কলেজের প্রথম দিন। দীপ্তি সেন, সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার চোখে মুখে নতুন স্বপ্নের ঝিলিক। সে পড়াশোনায় খুব মনোযোগী, বাবার সরকারি চাকরির সীমিত আয়ে সংসার চলে কোনোমতে। দীপ্তির বাবা চান, মেয়ে ভালো চাকরি করুক, সংসার সামলাক।
অন্যদিকে, সৌরদীপ মিত্র। শহরের নামকরা ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। গাড়ি, বাড়ি, চাকচিক্য—সবই তার জীবনে আছে। কিন্তু সৌরদীপের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, সে খুঁজে বেড়ায় সত্যিকারের ভালবাসা।
প্রথম দেখা
কলেজের ক্লাসে প্রথম দিনেই দীপ্তি আর সৌরদীপের দেখা। দীপ্তি একটু লাজুক, ক্লাসের এক কোণে বসে। সৌরদীপের চোখ পড়ে যায় তার ওপর। দীপ্তির সরলতা, মৃদু হাসি, আর চোখের গভীরতা সৌরদীপকে মুগ্ধ করে। ক্লাস শেষে সৌরদীপ এগিয়ে আসে—
— "তুমি কি নতুন এসেছো? আমার নাম সৌরদীপ।"
— "হ্যাঁ, আমি দীপ্তি।"
এই ছোট্ট পরিচয় থেকে শুরু হয় তাদের বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ায় গভীর অনুভূতিতে। দু’জনেই বুঝতে পারে, তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারে না।
ভালবাসার স্বীকারোক্তি
একদিন কলেজের গাছতলায় বসে সৌরদীপ দীপ্তিকে বলে—
— "দীপ্তি, জানো, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।"
দীপ্তি একটু লজ্জা পায়, চোখ নামিয়ে বলে—
— "আমি-ও তোমাকে ভালবাসি, সৌরদীপ। কিন্তু জানো তো, আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তোমার পরিবার, আমার পরিবার..."
সৌরদীপ দীপ্তির হাত ধরে বলে—
— "ভালবাসার কি কোনো পার্থক্য হয়, দীপ্তি? আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি।"
বাধা-বিপত্তি
তাদের প্রেমের কথা দুই পরিবারেই জানাজানি হয়। সৌরদীপের বাবা রীতিমতো ক্ষেপে যান—
— "তুমি কি পাগল হয়েছো? আমাদের পরিবারের মান-সম্মান, ব্যবসা—সবকিছু তুমি নষ্ট করবে?"
সৌরদীপ প্রতিবাদ করে, কিন্তু বাবার চোখে দীপ্তি শুধুই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। দীপ্তির বাবাও চিন্তিত, মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তিনি বলেন—
— "মা, এই সম্পর্ক তোমার জন্য ঠিক নয়। ওদের পরিবার আমাদের মতো নয়।"
দীপ্তির কষ্ট
প্রতিদিন রাতে দীপ্তি জানালার পাশে বসে কাঁদে। তার চোখের জল ভিজে যায় বালিশ। সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে—
— "ভগবান, আমার সৌরদীপ যেন আমার কাছে ফিরে আসে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।"
সৌরদীপও দীপ্তির জন্য লড়াই করে যায়। বাবার সাথে কথা বলে, মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পরিবারের বাধা, সমাজের কু-নজর—সবকিছুই তাদের প্রেমকে বারবার পরীক্ষা নিতে থাকে।
দূরত্ব ও অপেক্ষা
একসময় সৌরদীপের বাবা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য, যাতে সে দীপ্তিকে ভুলে যায়। দীপ্তি আরও একা হয়ে পড়ে। সে প্রতিদিন সৌরদীপের ফেলে যাওয়া চিঠি পড়ে, তার স্মৃতিতে বেঁচে থাকে।
কয়েক মাস কেটে যায়। দীপ্তির মন ভেঙে যায়, কিন্তু সে আশা ছাড়ে না। প্রতিরাতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে—
— "ভগবান, আমার ভালবাসা যেন ফিরে আসে। আমি শুধু ওর অপেক্ষায় আছি।"
ফিরে আসা
একদিন হঠাৎ দীপ্তির বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে থামে। দরজা খুলে নামে সৌরদীপ। দীপ্তির চোখে জল চলে আসে। সৌরদীপ বলে—
— "আমি ফিরে এসেছি, দীপ্তি। আমি কাউকে ভয় পাই না। আমি তোমার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি।"
সৌরদীপের দৃঢ়তা দেখে তার বাবা-মাও অবশেষে মেনে নেন। তারা বুঝতে পারেন, সত্যিকারের ভালবাসা কোনো বাধা মানে না।
বিয়ে ও নতুন শুরু
সব বাধা পেরিয়ে, দীপ্তি আর সৌরদীপের বিয়ে হয়। দীপ্তির চোখে তখন আনন্দের অশ্রু। সে ভগবানের কাছে বলে—
— "ধন্যবাদ ভগবান, তুমি আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিয়েছো।"
তাদের ভালবাসা প্রমাণ করে, অপেক্ষা আর বিশ্বাস থাকলে, সমস্ত বাধা পেরিয়ে সত্যিকারের ভালবাসা একদিন ঠিকই মিলিত হয়।
বহু প্রতিকূলতা, অশ্রু আর অপেক্ষার পর অবশেষে দীপ্তি ও সৌরদীপ একসাথে জীবন শুরু করল। বিয়ের পর তাদের ভালবাসা যেন আরও গভীর, আরও নিখাদ হয়ে উঠল। সংসারের ছোট ছোট মুহূর্তে তারা খুঁজে পেল নতুন সুখ, নতুন আশ্রয়। দীপ্তি প্রতিদিন সকালে সৌরদীপের জন্য চা বানিয়ে দেয়, সৌরদীপ অফিস যাওয়ার আগে দীপ্তির কপালে আলতো করে চুমু খায়—এইসব ছোট ছোট মুহূর্তেই তারা বুঝতে পারে, ভালবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, বরং একে অপরের পাশে থেকে জীবনকে সুন্দর করে তোলা।
তাদের চোখে আজও সেই প্রথম ভালোবাসার দীপ্তি। দীপ্তি ভাবে—প্রতিটি অশ্রু, প্রতিটি প্রার্থনা, প্রতিটি অপেক্ষা আজ সার্থক। সৌরদীপ ভাবে—সব বাধা পেরিয়ে আজ সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াটাকে পাশে পেয়েছে। তারা জানে, জীবনে ঝড় আসবেই, কিন্তু একে অপরের হাত ধরে থাকলে সব ঝড়ই একদিন শান্ত হবে।
তাদের ভালবাসা আজও প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে চলে—নতুন আলোয়, নতুন আশায়। দীপ্তি আর সৌরদীপের গল্প তাই প্রমাণ করে, সত্যিকারের ভালবাসা কখনও হারিয়ে যায় না; বরং সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর, আরও অটুট হয়ে ওঠে।