু থাকলে ভালো হতো, পরামর্শ করা যেত। এখন যা হচ্ছে, তাতে শুধু নিজের মানসিক চাপ বাড়ছে। তবু দাঁড়াতেই হয়।
বিকাল এখন কত হবে কে জানে! রোদের তেজ অনেক কমে গেছে। আলো থাকতে থাকতে মানিকপাড়ায় পৌঁছাতে হবে। দেখি দিদির সাথে লক্ষ্মী একটা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে আসছে। দিদিকে বিদায় জানিয়ে, লক্ষ্মীর সাথে বেরিয়ে পরি। শিবমন্দির পর্যন্ত দিদিও এগিয়ে আসে।
আবার সেই একই পথে আমরা হেঁটে চলেছি। যখন রেলব্রীজ পার হচ্ছি, তখন বিল্টুর সাথে দেখা হয়ে যায়। বিল্টু, ঠাকুমার অসুস্থতার খবর স্কুলে জানিয়ে আমার মার্কশিটও তুলে এনেছে। তাই আমাকে কালকেই স্কুলে না গেলেও চলবে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে যেন ভর্তি হয়ে নিই।
ভর্তি হতে কত টাকা লাগবে বলেছে রে?
দুশো আশি টাকা করে লাগবে। আর যদি প্রাকটিক্যাল থাকে, তবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য পঞ্চাশ টাকা করে বেশি দিতে হবে।
কিন্তু এতো টাকা জোগাড় হবে কিভাবে! কোথা থেকে পাব!
এসব কথা কে শুনবে বল! টাকা জোগাড় করে তবে ভর্তি হওয়া যাবে।
সে দেখা যাবেক্ষণ। টাকার জোগাড় ঠিক হয়ে যাবে। শোন, তুই একটা কাজ করবি। কালকে নকুলকে বলে বিকেলে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে আসবি। কালকেই ঠাকুমাকে ছেড়ে দেবে।
আচ্ছা।
আজকে আমি আর লক্ষ্মী গেলে, বাবা আর নিমাইকাকা ফিরবে।
তাহলে তোরা আর দেরি করিস না। তোকে একটা কথা বলবো, রাগ করবি না তো?
রাগ করব কেন?
না না, যদি রাগ করিস, তাই আগে থেকেই বলে রাখছি।
নে বল, অতো ন্যাকামো করিস না!
তোদের দুজনকে যখন দূর থেকে দেখি, তখন বুঝতেই পারিনি, তোদের দেখে তো জোড়ে যাচ্ছিস বলে মনে হচ্ছে!
তুই না! সব সময় এসব ভালো লাগে না। আচ্ছা আয়। বলে এগিয়ে যাই।
রাগ করলি না তো?
আমি চুপ করেই থাকি।
ঠিক আছে, কালকে তোর সাথে আবার কথা হবে, বলে বিল্টুও চলে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। তোর মার্কশিটটাও দেখবি না!
কালকে বাড়ি ফিরে দেখবো। এখন আর দেখতেও ইচ্ছে করছে না।
তবে আয়।
আমিও এগিয়ে চলি। বেশ কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ। সূর্যের আলো কমে এসেছে। সুন্দর বাতাসও বইছে। রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। এমন সময় লক্ষ্মী বলে, সৌরভদা, একটা কথা বলব?
বলো।
সকালের জন্য তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো? আমার না সব সময় তোমাকে ভালো লাগে।
তোমাকে তো কতবার বলেছি, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন আমার পিছনে পরে আছো! যা হবার নয়, তা কেন বারবার বল!
তোমাকে সব সময় চোখের সামনে দেখি। যখন একা থাকি, সব সময় তোমার কথাই মনে পরে। কি করে অন্য কিছু ভাববো?
