(এই গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক | বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই | বাস্তবের যদি কোনো মিল থেকে থাকে তাহলে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় |)
প্রতিশোধ
আজ ফুলপুর গ্রামের লোকজন অত্যন্ত আনন্দিত | কারণ আজ মায়াবতীর বিয়ে | মায়াবতী সহজ , সরল , সাদাসিধে , প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিমান স্বভাবের একটি মেয়ে | ছোটবেলায় মায়াবতীর মা-বাবা এক্সিডেন্টে মারা যায় | ছোটবেলা থেকেই সে কাকা-কাকিমার কাছেই মানুষ হয়েছে | মায়াবতীর এই রকম স্বভাবের জন্য গ্রামের সকল লোকজন ওকে খুব ভালোবাসতো | যার ফলস্বরূপ আজ মায়াবতীর বিয়েতে সকল গ্রামবাসী তাদের নিজস্ব সামর্থ্য মতো দেওয়ার চেষ্টা করেছে |
সন্ধ্যে থেকেই মায়াবতী বউ সেজে বসে আছে | কিন্তু সে জানে না কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে | তবে নামটা শুনে ছিল অনুব্রত | মায়াবতী একা একা বসে এই সব কথা ভাবছিলো ঠিক এমন সময় একজন এসে বলল বর এসে গেছে | বর এসেছে শুনতেই মায়াবতীর মনে একটা ভয় কাজ করতে লাগলো | মায়াবতীর সব বন্ধুরা মিলে ওকে বিয়ের মন্ডপে নিয়ে গেলো |
প্রায় রাত ন’টা নাগাদ মায়াবতীর বিয়ে সম্পন্ন হলো | ফুলসজ্জার রাতে মায়াবতী বসে-বসে ভাবছিলো যে তার বর নিশ্চয়ই এতটাও দেখতে খারাপ নয় | দেখতে শুনতে বেশ ভালই |
এদিকে অনুব্রত মনে মনে চিন্তা করছিলো তার একটি অচেনা মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে | কিভাবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না | যাই হোক একটু ইতঃস্তত বোধ করে রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল | হঠাৎ তার মনে হল রুমের ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসছে | মনে হল কেউ যেন ঘষে ঘষে কিছু একটা কাটছে | একে তো গ্রাম্য এলাকা | জন্তু-জানোয়ার এর ভয় | মায়াবতী ঠিক আছে তো ? তখন ঘড়িতে রাত একটা বাজে | অনুব্রত রীতিমতো একটু ভয় পেয়ে গেল | এখন সে আবার দরজায় কান দিয়ে শব্দ টা আবার শোনার চেষ্টা করল কিন্তু সেই শব্দটা আর শুনতে পেলো না | সে কি করবে বুঝতে না পেরে দরজায় টোকা দিল | মায়াবতী এসে দরজা খুলে দিলো |
দরজা খুলতেই অনুব্রত মায়াবতীকে জিজ্ঞাসা করলো ,তুমি ঠিক আছ তো ?
মায়াবতী একটু লাজুক স্বরে বললো , হুম ... |
অনুব্রত ঘরের ভেতর দেখলো সব ঠিকঠাক | অনুব্রত এটাকে তার নিজের মনের ভুল মনে করে ব্যাপারটাকে আর অতটা গুরত্ব দিলো না | এবার অনুব্রত আর কিছু না ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল আর সে মায়াবতী কেউ ঘুমিয়ে পড়তে বলল |
পরের দিন সকালে মায়াবতীর বিদায় কার্য সম্পন্ন হলো এবং অনুব্রত মায়াবতীকে ওর নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো |
তারপর যতই দিন যেতে লাগল ততই অনুব্রত মায়াবতীর প্রেমে পড়ে যেতে লাগল | মায়াবতীকে ছাড়া অনুব্রতর আর কিছু ভালো লাগতো না | যেন কোনো অজানা আকর্ষণ অনুব্রত কে মায়াবতীর কাছে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো | অফিসের কাজে মন বসত না | অনুব্রতর সবসময় মায়াবতীর কথাই ভাবতে ইচ্ছা করতো | এই ভাবে দিন এগোতে লাগলো |
একদিন অনুব্রত কে কিছু লোকজন অফিসের কাজের কারণে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যায় | সেটা মায়াবতী দেখেছিল |
পরের দিন সকালে অনুব্রত যখন অফিসে গেল তখন অফিসের গেটের সামনে একটা পুলিসের গাড়িকে দেখতে পেলো | অনুব্রত প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না | তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে অফিসের সামনের প্লে-গ্রাউন্ডে অনেকগুলো লোকের জটলা দেখতে পেল |
অনুব্রত সেই ভিড়ের মধ্যে থাকা অফিসের একজন নতুন কর্মচারী কে জিজ্ঞাসা করল , এখানে কি হয়ছে ?
