Read What my heart needs by Brishti Roy in Bengali Women Focused | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

আমারো পরান যাহা চায়

নারীচরিত্র বোঝা নাকি ভগবানের ও অসাধ্য। তা কথাখানি সঠিক বটে। এর বহু পরীক্ষিত প্রমাণ বড় বড় কবিসাহিত্যিক রাই দিয়ে গেছেন। তা ভালোবাসার ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হয় কেন? একটু ভিন্ন স্বাদের ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে আজকের এই গল্প।।                                                  " এই যে এলেন, আমার রানিমা , রাজকার্য টি সেরে। তা দেরি হবে বলে দিলে তো হয়, তোমার জন্য তো ভাত বেড়ে হাঁ করে বসে থাকতে হয়না।" খানিক টা চেঁচিয়েই বললেন নীলিমা। রাত 10.30 এর সময় হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এমনিতেই ক্লান্ত ছিল বীথি, তাই আর এখন কোনো উত্তর না দিয়ে ও চুপচাপ উঠে গেল উপরে। " দয়া করে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এস এবার।খাবার টা তো জুড়িয়ে গেল।" গজগজ করতে করতে বললেন নীলিমা।।                                                                সল্টলেকের এই দিকটাতে ঘরবাড়ি এমনিতেই কম। তায় আবার এই পাড়াটা একটু পুরোনো। পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে যে দোতলা কমলা রঙের বাড়িটা বেশ কয়েক বিগত দশক গুলোতে অযত্নের ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই থাকেন নীলিমা রায়, বীণাপানি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের একসময়ের রাশভারী , দাপুটে অঙ্কের শিক্ষিকা, আর তাঁর বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত একমাত্র ছেলে অর্ণবের বউ বীথিলেখা রায়, শ্রী গঙ্গাধর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চাইল্ড স্পেশালিস্ট। বাড়িতে এই দুটি প্রাণী ছাড়া লোক বলতে কাজের মেয়ে মিনতিদি, সকালের রান্না বান্না করার জন্য আর নিত্যনৈমিত্তিক কাগজওয়ালা, দুধওয়ালা,এদের যাতায়াত।নীলিমা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর দশেক হলো।বছর ছয়েক আগে স্বামী নিরঞ্জন গত হওয়ার পর একপ্রকার জোর করেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন নীলিমা, বাড়িতে একজন লোক এলে ফাঁকা ফাঁকা ভাবটাও কমবে আর ওনার একজন সঙ্গীও জুটবে। পাত্রী দেখতে শুনতে বেশ ভালো , সুন্দর মুখশ্রী এসব দেখে মা, ছেলের দুজনের ই পছন্দ হয়ে যায়। তাই ঘরোয়া পাত্রীর খোঁজে থাকলেও ভালো পাত্রী পেয়ে যাওয়ার কথা ভেবে আর বীথির চাকরির ব্যাপার টা নিয়ে মাথা ঘামান নি নীলিমা। তারপর যথা সময়ে ধুমধাম করে বিয়েও হয়ে যায়।প্রথম প্রথম কয়েকটা বছর বেশ ভালোই কাটছিল, সমস্যা শুরু হলো যখন অর্ণবের আমেরিকা যাওয়ার জন্য জব অফার লেটার এলো। ছেলে বউকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, আর নীলিমা ছেলেকে যেতে দেবেন না আর বৌমা কেও না। মা ছেলের মধ্যে তর্ক চলাকালীন বীথি বাধ সাধল, " মা আমারও তো একটা চাকরি আছে, আমি চাকরি ছেড়ে শুধু মাত্র ঘর সামলাতে অর্ণবের সাথে আমেরিকা যেতে পারবো না, তার চেয়ে আমি  এখানেই থাকবো আপনার সাথে, আর অর্ণব যদি যেতে চায় তো যাক।" মা ও ছেলের রাগারাগি এবার গিয়ে পড়লো বীথির ওপর। অর্ণব তো রেগে বলেই ফেললো, " কি ভাব নিজেকে, শুধু তোমার একার ই চাকরির দাম আছে, আমার নেই, আর তোমাকে না নিয়ে আমি যেতে পারবো না, বেশ তুমি যাবে না তো ঠিক আছে, আমি একাই যাবো আমেরিকা, কালকেই আমি ফ্লাইটের টিকিট বুক করছি, কালই আমি চলে যাবো। " অর্ণব সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর নীলিমা কিছুক্ষন বীথির ওপর অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে চলে গেলেন। খানিকটা ঘোরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলো বীথি।।                                    