(এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক | বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই | বাস্তবের সাথে যদি কোনো মিল থেকে থাকে তাহলে সেটা সম্পূর্ণরূপে অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় |)
আমার মামাতো ভাই দিল্লীতে থাকে | আমার মামাতো ভাই আমাকে প্রায়শয় ওর বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতো | পড়াশোনা চলাকালীন আমরা একসাথেই দিল্লি উনিভার্সিটি থেকে অনার্স পাস করি | কলেজে মামাতো ভাই আর আমার ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও আমদের দুজন্কার বন্ধুত্ব খুব ভালো ছিলো | ভাগ্যক্রমে এখন চাকরির সুবাদে আমরা দুজনে দিল্লীতে থাকি | তবে দিল্লীতে ওর বাড়ি থাকে আমার বাড়ির দুরত্ব অনেকটাই | মামাতো ভাই চাকরি পাবার পর বিয়ে করেছে | তবে আমি এখনো বিয়ে করিনি | আমি এখন পুরোপুরি সিঙ্গেল | তবে হয়ত খুব শীগ্রই চার হাত এক হতে পারে |
মামাতো ভাই এর বারবার অনুরোধের জন্য আমি অফিস থাকে দিন-তিনেকের ছুটি নিয়ে নিলাম | আমি মামাতো ভাই কে ফোনে বললাম কাল ওদের বাড়ি যাচ্ছি | মামাতো ভাই কথাটা শুনে রীতিমত বেশ আনন্দিত হলো | পরের দিন সকালে প্লান মত সব ঠিকঠাক করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম | মনে করলাম সন্ধে বেলায় রওনা হবো | সেই মত ড্রাইভার কে সব ঠিকঠাক ভাবে বুঝিয়ে দিলাম |
সন্ধার খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম | বেরনার সময় মা যথারীতি সাবধানতা বাণী দিতে লাগলো | সাথে একটি তাবিজও দিলো | আমি তো এই সব দেখে অবাক |
আমি বললাম , মা তুমি সেই আগেকার দিনের মানুষই রয়ে গেলে | আর এই সব তাবিজ-মাদুলিতে কি কেউ বিশ্বাস করে ! এই সব জিনিস গুলো অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার কে প্রশয় দেয় | আর তুমি ......
মায়ের তো সটান জবাব , কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক আমি করি | নে তুই এটা হাতে বেধে নে |
আর কি করা যায় যথারীতি মায়ের হুকুম মেনে মাদুলিটা হাতে পরে নিলাম | এবার আমি আর ড্রাইভার জীবন গাড়িতে উঠে পড়লাম |
ঘড়িতে তখন রাত আটটা বাজে | শহরের কোলাহল থেকে অনেক দুরে চলে এসছি | এমনিতেই অমাবস্যার রাত | চারিদিক গাড় নিকষ কালো অন্ধকার | গাড়ির হেডলাইট এ রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলোকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে | ড্রাইভারের পাশের সিটেই আমি বসে ছিলাম | পুরো গাড়িটায় আমি আর জীবন ছাড়া আর কেউ নেই | মাঝে মাঝে ওর সাথে কথা হচ্ছে আর গাড়ি একশ থেকে একশ-কুড়ি কিমি বেগে ছুটে চলেছে |
ঠিক এমন সময় আমার ফোন টা বেজে উঠল | আমি পকেট থাকে ফোন টা বার করে দেখলাম মা ফোন করেছে |
আমি ফোন টা রিসিভ করলাম | হ্যালো বলতেই মা জিজ্ঞাসা করলো , একা যাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো তোর ?
আমি বললাম , আরে না .... না কোনো অসুবিধে হচ্ছে না |
তুমি চিন্তা কর না | আমি পোঁছে তোমাকে ফোন করবো | এই বলে ফোন টা রাখে দিলাম |
জীবন কিছুক্ষণ পর একটা গান চালালো | গান টা আমার খুব পছন্দের | গান শুনতে শুনতে কখন যে চোখে ঘুম নেমে এসছিল জানি না |
হঠাৎ করে জীবন এমন ভাবে গাড়ির ব্রেকটা মারলো , যেন পুরো গাড়িটা উল্টে যাবার জোগার |
আমি জীবন কে ধমক দিয়ে বললাম , এটা কি হলো জীবন ? এত জোরে কখনো গাড়ির ব্রেক মারে ?
