রোমন্থন
এক ক্লান্তিহীন যাযাবরের জীবনালেখ্য
অবতরণিকা
কোনো বিষয় নিয়ে নাতিক্ষুদ্র কিছু লেখার তাগিদ গভীরভাবে অনুভব করলে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যায় ঘটনাক্রম মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে নিতে আর কোথা থেকে শুরু করবো এই ভাবনায়। বিশেষ করে, বিষয়টি যখন হয় আত্মকথন, যার অধিকাংশ জুড়ে আছে চিরদুঃখিনী অবর্ণনীয় সহনশীলা ও সকলের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী এক মায়ের চরম আত্মত্যাগের কথা, তখন প্রতি পদে ছিন্ন হতে থাকে ভাবনার সূত্র।
চিরকাল পৃথিবীতে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ থাকে, যারা তাদের পরিবারের অতীত সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং তাদের পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের নিকট থেকে পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত হয়ে থাকে। আমার প্রাণাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তান ঋভু (পোশাকি নাম অনিরুদ্ধ) সেই অল্প সংখ্যক মানুষের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমার পুত্র কখনও তার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেনি, যদিও, আমি মাঝে মাঝে আমার ও আমার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কিছু কিছু ঘটনার কথা তাকে বলেছি। আমার পুত্র আগ্রহ প্রকাশ করেনি, তার অর্থ এই নয় যে, সে অসংবেদনশীল বা পূর্বপুরুষদের প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাব রয়েছে। আমি জানি যে আমার পুত্রের প্রকৃতি কোমল ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। আমার বিবেচনায়, প্রত্যেকের উচিৎ তার পিতা-মাতা ও পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত হওয়া। তাই, আমি আমার নিজের এবং আমার পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা ও জীবনে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি এখানে সংক্ষিপ্তভাবে লিপিবদ্ধ করলাম এই আশা নিয়ে যে, আমার এই জীবনালেখ্যটি আমার শুভানুধ্যায়ীরা এবং বিশেষ করে আমার পুত্র তাদের কোনো এক অলস অবকাশে পড়বে।
অশোক ঘোষ
প্রথম অধ্যায়
মায়ের কথা
তখন ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ। সেই ভারতবর্ষের অন্তর্গত বঙ্গদেশে কপোতাক্ষ নদের অনতিদূরে এক অখ্যাত অথচ বর্ধিষ্ণু গ্রাম গঙ্গারামপুর। সেই গঙ্গারামপুর গ্রামের এক বনেদি পরিবারের কর্তা ছিলেন কালীপদ রক্ষিত। তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন আশালতা যাঁর অন্য নাম ছিল ভবানি। কালীপদ রক্ষিত ছিলেন ছয় পুত্র ও চার কন্যার পিতা। কালীপদ রক্ষিতের দশটি সন্তানের মধ্যে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে প্রথমে কন্যা সন্তানের জন্ম, যার নামকরণ করা হয়েছিল “মীরা” – আমার গর্ভধারিণী মা।
মায়ের জন্মের প্রায় দুই বছর পর আমার মায়ের এক ভাইয়ের জন্ম হয় এবং স্বলপকালের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তারপর ক্রমে ক্রমে মায়ের আরও নয়টি ভাই-বোন জন্মগ্রহণ করে।
সেকালে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদেরকে প্রথাগতভাবে শিক্ষাদানের প্রচলন প্রায় ছিল না বললেই চলে। যে কারণে, লেখাপড়া শেখার অসীম আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, আমার মা বাড়িতেই বাংলা পড়তে ও লিখতে শেখে। মায়ের পিতৃগৃহে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি ছাড়াও বহু প্রথিতযশা লেখকের গল্প ও উপন্যাসের সম্ভার ছিল, যেগুলি মা বারবার পড়ত।
অন্যদিকে, আমার মায়ের মা অর্থাৎ আমার দিদিমা দুই/আড়াই/তিন বছর অন্তর গর্ভধারণ ও সন্তানের জন্মদান করার জন্য প্রায়শঃ অসুস্থ থাকতেন। যার ফলে, আমার মা তার শৈশবে, যখন তার পুতুল খেলার বয়স, তখন ছোটো ভাই-বোনদেরকে পরম স্নেহে ও আদরে কোলে-পিঠে করে বড় করে তুলছে। শুধু তাই নয়, মাত্র নয়-দশ বছর বয়স থেকে আমার মা দিদিমার তত্ত্বাবধানে রান্নার দায়িত্বও নিজের ছোট্ট দুটি হাতে তুলে নিয়েছিল।
এইভাবে এক গতানুগতিক জীবন কাটাতে কাটাতে, আরও দুই বোন আর চার ভাই জন্মগ্রহণ করার প্রায় ছয় মাস পরে ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে মাত্র ষোলো বছর বয়সে খলিষখালী গ্রামে বটকৃষ্ণ ঘোষের কনিষ্ঠ পুত্র সুধীর কুমার ঘোষের সাথে আমার মায়ের বিবাহ সম্পন্ন হয়। আমার মা বুকভরা আশা আর দু’চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ষোলো বছর বয়সে নতুন সংসারে বধূরূপে এলো। আমার দুই পিসির অনেক আগেই বিয়ে হয়েছিল, যদিও আমার তখনও জ্যাঠামশাই অবিবাহিত ছিলেন।
আমার ঠাকুরদাদা বটকৃষ্ণ ঘোষ সুশিক্ষিত, সংবেদনশীল ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি একটি নামী কোম্পানীতে চাকরীরত থাকাকালিন মধ্যচল্লিশ বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর দুই কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে আমার বাবা ছিল কনিষ্ঠ পুত্র ও তৃতীয় সন্তান।
আমার বাবা সুদর্শন ও সুঠাম শরীরের অধিকারী ছিল এবং যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিল। নানা রকম ব্যবসা-বানিজ্য করে আমার বাবা পারিবারিক সম্পত্তির পরিমাণ বাড়িয়েছিল।
আমার বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখ-শান্তিতে ভরপুর এবং সংসারে ছিল সচ্ছলতা। বিয়ের এক বছর পর আমার দিদির জন্ম হলো। দিদির জন্মের দেড় বছর পর আমার জন্ম এবং আমার জন্মের চার বছর পর আমার ছোটো ভাই ও আরো তিন বছর পরে জন্ম হলো আমার ছোটো বোনের। আমাদের চার ভাই-বোনের নামকরণ করা হয়েছিল যথাক্রমে মণিকা (ডাকনাম টুনটুন), হাবুল, মুকুল ও কণিকা (ডাকনাম বুলবুল), পরবর্তীকালে আমার দ্বিতীয় নাম রাখা হয় অশোক। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ভাগ্যবান। আমার প্রতি সকলের আদর ও স্নেহ অন্য তিন ভাই-বোনের তুলনায় ছিল অধিকতর, যা আমি ছোটোবেলা থেকেই অনুভব করতাম।
ইতিমধ্যে, আমার জন্মের কিছুদিনের মধ্যে আমার জ্যাঠামশাই বিয়ে করেন। জ্যাঠামশাইয়ের বড় ভায়রাভাই ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ (দেবু) সরকার। দেবু সরকার মাঝেমধ্যেই আমাদের বাড়ি আসতেন এবং তিনি আমার বাবার সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতেন। এই দেবু সরকার অচিরেই ভয়ঙ্কর কাল হয়ে আমাদের সুখের সংসার তছনছ করে দিয়েছিলেন।
দেবু সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আগে আমার বাবা কখনও মদ বা ঐ জাতীয় মাদকে আসক্ত ছিল না। অন্যদিকে, দেবু সরকার নিয়মিত মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন। দেবু সরকার কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে করতে এক সময় আমার বাবাকে নানাভাবে মদ খাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে আমাদের সুখের সংসারকে অনিবার্য ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন।
প্রথম দিকে বাবা মদ্যপান করত শুধুমাত্র দেবু সরকার আমাদের বাড়িতে যখন মাঝেমধ্যে এসে সন্ধ্যার পর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মদ্যপানে যেতেন। এইভাবে মাঝেমধ্যে মদ্যপান করতে করতে, আমার বাবা কিছুদিনের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং এমনই অবস্থা হয়েছিল যে প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই বাবা মদ্যপানের জন্য মদবিক্রেতার বাড়িতে চলে যেত। বাবা সাধারণত দুইজন মদবিক্রেতার বাড়িতে যেত, যাদের মধ্যে একজন ছিল খলিষখালীর লম্বা ঠাকুর আর অন্যজন ছিল নিকটবর্তী চোমরখালী গ্রামের সুশীল। মদের নেশায় ভয়ঙ্কর আসক্ত হওয়ার দরুন বাবা ক্রমশ আগের মতো ব্যবসা-বানিজ্য এবং টাকা-পয়সা রোজগার করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছিল। যার ফলে, অনিবার্যভাবে ব্যবসার পুঁজি ও নিজেদের জমির নানা রকম ফসল বিক্রির টাকা-পয়সা দিনের পর দিন মদের নেশার জন্য বরবাদ হতে থাকলো।
আমার ঠাকুরদাদা, ঠাকুরমা, মা এবং অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীরা নানাভাবে বোঝানো সত্ত্বেও, বাবার মদ্যপানের নেশা উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছিল আর সেইসঙ্গে বাবার ভিতর থেকে মানবিক গুণাবলি ও কোমল প্রবৃত্তিগুলি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এইভাবে চলতে চলতে একটা সময় নেশার খরচ যোগানোর জন্য মায়ের সমস্ত গয়নাগাটির সঙ্গে বাবা আমার ও আমার দিদির কয়েকটি সোনার চেইন এবং আঙটিও বিক্রি করে দিয়েছিল। মা যখন বাবার এই সমস্ত কাজকর্মের প্রতিবাদ করত, মায়ের উপর চলত দুঃসহ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। ক্রমশ এমন পরিস্থিতি হলো যে, আমাদের দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। কোনো কোনো দিন এমনও গেছে যে, মা কষ্ট করে কিছুটা কচুশাক, নটে শাক বা কলমি শাক যোগাড় করে শুধু একটু নুন হলুদ আর নামমাত্র তেল দিয়ে রান্নার করে আমাদের খেতে দিয়েছে, যাতে আমরা অন্তত বেঁচে থকতে পারি।
একদিকে বাবার অবর্ণনীয় অত্যাচার অন্যদিকে চারটি ছোটো ছোটো সন্তানকে দু’বেলা পেট ভরে খাবার না দিতে পারার ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণা দিনের পর দিন বছরের পর বছর আমার মাকে সহ্য করতে হয়েছে।
যখন নেশার খরচ যোগানোর জন্য মায়ের সমস্ত গয়নাগাটির সঙ্গে বাবা আমার ও আমার দিদির কয়েকটি সোনার চেইন এবং আঙটিও বিক্রি করে দেওয়ার পর বিক্রি করার মতো ঘরে মূল্যবান আর কিছু ছিল না, তখন বাবা কিছুটা করে জমি বিক্রি করা শুরু করেছিল আর এই সুযোগে, আমার জ্যাঠামশাই বাজারদরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে সেই জমি কিনে নিতে থাকলো। এইভাবে, একে একে আমাদের সমস্ত জমি জ্যাঠামশাই নামমাত্র দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়
আমার শৈশব ও কৈশোর
যে অতিশৈশব বয়সকালে চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি স্মৃতিতে গ্রথিত হয় না, আমার সেই অতিশৈশব বয়সে আমি কেমন ছিলাম, আমার প্রতি সকলের ব্যবহার কেমন ছিল ইত্যাদি সম্পর্কে আমার মা এবং আরও অনেকের কাছে পরবর্তীকালে জানতে পারি যে, আমি অত্যন্ত মেধাবী ও শ্রুতিধর ছিলাম। শুধুমাত্র আমাকে নয়, আমার বাকি তিন ভাইবোনকেও মা খুব যত্ন করে বাংলা এবং ইংরাজী অক্ষর পরিচয় করানো থেকে বাংলায় প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও ইংরাজীতে ওয়ার্ড বুক পড়তে শিখিয়েছিলেন। আমার ঠাকুরদাদা আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং আমাকে অনেক কিছু শেখাতেন। আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমার ঠাকুরদাদা আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাইমারী স্কুলে গিয়ে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আমার বয়স কম থাকার জন্য স্কুলের প্রধানশিক্ষকের আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু ঠাকুরদাদার কথায় আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। যখন আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার ঠাকুরদাদা মারা যান। মৃত্যুর আগে আমার মায়ের হাতদুখানি জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন আর আমার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, মাগো আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে আমার নাতিটাকে মানুষ করে দিতে পারতাম। ওর পড়াশুনার প্রতি যত্ন নিও, দেখবে ও একদিন অনেক বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট মুছে দেবে।
ঠাকুরদাদার মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যার ফলে, পুরানো নাম পূর্ব পাকিস্তান মুছে গিয়ে নতুন স্বাধীন দেশের জন্ম হলো, নাম বাংলাদেশ। সেই যুদ্ধ চলাকালিন কয়েক লক্ষ মানষকে হত্যা করেছিল তৎকালিন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর পাকিস্তানের সমর্থক স্থানীয় মুসলমানদের সংগঠন রাজাকার বাহিনী। যার ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের গ্রামটি ছিল আয়তনে বিশাল আর গ্রামের অধিকাংশ পরিবার ছিল বর্ধিষ্ণু। হাতে গোণা কয়েকটি পরিবার ছাড়া আমাদের গ্রামের বাসিন্দারা ছিল হিন্দু। আমাদের গ্রামের চারপাশে কিছু গ্রাম ছিল মুসলমান অধ্যুষিত। সেই যুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়নি, কারণ, আমাদের ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এতদ্ সত্ত্বেও, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল।
আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভারতে চলে আসবার। কিন্তু, আমাদের পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি আমার জীবনে এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় ঘটে যাওয়ার কারণে। সেদিন সকালবেলায় আমি ও আমার সমবয়সী তিনজন জ্ঞাতিকাকা আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা বাগানের মধ্যে গিয়ে লুকোচুরি খেলার সময় আমি একটা বিশাল কদম গাছের একদম মগডাল পর্যন্ত উঠে যাই। তারপর যে ডালটিতে আমি পা রেখে দাঁড়িয়েছিলাম সেটি হঠাৎ ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি নিচের ডালগুলিতে ধাক্কা খেতে খেতে মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার সেই পড়ে যাওয়া দেখে, আমার সঙ্গীদের মধ্যে একজন দৌড়ে গিয়ে বাড়িতে খবর দেওয়ায়, আমার বাবা এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। তখন গ্রামে কোনো ডাক্তার ছিল না। আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসবার পর নানাভাবে চেষ্টা করার ফলে প্রায় দশ ঘন্টা পর ধীরে ধীরে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসবার পর আমি সমস্ত শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম আর সেইসঙ্গে চেষ্টা করা সত্ত্বেও পাশ ফিরে শুতে পারছিলাম না এবং হাত-পা ঠিকমতো নাড়াতে পারছিলাম না। সেই দুর্ঘটনার পরে মায়ের অক্লান্ত সেবা ও পরিচর্যায় প্রায় ছয় মাস পর আমার নবজন্ম হলো এবং মায়ের সহায়তায় আবার আমি উঠে দাঁড়িয়ে নতুন করে হাঁটা-চলা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
অবশেষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুর্দমনীয় সাহস, আত্মবলিদান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখটি স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হলো বাংলাদেশের বিজয় দিবস হিসাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার জীবনে আরও দু’টি বছর কেটে গেলো অলসভাবে। এদিকে বাবার চরম মাদকাসক্তির জন্য আমাদের সংসারে তখন চরম দারিদ্র্য এবং আমার পড়াশুনাও বন্ধ। তারপর আমার লেখাপড়া নতুন করে শুরু করার জন্য, আমার দাদামশাই আমাকে গঙ্গারামপুর গ্রামে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। পড়তে খুব ভালোবাসতাম বলে মামারবাড়িতে থাকাকালিন সেখানে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি ছাড়াও বহু প্রথিতযশা লেখকের যে সমস্ত বই ছিল, তার মধ্যে প্রায় সবগুলি আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মামারবাড়িতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হলো না। আমার সেই কিশোর বয়সে মামারবাড়িতে থাকাকালিন বাবার নির্দেশ এলো আমাকে ভারতে যেতে হবে নতুনভাবে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করার জন্য।
তৃতীয় অধ্যায়
কৈশোরকালে শুরু আমার পথচলা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে
বাবার নির্দেশানুযায়ী এবং ব্যবস্থাপনায় একজন লোকের সঙ্গে একদিন বেরিয়ে পড়লাম ভারতে আসবার উদ্দেশ্যে। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসবার আগে বাবা জানিয়েছিল যে, বাবা বাড়ির সবাইকে নিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে চলে আসবে। যে লোকটার সাথে বাবা আমাকে পাঠিয়েছিল, সেই লোকটার বাড়ি ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে, যেখান থেকে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হাকিমপুর ছিল খুবই কাছে। সেদিন রাতে সেই লোকটার বাড়িতে থেকে পরদিন ভোরবেলায় তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হাকিমপুরে এসে সেখান থেকে বাসে করে দুপুরবেলা নাগাদ মছলন্দপুরে পৌঁছে গেলাম। মছলন্দপুরে পৌঁছে যাওয়ার পর, সেই লোকটা আমাকে যশোহর মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে একটা বড় মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলো। তারপর আমাকে বসিয়ে রেখে দোকানের মালিকের কাছে গিয়ে কিছু কথা বলে আমাকে দোকানের মালিকের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো এখন থেকে তুই এখানে থাকবি আর এই দোকানে কাজ করবি। দোকানের মালিক তোকে দু’বেলা খেতে দেবে আর মাসে ১৫টাকা করে মাইনে দেবে। আমি তখন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে এবং আচ্ছন্ন অবস্থায় কোনোরকমে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে পেরেছিলাম। আমি আমার চেনাপরিচিত শৈশব ও কৈশোরকালের কিছুটা সময় কাটানো, অত্যন্ত ভালোবাসার গ্রাম্যজীবন, আমার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে এক সম্পূর্ণ নির্বান্ধব, অচেনা, ইঁট-কাঠ-পাথরে গড়ে ওঠা এক ছোট্ট শহরে নতুন জীবন শুরু করলাম। ওই মিষ্টির দোকানের মালিক ছিলেন অত্যন্ত ভদ্রলোক ও সংবেদনশীল। মিষ্টির দোকানের মালিকের বাড়ি থেকে আমার জন্য দু’বেলার খাবার আসতো। দোকানে আমার কাজ ছিল খরিদ্দার দোকানে বসে মিষ্টির খেয়ে চলে যাওয়ার পর টেবিল পরিস্কার করা এবং কাপ-প্লেট ধোয়া। আমি ছাড়া আরও দু’জন একই কাজ করতো। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে দোকান বন্ধ হওয়ার পর রাত প্রায় ১১টা নাগাদ দোকানের মধ্যে বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়তাম এবং ভোর ৬টার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। কয়েক দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম আর অধীর আগ্রহে দিনাতিপাত করছিলাম বাবা, মা, ভাইবোনদের আসার প্রতীক্ষায়।
অবশেষে প্রায় তিন মাস পরে বাবা বাড়ির সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে এসেছিল। ভারতে এসে মছলন্দপুরের সেই মিষ্টির দোকানের মালিকের সাথে কথা বলে বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের গ্রাম থেকে বহুদিন আগে চলে আসা মছলন্দপুরে সপরিবারে বসবাসকারী শচীন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে। সেখানে থাকাকালিন শচীন্দ্রনাথ চৌধুরীর পাঁচটি পুত্রের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ পুত্র ছিল প্রায় আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী। ওরা দুই ভাই লোকাল ট্রেনে বাদাম ভাজা বিক্রি করতো। আমরা ওদের বাড়িতে যাওয়ার পর লোকাল ট্রেনে বাদাম ভাজা বিক্রির ব্যাপারে খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে দু’দিন পর থেকেই আমরা দুই ভাই ওদের সঙ্গে বেরিয়ে লোকাল ট্রেনে ঘুরে ঘুরে বাদাম ভাজা বিক্রি করা শুরু করলাম। শচীন্দ্রনাথ চৌধুরীর পরিবার ছিল অনেক বড় আর প্রয়োজনের তুলনায় বাড়িতে জায়গা অনেক কম থাকায় ওদের সাথে আমরাও খুব কষ্ট করে থাকতাম।
এইভাবে কয়েক মাস থাকবার পর আমরা ওখান থেকে চলে গিয়ে গোবরডাঙ্গার চণ্ডিতলায় আমাদের গ্রামে এক সময় বসবাসকারী বাবার বন্ধু অজিত ঘটকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। গোবরডাঙ্গার চণ্ডিতলায় থাকাকালিন একদিন আমাকে নিয়ে বাবা কোলকাতার বেলগাছিয়ায় ললিত স্মৃতি ছাত্রাবাসে গিয়েছিল সেখানকার ক্যান্টিনে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। সেই ছাত্রাবাসে আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা থাকতো। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে বাবার বিভিন্ন রকমের কাজে অসাধারণ যোগ্যতা ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রান্নায় দক্ষতা। সেই ক্যান্টিনটা চালানোর জন্য ঠিকা নিয়েছিলেন অজিত ঘটকের ছোট ভাই অসিত ঘটক। সেই ক্যান্টিনে আমার কাজ ছিল শাক-শব্জি কাটা ও ধোয়া, ঘরের মেঝে মোছা, ছাত্ররা খেয়ে চলে যাওয়ার পর টেবিল পরিস্কার করা এবং এঁটো থালা-বাসন ধোয়া আর বাবার কাজ ছিল রান্না করা। আমাদের দু’জনের এই কাজের জন্য বাবাকে কত পারিশ্রমিক দেওয়া হতো আমি তা জানতাম না। সেখানে কয়েক মাস কাজ করবার পর আমরা ফিরে গেলাম গোবরডাঙ্গায় আর ফিরে যাওয়ার দুই দিন পর থেকে আমি আবার লোকাল ট্রেনে ঘুরে ঘুরে বাদাম ভাজা বিক্রি করা শুরু করলাম।
তারপর ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে আমরা চলে এলাম হৃদয়পুরে। হৃদয়পুরে এসে রেললাইনের ধারে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে আমরা থাকা শুরু করলাম। হৃদয়পুরে আসার পর কিছুদিনের মধ্যে আমি বাদাম বিক্রি ছেড়ে দিয়ে বারাসতে কোর্টের কাছে একটা দোকানে দৈনিক ২টাকা পারিশ্রমিকে কাজ শুরু করলাম। সেই দোকানে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। সেই দোকানে কাজ শুরু করার অল্প কিছুদিনের মধ্যে এক সন্ধ্যায় ট্রেনের ধাক্কা লেগে আমার বাবা মাত্র ৪৫ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেলো। আমাদের সেই চরম দুঃসময়ে আমরা যেখানে থাকতাম সেই পাড়ার গোপাল ঘোষ, অমর সিংহ এবং আরও অনেকে সহানুভূতিশীল হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের দেওয়া আর্থিক সহায়তায় আমরা কোনোরকমে বাবার পারলৌকিক কাজ করতে পেরেছিলাম।
বাবার অকালমৃত্যুর কারণ আমাদের অবর্ণনীয় অসহায় অবস্থায় কিছুটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যাঁরা, তাদের ম্ধ্যে গোপাল ঘোষ এবং অমর সিংহদের পরিবার। আমাদের দু’ভাইয়ের দৈনন্দিন রোজগার ছিল তিন থেকে চার টাকা। ওই সামান্য রোজগারে পাঁচজন মানুষের দু’বেলা পেট ভরে খাবার সংস্থান করা ছিল অসম্ভব। আমাদের যাতে দু’বেলা পেট ভরে খাবার দিতে পারে, তার জন্য মা উল্টোডাঙ্গায় একটা ধূপকাঠির কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিল, যেখান থেকে মা প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই টাকা রোজগার করে আনতো। এ ছাড়াও গোপাল ঘোষ এবং অমর সিংহদের পরিবার থেকে মাঝে মাঝে তাদের বেঁচে যাওয়া খাবার আমাদেরকে দিত, যা সেই সময় আমাদের ক্ষিধে মেটাতে অনেকটা কাজে লাগতো।
১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি আমি দোকানের কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়ির কাছেই দত্ত প্রিন্টার্স নামে একটা প্রেসে কাজ শেখা শুরু করলাম। সেখানে বাংলা ও ইংরাজীতে কম্পোজিং শিখে প্রায় ছয় মাস পর যখন ঠিকমতো কাজের উপযুক্ত হোলাম তখন থেকে মাসে ১৫০টাকা করে মাইনে পেতে শুরু করলাম। প্রেসে কাজ শেখার সময়কালে আমাদের সংসারে অনটন আরও তীব্রভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল আর সেই সময়ে আমার মা অধিকাংশ দিন অনাহারে থেকে আমাদের মুখে যতটা সম্ভব খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতো। ইতিমধ্যে ১৯৭৯ সালে আমার দিদির কোলকাতায় আর ১৯৮২ সালে ছোটো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। দুই বোনের বিয়ের খরচপত্রের অধিকাংশ আমার বড়মামা আর বাকিটা আমাদের পাড়ার সমস্ত শুভানুধ্যায়ীরা করেছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আমার দুই বোনের বিয়ের ক্ষেত্রে বরপক্ষের কোনো প্রকার দাবি ছিল না, আর তা ছাড়া আমাদের আর্থিক দুরাবস্থার জন্য কোনো দাবি থাকলেও তা পূরণ করা সম্ভব হতো না।
দিদি ও বোনের বিয়ের পর ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসের প্রিন্টিং মেশিনে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘনাক্রমে আমার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলসহ পাশাপাশি তিনটে আঙ্গুল ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায়। সেই দুর্ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ডাক্তার বিভু চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে গেলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন আমার তিনটে আঙ্গুল কেটে বাদ দিতে হতে পারে এবং আমাকে অবিলম্বে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে বললেন। ডাক্তার বিভু চক্রবর্তীর উপদেশে আমাকে সেই রাতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার সুনীল ঠাকুরের চিকিৎসাধিনে আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বেড খালি না থাকায় আমাকে করিডোরে শুইয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন ডাক্তার এসে আমার ভেঙ্গে যাওয়া আঙ্গুলগুলি ভালো করে পরিস্কার করার পর সেখানে মলম লাগিয়ে ও ইঞ্জেকশান দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। তার পরদিন থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন আমাকে ওষুধ ও ইঞ্জেকশান দেওয়ার ৫-৬ দিন পর ডাক্তারবাবুরা আমার আঙ্গুলগুলি থেকে ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে বললেন “যাক, আঙ্গুলগুলি বেঁচে গেছে”। এর দু’দিন পর থেকে শুরু হলো নতুন সমস্যা – কিছু দাবি পূরণের জন্য ডাক্তারবাবুদের লাগাতার কর্মবিরতি, যা অনেকদিন ধরে চলেছিল। ডাক্তারবাবুদের কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পরদিন আমার প্রবল জ্বর হলো সঙ্গে তীব্র অরুচি আর ভয়ঙ্কর দুর্বলতা। যেহেতু ডাক্তারবাবুদের কর্মবিরতি চলছিল সেই হেতু হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ম্যালেরিয়া জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিত, যদিও সেই ওষুধ আমার অসুখে একেবারেই কোনো কাজ করছিল না। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালিন হৃদয়পুর থেকে ট্রেনে করে এসে শিয়ালদহে নেমে সেখান থেকে মেডিক্যাল কলেজে পর্যন্ত হেঁটে আমার মা প্রত্যেকদিন দুপুরবেলায় আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতো। মা কোলকাতার রাস্তাঘাট সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল না থাকায় পথ হারিয়ে কখনও বড়বাজারের দিকে কখনও বা হেদুয়ার দিকে চলে যেত। তারপর ভুল পথে এসে বুঝতে পেরে পথচলতি মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে যেত। এদিকে আমার অসুখের প্রকোপ আর শারীরিক দুর্বলতা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায়, ২১ দিন পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে আমার এক বন্ধু তাপস পালের সহায়তায় বাড়ি ফিরে গেলাম। ফিরে আসার পর ডাক্তার বিভু চক্রবর্তী বাড়িতে এসে আমার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে বললেন আমার টাইফয়েড হয়েছে এবং সেইমতো ওষুধপত্র লিখে দিয়ে গেলেন। সেই ওষুধ খেয়ে তিন দিনের মধ্যে আমার জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ সেরে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর প্রায় তিন মাস সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকবার পর আমার ভেঙ্গে যাওয়া আঙ্গুলগুলি ধীরে ধীরে নাড়াতে সক্ষম হবার পর আবার প্রেসের কাজে যোগ দিলাম।