বুঝতে পারি, আজও লক্ষ্মীকে বোঝানো সম্ভব হবে না। তাই চুপ করে হাঁটতে থাকি।
একসময় হাসপাতালে পৌঁছাই। বাইরে সিস্টারদিদিকে দেখতে পাই। ঠাকুমার খবর জিজ্ঞেস করি।
তোমার ঠাকুমা যে রকম আছে, তাতে কাল বাড়ি ফিরতে পারবে। যাও, একবার দেখা করে এসো।
আমরা ভিতরে ঢুকি। দেখি ঠাকুমা, পিসি, বাবা, কাকা গল্প করছে। আমি ঢুকতেই পিসি বাবাকে উঠে পরতে বলে। গরুর গাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যাবে। তাই বাবাও উঠে পরে।
নিমাইকাকা স্টেশনে থেকে যাবে। আমিও এগিয়ে দেওয়ার জন্য বেরোই। ততক্ষণে গাড়িতে গরু জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সামনে একটা লণ্ঠনও জ্বলছে দেখলাম। বাবা ও নিমাইকাকা গাড়িতে উঠে বসলে, গাড়ি ছেড়ে দেয়।
হাসপাতালের সামনের আলো ততক্ষণে জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কার আকাশের জন্য আজ সব কিছুই যেন ভালো লাগে। মন থেকে সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেছে। রাস্তার উল্টোদিকের নারকেল গাছগুলো দেখে মনে হয় যেন কোন শিল্পী রংতুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে। শুধু হাওয়ায় পাতাদের নড়াচড়া দেখে বাস্তবে ফিরে আসতে হয়। আমার ঠিক পিছনেই কুকুর দুটো একসাথে খেলে বেড়াচ্ছে।
আমি কল থেকে কিছুটা জল খেয়ে এবং চোখে মুখে দিয়ে, আবার গত রাতের জায়গায় গিয়ে বসি। দেখি, ডাক্তারবাবু বেরিয়ে আসছেন।
এই শোন, তুমি এবারে মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছ?
না ডাক্তারবাবু, আমি না, আমার ভাই বিল্টু এবারে ফার্স্ট হয়েছে।
সে কোথায়? এখানে আসেনি?
না ডাক্তারবাবু, কালকে বিকেলে আসবে।
ঠিক আছে, একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বোল।
আচ্ছা ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে কোয়ার্টারের দিকে চলে যায়। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুর চলে যাওয়া দেখতে থাকি। হঠাৎ দেখি লক্ষ্মী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে।
সৌরভদা, তোমার ঠাকুমা একবার ডাকলো।
চলো যাচ্ছি। সিস্টারদিদি আবার রাগ করবেন না তো?
লক্ষ্মীর সাথে ভিতরে ঢুকি। পিসির পাশে সিস্টারদিদি বসে আছেন। ঠাকুমা বেডের একপাশে আধশোয়া হয়ে আছে। সিস্টারদিদি বলে, এখন ভিতরে থাকতে পার। তাছাড়া আর কোন রোগীও তো নেই। রাতে বাইরে চলে যেতে হবে। এখনও মোটামুটি একঘণ্টা ভিতরেই থাকতে পার। এখানে পাখার হাওয়াও পাবে।
আচ্ছা দিদি।
তোমরা একটু গল্প করো। আমি ওদিকটা দেখি।
বলে সিস্টারদিদি বেরিয়ে যায়। তখন ঠাকুমা বলে, জানিস সৌরভ, এযাত্রায় তোর জন্য বেঁচে গেলাম।
ঠাকুমা ওসব কথা বোল না।
আমার কি মনে হয় জানিস?
কি?
যতদিন না নাতবউ ঘরে আনচিস, ততদিন আমি ঠিক টিকে থাকবো।
ঠাকুমা!
