Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অবচেতনার অন্ধকারে - 5

চোখ খুলে লুসি দেখলো ঘরে জ্বলছে সেই স্বপ্নময় নীল আলো। সে তাকাল, চোখের সামনে ছায়ার মতো সরে যায় দুটি দৃশ্য, একটিতে যে উদ্দাম অভিসারে মত্ত, হাতে তার সুরা পাত্র, সুরমা টানা চোখের কোন যৌবনের সহস্র সঙ্গী করে। অন্য ছবিটি এক দেহ পিপাসু বুভুক্ষু রমণীর, যে প্রতিরাতে নিজেকে নিবেদিত করে এক কিশোরের কাছে।

- না, না, বিশ্বাস কর, এ জীবনে আমি সেইবা অথবা আগাথা হতে চাই না। আমি পবিত্র ভাবে বাঁচতে চাই। দেখতে চাই বসন্তকে। উপভোগ করতে চাই দূর আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া স্কাইলার্কের কাকলি।

আত্মার গভীরে প্রোথিত চেতনার মধ্যে আলোড়িত এক বাঙময় সত্তা লুসিকে বার বার মনে করায়, সে ব্যাভিচারিনী সে কলঙ্কিতা এবং সে হত্যাকারী।

দুটি পরস্পর বিরোধী চিন্তার মধ্যে পিষ্ট হতে হতে লুসি যেন ক্রমশঃ ডুবতে থাকে - চেতনা থেকে অবচেতনাতে, আলো থেকে অন্ধকারে, জীবনের উল্লাস থেকে মৃত্যুর নীরবতায়।

হিমেল হওয়ার হাহাকার -

হাতখানি কেঁপে ওঠে তার। পাথরের সিলেটে আঁকা বাঁকা এলোমেলো অক্ষরে কি যেন লিখছে সে। সে, লুসি, এক কদিনে আরো একটু শীর্ণা হয়েছে। সেদিন ছিল রহস্যময় মিশরে, আজ এসেছে আমেরিকাতে। এখন নিউইয়র্ক শহরের এক আকাশ ছোঁয়া বাড়ির সতেরো তলার একটি নিভৃত ঘরে বসেছে হেনরির ডাকিনি বিদ্যার পরীক্ষা। এখানে লুসিকে করা হয়েছে মিডিয়াম, যার মাধ্যমে অশরীরী আত্মারা ক্ষণকালের জন্য জীবন্ত হয়ে উঠবে।

- কি দেখতে পাচ্ছ লুসি?

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ক্লারা প্রশ্ন করে। কোনো জবাব নেই। সে লুসির মাথার মধ্যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠায়, ঘরের তাপমাত্রা আরো একটু কমিয়ে দেয়, তারপর তার এক আঙ্গুল লুসির কপালে রেখে সম্মোহনের নিপুন ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ স্থির রেখে আবার প্রশ্ন করে - জবাব দাও, তোমার চোখের সামনে কার মুখ ভেসে উঠেছে?

বিদ্যুৎ তরঙ্গে লুসির চেতনা অব্যক্ত যন্ত্রনায় একবার মাত্র কেঁপে ওঠে, তারপর সে আচ্ছন্নের মতো বলে - আমার চোখের সামনে আবছা কুয়াশার মধ্যে ভেসে ওঠে একটি শিশুর মুখ। সে হলো তিন বছরের আদরের মেয়ে, সে থাকে পার্ক এভিনিউয়ের ৫৬ নং বাড়ির দোতলায়। তার বাবা মিস্টার জনকিল বার্ন হলো অটোমোবাইল কোম্পানির ম্যানেজার।

....... মেয়েটিকে এখন তার মা কোলে করে নিয়ে চলেছে কেজে। এই মুহূর্তে তারা রাস্তা পার হবে।

- শোন লুসি, তোমার সমস্ত চেতনা কেন্দ্রীভূত কত ঐ তিন বছরের মেয়েটির ওপরে। আর অন্তরের সমস্ত অভিশাপ সংবাদিত করো তার প্রতি। যেন রাস্তা পার হতে গিয়ে দ্রুত বেগে ছুতে আসা মোটরের তলায় প্রাণ হারায় সে।

- না, আমি এই হত্যা কিছুতেই করতে পারবো না।

মুখ বন্ধ, তাই লুসির কণ্ঠস্বর শোনা গেলো না। কিন্তু তার চেতনার মধ্যে ঐ শব্দ কটি আলোড়িত হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্লারার হাতের ইলেকট্রিক চাবুক নিঃশব্দে একবার ঝলসে ওঠে। গুমরে কাঁদে লুসি, এ কান্না অশ্রু বিহীন, শুধু তার অন্তরের আত্মা কেঁপে ওঠে। সে তার চেতনাকে একত্রিত করে পার্ক এভিনিউতে।

যেন চোখের সামনে ছবিটি মতো দৃশ্যমান ঐ ফুটফুটে মেয়ে লুইজা। তার মা তাকে এক পা এক পা করে হাঁটাচ্ছে রাস্তা দিয়ে।

লুসি মনে মনে চিন্তা করছে ..........একশো পঞ্চাশ মাইল বেগে ছুটে আসছে ক্রিম রঙের রেসিং কার। যেটি আর এক মুহূর্তের মধ্যে লুইজাকে ভূপাতিত করে বেরিয়ে যাবে।

একটি মুহূর্ত, একটি শিশুর জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দোদুল্যমান সুতোর মতো আন্দোলিত। লুসির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, বাইরে প্রথম জানুয়ারীর হিমেল রাত।

হটাৎ লুইজার চিরকার শোনা গেলো। হলুদ ফ্রক পরা একরাশ সোনালী চুলের ফুটফুটে মেয়েটির কোমল বুক চিরে উষ্ণ রক্ত পান করেছে তৃষিত পার্ক এভিনিউ।

তার মা রাস্তার ওপর আঁকড়ে ধরেছে রক্তাত্ত লুইজাকে। খুনী রেসিং কারে বিদ্যুৎবেগে ট্রাফিকের নিয়ম না মেনে ছুটে চলেছে দৃষ্টির অন্তরালে।

কিন্তু এ কি ? ক্লারার চোয়াল বেয়ে তাজা রক্তের স্রোত আসছে কেন ? এবং দৃশ্যমান তার দুটি হিংস্র শদন্ত ? তবে কি সে অনাদি অনন্ত কালের ভ্যাম্পায়ার ?

ভয়ে বিস্ময়ে অনুশোচনায় লুসি জ্ঞান হারালো।

সেই প্রথম, সেই শুরু। তারপর ? তারপর ?

তারপর অনেক্ষন লুসি নিজের আত্মাকে প্রশ্ন করেছে দুরন্ত অনুশোচনায়। তারপর রাট গভীর হলে কে যেন তাকে লীলায়িত ভঙ্গিমায় ডাক দেয়।

লুসি আজ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে ছিল তার বিছানায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হিমেল হাওয়ার হাহাকার বিদীর্ণ হচ্ছে শহর নিউয়র্কের অন্তরে।

নিজের ঘরের মধ্যে লুসি যেন ভয়ে অশরীরী অস্তিত্ব অনুভব করে।

এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, যাকে সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না অথচ প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করছে তার নীরব পদচারণা। শুনছে তার বিকৃত কণ্ঠস্বর এবং স্পর্শ পাচ্ছে তার অপার্থিব দেহ বাহিত দুর্গন্ধ বাতাসের।