নিয়মিত ভাবে প্রেসে কাজ করতে করতে ১৯৮৫ সালে দুর্গাপূজোর সময় শিলিগুড়ি থেকে আমার ছোটো বোন ও ভগ্নিপতি বেড়াতে এসে আমাকে বললো, দাদা আমার দু’জন দাদু শিলিগুড়ি কোর্টের ওকালতি করেন, আপনি যদি তাদের কাছে কাজ করতে রাজি থাকেন তাহলে আমি দাদুর সাথে কথা বলে আপনাকে জানালে আপনি শিলিগুড়িতে চলে আসবেন। আমি তখন মাসিক ২৫০ টাকা বেতনে প্রেসে কাজ করি এবং স্বল্প আয়ের কারণে সংসার চলতো অতি কষ্টে। সেই কারণে আমি ছোটো ভগ্নিপতির প্রস্তাবে এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। শিলিগুড়িতে ফিরে গিয়ে ছোটো ভগ্নিপতি তার উকিল দাদুর সাথে কথা বলে আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিলিগুড়িতে যেতে বলে আর আমিও কালক্ষেপ না করে ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে আমি প্রেসের কাজ ছেড়ে দিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাই এক নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। এদিকে হৃদয়পুরে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে গেলাম মা আর ছোটো ভাইকে।
চতুর্থ অধ্যায়
আমার নতুন কর্মক্ষেত্র শিলিগুড়ি
আমার ছোটো ভগ্নিপতির যোগাযোগে ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসের কাজ ছেড়ে দিয়ে শিলিগুড়িতে গিয়ে সেখানকার নামকরা উকিল জগদীশ চন্দ্র ঘোষের কাছে আমি কাজে যোগদান করি। জগদীশ চন্দ্র ঘোষ নিজে প্রথম দিকে যথেষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও জীবনে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ম্যাট্রিক পাশ করবার পর মোক্তারী পাশ করে ১৯৫৫ সালে শিলিগুড়ি কোর্টে মোক্তার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে এ্যাড্ভোকেট্স এ্যাক্ট প্রণয়ন হওয়ায় তিনি সেই আইনের ধারা অনুযায়ী এ্যাড্ভোকেট হিসাবে ওকালতি করতেন। তিনি ওকালতি পেশা থেকে অর্জিত অর্থে মেজ ভাইকে যাদবপুর থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, সেজ ভাইকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. আর ছোটো ভাইকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.বি. পাশ করান এবং চার বোনের সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, তিনি তাঁর পুত্রকে লন্ডন থেকে এলএল.বি. ও ব্যারিস্টারি পাশ করান। তাঁর একটি মেয়ে ছিল যে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করেনি।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষের কাছে আমি কাজে যোগদান করবার পর প্রথম কয়েকটা দিন কেটে গেলো আমাকে কি কি কাজ করতে হবে সেই সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝতে। আমার উপর আদালতে বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত যে কাজগুলির দায়িত্ব ছিল, সেগুলির মধ্যে সমস্ত মামলার নথি ঠিকমতো গুছিয়ে রাখা, আদালতে বিভিন্ন মামলায় নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, মক্কেলদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা, প্রতিদিন আদালত থেকে মামলার পরবর্তী তারিখ সংগ্রহ করে মক্কেলদেরকে জানানো, সকাল ও সন্ধ্যায় সেরেস্তায় বসে মামলা অনুযায়ী হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের ঘোষিত উপযুক্ত রায় সম্বলিত বিভিন্ন বই গুছিয়ে রেখে পরদিন আদালতে নিয়ে যাওয়া, নানা ধরণের দরখাস্ত টাইপ করা ইত্যাদি। এখানে বলে রাখি যে জগদীশ চন্দ্র ঘোষের কাছে আমি কাজে যোগদান করবার মাস দুয়েক পরে আমি একটা টাইপ স্কুল থেকে টাইপ করা শিখে নিয়েছিলাম, যার ফলে টাইপ করে আমার কিছু বাড়তি রোজগার হতো। এই কাজে কোনো মাসিক বেতন বা নিয়মিত রোজগার ছিল না। প্রত্যেক মাসে রোজগারের পরিমাণ নির্ভর করতো সেই মাসে জগদীশবাবুর কতগুলি মামলা ছিল, কতগুলি জমি-বাড়ির দলিলপত্র করা হয়েছিল এবং সেই কাজগুলি করে কত টাকা রোজগার হতো, তার পরিমাণের উপর। আমি এই কাজে যোগ দেওয়ার পর প্রথম মাসে আমার রোজগার হয়েছিল প্রায় ৮০০ টাকা। পরবর্তী সময়ে আমার গড় মাসিক রোজগারের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। শিলিগুড়ি যাওয়ার পর প্রথমদিকে কয়েক মাস আমার ভগ্নিপতির বাড়িতে থাকতাম। পরে রোজগারের পরিমাণ একটু বাড়তেই ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি একটা বাড়ি ভাড়া করে হৃদয়পুর থেকে মাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে গেলাম। সেই সময়টায় যথেষ্ট আর্থিক স্বাচ্ছল্য না থাকলেও, আর্থিক কষ্ট দূর হয়ে যাওয়ায় এবং চরম হতাশা আর অসহনীয় দুঃখকষ্টের অবসান হয়ে এক চিলতে আশার আলো দেখতে পেয়ে আমার মা খুব খুশী হয়েছিল। জগদীশবাবুর কাছে কাজে যোগ দেওয়ার বছর দুয়েক পর থেকে তিনি অনেক ব্যাপারে আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময় তিনি সব ধরণের দরখাস্ত, দলিলপত্র ইত্যাদি নিজে লিখে আমাকে দিয়ে বলতেন অশোক ভালো করে দেখে নিয়ে যদি কোনো ভুল থাকে তাহলে সংশোধন করে টাইপ করে দিও। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে সাধারণ দরখাস্ত, দলিলপত্র, বাড়ি ভাড়ার চু্ক্তিপত্র ইত্যাদির খসড়া আমাকে দিয়ে লেখাতেন এবং বিভিন্ন মামলায় আমাদের মক্কেলদের মামলার ন্যায় একই ধরণের মামলায় বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের ঘোষিত উপযুক্ত রায় বিভিন্ন বই (Law Journal) থেকে খুঁজে বের করে দিতে বলতেন। শিলিগুড়িতে থাকাকালিন আমি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলাম, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শ্রী অনুপ দেব, যিনি পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। জগদীশবাবু কাস্টমস্ ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ দপ্তরের আইনজীবী হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সেই সুবাদে অনেক কাস্টমস্ ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ অফিসারদের সঙ্গে আমার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, যা এখনও বজায় রয়েছে।
ইতিমধ্যে ১৯৮৬ সালের শেষদিকে আমার ছোটো ভাই হৃদয়পুরে থাকাকালিন নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করেছিল এবং ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে আর ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি আমার ভাইয়ের পরপর দুটি কন্যার জন্ম হয়েছিল। সেইসময় আমার রোজগার কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮৯ সালের শেষদিকে একসঙ্গে থাকবো বলে সপরিবারে আমার ভাইকে শিলিগুড়িতে আমার কাছে নিয়ে এলাম। শিলিগুড়িতে আসার পর আমার ভাই একটা দোকানে মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে কাজে যোগ দিয়েছিল, যা থেকে সংসারে প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য পরিমাণ টাকা খরচ করতে পারতো। ভাইয়ের দুটি মেয়েই আমার খুবই ন্যাওটা ছিল এবং আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো।
জগদীশবাবু তাঁর মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু নিজের পেশাগত ব্যস্ততার কারণে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ-খবর করার জন্য সময় পাচ্ছিলেন না। একদিন কথায় কথায় আমার আত্মীয়-স্বজনদের কথা উনি জানতে চাওয়ায় আমি আমার মামাদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলি। সেই সময় দুর্গাপুরে আমার বড়মামার কাছে থেকে আমার চতুর্থ মামা এম.এ. পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। জগদীশবাবু তখন আমাকে প্রস্তাব দিলেন মামাদের সঙ্গে কথা বলতে যদি উভয় পরিবার পাত্র-পাত্রী দেখার পর সম্মত হয় তাহলে আমার চতুর্থ মামার সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে হতে পারে। তিনি আরও বললেন যে আমার চতুর্থ মামাকে তিনি কোনো ভালো চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার পদে চাকরীর বন্দোবস্ত করে দেবেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার পদে চাকরী ছিল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এরপর আমার মধ্যস্থতায় এবং উভয়পক্ষের সম্মতিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার মামার সাথে জগদীশবাবুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল।
মামার বিয়ের বছরখানেক পর থেকে আমার মা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন আমাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলেও আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ, তখন ভাইয়ের পরিবার, মা ও আমাকে নিয়ে মোট ছয়জন মানুষ ভাড়াবাড়িতে থেকে, ভাইয়ের দুটি মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে তাদের পড়াশুনা এবং সংসারের অধিকাংশ খরচের দায়িত্ব বহন করার পর আমার পক্ষে বিয়ে করার চিন্তা করা ছিল বিলাসিতা। আমার আপত্তি সত্ত্বেও মা আমাকে না জানিয়ে আমার জন্য পাত্রী নির্বাচন করে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে বলে পাত্রীপক্ষকে মোটামুটি কথা দিয়ে এসে তারপর আমাকে মেয়েটির ছবি দেখিয়ে বললো এই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো বলে ঠিক করেছি, তুই একটা দিন ঠিক করে এই মেয়েটিকে একবার দেখে আয়।
আমি রাজি না হওয়ায়, আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার কাছেই মেয়েটির দিদির বাড়িতে মেয়েটিকে এনে আমাকে দেখানোর ব্যবস্থা করায়, আমি এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে দেখে এসে মাকে আমার বিয়ে না করার পূর্ব সিদ্ধান্তই জানিয়ে দিলাম। আমার সেই সিদ্ধান্তে মা মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়ে অনেক অভিমানে কয়েকদিন পরে দুর্গাপুরে বড়মামার কাছে গিয়ে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে বেহালায় দিদির কাছে চলে গিয়েছিল। এইভাবে প্রায় ছয় মাস আমাদের ছেড়ে দিদির কাছে থাকবার পর আমি আমার মত পরিবর্তন করে বিয়ে করতে রাজি হয়ে ভাইকে বললাম মাকে নিয়ে আসতে। ভাই পরদিন কোলকাতায় গিয়ে বেহালায় দিদির কাছ থেকে মাকে নিয়ে এলো। তারপর ১৯৯৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর শিলিগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার রাধাপদ বোসের দ্বিতীয়া কন্যা মীনা বোসের সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। আমাদের বিয়ের দুই বছর পর ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালের এক শুভক্ষণে আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের জীবনে একরাশ খুশি ও আনন্দ বয়ে নিয়ে এলো আমার একমাত্র পুত্রের জন্ম। আমার পুত্রের জন্মের পর তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পরদিন আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো এবং একটানা ১৭ দিন হাসপাতালে চিকৎসাধিন থাকার পর তাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। আমার সদ্যজাত পুত্রের দুর্ভাগ্য যে সে মায়ের দুধ খাওয়া থেকে একেবারেই বঞ্চিত হয়েছিল কারণ তার মায়ের বুকে দুধের ধারা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমার পুত্রের নামকরণ করেছিল আমার মা, ডাকনাম ঋভু এবং পোশাকি নাম অনিরুদ্ধ। এই দুটি নাম ছাড়াও, আমার মা ওকে আদর করে ধনো বলে ডাকতো। আসলে মা ওকে অপার স্নেহবশত ধন শব্দটিকে আদর করে ধনো উচ্চারণে ডাকতো। মা ওকে প্রতিদিন রোদ্দুরে শুইয়ে সারা শরীরে ভালো করে তেল মাখিয়ে ঈষদুষ্ণ জলে চান করিয়ে দিত। আমার দিদি ও বোন দু’জনেরই দুটি করে ছেলে, যাদের জন্মের সময়ও মা দিদি ও বোনের কাছে থেকে বাচ্চাদের ঠিকমতো দেখাশুনা ও পরিচর্যা করে কয়েক মাস পরে আমার কাছে ফিরে আসতো।
আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বিষহ সময় শুরু হলো আমার বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে। একদিকে, আমার মায়ের মধ্যে সমস্ত রকমের গুণ ও সহনশীলতা থাকা সত্ত্বেও মা কখনও কোনো ব্যাপারেই অন্যের উপর নির্ভর করা পছন্দ করতো না এবং আশা করতো বাড়ির সবাই তার কথা শুনে চলবে। অন্যদিকে, আমার স্ত্রী যথেষ্ট সংসারী এবং আমার প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কারোর কথা শুনে চলা একেবারেই পছন্দ করতো না। আমার স্ত্রীর এরূপ অনমনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণ হিসাবে আমি যা বুঝেছিলাম তা হলো - আমার শ্বশুরের পাঁচজন সন্তানের মধ্যে চারটি মেয়ে ও একটি ছেলে, তাদের মধ্যে আমার স্ত্রী ছিল দ্বিতীয় সন্তান এবং আমার শ্বশুরবাড়িতে সবকিছুতেই চলতো তারই কর্তৃ্ত্ব। যার ফলে, আমার মা ও স্ত্রীর মধ্যে ছোটোখাটো বিষয়েও মতপার্থক্যের কারণে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া হতে থাকলো এবং দু’জনের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিল, যা ক্রমশ বেড়েই চলল। আমি দু’জনকে নানাভাবে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। আস্তে আস্তে এমন অবস্থা হলো যে দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেলো, যা আমার মায়ের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। জীবনের বিভিন্ন সময়ে অনেকের কাছ থেকে মায়ের আঘাত পাওয়া, সারাটা জীবন অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং মায়ের প্রতি আমার স্ত্রীর ব্যবহার, বিশেষ করে আমার আপত্তি সত্ত্বেও যাকে নিজে পছন্দ করে পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছিল, মায়ের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার জন্য মা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সংসারে যে সময় এই রকম অশান্তির বাতাবরণ সেই সময়টায় আমার টাকা-পয়সার আরো বেশি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আগের তুলনায় রোজগার কমতে থাকলো। এই রকম এক অসহনীয় অবস্থা চলতে চলতে ইতিমধ্যে আমার পুত্রের বয়স সাত মাস পার হলো। ছোটোবেলায় আমার পুত্র এতটাই সুদর্শন ছিল যে ওকে যেই দেখতো সেই কোলে তুলে আদর করতে চাইতো। আমার এবং আরও সবার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল একেবারে ছোট্ট অবস্থা থেকেই আমার প্রতি আমার ছেলের ছিল এক অদ্ভুত টান। ও সবচেয়ে ভালোবাসতো আমার কোলে থাকতে। কখনও কান্নাকাটি করলে আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই ও শান্ত হয়ে যেত।
আমি যে সময় এই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেই সময় আমার যে মামা চা বাগানে চাকরী করতেন এবং জগদীশবাবুর মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন, আমার দিদিমা সেই মামার কাছে এসে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। জগদীশবাবুর মেয়ে, অর্থাৎ আমার মামি কয়েক সপ্তাহ পরপর বাপের বাড়ি আসতো। যে সময় বাপের বাড়ি আসতো সেই সময় জগদীশবাবু তাঁর মেয়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে আমার কাছে আমার দিদিমার সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করতেন, যা আমার কাছে ছিল একেবারেই অবিশ্বাস্য। কারণ, আমার দিদিমা ছিলেন মমতাময়ী ও অত্যন্ত সাদাসিধা স্বভাবের মানুষ এবং তিনি কখনও কারোর সাথে এমন ব্যবহার করতেন না যাতে সে কষ্ট পেতে পারে। প্রথমদিকে আমি জগদীশবাবুর অভিযোগের জবাবে বলেছিলাম যে, আমার দিদিমা তো অত্যন্ত সাদাসিধা স্বভাবের মানুষ, তিনি কি করে এমন ব্যবহার করতে পারেন? জগদীশবাবুর প্রতিক্রিয়া ছিল – তুমি তো এই কথা বলবে কারণ “blood is thicker than water”।
একদিকে রোজগার কমে যাওয়া ও পারিবারিক অশান্তি, অন্যদিকে কর্মস্থলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, এই দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে আমি একবার আত্মহননের কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মন থেকে এমন ভাবনা ঝেড়ে ফেললাম কারণ আমাকে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তানকে নিয়ে আমার দেখা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হবে আর শূ্ণ্য থেকে শুরু করে তিলে তিলে গড়ে তোলা আমার সংসারকে বিনষ্ট হোতে দিয়ে আমার মাকে তার জীবনের নিষ্ঠুরতম মানসিক আঘাত দিতে পারবো না। অবশেষে আমি আমার স্থৈর্য হারিয়ে ফেলে কাজে ইস্তফা দিয়ে ১৯৯৭ সালের আগষ্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাউকে কিছু না জানিয়ে আর মা, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ছোটো ভাইয়ের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়লাম অনির্দিষ্টের পথে। শিলিগুড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় একটা ছোট্ট কাগজে লিখে রেখে এসেছিলাম “সংসারে নিত্য অশান্তিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনির্দিষ্টের পথে বেরিয়ে পড়লাম। আমার খোঁজ কোরো না। যদি জীবনে দাঁড়াতে পারি, আমি ফিরে আসবো।“
পঞ্চম অধ্যায়
আমার শিক্ষা-দীক্ষা
আগেই জানিয়েছি যে, প্রাথমিক স্তরের পরে আমার পক্ষে প্রথাগতভাবে শিক্ষালাভ করার না ছিল কোনো সুযোগ না ছিল আর্থিক সঙ্গতি। ভয়ঙ্কর প্রতিকুলতা থাকা সত্ত্বেও আমার তীব্র আকাঙ্খা ছিল শিক্ষালাভের। শিক্ষালাভের জন্য আমার এই তীব্র আকাঙ্খায় তাড়িত হয়ে, হৃদয়পুরে থাকাকালিন আমাদের পাড়ায় যে সমস্ত ছেলেরা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীতে পড়তো, কাজ থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর তাদের কাছ থেকে এক একদিন এক একটি বিষয়ের বই নিয়ে এসে পড়তাম। এ ছাড়াও অনেকের কাছ থেকে বিখ্যাত লেখকদের লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের বই সংগ্রহ করে আমি ও আমার মা দু’জনে পড়তাম। আমার ও আমার মায়ের অগণিত বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল হৃদয়পুরে আমাদের পাড়ায় পদক্ষেপ ক্লাবের সৌজন্যে। পদক্ষেপ ক্লাবে প্রায় পাঁচ হাজার বই সংবলিত একটি নাতিক্ষুদ্র গ্রন্থাগার ছিল এবং প্রতি রবিবার সেই গ্রন্থাগার খোলা হতো সদস্যদের বই দেওয়া ও নেওয়ার জন্য। আমি ওই গ্রন্থাগার থেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বই নিয়ে এসে আমি ও আমার মা পড়তাম। আমার বই পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে কিছুদিনের মধ্যে ক্লাবের পক্ষ থেকে গ্রন্থাগারের দেখাশুনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে, সপ্তাহে একখানি বইয়ের পরিবর্তে আমি পাঁচ-ছয়খানি বই এনে সপ্তাহভর আমি আর মা পড়তাম। এরপর যখন ১৯৮৫ সালের শেষদিকে হৃদয়পুর থেকে শিলিগুড়ি চলে গেলাম, ততদিনে ঐ গ্রন্থাগারের অধিকাংশ বই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল।
শিলিগুড়ি গিয়ে জগদীশ চন্দ্র ঘোষের কাছে আমি কাজে যোগদান করবার পর শুরু করলাম আমার ইংরাজী শিক্ষা। আইনজীবীদের পেশাগত প্রয়োজনে বিভিন্ন আইনসংক্রান্ত প্রচুর বই সংগ্রহে রাখতে হয়। শিলিগুড়িতে আইনজীবিদের মধ্যে জগদীশবাবুর আইনসংক্রান্ত বইয়ের পরিমাণ ছিল সর্বাধিক এবং রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তাঁর সেই বিপুল সংখ্যক বিভিন্ন আইনের বই আমি নিয়মিত পড়া শুরু করলাম। কোনও ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে কোনোরূপ সাহায্য না নিয়ে শুধুমাত্র ডিকশনারির সহায়তা নিয়ে আমি ইংরাজী ভাষা শিক্ষালাভে ব্রতী হয়েছিলাম। এইভাবে আমার ইংরাজী শিক্ষার পাশাপাশি আমি বিভিন্ন বাংলা গল্প-উপন্যাসের বইও নানাভাবে সংগ্রহ করে এবং কিনে আমি ও আমার মা পড়তাম। প্রাথমিক স্তরের পরে আমার পক্ষে প্রথাগতভাবে শিক্ষালাভ করা সম্ভব না হলেও, আমি আজীবন এভাবেই নিজেকে সুশিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছি। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো আমার মায়ের ও ঠাকুরদাদার কাছে, যাঁরা আমার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন শিক্ষালাভের জন্য তীব্র অভীপ্সা।
ষষ্ঠ অধ্যায়
শিলিগুড়ি থেকে আমার কোলকাতায় আগমন
১৯৯৭ সালের আগষ্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাউকে কিছু না জানিয়ে মা, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ছোটো ভাইয়ের কাছে রেখে শিলিগুড়ি ছেড়ে কোলকাতায় এসে প্রথমে উঠলাম বেহালায় দিদির বাড়িতে এবং দিদিকে আমার আসার কারণ বিস্তারিতভাবে জানালাম। আমার দিদি অত্যন্ত স্নেহশীলা এবং জামাইবাবুও তদ্রুপ। তারপর দিদির কাছেই কয়েক মাস থাকলাম। দিদির ওখানে থাকাকালিন দিদি আমাকে হাতখরচের জন্য প্রয়োজনমতো কিছু টাকা মাঝে মাঝে দিত। দিদির ওখানে পৌঁছানোর কয়েকদিন পর থেকে চাকরীর সন্ধান করতে থাকলাম।
চাকরীর সন্ধানে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম স্ট্র্যান্ড রোডে কাস্টমস্ অফিসে এই আশা নিয়ে যে সেখানে হয়তো শিলিগুড়িতে থেকে বদলি হয়ে আমার ঘনিষ্ট কোনো না কোনো অফিসার কোলকাতার অফিসে যোগ দিয়েছেন আর তাদের মধ্যে কেউ আমাকে চাকরী পাওয়ার বাপারে হয়তো সহযোগিতা করতে পারে। সৌভাগ্যবশত আমার ঘনিষ্ট কয়েকজন অফিসারকে সেখানে পেয়ে গেলাম। সেই অফিসারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুজন দাস এবং সুজিত চক্রবর্তী। আমার কাছ থেকে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সবকিছু শোনার পর দু’জনেই আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন যে তাঁরা আমার চাকরীর জন্য অবশ্যই যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। কয়েকদিন পরে সুজন দাস এবং সুজিত চক্রবর্তীর সাথে আমি আবার দেখা করায় তাঁরা জানালেন যে তখনো পর্যন্ত আমার চাকরীর কোনো বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি যদিও তাঁরা চেষ্টা করছেন। সেদিন সেই সাক্ষাৎকারের শেষে সুজনবাবু আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেটস্ ম্যান খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে নিজের খরচে আমার নামে চাকরীপ্রার্থীর কলামে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর আমি বেশ কয়েকটি চাকরীর প্রস্তাব পাই। যে সমস্ত সংস্থার থেকে প্রস্তাবগুলি পেয়েছিলাম, তাদের কেউই মাসিক এক হাজার টাকার বেশি বেতন দিতে সম্মত না হওয়ায় অবশেষে ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে নিউ আলিপুরে ইন্টারন্যাশনাল প্যাকারস্ এ্যাণ্ড মুভারস্ নামে একটি সংস্থায় মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে টাইপিস্ট হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলাম।
দিদির ওখানে থাকাকালিন পাশের বাড়ি থেকে প্রতিদিন ইংরাজী দৈনিক খবরের কাগজ “The Telegraph” এনে পড়তাম আর বিশেষ করে “চাকরী খালি”-র পাতা খুঁটিয়ে দেখতাম। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি একদিন ঐ খবরের কাগজে চাকরী খালি-র একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। বিজ্ঞাপনটি বাংলায় অনুবাদ করলে যে অর্থ হয় তা হলো “ইংরাজী ভাষায় কথা বলা ও লেখায় ভালো দক্ষতা থাকলে নিম্নে প্রদত্ত বক্স নম্বরে দরখাস্ত করুন”। সেই বিজ্ঞাপনটিতে সংস্থার নাম বা তাদের কার্যাবলি সম্পর্কে কোনো বিবরণ না থাকা সত্ত্বেও আমি অনুমান করতে পারলাম যে কাজটি নিশচয়ই ইংরাজীতে বিভিন্ন ধরণের মুসাবিদা লেখা ও প্রয়োজনানুযায়ী বলা সম্পর্কিত হবে। যাই হোক, বিজ্ঞাপনটি দেখবার পর আমি আমার প্রথানুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ইংরাজীতে বিভিন্ন ধরণের মুসাবিদা লেখা ও প্রয়োজনানুযায়ী বলা সম্পর্কিত কাজের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে একখানি দরখাস্ত লিখে বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত বক্স নম্বরে পাঠিয়ে দিলাম।