জীবন বলল , আমার দোষ না স্যার , ওনার দোষ | ওনার জন্য সবকিছু |
আমি আস্তে আস্তে গাড়ির সমানের দিকে তাকিয়ে দেখি ২১ থেকে ২২ বছরের একটি মেয়ে একটা বাচ্চা কে কোলে করে নিয়ে দাড়িয়ে আছে | ঘড়িতে তখন রাত ১২ টা বাজে | মেয়েটির পরনে সাদা শাড়ি | শাড়ির আঁচল মাটির সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে | চুলগুলো এলোমেলো ভাবে হওয়ায় উড়ছে |
আমি গাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এসে বললাম , কি ব্যাপার ? আপনি এত রাতে এই শুনশান রাস্তায় বাচ্চাকে কোলে করে আমার গাড়ির সামনে আসলেন কেন ?
তখন মেয়েটা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল , আমাকে বাঁচান | ওরা আমাকে মেরে ফেলবে | আমি কোনো রকমে ওদের ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি | সামনেই আমার শ্বশুরবাড়ি | দয়া করে আমাকে আপনারা আপনাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন |
আমি বললাম , দেখুন আপনি রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান | আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারবো না |
এই কথা বলতেই মেয়েটা আমার পা জড়িয়ে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল |
ওদিক থেকে জীবন বলল , আমাদের গাড়ির পিছনের সিট তো খালি পড়ে আছে | আমরা না হয় ওকে এই বিপদ থেকে একটু সাহায্য করি আর সামনেই তো ওর শ্বশুর বাড়ি আমরা ওখানেই ওকে নামিয়ে দেব |
জীবনের কথা শুনে মেয়েটাকে আমি গাড়িতে উঠতে বললাম | মেয়েটি বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে গাড়ীর পিছনের সিটে গিয়ে উঠে বসলো | এরপর জীবন গাড়ি স্টার্ট করে দিল |
কিছুক্ষণ পরে গাড়ির ভিতরে আমার আর জীবনের কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো | একটা চাপা কটু ও বিশ্রী আশটে গন্ধে গাড়ির ভেতরটা যেন ম-ম করছে | আমরা আর থাকতে পারলাম না | সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির জানলাগুলো খুলে দিলাম | জীবন গাড়িটাকে রাস্তার ধারে দাঁড় করালো |
হঠাৎ আমাদের দুজনের কানে একটা অদ্ভুত শব্দ এলো | মনে হচ্ছে কেউ যেন কিছু একটা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে | আমরা ভালো করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম | শব্দটা আসছে গাড়ির পিছনের সিট থেকে | আমি আর জীবন একটু ভয়ে-ভয়ে গাড়ির পিছনের সিটের দিকে তাকালাম | তারপর আমরা যা দেখলাম তাতে আমাদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল | আমরা আমাদের নিজেদের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না |
আমরা যে মেয়েটাকে গাড়িতে তুলেছিলাম সেই মেয়েটা এখন একটি ভয়ানক দানবে পরিণত হয়েছে | সেই দানবটার বড়-বড় হাত এবং সেই হাতে বড়-বড় ধারালো নখ | চোখগুলো পুরো একেবারে টকটকে লাল যেন কোন আগুনের গোলা | ঠোট থেকে লাল রক্তের লালা ঝরছে | সারা শরীরে শ্যাওলা জাতীয় থকথকে পদার্থ লেগে রয়েছে | সে এক বিভৎস রূপ |
আমি দেখলাম দানবটা সেই ছোট্ট বাচ্চাটার শরীর থেকে মাংসগুলোকে পরম তৃপ্তি তে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছিল | দৃশ্য টা এতই ভয়ংকর সেটা বলে বোঝানো যাবে না |