সেই লোকটা জবাবে বলল , আমাদের অফিসের দুজন স্টাফের লাশ পাওয়া গেছে |
অনুব্রত সেই লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম , এটা কী ভাবে হলো ?
লোকটা বললো , আমি জানি না | সকালে ওয়াচমেন এসে যখন অফিসের গেট খুলছিলো তখন এই লাশগুলোকে ও দেখতে পায় | ওই আমাদের সকলকে ফোন করে জানায় | পুলিশ এসেছে | প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে দিয়েছে |
অনুব্রত সেই লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে লাশ গুলোর কাছে গেল | অনুব্রত দেখলো লাশ গুলোকে সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে | বাইরে শন-শন করে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছিল | বাইরের সেই প্রচন্ড হওয়ার কারণে লাশের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরে গেল | লাশ গুলোকে দেখে অনুব্রত চমকে গেল | এই লোকগুলো তো অনুব্রতর চেনা | এই লোকগুলোই তো কালকে অনুব্রতকে হুমকি দিয়েছিল | অনুব্রত নিজেকে একটু সামলে নিয়ে লাশগুলোকে দেখতে লাগলো | লাশ গুলোকে দেখতে- দেখতে অনুব্রতর চোখ একটা জায়গায় আটকে গেল |
অনুব্রত নিজের মনে বললো , ওটা কি ?
কাছে গিয়ে অনুব্রত জিনিসটাকে হাতে তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো | জিনিসটা অনুব্রতর খুব চেনা | আরে .... এটা তো মায়াবতীর আংটি | এটা এখানে এলো কিভাবে ? এই কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ অনুব্রতর মনে পড়ে গেল কালকে যখন এই লোক গুলো আমাকে হুমকি দিচ্ছিলো তখন মায়াবতী দেখেছিল | অনুব্রতর আর বুঝতে দেরী হলো না যে ওদেরকে কে খুন করেছে |
অনুব্রতকে আজ সকাল সকাল বাড়ি চলে আসতে দেখে মায়াবতী জিজ্ঞাসা করল , কি ব্যাপার অনুব্রত আজ সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে এলে ? আমাকে বাড়িতে একা রেখে দিয়ে গিয়ে তোমার নিশ্চয়ই অফিসের কাজে মন লাগছে না ?
অনুব্রত বললো , না .... তা নয় | কালকে আমাকে যে দুজন লোক হুমকি দিতে এসেছিল তাদের লাশ আজ অফিসে পাওয়া গেছে | পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করেছে | যতদিন না তদন্ত শেষ হয় ততদিন অফিস শীল থাকবে | তাই চলে এলাম | তোমার কি মনে হয় ওদের কে খুন করতে পারে ?
মায়াবতী বলল , আমি কি করে জানবো , আমি কি ওদের খুন করেছি নাকি |
অনুব্রত বললো , হুম ... | আচ্ছা তোমার হাতের আংটিটা কোথায় গেল ?
