প্রথম দেখা
বাসস্ট্যান্ডে তখন ভোরের কুয়াশা। শহরের ব্যস্ততা তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। প্রতীক তার ব্যাগ থেকে বইটি বের করে পড়ছিল—হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’। হঠাৎ পাশে বসে পড়ল এক অচেনা মেয়ে, হাতে ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। দু’জনের চোখাচোখি, তারপর অদ্ভুত এক নীরবতা।
সৃজশ্রী প্রথমে তাকাল, তারপর বলল,
—“আপনি মুরাকামি পড়েন? আমার মনে হয়, তার গল্পগুলো খুব বিষণ্ণ।”
প্রতীক হাসল,
—“বিষণ্ণতা ছাড়া কি জীবন সম্পূর্ণ হয়?”
—“আচ্ছা, তাহলে আনন্দ?”
—“আনন্দ আসে, চলে যায়। বিষণ্ণতা থেকে যায়, গল্প হয়ে।”
সেই ছোট্ট তর্ক, সেই হাসি—সেখান থেকেই শুরু। প্রতীক তার মতোই নিরব, অথচ চাহনিতে মায়া। সৃজশ্রী প্রাণবন্ত, চোখে স্বপ্ন। দু’জনের আলাপ জমে উঠল, বাসের অপেক্ষা যেন অজান্তেই দীর্ঘ হল।
২. বন্ধুত্বের শুরু
সেই দিনের পর থেকে প্রায়ই দেখা হতে লাগল। বই, সিনেমা, গান—সবকিছুতেই দু’জনের মতের অমিল, তবু এক অদ্ভুত টান। প্রতীক তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত—গ্রাফিক ডিজাইনের জগতে সে নিঃশব্দে নিজের গল্প আঁকে। সৃজশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তার স্বপ্ন—একদিন বড় লেখক হবে।
একদিন বিকেলে, ক্যাফেতে বসে সৃজশ্রী বলল,
—“তুমি এত চুপচাপ কেন?”
প্রতীক হেসে বলল,
—“সব কথা মুখে বলা যায় না। কিছু কথা চোখে থাকে।”
সেই চোখের ভাষা বুঝতে শিখল সৃজশ্রী। বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপ নিল।
৩. গোপন সত্য
প্রতীক মাঝে মাঝে হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সৃজশ্রী জিজ্ঞেস করলে সে এড়িয়ে যায়। একদিন, প্রতীক তার হাত ধরে বলল,
—“তুমি কি জানো, কিছু গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়?”
—“কেন?”
—“কারণ, সব গল্পের শেষটা আমরা ঠিক করতে পারি না।”
সৃজশ্রী বুঝতে পারল, প্রতীকের মনে কিছু আছে। সে স্বপ্ন দেখে—একসাথে ঘর, সংসার, সন্তান। প্রতীক চুপচাপ শুনে যায়, হাসে, কিন্তু তার চোখে এক অজানা ভয়।
৪. দূরত্ব
একদিন প্রতীক হঠাৎ সৃজশ্রীকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ফোন ধরে না, মেসেজের উত্তর দেয় না। সৃজশ্রী অস্থির হয়ে পড়ে। সে প্রতীকের বাসায় যায়, অফিসে খোঁজ নেয়—কিন্তু প্রতীক নেই। কেবল প্রতীকের ডেস্কে পড়ে আছে একটি চিঠি—
“সৃজশ্রী,
আমি জানি, তুমি আমাকে খুঁজছো। কিন্তু আমি চাই না, আমার জীবনের অন্ধকার তোমার জীবনের আলো নষ্ট করুক। আমার হার্টে সমস্যা, সময় খুব কম। আমি চাই, তুমি আবার ভালোবাসো, আবার হাসো। আমার জন্য দুঃখ কোরো না।
যদি একদিন সত্যিই ক্ষমা করো, আমার নামে একটা গাছ লাগিয়ো।
—প্রতীক”
৫. বিদায়ের মুহূর্ত
চিঠি হাতে নিয়ে সৃজশ্রী ছুটে যায় হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারে—প্রতীক আর নেই। হাসপাতালের করিডোরে সে ভেঙে পড়ে, কাঁদে, অথচ প্রতীকের শেষ কথাগুলো তার কানে বাজে—
“ভালো থেকো, ভালোবাসো আবার।”
৬. নতুন শুরু
পাঁচ বছর কেটে গেছে। সৃজশ্রী এখন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। স্কুলের বাগানে একটি ছোট্ট গাছ—তুলসী গাছের নিচে বসে সে প্রতীকের স্মৃতিতে ডুবে থাকে। গাছের নিচে ছোট্ট ফলক—
“প্রতীকের স্মৃতিতে—ভালোবাসা কখনও মরে না।”
একদিন, এক নতুন ছাত্রী—রিমঝিম—তার কাছে আসে। হাতে একটি খাতা।
—“ম্যাডাম, আপনি কি গল্প লেখেন?”
