Read Not good, but true. by Sneha Chakraborty in Bengali Short Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ভালো না, কিন্তু সত্যি

রুদ্রশ্রী ছোটবেলা থেকেই একটু আলাদা। কারো চোখে ঠিকঠাক বাচ্চা বলে মনে হয়নি তাকে। মা বলতেন, “এমন বেয়াড়া মেয়ে হয় না!” স্কুলে শিক্ষকরা বলতেন, “বড্ড প্রশ্ন করে, মাথা ঘুরিয়ে দেয়।” বন্ধুরা বলত, “ওকে নিয়ে কিছু বোঝা যায় না!”

রুদ্রশ্রী কারুর কাছে ভালো মেয়ে হতে পারেনি। ভালো মানে—যেমনটা মা-বাবা চায়, শিক্ষক চায়, সমাজ চায়। সে বই পড়ত, তবে পুঁথিগত নয়। সে আঁকত, তবে নিখুঁত রেখায় নয়। সে স্বপ্ন দেখত, তবে নিয়মের মধ্যে নয়। আর তাই, অল্প বয়সেই তার নামের পাশে একটা অদৃশ্য ট্যাগ জুড়ে গিয়েছিল—অযোগ্য।

কৈশোরে এসে একবার ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছিল। অরিত্র নামের এক ছেলেকে খুব ভালো লেগেছিল তার। অরিত্র বলত, “তুমি একটু কম বোকা হলে ভালো হতো!” সে চেয়েছিল রুদ্রশ্রী একটু শান্ত হোক, একটু গড়পড়তা হোক, অন্য মেয়েদের মতো হয়ে উঠুক। রুদ্রশ্রী পারল না। সে কারুর ভালো প্রেমিকা হতে পারল না।

তাই একদিন অরিত্র চলে গেল। এবং ফেলে রেখে গেল সেই চেনা সংজ্ঞা—“তুমি ভালো না।”

তারপর বিয়ে হলো। পাত্র, পরিবার—সবই ঠিকঠাক। কিন্তু সমস্যা হলো সেই পুরনো জায়গায় এসে—সে ঠিকঠাক স্ত্রী হতে পারল না। রান্না তার আয়ত্বে এল না। শাড়ি পরে অতিথি সামলানো তার কাছে ছিল অপমানের মতো। সে চাইত বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে, চুপ করে জানালার ধারে বসে থেকে পাহাড়ের স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু সে স্বপ্নের জায়গা সংসারে ছিল না।

তাকে বলা হল, “তুমি দায়িত্ব নিতে পারো না। স্ত্রী হওয়া তোমার ধাতে নেই।”

তবু সময় গড়াল। এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল সে। সবাই বলল, “এবার বুঝি রুদ্রশ্রী বদলাবে, মা হবার পর মেয়েরা বদলে যায়।”

কিন্তু না। রুদ্রশ্রী তার মেয়েকেও আলাদা রকম ভালোবাসত। সে মেয়েকে বই পড়তে শেখাত, কিন্তু খেতে খাওয়াতে ভুলে যেত। খেলতে নিয়ে যেত বৃষ্টির মধ্যে, কিন্তু ছাতা আনতে ভুলে যেত। মেয়ের স্কুলে সে সময়মতো যেত না, কারণ নিজের এক লেখায় ডুবে থাকত। সমাজ বলল, “এ কেমন মা?”

এভাবেই রুদ্রশ্রীর জীবনের প্রতিটা পর্বে, একটাই অভিযোগ—সে কিছুতেই “ভালো” হতে পারে না। ভালো মেয়ে, ভালো বান্ধবী, ভালো প্রেমিকা, ভালো স্ত্রী, ভালো মা—কিছুই না।

তবে একদিন, তার মেয়ে—তখন বয়স তেরো—একটি রচনায় লিখল, “আমার মা সবচেয়ে অদ্ভুত মানুষ। তিনি আমাকে সময়মতো খেতে দেন না, স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়। কিন্তু তিনি আমাকে ভাবতে শেখান, স্বপ্ন দেখতে শেখান। তিনি আমাকে শেখান, ভালো না হলেও কীভাবে সত্যি হওয়া যায়।”

রুদ্রশ্রী চোখ বুজে থাকল অনেকক্ষণ। মনে মনে বলল, “আমি সত্যিই ভালো হতে পারিনি... কিন্তু আমি কি নিজে হতে পেরেছি?”