এই দৃশ্য দেখে আমরা দুজনে প্রচন্ড ঘামতে শুরু করলাম | আমার গলা থেকে যেন কোন আওয়াজই বেরোলো না | হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে | জীবন এই সবকিছু দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে | আমি যে এতক্ষণ ধরে দানবটাকে দেখছিলাম সেটা এখনও সে খেয়াল করিনি | আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না | আমার মাথা কাজ করছিল না | আমি আরেকবার দানব্টার দিকে তাকালাম | এবার দানব্টার লাল চোখে চোখ পরে যায় | এবার সে তার বীভৎস লালা জড়ানো চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকায়|
একটু একটু করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে | তখন তার ঠোটে একটা পৈশাচিক হাসি বিরাজ করছে | যখন দানবটা আমার অনেক কাছে চলে আসে তখন আমি দুই হাত দিয়ে আমার মুখ ঢাকলাম আর ঠিক তখনই মায়ের দেওয়া সেই তাবিজটা থেকে একটা তীব্র নীল আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল | নীল আলোর প্রভাবে সেই দানবটা আমার থেকে অনেকটা দুরে সরে গেল | তারপর যা ঘটল তা অতি ভয়ঙ্কার | নীল আলোর প্রভাবে দানবের সারা শরীর থেকে মাংস গুলো ঝরে পড়তে শুরু করল | দানবটা একটি প্রচণ্ড হাড়-হিম করা চিৎকার করে উঠল | যেন কোনো অদৃস্য শক্তি দানবটার শরীর টাকে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলতে চায় | এবার দানবটা আরও একটি ভয়ংকর চিত্কার করে উঠলো | আমি দেখলাম দানবটার শরীরটা মাঝখান থেকে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে | সে এক ভয়ঙ্কর হাড় হিম করা দৃশ্য যা আমি কোনদিন ভুলবো না | এরপর দানব এর সারা শরীরটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে ধুলোর মত বাতাসে মিলিয়ে গেল |
ঘটনাটা ঘটার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারেনি | ঘুমটা ভাঙলো জীবনের কণ্ঠস্বরে | জীবন বলল , স্যার উঠে পড়ুন ..... সকাল হয়ে গেছে |
আমি বাইরে চারি দিকে তাকালাম সকালের সূর্যের প্রথম কিরণ চারিদিক আলোকিত করে তুলেছে | ঘুম থেকে উঠতেই জীবন কালকের সেই দানবটার কথা জিজ্ঞাসা করল |
আমি বললাম , তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তার ঠিক পরে আমিও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম | তাই কালকের ঘটনাটা ব্যাপারে আমার আর কিছু মনে নেই | কালকের রাতের বাদ বাকি ঘটনাটা আমি আর জীবন কে বললাম না |
প্রায় সকাল সাতটা নাগাদ আমি আমার মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে পৌছালাম |
মামাতো ভাই আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল , কিরে তোর কাল রাতে তো আমার এখানে আসার কথা ছিল , তোর আসতে এত দেরি হল কেন ?
তখন আমি আর জীবন কালকে রাত্রের ঘটনাটা সব খুলে বললাম |
আমার মামাতো ভাই ঘটনাটা শুনে একটু গম্ভীর গলায় বলল , তোরা যে হাইওয়ে দিয়ে কাল রাত্রে আসছিলিস সেই হাইওয়েতে প্রায় বছর তিনেক আগে একটা ২১ থেকে ২২ বছরের মেয়েকে তার বাচ্চা সমেত কতগুলো লোক মিলে কুপিয়ে খুন করে তার লাশটাকে পাশের একটি নদীতে ফেলে দিয়েছিল | তখন থেকেই ওই হাইওয়েতে ওই মেয়েটা আত্মা ঘুরে বেড়ায় | সেই জন্য ওই হাইওয়ে দিয়ে রাত্রি দশটার পর কেউ যায়না | তোরা ওই হাইওয়ে সম্পর্কে জানতিস না যার জন্য তোদের সাথে এই রকম ঘটনা ঘটেছে |
আমরা মামাতো ভাইয়ের কথা শুনে আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম |