গোপাল ছিল একটি ছোট অখ্যাত গ্রামের ছেলে। তাদের ছোট্ট কুঁড়েঘরে মা আর ছোট বোনের সঙ্গে সে থাকত। তার বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে। গোপাল মা গ্রামের একটি সরকারি স্কুলে রান্নার কাজ করতেন। তাদের টানাটানির সংসার, কিন্তু তিনি ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন সব সময়। তিনি চাইতেন তার ছেলে মানুষের মত মানুষ হোক। আর অনেক বড় হোক। নিজে প্রতিষ্ঠিত হোক। তার মতো যেনো তাকে দারিদ্রতার মধ্যে না কাটাতে হয় পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল। সে খুব ভালো ছাত্র ছিল। সে প্রতিদিন স্কুল শেষে মায়ের রান্নার কাজে সাহায্য করত, তারপর বিকেলে লণ্ঠনের আলোয় সে পড়তে বসত। বন্ধুরা যখন খেলত, গোপাল বইয়ের পাতায় ডুবে থাকত। কারণ সে জানত—এই পড়াশোনাই তাকে তার স্বপ্নের কাছে পৌঁছে দেবে।
একদিন স্কুলে একটি বিজ্ঞপ্তি এল—জেলার সেরা ছাত্র বেছে নেওয়া হবে, যাকে স্কলারশিপ দিয়ে শহরে পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে। শিক্ষকরা বললেন, “গোপাল,তুই তো খুব ভালো পড়িস, চেষ্টা কর।”
গোপাল মনপ্রাণ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। সে জানত, এই সুযোগই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সে পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। রাত দিন জেগে সে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনো করত। তারপর দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন এলো। পরীক্ষা হলো। গোপাল নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল।
কয়েক সপ্তাহ পর, ফলাফল প্রকাশ হলো। সবার সামনে প্রধান শিক্ষক ডেকে বললেন, “এই বছরের সেরা ছাত্র— গোপাল সাহা” মুহূর্তেই করতালিতে গর্জে উঠল গোটা স্কুল। গোপাল চোখে জল, মুখে হাসি। তার মা খুব খুশি হয়েছিল ।
সে শহরে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। কঠোর পরিশ্রম আর মায়ের আশীর্বাদে সে ধীরে ধীরে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। অনেক বছর পর, একদিন সে তার গ্রামের স্কুলে ফিরে এল—একজন সফল বিজ্ঞানী হিসেবে।
সে সেদিন বলল, “আমি বড় হতে পেরেছি কারণ আমি কখনো স্বপ্ন দেখা থামাইনি। আর আমার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন—ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভব কিছুই নেই।”
গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেদিন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখল।
গোপাল যখন নিজের গ্রামের স্কুলে ফিরে আসে, তখন তার সঙ্গে ছিল অনেক পুরস্কার, সম্মাননা, আর সাফল্যের গল্প। কিন্তু সে সেদিন শুধু নিজের কৃতিত্বের গল্প শোনাতে আসেনি।
সে ঘোষণা দিল, “এই স্কুলের প্রতিটা মেধাবী ছাত্রকে আমি সাহায্য করব। আমি জানি, অনেকের বাড়িতে বই কেনার টাকা নেই, ভালো জামা নেই স্কুলে আসার, কিন্তু আছে স্বপ্ন। আমি সেই স্বপ্নগুলোর পাশে থাকব।
গোপাল নিজের জমানো টাকা দিয়ে স্কুলে একটি কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করল, লাইব্রেরিতে নতুন বই এনে দিল, আর যেসব ছেলেমেয়ে স্কুল ছাড়তে বসেছিল, তাদের জন্য একটি ছোট ফান্ড তৈরি করল। তার মা তখনো জীবিত ছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি গোপালকে শুধু খাবার দিতাম না, সাহস দিতাম। আজ আমার ছেলেই আরেকজনের সাহস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোপাল বলল, “আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার পেছনে এই স্কুল, এই গ্রাম আর আমার মায়ের অবদান। আমি চাই, ভবিষ্যতের প্রতিটা গোপাল, রূপা বা সুমন যেন জানে—তাদের স্বপ্নও বাস্তব হতে পারে।”
সেদিন গ্রামের প্রতিটি মানুষ একজোট হয়ে গোপালকে অভিনন্দন জানাল। স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরা তার autographed ছবি চাইল। কেউ একজন বলল, “গোপালদা আমিও একদিন আপনার মতো হতে চাই।”
গোপাল হেসে বলল, “তোমরা আমার থেকেও অনেক ভালো করবে, যদি শুধু বিশ্বাস করো নিজের উপর আর কখনো হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যাও।
সেই দিনের পর থেকে পদ্মপুর গ্রামের পুরো চেহারাই বদলে গেল—কারণ এক ছেলের স্বপ্ন দেখা, ইচ্ছাশক্তি আর নীতির শক্তি সবার ভিতরে আলো জ্বালিয়ে দিল।
---
চূড়ান্ত শিক্ষা:
একজন মানুষের সাফল্য কেবল তার নিজের নয়—তা অন্য অনেকের জীবনের পথ দেখাতে পারে। সাহস, সততা আর স্বপ্ন মিলেই তৈরি হয় সত্যিকারের নায়ক।