কলকাতার এক শান্ত বিকেলে, সাউথ সিটির কাছে ছোট্ট এক পার্কে সৌমদীপ গুহ হাঁটছিল। সরকারি অফিসের কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে সে প্রায়ই এখানে আসত। তার চোখে ছিল স্বপ্ন, মনে ছিল কিছুটা দ্বিধা। হঠাৎই তার চোখে পড়ল এক অপরূপা তরুণীকে—সুপর্ণা মৈত্র। সুপর্ণার চোখে ছিল গভীরতা, চুলে ছিল হালকা বাতাসের ছোঁয়া। সে পার্কের এক কোণে বসে বই পড়ছিল। সৌমদীপের মনে হল, যেন কোনো কবিতার পাতা থেকে উঠে এসেছে এই মেয়েটি।
সৌমদীপ একটু দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেল। “এই বইটা তো আমিও পড়েছি,” বলল সে, একটু হাসি নিয়ে। সুপর্ণা তাকিয়ে মৃদু হাসল, “তাহলে তো আপনি আমার চেয়ে এক পাতা এগিয়ে আছেন!” সেই হাসির মধ্যে ছিল এক অজানা টান। দু'জনের আলাপ শুরু হল বই, সিনেমা, জীবন নিয়ে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, কিন্তু তাদের কথা যেন শেষ হয় না।
বন্ধুত্ব থেকে প্রেম
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতে লাগল তাদের। কখনো পার্কে, কখনো ক্যাফেতে, কখনো বা বইমেলায়। সৌমদীপের সরলতা, হাস্যরস, আর জীবন নিয়ে তার সহজ দর্শন সুপর্ণার মন ছুঁয়ে গেল। অন্যদিকে, সুপর্ণার আত্মবিশ্বাস, স্বপ্ন দেখার সাহস, আর তার চোখের গভীরতা সৌমদীপকে মুগ্ধ করল।
একদিন হঠাৎ বৃষ্টি নামল। দু’জনে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। সুপর্ণা হেসে বলল, “জানো, বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। মনে হয়, সবকিছু ধুয়ে-মুছে নতুন করে শুরু হচ্ছে।” সৌমদীপ মৃদু হেসে বলল, “তবে আমাদের গল্পও হয়তো আজ নতুন মোড় নেবে।” সেই মুহূর্তে, দু’জনের চোখে চোখ পড়ল। কোনো কথা না বলেও, তারা বুঝে গেল—এটাই প্রেম।
প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা
দিন গড়াতে লাগল। তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হল। সুপর্ণার বাবা, বিজন মৈত্র, কলকাতার এক বিশাল ব্যবসায়ী। তিনি চাইতেন, মেয়ের বিয়ে হোক তার সমান মান-সম্মান ও প্রতিপত্তির পরিবারের সঙ্গে। অন্যদিকে, সৌমদীপের বাবা ছিলেন ছোট সরকারি কর্মচারী। তাদের জীবন ছিল সাধারণ, কিন্তু ভালোবাসা ও সম্মান ছিল অপরিসীম।
সৌমদীপ ও সুপর্ণা জানত, তাদের সম্পর্ক সহজ হবে না। কিন্তু তারা একে অপরকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না। সুপর্ণা বলত, “তুমি ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।” সৌমদীপ বলত, “তুমি আছ বলেই আমার জীবন এত সুন্দর।”
বাধার শুরু
একদিন সুপর্ণার বাবা জানতে পারলেন, তার মেয়ে একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারীর ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। বিজনবাবু রেগে আগুন। তিনি সুপর্ণাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি জানো, আমাদের পরিবারের মান-সম্মান কী? তুমি কি ভাবছো, ওই ছেলেটা তোমাকে সুখী রাখতে পারবে?” সুপর্ণা চুপ করে শুনল। সে জানত, বাবার মন বদলানো সহজ নয়।
কিছুদিন পর বিজনবাবু সুপর্ণার বিয়ে ঠিক করে দিলেন এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে। সুপর্ণা ভেঙে পড়ল। সে সৌমদীপকে জানাল সবকিছু। সৌমদীপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুমি যদি চাও, আমরা পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমার।”
পালিয়ে যাওয়া
সুপর্ণা অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল—সে তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেই জীবন কাটাবে। এক রাতে, বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে, সে চুপচাপ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সৌমদীপ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। দু’জনে মিলে চলে গেল এক দূর শহরে, নতুন জীবনের খোঁজে।