আচ্ছা, আচ্ছা, আর বলবো না।
পিসির দিকে তাকিয়ে বলি, পিসি, তোমরা এখানে থাক, আমি বাইরে আছি।
আচ্ছা, আয় বাবা।
আমিও বাইরে চলে আসি। আমার সাথে লক্ষ্মীও এগিয়ে দেওয়ার জন্য আসে। হাঁটতে হাঁটতেই বলে, সৌমিপিসি রাতের খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে, যখন খাবে বোল, বেড়ে দেব। আমি শুধুই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। লক্ষ্মীও ফিরে যায়। আমি বাইরে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতেই আবার ফিরে আসি।
বসে বসে মশার কামড় খেতে থাকি। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানি না, হঠাৎ দেখি ডাক্তারবাবু আসছেন। উঠে দাঁড়াই। ডাক্তারবাবু সোজা ভিতরে ঢুকে যান। সামনেই সিস্টারদিদিকে পেয়ে যাই। সিস্টারদিদিই আমাকে বলে ডাক্তারবাবুর সাথে যেতে। ডাক্তারবাবু ঠাকুমাকে এখন আর একবার দেখবেন। আমিও ডাক্তারবাবুর পিছন পিছন ঠাকুমার কাছে যাই।
***
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির দিকে যাবার কথা ভাবি। কিন্তু ঠাকুমার সাথে একবার দেখা করে গেলে ভালো হতো। তাই যতক্ষণ না ভিতর থেকে গেট খুলছে, ততক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করতেই হয়।
দেখি দরজার ভিতর থেকে শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলে পিসি বাইরে আসে। তুই যেন একা একা বাড়ি চলে যাস না। তোর সাথে লক্ষ্মীও যাবে। ও বেচারীর হয়েছে জ্বালা। এদিক ওদিক দুদিকই সামলাতে হচ্ছে।
আচ্ছা।
একটু দাঁড়া।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্মী চলে আসে। আমিও ততক্ষণে ঠাকুমার সাথে দেখা করে এসেছি। ঠাকুমার এখন আর কোন কষ্ট নেই, তাছাড়া আজই ঠাকুমাকে ছেড়ে দেবে।
পিসিকে বিদায় জানিয়ে আমি আর লক্ষ্মী বাড়ির পথ ধরি।
জানো সৌরভদা, সিস্টারদিদি না খুব ভালো।
কেন রে?
তোমাদের ইসকুলে ভর্তির খরচ দেবে বলেছে।
তুই নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলেচিস!
না গো, তোমার পিসির সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন শুনেছি।
হঠাৎ করে টাকা দিতে যাবে কেন!
এই কদিন তোমাকে দেখে ভালো লেগে গেছে। আর বিল্টু কাকার ভালো রেজাল্টের খবরও শুনেছে।
ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি চল, না হলে বেশি রোদে কষ্ট হবে।
চলো তবে। আচ্ছা সৌরভদা, রেললাইন দিয়ে যাচ্ছি, ট্রেন চলে আসবে না তো?
ট্রেন আসার অনেক আগেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব।
সৌরভদা, তোমার গামছাটা একবার দিও, আজও একবার চান করে নেব।
সে দেবক্ষণ, কিন্তু চান করার পর পাগলামি করলে আমি রেগে যাব।
লক্ষ্মী শুধু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
বাড়িতে ফিরে দেখি, আজও লোকে লোকারণ্য। সুরোজিৎস্যার ও অনুপস্যার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। বাবার সাথে কথা বলছেন। পাশে বিল্টু ও দিদি। পাড়ার সব লোক বাইরে ভিড় করে আছে। সুরোজিৎস্যার বলছেন, স্কুল থেকে একটা অনুষ্ঠান করে বিল্টুকে সাইকেলটি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিল্টুর দিদার কথা ভেবে আমরা তোমাদের বাড়িতেই সম্বর্ধনা দেওয়ার কথা ভেবেছি।
