চিলেকোঠার ঘর পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎই চোখ পড়ে জানালার ধারে,পরিপাটি করে রাখা হারমোনিয়ামের উপর। কত স্মৃতি জুড়ে আছে এই হারমোনিয়ামের সঙ্গে।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি হয় সুরমা ও পরমার।রবিঠাকুরের গান বেশি শেখাতেন তাদের মা।ভোর ভোর উঠে বিভিন্ন রাগ রাগিনী অনুশীলন করাতেন মা।
রবিঠাকুরের জন্মদিন সে যেন এক উৎসব ছিল তাদের দুবোনের কাছে।রবিঠাকুরের গলায় মাল্যদান করতো তারা।পরিপাটি করে সেজে,লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে,চুলে বেল ফুলের মালা দিয়ে,তারা পাড়ার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো।তারা প্রথম গান করেছিল,"এলেম নতুন দেশে"।করতালি দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিল সকলে।তাদের মায়ের চোখে আনন্দের বারি টলমল করেছিল সেদিন।
তাদের মা বাবা পরিশ্রম করতেন দিবারাত্রি,যাতে তারা গান নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে।অপূর্ব কন্ঠ ছিল তাদের দুবোনের। তাদের মা তাদের গলা যাতে ঠিক থাকে সে চেষ্টা করতেন।
রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন তাদের ও খুব মন খারাপের দিন ছিল। তাদের পাড়ায় প্রথম যখন 22শে শ্রাবণ,অর্থাৎ রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন পালন করা হয়েছিল,সেদিন তাদের ও গান পরিবেশন করার জন্য ডাকা হয়েছিল। তারা দুই বোন সেজে,কালো পাড় সাদা শাড়ি পড়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিল। তারা গেয়েছিল, "তবু মনে রেখো"। মাইকে বহুদূর অবধি তাদের গান শোনা গিয়েছিল। তাদের বাবা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে এক অদ্ভুত আলো আঁধারী তৈরি হয়েছিল,তিনি একটি বটগাছের আড়ালে ছিলেন এবং সেখানে হাল্কা রাস্তার আলো এসে পড়ছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে তার দুই কন্যার গান শুনছিলেন এবং আনন্দে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে তারা যখন তাদের মায়ের কাছে,তাদের গর্বিত মা তাদের আলিঙ্গন করে বলেন,এই তো সবে শুরু হলো মা,এরকম ভাবে তোমরা এগিয়ে চলো। তাদের মায়ের কাছ থেকে এমন আশীর্বাদ পেয়ে তাদের মন আনন্দে ভরে উঠেছিল।
কালের নিয়মে তারা স্কুলের গণ্ডি খুব সুন্দর করে পার হয়।তাদের এবং তাদের বাবা মায়ের ইচ্ছায় তারা সঙ্গীত নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়।তাদের বাবার ইচ্ছা ছিল একজন গৃহ শিক্ষক রাখবেন,কিন্তু তাদের মা জানান,আমি তো ওদের কে এখনও শেখাতে পারছি,যখন একান্ত অসুবিধা হবে তখন না হয় রেখো।
যখন তিনি সুরমা ও পরমাকে হারমোনিয়াম সহযোগে অনুশীলনে বসতেন, মনে হতো যেন কোন এক দেবী তাদের ঘরে অধিষ্ঠান করছেন। তাদের সে রূপ দর্শন করে তাদের বাবা গর্ব অনুভব কলতো।
এভাবে বেশ সুন্দর কাটছিল তাদের দিনগুলি।এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় তীব্র জ্বরের কবলে পড়েন সুরমা ও পরমার মা।তারা দিগ্ বিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে তাদের মায়ের অসুস্থতার কারনে।অনেক চিকিৎসক আসেন,চিকিৎসা করেন,ওষুধ দেন।নিয়ম করে তারা দুবোন পথ্য ও ওষুধ দেয়।তারা দুবোন ভাগাভাগি করে সংসারের সব কাজ করে।কিন্তু তাদের মায়ের সাস্থ্য কিছুতেই ঠিক হয়না।
এমনই এক বৃষ্টিমুখর দিনে তারা তাদের মায়ের দু পাশে বসেছিল, হঠাৎই তিনি তাদের দু হাত নিজের হাতে নিয়ে বলেন,প্রতিজ্ঞা করো,যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন,তোমরা গান ছাড়বেনা। তা শুনে তারা সে প্রতিজ্ঞা করে।এর অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দেহত্যাগ করেন।
তাদের বাবা বড় সমস্যার মধ্যে পড়েন তার দুই মেয়েকে নিয়ে।পাশাপাশি তার অনেক আর্থিক সমস্যা চলে। তার দুই মেয়েকে সুন্দর করে মানুষ করতে সমস্যা হয়,কিন্তু তাও তিনি তাদের স্বপ্ন ও নিজের এবং তার স্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন।অনেক সমস্যার মধ্যেই তারা স্নাতক হয়ে কলেজ থেকে বের হয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি তারা টিউশন করতো,যাতে তারা তাদের নিজস্ব খরচা চালাতে পারে।স্নাতক হওয়ার পর পরমা বিভিন্ন টি.ভি.চ্যানেলে অডিশন দেওয়া শুরু করে,এবং তাদের বাবা ও মায়ের আশীর্বাদে সে একটি নাম করা টি.ভি.চ্যানেলে সুযোগ পেয়ে যায়।