তাদের বিয়ে হল ছোট্ট এক মন্দিরে, দুই বন্ধুর উপস্থিতিতে। নতুন শহরে, নতুন নাম-পরিচয়ে, তারা শুরু করল সংসার। প্রথমদিকে অনেক কষ্ট ছিল, টাকার টানাটানি, অজানা শহরে নতুন করে সব শুরু করা। কিন্তু তাদের ভালোবাসা ছিল অটুট। সৌমদীপ চাকরি পেয়ে গেল এক স্কুলে, সুপর্ণা শুরু করল টিউশনি। ধীরে ধীরে তারা গুছিয়ে নিল নিজেদের জীবন।
সম্পর্কের স্বীকৃতি
সৌমদীপের বাবা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের মুখের হাসি দেখে তিনি মেনে নিলেন সুপর্ণাকে। “তোমরা সুখী থাকো, এটাই আমার চাওয়া,” বলেছিলেন তিনি। সৌমদীপের মা সুপর্ণাকে মেয়ের মতো ভালোবেসে নিলেন। ছোট্ট সংসার, কিন্তু ভালোবাসা ছিল অফুরান।
অন্যদিকে, সুপর্ণার বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারে ভেঙে গেল। বিজনবাবু মেয়েকে ক্ষমা করতে পারলেন না। “তুমি আমাদের পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করেছো,” বলেছিলেন তিনি। সুপর্ণা অনেকবার চিঠি লিখেছিল, ফোন করেছিল, কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি।
নতুন জীবনের সংগ্রাম
১৫ বছর কেটে গেল। সৌমদীপ ও সুপর্ণার জীবনে অনেক পরিবর্তন এল। তাদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়েছে। সৌমদীপ স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সুপর্ণা নিজের কোচিং সেন্টার খুলেছে। তাদের জীবন ছিল সাদামাটা, কিন্তু সুখে ভরা।
তাদের সন্তানরা বড় হতে লাগল। মাঝে মাঝে, সুপর্ণার মন খারাপ হত বাবাকে মনে করে। সে জানত, বাবার ভালোবাসা সে হারিয়েছে, কিন্তু বাবার প্রতি তার ভালোবাসা কখনো কমেনি।
১৫ বছর পর মিলন
একদিন, হঠাৎ সুপর্ণার ফোনে একটি অজানা নম্বর থেকে কল এল। ওপাশে বিজনবাবু। কণ্ঠে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু গলায় ছিল মমতা। “সুপর্ণা, তুমি কেমন আছো?” সুপর্ণা বিস্মিত, আনন্দিত, আবেগে ভেসে গেল। “বাবা!”—শুধু এটুকুই বলতে পারল।
বিজনবাবু বললেন, “আমি ভুল করেছি। এত বছর তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনি। তোমার সুখই আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া। আমি তোমাদের মেনে নিতে চাই।” সুপর্ণার চোখে জল এসে গেল। সে ছুটে গেল বাবার কাছে, সঙ্গে নিয়ে গেল সৌমদীপ ও তাদের সন্তানদের।
বিজনবাবু প্রথমে সৌমদীপের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। তারপর এগিয়ে এসে বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে সুখী রেখেছো, এটাই আমার গর্ব।” সৌমদীপ মাথা নিচু করে বলল, “আমি শুধু আমার ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি, আর কিছু না।”
নতুন অধ্যায়
সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেল। বিজনবাবু সুপর্ণা ও তার পরিবারকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বড় বাড়ির খোলামেলা বারান্দায়, এক সন্ধ্যায়, সবাই মিলে বসে গল্প করছিল। সুপর্ণা বাবার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “বাবা, আজ আমি সত্যিই সম্পূর্ণ।”
সৌমদীপ পাশে বসে হাসল। তাদের সন্তানরা দৌড়াচ্ছে, খেলা করছে। বিজনবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভালোবাসা কখনো হেরে যায় না। সময় লাগলেও, ভালোবাসাই সবকিছু জয় করে।”
উপসংহার
এভাবেই সৌমদীপ ও সুপর্ণার প্রেমের গল্প শেষ হল না, বরং নতুন করে শুরু হল। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছিল ভালোবাসা, সংগ্রাম, আর পারস্পরিক সম্মান। তারা প্রমাণ করল—ভালোবাসা কোনো বাধা মানে না, কোনো পার্থক্য মানে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সব সম্পর্কই মিলিয়ে যায় ভালোবাসার আলোয়।