মায়াবতী বলল , আজকে সকাল থেকেই আমি আংটিটা খুজছি | কোথায় যে গেল খুঁজে পাচ্ছিনা |
অনুব্রত তখন পকেট থেকে আংটিটা বার করে মায়াবতীকে দিয়ে বললো , সকালে তোমার আংটিটা এখানকার মেঝেতে পড়ে ছিল | আমি তুলে নিয়ে আমার পকেট এ রেখেছিলাম | সকালে মনে ছিলোনা তোমাকে আংটি টা দেওয়ার কথা | তোমার হাতের আঙুলটা ফাঁকা দেখে আমার মনে পড়লো | অনুব্রত নিজেই আবার মায়াবতীকে আংটিটা পরিয়ে দিলো |
রাত্রি তখন দুটো বাজে | একটা অদ্ভুত আওয়াজে অনুব্রতর ঘুমটা ভেঙে গেল | শব্দটা আসছে বাড়ির ছাদ থেকে | অনুব্রত মায়াবতী কে ডাকার চেষ্টা করল কিন্তু দেখল মায়াবতী বিছানায় নেই | মনে হয় ওয়াশরুমে গেছে | অনুব্রত ওয়াস রুমের দরজা খুলে দেখলো মায়াবতী সেখানে নেই| অনুব্রত খেয়াল করল সেই অদ্ভুত আওয়াজটা আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না | মায়াবতীকে অনুব্রত সারা ঘর খুঁজে ফেলল কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না | মায়াবতী খুঁজতে খুঁজতে অনুব্রত ছাদে গিয়ে পৌছালো | ছাদে গিয়ে অনুব্রত যা দেখলো তা সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি | মায়াবতী একটা মরা লাশের শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর মায়াবতীকে এ কি একই রকম দেখতে হয়েছে | চোখের কঠোর দুটো যেন ফাঁকা , গালে বড় বড় কাটা দাগ , মাথার মাঝ বরাবর দু'ভাগে ভাগ করা | মনে হচ্ছে তাকে যেন কেউ খুব নৃসংস ভাবে খুন করেছে | মায়াবতীর সারা শরীরে মাটি লেগে রয়েছে | যেন মায়াবতীকে কেউ মাটির তলায় পুতে রেখেছিল | অনুব্রত আর থাকতে পারল না | সে অজ্ঞান হয়ে ছাদের মেঝেতে পড়ে গেল |
পরের দিন সকালে যখন অনুব্রতর জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখলো সে বিছানায় শুয়ে আছে | পাশে মায়াবতী বসে আছে | মায়াবতীকে দেখে অনুব্রত এবার ভয় পেতে শুরু করলো |
এভাবে কিছুদিন চলতে লাগল |
তারপর একদিন রাতে অনুব্রত সাহস করে মায়াবতীকে জিজ্ঞাসা করল , তুমি কে ? কি চাও তুমি ?
মায়াবতী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জবাব দিলো , আমি মায়াবতী | আমি আজ থেকে প্রায় ছমাস আগে মরে গেছি | মরে গেছি বলাটা ভুল হবে আমাকে খুন করা হয়েছে | আমাকে আমার নিজের কাকা-কাকিমা খুন করেছে | ওরাই সামান্য সম্পত্তির লোভে আমার মা-বাবাকে খুন করেছিল আর যখন আমি সেটা জানতে পারি তখন ওরা আমাকেও খুন করে | আর আমার লাশটাকে জঙ্গলে ফেলে দেয় | পুলিশ আমার লাশটাকে বেওয়ারিশ মনে করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল | কিন্তু আমার আত্মা তখনও শান্তি পাই নি | আমি আমার মা –বাবার খুনিকে কিভাবে ছেড়ে দিতাম | তাই আমি আমার এবং মা–বাবার খুনের প্রতিশোধ নেবার জন্য ফিরে এলাম | ওরা আমার থেকে মুক্তি পাবার অনেক চেষ্টা করেছিলো | কিন্তু আমি ওদেরকে ছাড়িনি | আমি নিজের হাতেই ওদেরকে শাস্তি দিয়েছি |
এবার অনুব্রত মায়াবতীকে জিজ্ঞাসা করলো , তুমি আমার অফিসের ওই লোক দুটোকে খুন করলে কেন ?
মায়াবতী বলল , কারণ ওরা তোমাকে হুমকি দিয়েছিল তাই | আমি থাকতে তোমাকে কেউ হুমকি দেবে এটা কখনো সম্ভব নয় | তাই আমি ওদের খুন করেছি |
অনুব্রত বলল , তাহলে এবার তুমি কি চাও ?
মায়াবতী বলল , তোমাকে....... তোমার ভালোবাসা আমাকে পাগল করে তুলেছে | আমি তোমার কোন ক্ষতি চাই না | শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই |
অনুব্রত বললো , তা হয় না .... তুমি একজন আত্মা |
মায়াবতী বললো , আমি জানি | আমি চলে যাব | আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্তিতে তুমি আর একটা নতুন করে বিয়ে করে নিও | আমাকে ক্ষমা করে দাও |
মায়াবতী বলল , অনুব্রত আমকে শেষ বারের মতন একবার আলিঙ্গন কর | এতেই আমার মুক্তি |
অনুব্রতর দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে | তারপর অনুব্রত দেখল মায়াবতীর শরীরটা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল |
অনুব্রত মনে মনে বলল , মায়াবতী চলে গেছে !
এক বছর পর অনুব্রত আবার নতুন করে বিয়ে করেছে | নতুন সংসার শুরু করেছে | তারপরও মাঝে মাঝে অনুব্রত গভীর রাতে ছাদে যায় মায়াবতী কে দেখতে | যদি তাকে দেখতে পায় | কারণ জীবনের প্রথম ভালবাসাকে কখনোই ভোলা যায় না |