দরখাস্তখানি পাঠিয়ে দেওয়ার দিন পনেরো পরে এক শুক্রবার রাতে দিদির বাড়িতে কাজ থেকে ফিরে আসবার পর একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা খুলে দেখলাম সেটা এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানি নামক একটি সলিসিটারস্ ফার্ম ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ দিনেই ইন্টারভিউয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল। অনেক আশা নিয়ে পরদিন ঐ চিঠিতে উল্লিখিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করায় ঐ সংস্থার একজন অংশীদার শ্রী নরেশ বালোদিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর তিনি আমাকে সোমবার সকাল ১০টার সময় দেখা করতে বললেন। পরে জেনেছিলাম বিজ্ঞাপনটি উনিই দিয়েছিলেন।
আশা ও আশঙ্কার দোলাচলচিত্তে সোমবার নির্দিষ্ট সময়ে এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানি-র অফিসে পৌঁছানোর ১০ মিনিটের মধ্যে নরেশবাবু আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে নিলেন। ওনার চেম্বারে ঢোকার পর উনি আমাকে বসতে বললেন। আমি বসবার পর উনি আমাকে আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারী মামলার বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করায় আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলাম। তারপর নরেশবাবু আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে মুসাবিদা করার অভিজ্ঞতার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় আমি ওনাকে বিশদভাবে জানালাম। প্রশ্নোত্তরপর্ব শেষ হলে উনি অফিসের একটি ছেলেকে ডেকে নিয়ে আমাকে কিছু সাদা কাগজ আর একটা কলম দিতে বললেন আর আমাকে বললেন তার সাথে গিয়ে অফিসের একটা ফাঁকা ঘরে বসে ইংরাজীতে জমিজমা বিক্রির দলিল, বায়নানামা, বাড়িভাড়ার চু্ক্তিপত্র ও জামিনের আবেদনপত্রের মুসাবিদা করবার জন্য। নরেশবাবুর নির্দেশমতো সকাল ১১টায় শুরু করে বিকাল ৫-৩০ নাগাদ মুসাবিদাগুলি লেখা শেষ করে নরেশবাবুর কাছে জমা দিলাম। এইভাবে ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ার পর আমি চাকরীটা পাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আশান্বিত হোলাম। প্রায় দু’সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। আমার দ্বিতীয় ইন্টারভিউ খুব সংক্ষিপ্তভাবে নিয়েছিলেন ওখানকার ম্যানেজিং পার্টনার শ্রী অভীক সাহা এবং আমি যথাযথ উত্তর দিয়েছিলাম। দিন দশেক পরে তৃতীয়বার ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পেলাম। নির্দিষ্ট তারিখে তৃতীয়বার ইন্টারভিউয়ের জন্য উপস্থিত হওয়ার কিছক্ষণ পরে একজন এসে আমাকে একটা বড় চেম্বারে নিয়ে গেলো, সেখানে একজন ভারিক্কি চেহারার প্রবীণ ব্যক্তি বসে ছিলেন আর পাশে একটা চেয়ারে নরেশবাবু বসে ছিলেন। পরে জেনেছিলাম ঐ প্রবীণ ব্যক্তির নাম শ্রী শ্যামানন্দ জালান এবং উনিই প্রকৃতপক্ষে এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানির মালিক। আমাকে উনি ওনার চেম্বারে একটা সোফায় বসতে বললেন। সোফায় বসে দেখলাম উনি আমার লেখা সেই মুসাবিদাগুলি দেখছেন আর মাঝে মাঝে আণ্ডারলাইন করছেন। কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে ঘুরে একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন – আমি কত টাকা বেতন আশা করি। অকস্মাৎ এই প্রশ্নে আমি একটু অপ্রতিভ হয়ে গিয়ে মাসে আড়াই হাজার টাকার কথা বললাম। আসলে, ঐ সংস্থার বেতন কাঠামো না জানায় এবং চাকরীটা যাতে হাতছাড়া না হয় সেই জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকার কথা বলেছিলাম। আমার উত্তর শুনে উনি আমাকে পরের দিন থেকেই ঐ সংস্থায় লিগ্যাল এ্যাসোসিয়েট পদে কাজে যোগ দিতে বললেন। ঐ সংস্থায় যোগদান করার কয়েকদিন পরে বুঝতে পারলাম ওখানকার বেতন কাঠামো অনুযায়ী আমি অত্যন্ত কম বেতন চেয়েছিলাম।
সপ্তম অধ্যায়
ঘোর অমানিশার পর আমার জীবনে নতুন সূর্যোদয়
যদিও আমাকে পরের দিন থেকেই কাজে যোগ দিতে বলেছিলেন, আমি কয়েকদিন সময় চেয়ে নিয়ে অবশেষে ২৩-০৩-১৯৯৮ তারিখে এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানিতে লিগ্যাল এ্যাসোসিয়েট পদে কাজে যোগদান করে যাত্রা শুরু করলাম সোনালী ভবিষ্যতের পথে।
এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানির অফিস ছিল সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমার বসবার জায়গায় টেবিলের উপর লেখার সরঞ্জাম, সাদা কাগজ, নোটবুক এবং একটি কম্পিউটার রাখা ছিল। জীবনে প্রথমবার আমি কম্পিউটার দেখলাম আর কম্পিউটার ব্যবহার করার ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসবার কিছুক্ষণ পর নরেশবাবু আমাকে তিনটে মামলার ফাইল দিয়ে বললেন সেগুলি পড়ে আলাদা আলাদা সংক্ষিপ্তসার ও আমার নিজস্ব মতামত লিখে দেওয়ার জন্য। ওনার কথামতো সেই ফাইলগুলি পড়ে সংক্ষিপ্তসার ও আমার নিজস্ব মতামত লিখে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে জমা করে দিলাম এবং সেগুলি পড়ার পর উনি যথেষ্ট খুশী হোলেন। আমি লক্ষ্য করলাম যে অফিসে প্রায় সবার টেবিলে কম্পিউটার আর সকলেই কম্পিউটারে টাইপ করছে। সেই সময় কম্পিউটারে ওয়ার্ডস্টার, ডস্ ইত্যাদি অপারেটিং সিস্টেমে কাজ হোতো। আমার টেবিলে রাখা কম্পিউটারে যাতে আমি নিজে কাজ করতে পারি তার জন্য আমি কয়েকটা দিন অন্য সবাই কি ভাবে কাজ করছে তা দেখে নিজেই কম্পিউটারে টাইপ করা শিখতে লাগলাম। এইভাবে মোটামুটি মাসখানেকের মধ্যে কম্পিউটারে ভালোভাবে টাইপ করা শিখে গেলাম। আমাকে যদিও একজন স্টেনোগ্রাফার দেওয়া হয়েছিল তবুও আমি নিজেই আমাকে দেওয়া কাজগুলি কম্পিউটারে টাইপ করতাম, যার ফলে আমি অনেকটা কম সময়ে আমাকে দেওয়া কাজগুলি করতে পারতাম। ঐ সংস্থায় মার্চ মাসে যোগদান করার পর দিদির বাড়ি থেকে জুলাই মাসে গোবরডাঙ্গায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানিতে যোগদান করার ছয় মাস পরে আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমার বেতন আড়াই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছিল। বেতন বৃদ্ধির পর আমতলার কন্যানগরে দুই কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে নভেম্বর মাসে শিলিগুড়ি থেকে মা, স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে এলাম। সেখানে দুই মাস থাকার পর ১৯৯৯ সালের জানুয়ারী মাসে বারাসাতের কাছে বামনগাছিতে মাসিক দুই হাজার টাকায় দু’কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এলাম। আমি বামনগাছিতে আসবার মাস তিনেক পরে আমার ভাইও সপরিবারে একটা আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বামনগাছিতে চলে এসেছিল।
আমি এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানিতে ২০০০ সালের ৩১শে জানুয়ারী পর্যন্ত কর্মরত থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখে টিটাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজ/টিটাগড় ওয়াগনস্ গ্রুপে মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতনে ল অফিসার হিসাবে যোগদান করি। এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানি থেকে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার সময় নরেশবাবু, অভীক সাহা এবং শ্যামানন্দ জালান তিন জনেই আমাকে আলাদাভাবে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে চাকরী না ছাড়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু, আমি যেহেতু আগেই টিটাগড় গ্রুপের থেকে নিয়োগপত্র গ্রহণ করেছিলাম, সেইহেতু আমি ওনাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
টিটাগড় গ্রুপে যোগদান করার পর আমার পুত্রকে বারাসাত ইন্দিরা গান্ধি মেমোরিয়াল হাই স্কুলে (ইংরাজী মাধ্যম) ভর্তি করে দিয়েছিলাম। বামনগাছি থেকে স্কুলে আসা-যাওয়ার অসুবিধা হওয়ার কারণে বামনগাছি থেকে হৃদয়পুরের কৈলাসনগরে মাসিক দুই হাজার টাকায় দু’কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এলাম। মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতন থেকে দুই হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর বাকি টাকায় খুব কষ্টে-সৃষ্টে সংসার চালাতে হতো। আমার পুত্র শৈশবে প্রায়শ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তো। সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ ও পুত্রের চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে আমার কাছে কোনো উদ্বৃত্ত টাকা থাকতো না। এমতাবস্থায়, পুত্রকে ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করার জন্য যখন মাত্র আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল অথচ আমার আর্থিক সংগতি ছিল না, তখন আমার অফিসের একজন মহিলা সহকর্মী সরোজ দে (বালদোয়া), যে এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানিতেও আমার সহকর্মী ছিল, সে উপযাচক হয়ে আমাকে শর্তহীনভাবে আড়াই হাজার টাকা ধার দিয়েছিল, যদিও সেই টাকা মাস ছয়েক পরে আমি ফেরৎ দিতে পেরেছিলাম। অযাচিতভাবে সরোজের সেই উপকার, যার জন্য আমি আমার পুত্রকে ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছিলাম, আমি সারাজীবন মনে রেখেছি। টিটাগড় গ্রুপে ২০০১ সালের মে মাস পর্যন্ত চাকরীরত থেকে জুন মাসে একটা সলিসিটারস্ ফার্ম এল.পি. আগরওয়ালা এ্যাণ্ড কোম্পানীতে যোগদান করে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০০১ পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলাম। তারপর ২০০২ সালের জানুয়ারী মাসে আমি টিটাগড় গ্রুপে পুনর্নিযুক্ত হই।
টিটাগড় গ্রুপে দ্বিতীয়বার যোগদান করার পরে আমি বেশ কয়েকবার চাকরী পরিবর্তন করেছি। টিটাগড় গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে একটা ব্যাপারে আমার মতানৈক্য হওয়ায় ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে আমি দ্বিতীয়বার পদত্যাগ করি। তারপর, ২০০৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত জেসপ এ্যাণ্ড কোম্পানীতে সহকারী ম্যানেজার পদে, ২০০৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এস. জালান এ্যাণ্ড কোম্পানিতে দ্বিতীয়বারের জন্য সিনিয়র এ্যাসোসিয়েট পদে, ২০০৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মুভওয়েল গৃহনির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থায় আইনি উপদেষ্টা ও মুসাবিদাকারী পদে, ২০০৭ সালের মে মাস থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ফ্রেন্স মোটর কার কোম্পানীর মানবসম্পদ ও আইন-কানুন বিষয়ক বিভাগে জেনারেল ম্যানেজার পদে, ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ট্র্যান্সেণ্ড ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড নামে একটি অস্ট্রেলিয়ান সংস্থায় লিগ্যাল ম্যানেজার পদে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত আমেরিকান টাওয়ার কর্পোরেশান প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি মোবাইল টাওয়ার সংস্থায় আইনি উপদেষ্টা পদে, ২০১১ সালের জুন মাসে মুভওয়েল গৃহনির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেডে মাত্র এক মাসের জন্য পুনর্বার আইনি উপদেষ্টা ও মুসাবিদাকারী পদে এবং ২০১১ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্কয়্যার ফোর হাউজিং এ্যাণ্ড ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডে লিগ্যাল হেড হিসাবে কৃতিত্বের সঙ্গে চাকরী করেছি। আমার কর্মদক্ষতায় প্রতিটা কর্মস্থলের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিল এবং প্রতিটা সংস্থায় সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সুগভীর আন্তরিকতার।
আমার বহুবার চাকরী পরিবর্তনের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ ছিল শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তির সঙ্গে মতানৈক্য এবং বেতনবৈষম্য। আমার কর্মদক্ষতা অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও প্রথাগত শিক্ষার শংসাপত্র না থাকার জন্য তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতদের তুলনায় আমার বেতনবৃদ্ধি যথেষ্ট কম পরিমাণে হোতো।
অষ্টম অধ্যায়
১৯৯৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আমার জীবনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা
আমার পুত্র ঋভুর বয়স তখন ছয় বছর পেরিয়ে সাত বছর চলছে। আমি সেদিন অফিসে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি থেকে আমার স্ত্রী ফোন করে জানালো যে স্কলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বারান্দায় সাইকেল চালানোর সময় ঋভুর পা ডেকচির মধ্যে রাখা ফুটন্ত এ্যারারুটের মধ্যে অসাবধানতাবশত ঢুকে গিয়ে ভীষণভাবে পুড়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম ওর ডান পায়ের পাতা পুরোটা পুড়ে ফোস্কা পড়ে গিয়ে সাংঘাতিকভাবে ফুলে আছে। ও কাঁদছিল না কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করছিল আর মাঝে মাঝে ওর ছোট্ট শরীরটা যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ওর ঐ যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা দেখে আমার বুকের ভিতরটায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল আর আমি শুধু বুকের মধ্যে ওর মাথাটা নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে পেরেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা আমি তো আছি। যে লোকটা ড্রেসিং করার জন্য আসতো সে তার পেশাগত অভ্যাসে যখন ক্ষতস্থান ঘষে পরিস্কার করতো তখন আমার ছোট্ট ছেলেটা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ছটফট করে কাঁদতো। দু’দিন পর ঋভু আমাকে বলল বাবা তুমি ড্রেসিং করে দিও কারণ ওর বিশ্বাস ছিল বাবা ওকে ব্যথা দেবে না। তারপর থেকে আমিই এমনভাবে ড্রেসিং করে দিতাম যাতে ও ব্যথায় কষ্ট না পায়। অনেকদিন ভুগেছিল ছেলেটা।
জেসপ কোম্পানীতে ২০০৩ সালে আমি যোগদান করার কয়েক মাস আগে বি.আই.এফ.আর-এর নির্দেশে ৭২% শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানীটার বেসরকারীকরণ করা হয়েছিল। আমি জেসপে যোগ দেওয়ার মাস তিনেক পরে সরোজ দে ওখানে যোগ দিয়েছিল। বহু বছর ভাড়াবাড়িতে থাকতে থাকতে প্রায়ই নিজস্ব একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখতাম। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য হৃদয়পুর স্টেশনে অপেক্ষা করার সময় হৃদয়পুরের বাসিন্দা আমার এক সহযাত্রী বন্ধুকে সেকথা বলায় তিনি আমাকে একটা বাড়ির সন্ধান দিলেন এবং পরবর্তী রবিবারে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটা দেখাতে নিয়ে গেলেন। বাড়িটা একতলা এবং অসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমার পছন্দ হয়ে গেলো। বাড়ির মালিক যে মূল্য চাইলেন আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। আমি তখন মাসে সতেরো হাজার টাকা বেতন পাই এবং সংসারের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে সেখান থেকে কিছুমাত্র সঞ্চয় করা সম্ভব হতো না। এদিকে আমি বাড়িটা কিনতে রাজি তো হয়ে গেলাম অথচ টাকা কিভাবে যোগাড় করবো সেটা ভেবেই দেখিনি। সেইজন্য, বাড়ির মালিককে বললাম বাড়ির কাগজপত্রের ফোটোকপি দিতে আরো বললাম আমি সপ্তাহখানেকের মধ্যে কিছু টাকা বায়না হিসাবে দিয়ে যাবো এবং আমার প্রস্তাবে উনি রাজি হয়ে গেলেন। পরের দিন আমার যে ব্যাঙ্কে এ্যাকাউন্ট ছিল সেখানে আমি বাড়ি কেনার লোন পাওয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে তারা জানালো যে লোন দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমার কর্মস্থল জেসপ একটি রুগ্ন কোম্পানী এবং এই ধরণের কোম্পানীতে যারা কর্মরত তাদেরকে লোন দেওয়ার ব্যাপারে বাধা-নিষেধ রয়েছে। এরপর আমি পরবর্তী তিনদিন আরো ৫টি ব্যাঙ্কে খোঁজখবর করায় একই জবাব পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লাম। এভাবে যখন হতাশ হয়ে পড়েছি, হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল সে লোনের বন্দোবস্ত করে দেবে। পরের দিন শুক্রবারে সেই ছেলেটি আমাকে নিয়ে স্ট্যাণ্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে নিয়ে গেলো এবং ব্যাঙ্কে কর্তৃপক্ষ সব কাগজপত্র দেখে আমাকে বলল যে আমি যেন বাড়ি কেনার জন্য একটা বায়নানামা করে এবং বেতনের শংসাপত্র বাড়ির কাগজপত্রের সঙ্গে জমা করে লোনের দরখাস্ত করলে ওরা মঞ্জুর করে দেবে। আমি আশান্বিত হয়ে সামান্য কিছু টাকা যোগাড় করে বাড়ির মালিককে দিয়ে বায়নানামা করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ লোনের আবেদনপত্র ব্যাঙ্কে জমা করে দিলাম এবং ব্যাঙ্ক আমার দরখাস্ত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মঞ্জুর করে দিল। এরপর সমস্যায় পড়লাম স্ট্যাম্প ডিউটি আর রেজিস্ট্রেশান ফী-এর জন্য কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করা, কারণ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ লোনের টাকা দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার সময় দেবে। আমার কিছু সংগতিসম্পন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকাটা সাময়িকভাবে ধার চাইতে পারতাম, কিন্তু তারা যদি নিরাশ করে এই দ্বিধায় কারোর কাছে টাকাটা সাময়িকভাবে ধার চাইতে পারিনি। এইরকম এক পরিস্থিতিতে ২০০৫ সালের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে সরোজ আমার বাড়ি কেনার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ায় আমি ওকে আমার সমস্যার কথা বললাম। ঐদিন দুপুরবেলা উপযাচক হয়ে সরোজ আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বলল আগে বাড়িটা রেজিস্ট্রি করে নাও তারপর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পেলে আমায় দিয়ে দিও। অবশেষে ২০০৫ সালের ১৯শে জানুয়ারী আমার নিজস্ব বাড়ির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। আমি বাড়িটা কেনার পর আমার পরিবারের সবাই অত্যন্ত খুশী হয়েছিল আর বিশেষ করে মা এত আনন্দিত হয়েছিল যে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আমার নিজস্ব বাড়ির স্বপ্ন তো বাস্তবায়িত হলো ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে। সময় যত এগোতে থাকলো আমার বেতনের পরিমাণও বাড়তে থাকলো আর সেইসঙ্গে বাড়তে থাকলো আর্থিক সচ্ছলতা। এরপর ২০১০ সালে নতুন ইণ্ডিকা ভিস্তা গাড়ি কিনলাম এবং বাড়িটার দোতলা সম্পূর্ণ করলাম। ইতিমধ্যে আমার দুই ভাইঝির বিয়ে হয়ে গেলো। আমার ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায়, দু’জনের বিয়েতে সমস্ত গহনাপত্র মায় পাত্রের গলার চেন ও আংটিসহ নগদ চল্লিশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আমার ভাই, ভাইবউ এবং দুটি মেয়েকে আমি সর্বদা আমার পরিবারের সদস্য বলেই মানি। এ ছাড়াও আমি ওদের যে কোনো সমস্যায় পাশে থেকে যথাসম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। শুধুমাত্র ছোটো ভাইয়ের পরিবার নয়, আমার দিদি ও ছোটো বোনের পরিবার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হোলে আমি ওদের পাশে থেকে সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। নিজের ভাইবোন ছাড়াও আমার অফিসের সহকর্মী, প্রতিবেশি, পরিচিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপরিচিত দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের প্রতিও আমি তাদের কারোর মেয়ের বিয়ে, কারোর ছেলে বা মেয়ের পড়াশুনা, কারোর ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই । বিনিময়ে কারোর কাছ থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা না করা সত্ত্বেও কেউ কেউ জনান্তিকে আমার নামে বিরূপ মন্তব্য ও কৃতঘ্নতা করেছে।
প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন দেখে, কখনও নিদ্রাবস্থায় আবার কখনও জাগ্রতাবস্থায়। নিদ্রাবস্থায় মানুষ যে স্বপ্ন দেখে তা তার অবচেতন মনস্থিত বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা, আকাঙ্খা ও জাগ্রতাবস্থায় দেখা বিভিন্ন ঘটনাবলির এক অসংলগ্ন প্রতিফলন। অপর দিকে, জাগ্রতাবস্থায় মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন আসলে তার মনে এক তীব্র বাসনার সযত্ন লালন ও তার বাস্তবায়নের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা। জাগ্রতাবস্থায় মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, অনেকের জীবনে তা বাস্তবায়িত হয় না, আবার অনেকের স্বপ্ন হয় সফল। আমার পুত্রকে কেন্দ্র করে তার জন্মলগ্ন থেকে জাগ্রতাবস্থায় আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম তাকে একজন মানবিক গুণসম্পন্ন ডাক্তার হিসাবে গড়ে তুলবো। আমার পুত্রকে ছোটোবেলা থেকেই বারংবার বলেছি তোমাকে ডাক্তার হোতে হবে এবং দরিদ্র মানুষকে নানাভাবে সাহায্য ও বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করতে হবে। ও একটু বড় হয়ে আমাকে শুধুমাত্র একবার প্রশ্ন করেছিল যে ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছু হয়েও তো গরীব মানুষকে সাহায্য করা যায়? জবাবে আমি বলেছিলাম যে ডাক্তার হয়ে তুমি একজন মরণোন্মুখ মানুষকে হয়তো চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলতে পারো যা অন্য কিছু হয়ে সম্ভবপর নয় আর এই জন্য ডাক্তারী পেশা হোলো শ্রেষ্ঠ মানবিক পেশা। আমার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য একাদশ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমার পুত্রকে সরকারী মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারী পড়ার জন্য নির্ধারিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য বিখ্যাত দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আকাশ ইনস্টিটিউট ও সি.বি. ক্লাসেস-এ ভর্তি করে দিলাম। তারপর অনেক উত্থান-পতনের মধ্যেও আমার পুত্র লক্ষ্যে অবিচল থেকে আপন মেধায় ২০১৭ সালে কোলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাকেন্দ্র ইনস্টিউট অফ পোস্ট-গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন এ্যাণ্ড রিসার্চে (পি.জি.) শিক্ষার্থি হিসাবে যোগদান করে। প্রথম বছরে আমার পুত্র আর ওর একজন বন্ধু অর্ণব প্রাইভেটে এ্যানাটমি পড়ার জন্য বিকালবেলায় কলেজ থেকে বেরিয়ে উল্টোডাঙ্গায় গিয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপকের কাছে পড়তে যেত। একদিন বিকাল তিনটে নাগাদ যখন আমি এক্সাইড মোড়ের কাছে অফিসে ব্যস্ত ছিলাম তখন অর্ণব আমাকে ফোন করে বলল রাস্তা পার হতে গিয়ে ঋভুর এ্যাক্সিডেণ্ট হয়েছে আর সবাই মিলে ওকে পাশেই একটা নার্সিং হোমে নিয়ে যাচ্ছে। খবরটা শুনে তৎক্ষণাৎ মনে হলো আমার হৃদপিণ্ডটা সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমি সব কাজ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম যে ঋভুর শরীরটা আতঙ্ক ও যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে আর ওর শরীরে বেশ কয়েকটা জায়গায় গভীর ক্ষত হয়েছে যে ক্ষতস্থানগুলি সেই নার্সিং হোম থেকে ড্রেসিং করে ইঞ্জেকশান ও ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। তারপর ঐ নার্সিং হোম থেকে ওকে সাবধানে গাড়িতে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে এলাম। অবশেষে ২০২২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে দুটি স্বর্ণপদকে সম্মানিত হয়ে এবং প্রথম স্থান অধিকার করে আমার আদরের একমাত্র পুত্র এম.বি.বি.এস. ডিগ্রী অর্জন করে আমার স্বপ্নকে আশাতীতভাবে সফল করেছে।
আমার মা দূরে কোথাও যেতে হোলে দূরত্ব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুযায়ী ট্রেনে বা অটোরিক্সায় চেপে যেত কিন্তু বাসে বা ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে কোথাও যেতে পারতো না কারণ বমি হতো ও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়তো। আমার পুত্রের দুটি স্বর্ণপদকে সম্মানিত হয়ে এবং প্রথম স্থান অধিকার করে এম.বি.বি.এস. পাশ করায় মায়ের এমন অনির্বচনীয় আনন্দ হয়েছিল যে মা শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। এম.বি.বি.এস. পাশ করার পর শংসাপত্র প্রদান উপলক্ষ্যে ০৪/০৫/২০২৩ তারিখে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নিজের চোখে আদরের নাতিকে শংসাপত্র নিতে দেখবে বলে শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও কয়েকটা ওষুধ খেয়ে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে করে পি.জি. হাসপাতালে গিয়েছিল। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের শেষে মা খুব খুশী হয়ে নাতিকে পাশে নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিল, যেগুলি এখন বেদনাদায়ক আনন্দের স্মৃতি হয়ে আছে। ছবি তোলার কিছুক্ষণ পরেই মা এমন ভয়ঙ্করভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে দু’বার বমি করে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় হাসপাতালের ভিতরে রাস্তার উপরেই শুয়ে পড়েছিল। তারপর আমার পুত্র এবং তার সঙ্গে থাকা দু’জন সিনিয়র ডাক্তার মাকে কিছু ওষুধ এনে খাইয়ে দেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে গাড়িতে মাকে আমার কোলে মাথা রেখে শুইয়ে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।
নবম অধ্যায়
ঋভুকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস
ঋভুর ছোটোবেলা থেকেই আমার নিরলস প্রচেষ্টা ছিল ওকে সমস্ত রকমের মানবিক গুনসম্পন্ন একজন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। আমার এই প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার জন্য স্কুলের পাঠ্যবই ছাড়াও আমি ওকে মাঝেমধ্যে গল্পচ্ছলে বিভিন্ন মহামানবের যেমন, মহাকবি কালিদাস, ভারবি, ভবভূতি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখের জীবনকাহিনী শোনাতাম। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদির থেকে শিক্ষামূলক ছোটো ছোটো গল্প বলতাম। এ ছাড়াও পৃথিবীতে প্রকৃতি, গাছপালা, জীবজন্তু, ইত্যাদির ভূমিকা ও প্রয়োজনীতার কথা বলতাম। ওকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় অথবা ট্রেনে যেতে যেতে কোনো ভিক্ষুক সামনে এলে ঋভুর হাত দিয়ে তাকে টাকা দিতাম। আমি ওকে বলতাম জীবনে কখনো তোমার বাবা-মা ছাড়া কারোর কাছ থেকে কখনও কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা মনের মধ্যে পোষণ কোরো না, কারণ আকাঙ্খা পূরণ না হোলে মনে মনে কষ্ট পাবে।
আমি ওকে বোঝাতাম জীবনে অন্যদের কাছ থেকে কোনো কিছু উপহার হিসাবে পেতে থাকলে হয়তো সাময়িক আনন্দ হয়, কিন্তু এই ধরণের প্রাপ্তি লোভের জন্ম দেয়। অপর দিকে তুমি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যদি সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও তাহলে দেখবে কারোর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার চেয়ে দেওয়ায় অনেক বেশি আনন্দ ও তৃপ্তি এবং মনটা থাকবে পাওয়ার আকাঙ্খা থেকে লোভমুক্ত। আমি ওকে আরো বলেছি, আমার মাধ্যমে তোমার এই পৃথিবীতে আগমন, তাই বাবা হিসাবে আমার সর্বতোভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য তোমাকে এই সমাজে একজন সৎ, সুন্দর, সুশিক্ষিত ও মানবিক গুনসম্পন্ন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, তবে তার বিনিময়ে তোমার কাছ থেকে আমি নিজের জন্য কিছুই প্রত্যাশা করি না কারণ এই ব্যাপারে তুমি তোমার বিবেচনায় যেটা ঠিক মনে করবে সেটা করার পূর্ণ অধিকার তোমার।
দশম অধ্যায়
কিছু নৈরাশ্য, কিছু বেদনা, কিছু হঠকারী ভুল
আমি একাধারে অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়, দৃঢ়চেতা ও অনমনীয় চরিত্রের মানুষ। আমার পুত্র ঋভুও ছোটোবেলা থেকেই শান্তশিষ্ট ও শান্তিপ্রিয়। ঋভু ছোটোবেলা থেকে ডাক্তারী পড়া পর্যন্ত ওর ঠাকুরমার পাশেই ঘুমাতো, আর ইন্টার্নশিপের সময় থেকে আলাদা একটা ঘরে ঘুমাতো। প্রতিদিন রাতে ও যখন ঠাকুরমার পাশে শুতে যেত, আমার মা ওকে প্রায়শ নানা গল্প শোনাতো, মাথায়, পিঠে আদর করে হাত বুলিয়ে দিত, লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ না আসা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো যাতে ও ঠিকমতো ঘুমাতে পারে। আমার মা কখনো কখনো ওর কাছে মার প্রতি আমার স্ত্রীর দুর্ব্যবহার সম্পর্কে বলতো হয়তো বা এই আশা নিয়ে যে তার আদরের নাতি ঠাকুরমার মানসিক কষ্টটা বুঝবে, কিন্তু ফল হয়েছিল বিপরীত। অবুঝ ঋভু ফলাফল কি হতে পারে তা না বুঝেই তার মায়ের সম্পর্কে ঠাকুরমার বলা কথাগুলো তার মাকে বলে দিত, যার ফলে আমার মা এবং স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়ে যেত। আমার মা ও স্ত্রীর মধ্যেকার অন্তহীন মানসিক দূরত্ব এবং মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো ব্যাপারেও মনান্তর মিটানোর জন্য আমি নানাভাবে চেষ্টা করেও বিফল হয়েছি। আমি বিফল হলেও, আন্তরিকভাবে আশা করতাম আমার পুত্র ঋভু একটু বড় হওয়ার পর ওর মা ও ঠাকুরমার মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে দু’জনের মধ্যেকার দূরত্ব ও মনান্তর মিটিয়ে দিতে কার্যকরী ভূমিকা নেবে। আমার সে আশা নৈরাশ্যে পরিণত হয়েছিল। আমার পুত্র বুদ্ধিমান, মেধাবী ও কোমল স্বভাবের হোলেও বিবেচক হয়ে উঠতে পারেনি।
ঋভুর ইন্টার্নশিপ চলাকালিন একদিনের ঘটনা, যা মায়ের এবং আমার মনে সৃষ্টি করেছিল এক গভীর ক্ষত। সেদিন আমি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর মা আমার কাছে এসে বলল যে বাড়ির পিছন দিকে মায়ের হাতে লাগানো একটা পেয়ারা গাছের চারা-র একটা ডাল ভাঙ্গা অবস্থায় দেখে আমার স্ত্রী সেটা ভেঙ্গে থাকতে পারে ভেবে নিয়ে কিছু কটু মন্তব্য করছিল যা শুনতে পেয়ে ঋভু এবং ওর মা দু’জনেই মায়ের সাথে রূঢ়ভাবে দুর্ব্যবহার করেছে। মায়ের কথা শুনে আমি যখন মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম তা শুনতে পেয়ে ঋভু এসে আমার মাকে কিছু কটুকথা বলা শুরু করতেই আমি প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওকে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়ে মাকে খাটের উপর বসিয়ে বোঝাতে থাকায় মা বারবার বিড়বিড় করে বলছিল, আমার ধনো অবুঝ, ও তো আমাকে খুব ভালোবাসে, ধনো নিজের মন থেকে নিশ্চয়ই আমাকে খারাপ কথা বলেনি। মায়ের এই কথাগুলো তখন আমার ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছিল যা একটা কাঠিন্যের মুখোশ পরে রোধ করার চেষ্টা করছিলাম।
আমি মাকে বাড়িতে রেখে আমার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বিমানযোগে কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। আমি উপলব্ধি করতে পারি যে মাকে সঙ্গে না নেওয়ায় মায়ের মনে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে, কিন্তু মা কখনো তা প্রকাশ করেনি। সবার কাছে মা আমার সম্পর্কে বলতো যে আমি মাকে খুব সুখে রেখেছি এবং আমি মায়ের কাছে একটি খাঁটি রত্ন বিশেষ। কিন্তু আমি জানি যে মায়ের জন্য আমার যা করা উচিৎ ছিলো আর আমি যা করতে পারতাম তার মধ্যে প্রায় কিছুই করিনি, যা আমার জন্য এক ক্ষমাহীন অপরাধ।
মাঝেমধ্যে আমি অফিস থেকে ফিরে আসবার পর মা আমাকে একা পেলে আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতো। প্রথম দিকে মায়ের কাছ থেকে অভিযোগ শোনার পর কখনো কখনো মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম আবার কখনো কখনো স্ত্রীকে ডেকে মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু বলতে শুরু করলে তা অবিলম্বে তুমুল ঝগড়ায় পরিণত হোতো। তার পর থেকে অনেক দিন এমন হয়েছে যে, অফিস থেকে ফিরে অফিসের পোশাক ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত-পা ধুয়ে ঘরে এসে বসার পর মাকে দেখলাম পাশের ঘর থেকে দুটি ঘরের মাঝের দরজা খুলে আমার ঘরের দিকে আসতে। আর তা দেখেই আমি ভাবতাম যে মা হয়তো আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জানাবে তাই আমি উঠে পাশে খাবার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতাম। তারপর কয়েক মূহুর্তের মধ্যে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেয়ে বুঝতাম মা তার ঘরে ফিরে গেছে। তার কিছুক্ষণ পরে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখতাম মা চুপ করে বসে আছে আর মায়ের দু’গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভিতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলেও মাকে একটু জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছে দিয়ে দুটো সান্ত্বনাবাক্য বলতে পারিনি বরং নিষ্ঠুরের মতো দেখেও না দেখার ভান করে মায়ের ঘর থেকে নিজেই একটা পান মুখে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
২০২৩ সালে আমের মরসুমে মা বেশ কিছু হিমসাগর আম কিনে এনে অনেকগুলি আমসত্ত্ব বানিয়ে নাতি-নাতনিসহ সবাইকে একখানা করে আমসত্ত্ব দিয়েছিল আর সবচেয়ে বড় আমসত্ত্বখানা আমার জন্য রেখে দিয়েছিল। আমি অফিস থেকে ফিরে আসবার পর কয়েকবার মা ঐ আমসত্ত্বখানা আমার কাছে এনে বলেছিল সবাইকে একখানা করে আমসত্ত্ব দিয়েছি, তুই এই আমসত্ত্বখানা খেয়েনে। প্রতিবার আমি মাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম এখন রেখে দাও পরে একসময় খাবো। মা দুঃখ পেয়ে বারবার ফিরে গিয়েছিল আর আমসত্ত্বখানা আবার যত্নসহকারে রেখে দিয়েছিল। এরপর এলো সেই অভিশপ্ত সময় যখন মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালিন মা আমাকে বার দুয়েক বলেছিল যে আলমারিতে কাগজে মুড়ে আমসত্ত্বখানা রাখা আছে, আমি যেন খেয়ে নিই নাহলে ওটা নষ্ট হয়ে যাবে। মা বারবার বললেও বাড়ি এসে আমি মায়ের অসুস্থতার কথা ভাবতে ভাবতে আমসত্ত্বখানার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপর মা একসময় সব মায়া কাটিয়ে চলে গেলো আর মায়ের পারলৌকিক কার্যাদি মিটে যাওয়ার দিন দুয়েক পর আমসত্ত্বখানার কথা মনে পড়ায় সেখানা আলমারি থেকে বের করে খবরের কাগজের মোড়ক খুলে দেখলাম আমসত্ত্বখানা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আমসত্ত্বখানার এই অবস্থা দেখে অজান্তেই আমার দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। আমসত্ত্বখানা একেবারেই খাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকায়, আমি তা থেকে ছোট্ট একটা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে খেয়েছিলাম।
আমার পুত্রের উদ্দেশ্যে করা আমার দুটি আলটপকা অন্যায় মন্তব্যের কারণে আমার উপর অত্যন্ত অভিমানবশত এবং অপমানিত বোধ করার জন্য আমার পুত্র আমার সঙ্গে এক মানসিক দূরত্ব তৈরী করেছে, যা আমি নিরন্তর উপলব্ধি করি। প্রথম মন্তব্যটি করেছিলাম চঞ্চল নামে একটি সেলুনের মালিকের কাছে যার কাছে ঋভু চুল কাটাতে যেত। ঋভুর বছর সতেরো বয়সে একদিন সকালে চঞ্চলকে বললাম যে ঋভু আসবে, ওর চুল ছোটো করে কেটে দিস, জবাবে ও বলল যে ঋভু কিন্তু ছোটো করে চুল কাটতে ভালোবাসে না। আমি রেগে গিয়ে বললাম যে ও এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি আর টাকা যখন আমি দেবো, ওর চুল আমার কথা মতো কেটে দিবি। আমার এই কথাটা চঞ্চল ঋভুকে বলে দেওয়ায় ও মানসিক আঘাত পেয়েছিল। দ্বিতীয় মন্তব্যটি অন্যায়ভাবে করেছিলাম একদম নতুন জুতো ফুটপাথ থেকে পালিশ করিয়ে নেওয়ার জন্য। ঋভু তখন ডাক্তারীর ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। আমি ওকে একজোড়া নতুন দামী জুতো কিনে দিয়েছিলাম যেটা প্রথমবার পরে কলেজে আসার পর কলেজ শেষে আমার অফিস এসে আমার পাশে বসে বলল, বাবা জুতোজোড়া নোংরা হয়ে গিয়েছিল তাই নীচে ফুটপাথ থেকে পালিশ করিয়ে নিয়েছি। এই কথা বলা মাত্র আমি আগুপিছু না ভেবে এবং রেগে গিয়ে অফিসের দু’তিনজন সহকর্মীদের সামনে বললাম তোমাকে জুতোপেটা করা উচিৎ। এইরকম দামী জুতো ফুটপাথের ঐ বাজে কালি দিয়ে পালিশ না করিয়ে বাড়িতে গিয়ে ভালো কালি দিয়ে পালিশ করে নেওয়া যেত। এই মন্তব্যের করবার পরই বুঝতে পারলাম আমি খুবই অন্যায় করেছি এবং আমার এই মন্তব্য করা একেবারেই উচিত হয়নি। আমার একজন্ বয়স্ক সহকর্মী এই মন্তব্য করার জন্য খুব আপত্তি করলেন। এদিকে, এই মন্তব্যের পর আমি দেখলাম ঋভুর দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে। ঋভুর চোখে কখনও জল দেখলে আমি নিজেকে সামলাতে পারতাম না তাই ওর চোখে জল দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আমার ভুল স্বীকার করলাম, কিন্তু সেইসঙ্গে বুঝতে পারলাম যে আমার এই অন্যায় মন্তব্য ওর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
একাদশ অধ্যায়
আমায় কাঙাল করে মায়ের তিরোধান
২০১৭ সালে আমার মায়ের সেরিব্রাল এ্যাটাক হওয়ায় মায়ের শরীরের বাঁদিকটা অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মাকে সেরিব্রাল এ্যাটাক হওয়ার পর বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করিয়েছিলাম এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধপত্র খেয়ে মা মোটামুটি সুস্থ ছিল এবং নিজের সমস্ত কাজকর্ম ও নিরামিষ রান্না নিজেই করতো। মা অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া একেবারেই পছন্দ করতো না। আমি মাকে অনেকবার বলেছি যে তোমার সব কাজকর্ম করার জন্য আমি তোমার পছন্দমতো কাউকে রেখে দিচ্ছি, কিন্তু মাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি।
