আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যেখানে জন্মসূত্রে লিঙ্গই ঠিক করে দেয় কে কতটা স্বাধীনতা পাবে, কার স্বপ্নের সীমা কতদূর । এই সমাজকে বলা হয় পুরুষশাসিত সমাজ —যেখানে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত, অধিকাংশ সুযোগ, এমনকি অধিকাংশ সম্মান পুরুষদের হাতেই কেন্দ্রীভূত। অথচ যে মায়ের গর্ভে আমাদের জন্ম, যার কোলে, সাহচর্যে আমরা বড় হয়ে উঠি, সেই মায়ের যন্ত্রণা, তার অবদানের কথা ক’জনই বা স্মরণ করে?
একটি কন্যা সন্তান জন্মের মুহূর্ত থেকেই যেন নিয়মের খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। ছোট্ট দুটি পায়ে পড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজের তৈরী করা কঠোর নিয়মের এক অদৃশ্য শিকল। তার হাসি, তার পোশাক, তার উচ্চারণ, এমনকি তার প্রতিটি নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিচার করে এই সমাজ। সে যদি একটু বেশি কথা বলে, তাকে বলা হয় ‘উদ্ধত’; যদি নিজের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যায়, ‘স্বার্থপর’ শব্দ শুনতে হয়; আর যদি ঘরের চার দেয়াল পেরিয়ে স্বপ্নের পানে ছুটে চলে, তখন তাকে "চরিত্রহীনার" তকমা পড়িয়ে দিতেও সমাজ বিন্দুমাত্র পিছুপা হয়না।
যদিও তার স্বপ্নের আকাশে সূর্য ওঠার অধিকার রয়েছে, সে তার আবেগ, তার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সমাজ যেন তাকে চুপ করিয়ে রাখতে চায়। তার স্বপ্নগুলোকে ছোট করে দেখা হয়, তার মূল্যায়ন হয় তার লিঙ্গের কারণে। মেয়েরা প্রাতিষ্ঠানিক বাধা, সাংস্কৃতিক নিয়ম, আর সামাজিক প্রত্যাশার মোহর থেকে মুক্তি পায় না।
অন্যদিকে, পুরুষদের জন্য স্বাধীনতা যেন জন্মগত অধিকার। তার ভুল গুলো হয় ‘ছেলেমানুষি’; তার রাগকে ‘স্বাভাবিক প্রবৃত্তি’ বলা হয়। তার স্বাধীনতা প্রায়শই অজুহাত পায় ‘রাগের মাথায়’ বা ‘ক্ষোভ প্রকাশের অংশ’ হিসেবে। কিন্তু নারীর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত যেন দোষের খাতা। তার স্বপ্ন, শ্রম, বুদ্ধি—সব কিছু অবমূল্যায়িত হয় কেবলমাত্র তার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে।
এই সমাজে এখনও প্রচুর অলিখিত নিয়ম চলে—নারীকে থাকতে হবে পুরুষের ছায়ায়, পুরুষের নির্দেশে। নারীত্বও নির্ধারিত হয় পুরুষের চোখ দিয়ে। নারী যদি চুপ থাকে, সে ‘ভদ্র’; প্রতিবাদ করলে সে ‘অভদ্র’। তার মৌলিক চাহিদাগুলোও সমাজ ‘বিলাসিতা’ বলে উড়িয়ে দেয়।
এই সব বিধিনিষেধের মাঝে নারী যেমন কষ্ট পায়, তেমনি সংগ্রাম ও করে চলে সাহস করে—শিক্ষার জন্য লড়াই করে, সম্মানের জন্য লড়াই করে, নিজের স্বপ্নের জন্য লড়াই করে। তারা জানে, তারা শুধু মেয়ে নয়, তারা মানুষ। তাদেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে , আত্ম মর্যাদা রয়েছে।
আজ মেয়েরা শুধু নীরব দর্শক নন। তারা কলম ধরেছে, মঞ্চে দাঁড়িয়েছে, গলা তুলেছে। তারা রুখে দাঁড়িয়েছে অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তারা চায় পুরুষদের পাশে সমান আসনে বসতে, সমান মর্যাদা ও সম্মান পেতে। তারা চায় তাদের স্বপ্ন পূরণের অধিকার, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে।
এই পরিবর্তনের পথ একেবারেই সহজ নয়। খাড়া পাহাড়ে ওঠা সে কি চারটি খানিক কথা! তবুও সমাজের মানিসিকতা বদলাতে, সুস্থ সমাজ গড়তে বাধা পেরিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন, প্রতিটি মেয়ে তার নিজের ছোট ছোট সিদ্ধান্তে একটু একটু করে গড়ে তুলছে এক নতুন সমাজের ভিত্তি।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই —পুরুষরা কি সত্যিকারের সঙ্গী হয়ে নারীর পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত? নাকি এখনও তারা পুরনো গোঁড়ামির বুড়ো বাঁধনগুলোতে বাঁধা থাকতে চায়?
নারীরা অনেক যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে, নিজেদের অধিকার দাবী করেছে। মুক্তির এই মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য নারীর আর্তনাদ। এই আর্তনাদ শুধু তাদের নয়, পুরো সমাজের শোনার দায়িত্ব। নারী-পুরুষ সবাই মিলে যদি সেই আর্তনাদের স্বীকৃতি দিয়ে পাশে দাঁড়াই, তাহলে সত্যিই পরিবর্তন আসবে।
আমরা চাই এমন একটি সমাজ, যেখানে মেয়েদের জন্ম নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই—বরং গর্ব আছে। যেখানে স্বপ্ন দেখা, নিজের জীবন গড়ার অধিকার লিঙ্গনিরপেক্ষ। যেখানে মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড় পরিচয়।
এই নতুন সমাজে, মেয়েরা আর সমাজের ছায়া নয়। তারা মঞ্চের মুখ্য অভিনেত্রী। তারা জীবনের গান গায়, লড়াই করে, জয় করে। তাদের আর্তনাদ হয়ে ওঠে মুক্তির সুর।
মেয়েদের সংগ্রাম যেন থেমে না যায়। তাদের স্বপ্ন যেন কখনো ছোট না হয়। আমরা চাই, একদিন এই সমাজে লিঙ্গের নামেই কোনো বাধা থাকবে না। যেখানে প্রতিটি শিশু—ছেলে বা মেয়ে—স্বপ্ন দেখতে পারবে স্বাধীনভাবে, বেঁচে থাকতে পারবে সম্মানের সঙ্গে।
এই প্রত্যাশা নিয়ে আজকের মেয়েরা নিজেদের পদচিহ্ন রেখে চলেছে। তাদের সাহস, তাদের সংগ্রাম, তাদের আশা—এসবই গড়ে তুলবে নতুন দিনের সমাজ।
তাই বলি, চল একসাথে দাঁড়াই, মঞ্চটি সবার জন্য উন্মুক্ত করি। যেখানে কেউ লজ্জা পাবে না, কেউ দমন হবে না। যেখানে সবাই পাবে সমান অধিকার, সম্মান আর ভালোবাসা।
“মুক্তির মঞ্চে” উঠুক সবাই—নারী ও পুরুষ, ছেলে ও মেয়ে। একসাথে গড়বো এমন এক সমাজ, যেখানে লিঙ্গ নয়, মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড় কথা।