অনুপস্যার বিল্টুকে একটা ফুলের তোড়া ধরিয়ে দিলেন। আমি সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করি। আমার দেখাদেখি সবাই হাততালি দিলে, সুরোজিৎস্যার আবার সবাইকে থামান। বলেন, এবারে অনুপবাবু বিল্টুকে সাইকেলটি দেবেন।
আর একটা কথা, এখন থেকে বিল্টুর পড়াশোনার সমস্ত খরচ স্কুল থেকেই মেটানো হবে। সৌরভ এদিকে আয়।
আমি এগিয়ে যাই।
আর সৌরভের জন্য সত্যিই গর্ব হয়। গত কদিনে ও সত্যিই একজন মানুষের মতো কাজ করেছে। যার জন্য ওর ঠাকুমা হয়তো আজই সুস্থ শরীরে বাড়িতে ফিরে আসবে। যে সময়ে ওর মাথার মধ্যে পরীক্ষার রেজাল্টের কথা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সেসব কথা মাথা থেকে সরিয়ে এখান থেকে মানিকপাড়া পর্যন্ত গরমের মধ্যেও ছোটাছুটি করে বেরিয়েছে। তাই আজ থেকে ওর পড়াশোনার যাবতীয় খরচও স্কুল থেকেই দেওয়া হবে।
লক্ষ্মী হাততালি দিয়ে ওঠে। কিন্তু আর কেউ না দেওয়ায় থেমে যায়। তখন সুরোজিৎস্যার আবার বলেন, তোমাদের সময় মতো তোমরা একবার স্কুলে এসে ভর্তি হয়ে যেও।
এরপর সুরোজিৎস্যার ও অনুপস্যার একটা করে মিষ্টির প্যাকেট আমার ও বিল্টুর হাতে তুলে দেন। এবং দিদিকে একটা বড় প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সকলকে দিতে বলেন।
স্যারেরা বাড়ি থেকে চলে গেলে আস্তে আস্তে ভিড় কেটে যায়। দিদিকে বলে আমিও শিবমন্দিরের পাশে চলে আসি। মন্দিরের চাতালে বসে পরি। দেখি লক্ষ্মী আসছে।
এখানে বসে আছ!
হ্যাঁ।
দাঁড়াও একটু পরিষ্কার করে দিই। সকালে আসা হয়নি, তাই চারিদিকে এখনও নোংরা জমে আছে। বলে, একটা খড়ের আঁটি নিয়ে শিবমন্দিরের চাতালটা ঝাঁট দিয়ে দেয়। ওর হয়ে গেলে, আমাকে বসতে বলে।
খড়ের আঁটিটাকে আবার একপাশে রেখে একটা ঝাঁটা দিয়ে চারপাশটাও ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। পাশের ডোবায় ঝাঁটাটা ধুয়ে আবারও একপাশে রেখে দেয়। আবার ডোবায় নেমে হাত ধুয়ে আসে। মন্দিরের ভিতরে ঢুকে একটা চুবড়ি বের করে আনে।
পাশের ফুলগাছগুলি থেকে ফুল তুলে এনে মন্দিরের ভিতরে ঢোকে। আমি বাইরে বসে বসেই দেখতে থাকি। অতি যত্নে একটা একটা করে ফুল সাজিয়ে দেয়। শিবঠাকুরকে প্রণাম করে বাইরে চলে আসে।
একেবারে আমার সামনে। এসেই আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
এবারে কিন্তু আমি সত্যিই রেগে যাব!
যাতে না রাগ, ঠাকুরের কাছে তাই মানত করে এলাম।
আচ্ছা লক্ষ্মী, তুমি কেন বুঝতে চাও না!
কি বুঝবো?
তুমি যা ভাবছ, তা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
কি সম্ভব নয়?
তোমাকে আবারও বলছি, তুমি আমাকে প্রণাম করবে না।
আচ্ছা বলো, তুমি কি আমার থেকে বড় নয়?
তোমার থেকে বড় হলেই তুমি তাকে প্রণাম করবে?
আমি তো আর সবাইকে প্রণাম করছি না, আমি শুধু আমার দেবতাকে প্রণাম করছি।
না লক্ষ্মী, এটা খারাপ দেখায়। কেউ দেখে ফেললে মুখ দেখাতে পারবো না।
যে দেখছে, তাকে দেখতে দাও। কদিন পরে সবাই তো জানবেই।
তুমি দেখছি আমায় পাগল করে দেবে!
তা তুমি যাই বল না কেন, এবারে আমি ঠিক করেই নিয়েছি।
কি ঠিক করেছ?
আমি আমার দেবতাকে যখনই দেখবো, তখনই প্রণাম করবো।
আবার পাগলামি!
তা তুমি বলতে পার। তবে তোমায় না পেলে পুরোই পাগল হয়ে যাব।
আমি আর কথা বাড়াই না।