২০২৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে আমার জীবনে অশনিসংকেত নিয়ে এলো হঠাৎ করে আক্রান্ত হওয়া। মা যখন দুঃসহ পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছে ঋভু তখন হাসপাতালে কর্তব্যরত থাকায় আমি ওকে ফোন করে মায়ের পেটের ব্যথার উপশমের জন্য কি করতে হবে জানতে চাওয়ায় ও ড্রটিন নামে একটা ওষুধ এনে খাইয়ে দিতে বলল। ঐ ওষুধটা এনে মাকে খাওয়ানোর পর বিশেষ কিছু ফল না পাওয়ায় আমি আবার ঋভুকে ফোন করে বলায় ও আমাকে একটা ইঞ্জেকশান আনিয়ে মাকে দেওয়ার বন্দোবস্ত কথা বলায় আমি সেই ইঞ্জেকশান আনিয়ে মাকে দেওয়াতে ব্যথা কয়েক ঘন্টার জন্য উপশম হয়ে আবার আগের মতো শুরু হয়ে গেলো। ঋভুকে ফোন করে সেকথা জানালে ও মায়ের সম্পূর্ণ পেটের আল্ট্রাসাউণ্ড সোনোগ্রাফী করিয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে বলল। আল্ট্রাসাউণ্ড সোনোগ্রাফী করার পর দেখা গেলো মায়ের পিত্তথলিতে একটা বেশ বড় ও কয়েকটা ছোটো পাথর হয়েছে। আল্ট্রাসাউণ্ড সোনোগ্রাফী রিপোর্ট পাওয়ার পর ডাক্তার গৌতম কুণ্ডু নামে একজন প্রবীণ শল্য চিকিৎসকের কাছে মাকে নিয়ে গিয়ে দেখানোতে তিনি নানারকম রক্তপরীক্ষা ও বুকের এক্সরে করিয়ে তারপর ওনার কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাতে বললেন আর পেট পরিস্কার রাখতে ও ব্যথার উপশমের জন্য কিছু ওষুধ খাওয়ানোর জন্য ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। পরদিন রক্তপরীক্ষা ও বুকের এক্সরে করিয়ে তার রিপোর্টগুলি ওনার কাছে নিয়ে গিয়ে দেখালে, উনি বলে দিলেন আগের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধগুলি খাওয়ানোর জন্য। আমি অপারেশানের ব্যাপারে জানতে চাওয়ায় উনি বললেন এখন দরকার নেই। ডাক্তার গৌতম কুণ্ডুর ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ানোর পর মায়ের যন্ত্রণার কোনো উপশম না হওয়ায়, ঋভু মাকে একাধিকবার পি.জি. হাসপাতালে নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখানোর বন্দোবস্ত করে। সেই সমস্ত ডাক্তারদের পরামর্শে মায়ের নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা, যেমন, নানারকম রক্তপরীক্ষা, সি.টি. স্ক্যান, আল্ট্রাসাউণ্ড সোনোগ্রাফী, কে.ইউ.ভি., এম.আর.সি.পি, কোলোনোস্কোপি ইতাদি করার পর সেগুলি দেখে ডাক্তারবাবুরা মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বললেন। এই দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষা চলাকালিন মায়ের খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং যেটুকু খেতে পারছিল তাও অধিকাংশ সময় বমি হয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে ১১ই আগস্ট, ২০২৩ তারিখে মাকে পি.জি. হাসপাতালের উডবার্ন ব্লকে মাকে ভর্তি করে দিলাম। আমার বড় ভাইঝি সুমি আমার মাকে ছোটো থেকেই মা বলে ডাকতো এবং মায়ের মতো ভালোবাসতো। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার দিন দশেক আগেই ও চলে এসেছিল আর মাকে ভর্তি করার পর মায়ের সঙ্গে দু’দিন হাসপাতালে থেকে দুর্গাপুরে ফিরে যায়। হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকেই মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলো। মাকে দেখার জন্য বেহালায় থেকে আমার দিদি প্রায় প্রত্যেকদিন দেখতে আসতো। চিকিৎসা শুরু হওয়া সত্ত্বেও মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি থাকলো এবং এমন অবস্থা হলো যে মা একটু জল খেলেও বমি হয়ে যাচ্ছিল। মায়ের যখন এইরকম অবস্থা, একদিন মা আমাকে করুণভাবে বললো দিদিকে বলতে সে যেন মায়ের জন্য অল্প একটু ডালের স্যুপ করে নিয়ে আসে। দিদি কয়েকবার এনেছিল কিন্তু মা দু’দিন দু-তিন চামচ করে খাওয়ার পর আর খেতে পারেনি। আমি দুইবেলা মাকে দেখতে যেতাম আর ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধপত্রের বন্দোবস্ত করে দিতাম। এ ছাড়াও ঋভু ঐ হাসপাতালের ডাক্তার হওয়ার সুবাদে মায়ের চিকৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা থেকে মায়ের চিকিৎসায় সক্রিয় সহযোগিতা ও আমার অনুপস্থিতিতে ওষুধপত্রের বন্দোবস্ত করতো। হাসপাতালে শুয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মা আমাকে মাঝে মাঝেই বলতো আমি তোকে ধনেপ্রাণে শেষ করে দিয়ে গেলাম। আমাকে বরং কোনো বিষাক্ত ইঞ্জেকশান দিয়ে আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা কর, এতে পূণ্য হবে। আমি শুধু মনের ভিতর ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা চেপে মাকে একটু বকাঝকা করে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতাম।
মায়ের সমস্ত রকমের শারীরিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে ডাক্তারবাবুরা ক্যান্সার হয়েছে সন্দেহ করে এফ.এন.এ.সি. পরীক্ষার জন্য পাঠালে রেডিওলজি ডিপার্টমেন্টে পাঠালে সেখান থেকে জানালো মায়ের শারীরিক অবস্থার কারণে এফ.এন.এ.সি. পরীক্ষা সম্ভব নয়। তারপর ডাক্তারবাবু আমাকে বললেন মায়ের চিকিৎসার জন্য দুটো রাস্তার মধ্যে একটা হোলো যেভাবে চিকিৎসা চলছে সেভাবেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া আরেকটা হোলো মায়ের অপারেশান করা। প্রথমটা করলে মা হয়তো এইরকম যন্ত্রণা সহ্য করে আরো কয়েকটা দিন বেশি বেঁচে থাকবেন আর দ্বিতীয়টা করলে এমনও হোতে পারে যে অপারেশান টেবিলেই মা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। মা যন্ত্রণায় যেভাবে কষ্ট পাচ্ছিল আমি নিজেই সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই ডাক্তারবাবুকে অপারেশান করার জন্য বললাম।
আমি সম্মতি দেওয়ার পর অপারেশানের দিন ঠিক হলো সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন। অপারেশানের দিন আমি ও ঋভু ছাড়াও আমার দিদি, দিদির বড় ছেলে সাহেব, ভাইঝি সুমি সঙ্গে জামাই রাজীব এবং আমার বাল্যবন্ধু তরুণ সকাল থেকেই হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম। মায়ের অপারেশান শুরু হোলো দুপুর প্রায় বারোটা নাগাদ। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপারেশান থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। দুপুর প্রায় আড়াইটে নাগাদ সিনিয়র সার্জন প্রফেসর ডাক্তার জয়েশ কুমার ঝা অপারেশান থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন উনি যতটা সম্ভব ভালোভাবে অপারেশান করেছেন এবং ভিডিও কলে ঋভুকে পুরো অপারেশানটা দেখিয়েছেন। উনি আরো বললেন যে অপারেশান করে সম্পূর্ণ পিত্তথলি, যকৃতের একটা বড় অংশ, কয়েকটা লিম্ফ নোড ও দুটো টিউমার বাদ দিয়েছেন। আরো আধঘন্টা পরে জুনিয়র সার্জনরা বেরিয়ে আমাকে বললেন অপারেশান ভালোভাবে হয়েছে আর সেইসঙ্গে আমার হাতে কৌটার মধ্যে রাখা অপারেশান করে মায়ের শরীর থেকে বাদ দেওয়া অংশগুলি দিয়ে সেগুলির বায়োপ্সি করাতে বললেন। ডাক্তারবাবুর কথামতো বায়োপ্সি করানোর পর জানতে পারলাম অপারেশান করে বাদ দেওয়া সমস্ত অংশগুলি ক্যান্সার আক্রান্ত। অপারেশানের পর মাকে চারদিন আই.টি.ইউ-তে রাখার পর আবার উডবার্নের কেবিনে পাঠিয়ে দেয়।
অপারেশান করার পর নানারকম ওষুধ খাওয়ানো, যন্ত্রণানাশক ইঞ্জেকশান দেওয়া ছাড়াও স্যালাইন, ক্যাথেটার, অক্সিজেন, রাইস টিউব ইত্যাদি দেওয়া সত্ত্বেও মায়ের শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছিল না। এরপর ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে ডাক্তারবাবু আমাকে ডেকে বললেন যে মায়ের চিকিৎসার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন ছিল, তিনি সবকিছুই করেছেন আর এখন যেটা প্রয়োজন তা হোলো মাকে তার চেনা পরিবেশ অর্থাৎ বাড়িতে রেখে আপনজনদের দ্বারা সেবা-শুশ্রূষা করানো, তাতে হাসপাতালের চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবুর উপদেশে ৩৬ দিন পর হাসপাতাল থেকে মাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। বাড়িতে ঠিকমতো চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করানোর জন্য সমস্ত ওষুধপত্র ও ২৪ ঘন্টার জন্য প্রশিক্ষিত আয়ার বন্দোবস্ত করলাম। দিনের পর দিন মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল।
মায়ের নয় জন ছোট ভাই-বোনের মধ্যে একজন বোন বারাসাতে থাকে, দুই ভাই ও এক বোন দুর্গাপুরে থাকে, এক ভাই সল্ট লেকে থাকে, এক ভাই শিলিগুড়ির কাছে একটি চা বাগানে থাকে। আমার দিদিমা বেশির ভাগ সময় অসস্থ থাকতো বলে এই ভাই-বোনদেরকে মা ছোটোবেলায় পরম স্নেহে কোলে-পিঠে করে বড় করেছে। অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় মায়ের মনে এক অব্যক্ত আশা ছিলো যে তার ঐ ভাই-বোনেরা হয়তো মাকে মাঝেমধ্যে দেখতে আসবে। মায়ের দুর্ভাগ্যবশত শুধুমাত্র বারাসাতের বোন মায়ের হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসার পরে মাত্র তিনদিন মাকে দেখতে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য আর অন্যান্য ভাই-বোনেরা একবারের জন্যেও মাকে দেখতে আসেনি।
আমার মায়ের মনে মায়ের মনে এক তীব্র আকাঙ্খা ছিল আবার সুস্থ হয়ে ওঠার। আমাকে মা কয়েকবার বলেছিল, বুঝলি ডাক্তারবাবুরা বোধ হয় আমার অপারেশানটা ঠিকমতো করতে পারেনি যার জন্য আমার শরীরটা একটুও ভালো হোচ্ছে না। আমি মাকে জানাতে পারিনি যে ভয়ঙ্কর মারণব্যাধি তোমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মা দু’এক চামচ মুসম্বি লেবুর ও বেদানার রস আর দু’এক চামচ এন্সিওর ছাড়া আর কিছুই খেতে পারছিল না, তাও আবার প্রায়শ বমি হয়ে যেত। এইভাবে মায়ের চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা চলতে থাকার পর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হঠাৎ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হওয়ায় পজ্ নামে একটা ইঞ্জেকশান দেওয়ায় রক্তপাত বন্ধ হলো। মায়ের এই রকম শারীরিক অবস্থা দেখে আমি দিদিকে আমার বাড়িতে ডেকে নিলাম। অক্টোবর মাসের ৩০ তারিখ থেকে মায়ের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। এরপর ২রা নভেম্বর দুপুর থেকে মায়ের ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট শরু হোলো এবং গলা দিয়ে ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হোতে থাকলো। মায়ের অবস্থা দেখে হাসপাতাল থেকে ঋভুকে ডেকে নিয়ে এসে রাত প্রায় ১১টা নাগাদ মাকে নিয়ে নারায়ণা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ১১-৪৫ নাগাদ আমার পৃথিবীটা শূন্য করে দিয়ে, মাথার উপর থেকে স্নেহাশীষের হাতখানি সরিয়ে নিয়ে, আমাকে সম্পূর্ণ অনাথ করে দিয়ে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করে আমার মা চিরনিদ্রায় চলে গেলো।
পরিশিষ্ট
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে প্রায় দীর্ঘ তেষট্টি বছর সময় মায়ের পক্ষপুটে থেকে, স্নেহাশীষ পাথেয় করে এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে যখন আমি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছেছি, তখন আমার মা এক সমুদ্র পুঞ্জিভূত কষ্ট বুকে নিয়ে ও চার মাস যাবৎ দুঃসহ শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে আমাকে চিরদিনের জন্য অনাথ করে দিয়ে ঢলে পড়ল পরম শান্তির নিদ্রায়, যে নিদ্রা থেকে জাগরণ ঘটে না। আমি শূন্য থেকে শুরু করে জীবনের দুর্গম পথে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, ঘোর অমানিশায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গে কন্টকময় পথে বহুকাল ধরে চলতে চলতে শরীর ও মন ক্ষতবিক্ষত করার পর মায়ের আশীর্বাদে পৌঁছে গিয়েছি আলোর পথে, জীবনে পেয়েছি স্বপ্নাতীত সাফল্য ও সচ্ছ্বলতা। দুর্গম যাত্রাপথে মা আমার কাছে ছিল আলোকবর্তিকা হাতে উত্তরণের দিশারি।
আমি এখনও জানিনা মা কি খেতে ভালোবাসতো বা মায়ের পছন্দ-অপছন্দ ছিল, কখনও সেসব জানার চেষ্টাও করিনি। মা কিন্তু আমার সমস্ত পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। আমার মা বরাবর খুব অল্পেই খুশী হোতো। মাকে কখনো একটা দামি শাড়ি কিনে দিলে মা খুবই রাগ করতো। মা উপদেশ দিত অতীতকে কখনো ভুলে যেও না।
মায়ের এইভাবে চলে যাওয়ার পর আমি মাঝে মাঝে যখন পি.জি. হাসপাতালে যাই, সেলুলয়েডে ভেসে ওঠা চলচ্ছবির মতো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাকে কখনো হাত ধরে, কখনো কোলে করে, কখনো বা স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে নিয়ে যাচ্ছি নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর জন্য আর অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে। বাড়িতেও আমি প্রতিনিয়ত মনশ্চক্ষে দেখতে পাই মা নানারকম সব্জি কাটছে নিরামিষ তরকারি রান্নার জন্য, নিজের জামা-কাপড় ও বাসনপত্র নিজেই ধূয়ে রাখছে, আমার জন্য পানের খিলি বানিয়ে ডিব্বা ভরে রাখছে, অফিস থেকে ফেরার পর মাঝেমধ্যে বাটি ভর্তি করে পিঠে, পায়স, পাটিসাপটা, তালক্ষীর ইত্যাদি এনে আমাকে বলছে এটুকু খেয়েনে আর এইসব দৃশ্য যত ভাবি তত আমার ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়। আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা মায়ের আর্তকন্ঠে বলা সেই কথা “বুঝলি ডাক্তারবাবুরা বোধ হয় আমার অপারেশানটা ঠিকমতো করতে পারেনি যার জন্য আমার শরীরটা একটুও ভালো হোচ্ছে না”।
আমার জীবন আজ শূন্যতায় পূর্ণ। প্রতি পদক্ষেপে আমার প্রেরণাদাত্রী, জীবনের দুর্গম যাত্রাপথে আলোর দিশারি আমার চিরদুঃখিনী মা তার স্নেহভরা হাত দু’খানি আমার মাথার উপর থেকে সরিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছে কোনো অজানা দেশে, হয়তো বা একটু শান্তির সন্ধানে, আর আমি জীবন্ত শরীরে মৃতবৎ রয়ে গেছি আজীবন ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের রোমন্থন করার জন্য।
__________