সৃজশ্রী হাসে,
—“তুমি কি গল্প পড়তে ভালোবাসো?”
—“খুব!”
সৃজশ্রী খাতা এগিয়ে দেয়—
—“এটা প্রতীকের লেখা অসমাপ্ত গল্প। আমি শেষ করে দিয়েছি। পড়ো, তারপর আমাকেও তোমার গল্প শোনাবে।”
৭. চিরন্তন ভালোবাসা
সন্ধ্যার আলোয় গাছের পাতার ফাঁকে সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ে। সৃজশ্রী জানে, প্রতীক নেই—তবু তার ভালোবাসা আছে, গল্প হয়ে, স্মৃতি হয়ে। প্রতীকের গাছ বড় হচ্ছে, তার ছায়ায় নতুন গল্প জন্ম নিচ্ছে।
সৃজশ্রী চোখ বন্ধ করে বলে,
—“ভালোবাসা কখনও মরে না। প্রতীক, তুমি আছো—এই গাছের পাতায়, আমার গল্পে, প্রতিটি শিশুর হাসিতে।”
এই গল্প শুধু প্রতীক আর সৃজশ্রীর নয়—এটি প্রতিটি অসমাপ্ত ভালোবাসার, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের, এবং প্রতিটি নতুন শুরু’র গল্প। ভালোবাসা কখনও মরে না—সে রূপ বদলায়, গল্প হয়ে বেঁচে থাকে।
গল্পের বার্তা
জীবন কখনও কখনও আমাদের সামনে এমন কিছু গল্প নিয়ে আসে, যেগুলোর শেষটা আমরা চাইলে বদলাতে পারি না। কিছু সম্পর্ক, কিছু ভালোবাসা অসমাপ্ত থেকে যায়—কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভালোবাসা হারিয়ে যায়। বরং, ভালোবাসা রূপ বদলায়—স্মৃতি হয়ে, অনুপ্রেরণা হয়ে, নতুন গল্প হয়ে।
ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে কাউকে মুক্তি দেওয়া, তার সুখের জন্য নিজের কষ্টকে মেনে নেওয়া।
প্রতীক ও সৃজশ্রীর গল্প আমাদের শেখায়—
জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ভালোবাসার ছায়া চিরকাল থাকে।
হারিয়ে যাওয়া মানুষদের স্মৃতিতে আমরা নতুন করে বাঁচতে পারি, নতুন স্বপ্ন দেখতে পারি।
কষ্টের মধ্যেও নতুন শুরু সম্ভব, যদি আমরা হৃদয় খুলে ভালোবাসতে পারি।
তাই, ভালোবাসা হারিয়ে গেলে ভেঙে পড়ো না। বরং সেই ভালোবাসার স্মৃতি দিয়ে নতুন জীবন গড়ে তোলো, নতুন গল্প লিখো। কারণ, ভালোবাসা কখনও মরে না—সে বেঁচে থাকে আমাদের হৃদয়ে, আমাদের কাজে, আমাদের গল্পে।