তাদের বাবার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় এগিয়ে আসে।তিনি ভাবেন,তার চাকরি থাকতে থাকতে সুরমা ও পরমার বিয়ে দিয়ে দিতে।
এদিকে পরমা অভিক নামে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়,কিন্তু তা পরিবারের কাউকেই জানায় না।তাদের বাবার সিদ্ধান্ত শুনে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়ায় তাদের বাড়িতে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে।তার বাবা তার শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন,তার দিদি সুরমা শোকে পাথর হয়ে যায়।দিন রাত তার বাবাকে তার প্রতিবেশীরা সন্তান ঠিক মতো মানুষ না করতে পারার গন্জ্ঞনা দেয়।তাতে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন, মানসিক ভাবে।
অন্যদিকে পরমা অভিককে বিয়ে করে তাদের বাড়ি গেলে অভিকের বাবা মা তাকে মেনে নেয় না।তাদের না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য অভিককে অনেক কথা শুনতে হয়।এদিকে পরমা টি.ভি চ্যানেলে কাজ করে বলে তাকেও কথা শুনতে হয়।ঠিক করে অনুশীলন করার সময় সে আর পায় না।তার মা,বাবা ও দিদির কথা তার মনে পড়ে।জীবনে কত বড় ভুল সে করেছে তার মাসুল গুনতে থাকে।
কিন্তু অভিকের ইচ্ছায় বাড়ির সব কাজকর্ম সেরে পরমা টি.ভি.চ্যানেলের কাজে যেত।বাড়ি ফিরে সামান্য বিশ্রাম করে সে আবার সাংসারিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতো।সে তার শাশুড়ি মাকে নিজের মায়ের মতো দেখতো।তার সামান্য অসুস্থতা দেখলে সে তাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলতো।তার এই যত্নে তার শাশুড়ি ও শ্বশুর তাকে মেনে নেয়।তারা পরমার বাবার সঙ্গে কথা বলে দাঁড়িয়ে থেকে পরমা ও অভিকের বিয়ে দিতে চায়।
অপরদিকে সুরমার বাবা তার সম্বন্ধ দেখতে শুরু করে।কিন্তু পরমার কথা জানতে পেরে তারা কেউ আর সুরমার সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাইত না।সুরমা ভাবতো সে চলে গেলে তার বাবার কিহবে।আর তার বাবা ভাবতো সে চলে গেলে সুরমার কিহবে।
এমন একদিন মধ্য কলকাতা নিবাসী সুজন রায়ের সম্বন্ধ আসে সুরমার জন্য।কোন এক অনুষ্ঠানে সুরমার গান শুনে রায় গিন্নি তাকে তার পুত্রবধূ করার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসেন।সুরমার বাবা তার কাছে কোন কিছু গোপন না করে সব খুলে বলেন।রায় গিন্নি সব শুনে তাকে তার বাড়ির বৌ করতে রাজি হন।অগ্রহায়নের মাসের শুরুতেই সুরমা ও সুজনের দুই হাত এক করবেন বলে যান।সুরমাকে দেখে আশীর্বাদ করে নিজের একটি হার দিয়ে যান।
এক শুভদিনে সুরমার আশীর্বাদ হয়।সেদিন সুরমার পরনে ছিল হলুদ রঙের হাল্কা বেনারসী শাড়ি।সাবেকি কিছু গয়না।চুলে সুন্দর একটি খোঁপা ও গোলাপ দেওয়া,চোখে কাজল,এই হাল্কা সাজেই সুরমাকে অপরূপা লাগছিল। কিন্তু সুরমার কেবল মা আর তার ছোট বোনের কথাই মনে পড়ছিল। সুরমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসে তাকে আশীর্বাদ করে গেলেন।অনুষ্ঠান শেষে তার বাবা তাকে ডেকে বলেন, আজ তুমি অনেক বড় হয়ে গেলে মা।তোমাকে আর ধরে রাখতে পারবো না।সেখানে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থেকো।সুরমা সম্মতি জানায় তার বাবার কথায়।
দেখতে দেখতে অগ্রহায়ন মাসের সেই বিশেষ দিন এসে উপস্থিত হয়।সকাল থেকে বিভিন্ন রীতি নীতিতে ব্যস্ত থাকে সুরমা।তার মায়ের কথা আজ যেন বেশি মনে পড়ে।আজকের দিনটিতে তার মা হয়তো তাকে কাছ ছাড়া করতেন না।কিংবা নিজে সাজিয়ে দিতেন তাকে।এমনই সব কথা তার মনে হতে থাকে।পরমা হয়তো এই দিন তার দিদির পাশে পাশে থাকতো।তাকে ছোট ছোট বিষয়ে সাহায্য করতো।
হঠাৎই কিছু উচ্চ কথাবার্তার শব্দে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে।সে নিচে গিয়ে দেখে সেখানে পরমা তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।তার বাবা কিছুতেই তাদের সম্পর্ক মানতে চাইছেন না।এমনকি পরমার এই সিদ্ধান্তের কারনে সুরমার একের পর এক বিয়ে ভাঙার কথা তাদের জানান।
পরমার শাশুড়ি ও শ্বশুর মশাই পরমার বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।তারা পরমা ও অভিককে মেনে নিতে বলেন।পরমা ও অভিকের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।কারন তারা তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছিল তাই।
অতি কষ্টে সুরমার বাবা পরমা ও অভিককে মেনে নেয়।তিনি ঠিক করেন সুরমার পাশাপাশি সেদিন ই তিনি পরমা ও অভিকের বিয়ে দেবেন।
চলবে...........