হয়তো সেটাই আসল। ভালো হওয়া নয়, নিজেকে সত্যি রাখা। তার জীবনের মূল্যবোধ আর প্রেম, সবটাই ছিল অসামান্য, কিন্তু পরিমাপযোগ্য নয়। সে কারুর চোখে ভালো হতে পারেনি, কারণ সে কারুর মতো হতে চায়নি।

একদিন তার লেখা একটা বই প্রকাশিত হল—ভালো হবার দায়। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা ছিল—
“এই বই তাদের জন্য, যারা সারাজীবন ধরে চেষ্টা করেছে কারুর ভালো হতে, কিন্তু ভুলে গিয়েছিল নিজের মতো থাকতে।”

রুদ্রশ্রী ভালো হতে পারেনি। কিন্তু সে এক মহৎ জীবন কাটিয়েছে। নিজের মতো করে, নির্জনে, নিষ্ঠায়, এবং নিঃসঙ্গতাতেও সাহসে ভরা।
রুদ্রশ্রী ভালো হতে পারেনি। কিন্তু সে এক মহৎ জীবন কাটিয়েছে। নিজের মতো করে, নির্জনে, নিষ্ঠায়, এবং নিঃসঙ্গতাতেও সাহসে ভরা।

তবুও, প্রতিদিন ভোরবেলা তার মধ্যে এক আত্মদ্বন্দ্ব চলত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করত, “এতটুকু যাত্রার শেষে, কী পেলাম আমি?”

বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। মেয়ে কলেজে পড়ছে, নিজের মতো ভাবছে, নিজের মতো পথ বেছে নিচ্ছে। এই পথচলার জন্য রুদ্রশ্রী তাকে কখনও বাঁধেনি, কখনও দিক দেখায়নি জোর করে। শুধু পাশে থেকেছে—নীরবে, সততায়।

একদিন সন্ধেবেলা, তার পুরনো বান্ধবী অনিন্দিতা বাড়িতে এল অনেক বছর পর। চা খেতে খেতে বলল, “তোর কথা ভাবলে আজও অবাক হই রে। তোকে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। এখন বুঝি—তুই ভালো হবার চেষ্টায় সময় নষ্ট করোনি। তুই বাঁচতে চেয়েছিলি।”

রুদ্রশ্রী মুচকি হাসল, “ভালো হতে চেয়েছিলাম, জানিস? ছোটবেলাতে ভাবতাম, মা যেন একদিন বলে, ‘আমার মেয়ে সবার সেরা।’ কলেজে ভাবতাম, বন্ধুদের মতো হতে পারলেই জীবন সহজ হবে। প্রেমে পড়ার সময় চেয়েছিলাম, কেউ বলুক, ‘তুমি আমার স্বপ্নের মতো।’ কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, এসব শব্দ খুব বাইরের। তারা আসে, যায়। নিজের সত্যি যদি না থাকে, তাহলে সবই ফাঁকা।”

অনিন্দিতা চুপ করে শুনছিল। তারপর বলল, “তুই জানিস না রে, তোর মতো মেয়েরা সমাজকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। তুই দেখিয়ে দিয়েছিস—ভালো হবার চাইতে নিজের মতো থাকা অনেক বড় সাহসের কাজ।”

সেই রাতটা রুদ্রশ্রী একা কাটাল না। বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল অজস্র তারা—কেউ উজ্জ্বল, কেউ ম্লান, কেউ প্রায় অদৃশ্য। হঠাৎ মনে হল, তারাও হয়তো জীবনে কখনো ‘ভালো তারা’ হয়নি, শুধু আলো দিয়েই গেছে।

সে নিজের বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। জীবনে হাজার অভিযোগ থাকলেও, তার সত্য, তার ভালোবাসা, তার নিজস্ব পথ—সবকিছু মিলিয়ে এক অসম্পূর্ণ অথচ সম্পূর্ণ গল্প তৈরি হয়েছে।

ভোর হতেই সে ডেস্কে বসল। নতুন লেখার শুরু করল—
“সবাই চায় ভালো হতে। কেউ চায় ‘ভালো মেয়ে’, কেউ ‘ভালো বউ’, কেউ ‘ভালো মা’। কিন্তু আমি, আমি শুধু চাই—নিজেকে চিনতে। নিজেকে বুঝে, নিজেকে নিয়ে বাঁচতে। তাতে যদি কেউ ভাবে, আমি ভালো নই—তাতে আমার আপত্তি নেই। কারণ আমি জানি, আমি সত্যি।”