তারপর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে। স্বামী স্ত্রীর অভিমানের বরফ কিছুটা হলেও গলেছে। সকালে বিকেলে নিয়ম করে ফোনে কথা হয় দুজনের। দুজনেই দুজনের চিন্তা করে। এদিকে শাশুড়ি বৌমার খিটিমিটি লেগেই থাকে,  বেশিক্ষন তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় না, তবে যখনই হয় খুব একটা ভালো কিছু ঘটে না। নীলিমা প্রায় ই গজগজ করেন, আর বীথি চুপ করে শুনে যায়, কখনো কখনো মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেয়, তখন আবার ঝগড়া বেঁধে যায়। এরপর নীলিমার গলা সপ্তমে উঠলেই বীথি সেখান থেকে চলে যায়। ওর ভয় হয় বেশি চিৎকার করলে যদি আবার কোনো অঘটন ঘটে যায়। তবে শাশুড়ি আর বৌমা দুজনেই দুজনের সামনে না হলেও খেয়াল রাখে বেশ ।গত তিন বছর এই অবিরাম সাংসারিক কাহিনীর সাতকাহন চলার পর হঠাৎ এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধেতে বীথিকে অর্ণব বলে, ও আগামী মাসে ফিরে আসছে ভারতে পাকাপাকি ভাবে। এখানেই ও জব করবে। বাকি দিনগুলো ও নিজের বাড়িতেই কাটাতে চায়।।            ফোনটা ছেড়ে চুপ করে সোফাতে বসে রইল বীথি। ব্যস্ত শহরটার গায়ের ধুলো মলিন জামাটাকে এই সন্ধ্যার বৃষ্টি ক্রমাগত ভিজিয়ে চলেছে। আধখোলা কাঠের জানালা টার ফাঁক দিয়ে রাস্তার মরে যাওয়া হলুদ নিয়নের আলোগুলো বীথির ঘরের সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার টাকে সামান্য আলোকিত করেছে। ঘরে আলো জ্বালাতে ভুলে গেছে বীথি। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।গলায় আঁচল দিয়ে সন্ধ্যা দেখাতে দেখাতে এগিয়ে আসছেন নীলিমা। " দেখেছো, দেখো , এই মেয়ের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে , মহারানী এখনো ঘুম থেকে ওঠেননি, ঘরের আলোটা ও জ্বালায়নি। বীথি, ও বীথি, বীথি...." ঘরের চৌকাঠে এসে থমকে গেলেন নীলিমা, আবছা আলোয় দেখলেন বীথি সোফায় বসে আছে। নিজে ঘরে ঢুকে আলো টা জ্বালালেন। তারপর বীথির পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন, " বীথি, কি হয়েছে মা , বল আমায়?" বীথি ফিরে তাকালো শাশুড়ির দিকে। দুচোখে জল ভরা দীঘির মতো টলটল করছে , " কিরে , তুই কাঁদছিস কেন ?" বীথি কাঁদতে কাঁদতে মুখটা গুঁজে দিলো নীলিমার কোলে। নীলিমা ওর মাথায় , পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। " বীথি, বলনা কি হয়েছে ? কাঁদছিস কেন বল ?"                                                              " মা, জানো অর্ণব পরের মাসে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা আসবে বলেছে। ও এখানেই সেটল হয়ে যাবে, আর আমেরিকায় যাবে না।"                           নীলিমা হেসে উঠলেন, " ও এই ব্যাপার। ধুরর, পাগলি মেয়ে, এর জন্য কেউ কাঁদে নাকি? কত ভালো খবর বলতো? কতদিন পর তোর বর তোর কাছে ফিরে আসছে, আর তোর ওপর অভিমান করে নেই, ভালোই তো এবার একসাথে আমরা বাড়িতে থাকবো , তুই কাঁদছিস কেন রে ?"                বীথি নীলিমা কে বলতে পারল না, ও সেই জন্যই কাঁদছে। তিন বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা নীলিমার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত ও ভীষণ ভালোবাসে। সারাদিনের কাজের ব্যস্ততার পর ক্লান্ত হয়ে যখন ও বাড়ি ফিরে দেখে নীলিমা ওর জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে, ক্লান্তি গুলো কোথায় পালিয়ে যায়। নীলিমার বকবকিগুলো ওর সারাদিনের কাজ করার শক্তি যোগায়। রাতে কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লে শাশুড়ি এসে যখন গায়ে চাদর টা টেনে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বীথি তখন ঠিক যেন তার নিজের তারা হয়ে যাওয়া মায়ের স্পর্শ পায়। নীলিমার কোলে মুখ গুঁজলে নুন হলুদের গন্ধ, ধূপের গন্ধ মিশে একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ পায় বীথি, সে গন্ধে ওর স্মৃতি গুলো জীবন পায়। শীতের দিনগুলোতে একই লেপের নীচে শাশুড়ি মায়ের গায়ে লেপ্টে মায়ের কোলে থাকা সন্তান যেমন উম পায় সেরকম উম কে মনে প্রানে উপভোগ করে বীথি। সেই সব কিছু আর একমাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, এই কষ্ট বীথির চোখ বারবার ভরিয়ে দেয়। ও নীলিমার কোলে মুখ গুঁজে শুধু কেঁদে যায়, হয়তো শেষ বারের মতো মন প্রাণ দিয়ে নিংড়ে নিতে চায় শাশুড়ির সবটুকু মাতৃস্নেহ।।