Read The call of green by Prabhakar Bhangar in Bengali কিছু | মাতরুবার্তি

Featured Books
  • LOVE UNLOCKED - 4

    Love Unlocked : 4Pritha :আজকে সারাটাদিন আরিয়া ক্যাফেই কাটিয...

  • জঙ্গলের প্রহরী - 11

    জঙ্গলের প্রহরীপর্ব - ১১- "আচ্ছা, মিস গোস্বামীটা বাদ দিয়ে আম...

  • মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 128

    মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২৮ বেদব্যাস বর্ণিত সুবর্ণষ্ঠীবীর কা...

  • LOVE UNLOCKED - 3

    Love Unlocked: 3Pritha :একটা ক্যাফের সামনে দাড়িয়ে আছে আরিয...

  • ঝরাপাতা - 10

    ঝরাপাতাপর্ব - ১০- "এসে তো কিছু বললি না আমাকে?" মণিকা কোনোমতে...

বিভাগ
শেয়ারড

সবুজের আহ্বান

পশ্চিমবঙ্গের এক কোণে, ছোট ছোট পাহাড়ের কোলে আর শাল-সেগুনের ছায়ায় ঘেরা রতনপুর গ্রাম। এখানে ভোরের আলো ফোটে পাখির কলতানে, আর দিনের শুরু হয় নদীর মৃদু বয়ে চলার শব্দে। এই গ্রামেরই একজন মানুষ, অভিরাজ সেন। বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু তার চোখে প্রকৃতির প্রতি এক গভীর মমতা। তিনি শুধু একজন স্কুলশিক্ষক নন, গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাখি, প্রতিটি নদীর জলের ধারা তার আত্মার অংশ। বিয়ে করেননি তিনি, প্রকৃতিকেই নিজের জীবনসঙ্গিনী করে নিয়েছেন। তার কাছে আধুনিকতার কোলাহল অর্থহীন, প্রকৃতির নীরবতাই তার একমাত্র সঙ্গী।
প্রতিদিন সকালে অভিরাজের হাত ধরে গ্রামের ছোট্ট শিশুরা বেরিয়ে পড়ে। কখনো তারা নতুন চারা রোপণ করে, কখনো নদীর পাড় থেকে প্লাস্টিক কুড়িয়ে পরিষ্কার করে, আবার কখনো গাছের ডালে পাখির বাসা বাঁধে। অভিরাজের ঘরটিও যেন প্রকৃতিরই অংশ। সেখানে বিদ্যুতের বাহুল্য নেই, জল অপচয় হয় না। সূর্যোদয়ের সাথে তার দিন শুরু হয়, আর সূর্যাস্তের সাথে সাথে দিনের সমাপ্তি হয়। তার জীবনযাত্রায় এক অদ্ভুত সারল্য আর শান্তি।
একদিন কলকাতা থেকে এক ঝাঁ-চকচকে গাড়ি এসে থামে রতনপুর গ্রামের পথে। গাড়ি থেকে নামেন ঐশী দত্ত, একজন শহুরে সাংবাদিক। পরিবেশ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য তিনি এই গ্রামে এসেছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা ঐশীর কাছে গ্রামের এই শান্ত জীবনযাত্রা, বিশেষ করে অভিরাজের রুটিনমাফিক কাজগুলো বেশ অদ্ভুত লাগে। "এই যুগেও এমন মানুষ হয় নাকি?" মনে মনে ভাবেন ঐশী। প্রথম কয়েকদিন তিনি দূর থেকে অভিরাজকে পর্যবেক্ষণ করেন, তার কাজের ধরন আর গ্রামবাসীদের সাথে তার সহজ সম্পর্ক দেখে বিস্মিত হন।
ধীরে ধীরে ঐশীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। তিনি অভিরাজের সাথে কথা বলেন, তার জীবনদর্শন সম্পর্কে জানতে পারেন। অভিরাজ তাকে বলেন, "প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া মানে শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, নিজের আত্মার শান্তিকেও ফিরে পাওয়া।" ঐশী মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন, কীভাবে একজন মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে, অল্পতেই সুখী হয়ে থাকতে পারে। অভিরাজের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ ঐশীর শহুরে জীবনদৃষ্টিকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, সত্যিকারের সুখ হয়তো কোনো আধুনিক গ্যাজেটে নয়, বরং মাটির কাছাকাছি থাকার মধ্যে। তার সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল এখন মুগ্ধতায় রূপ নিয়েছে।
তবে গল্পের মোড় নেয় এক ভিন্ন দিকে। রতনপুরের পাশেই সুবিশাল বনভূমি, যা গ্রামের মানুষের জীবনধারণের অন্যতম ভিত্তি, সেই বনভূমিতে একটি বড় শিল্প প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করে একটি বহুজাতিক কোম্পানি। গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা, এই প্রকল্প তাদের জীবনযাত্রা ও পরিবেশকে ধ্বংস করে দেবে। ঐশী নিজেকে এক কঠিন দ্বিধার মধ্যে আবিষ্কার করেন— একদিকে তার পেশাদারিত্ব, অন্যদিকে অভিরাজের প্রতি তার সম্মান এবং প্রকৃতির প্রতি তার নতুন জাগ্রত ভালোবাসা।
অবশেষে, ঐশী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার সাংবাদিকতার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে প্রকৃতি রক্ষা আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। একের পর এক রিপোর্টে তিনি কোম্পানির অপ-পরিকল্পনা এবং রতনপুর গ্রামের প্রাকৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার প্রতিবেদনগুলি দ্রুত জনমত তৈরি করে। শহরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনও এই আন্দোলনে শামিল হয়। অভিরাজ ও গ্রামবাসীদের সাথে ঐশীও রাজপথে নেমে আসে, তাদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায় দূর দূরান্তে।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে জয় হয় রতনপুরের মানুষের। জনমতের চাপে এবং ঐশীর বলিষ্ঠ সাংবাদিকতার কারণে শিল্প প্রকল্পটি বাতিল হয়। অভিরাজের গ্রাম রক্ষা পায়। ঐশী শহরে ফিরে গেলেও তার ভেতরের পরিবর্তনটা স্পষ্ট। সে আর আগের মতো যন্ত্রচালিত জীবন বাঁচতে চায় না। শহরের দূষণ আর কৃত্রিমতা তাকে আর টানতে পারে না।
কয়েক মাস পর, এক ঝলমলে সকালে আবার রতনপুর গ্রামের পথে গাড়ি থামে। এবার ঐশী একা নন, তার সাথে এসেছে শহরের কিছু শিক্ষার্থী। তাদের চোখে কৌতূহল, মনে প্রকৃতির প্রতি এক নতুন আকর্ষণ। তারা অভিরাজের কাছে এসেছে, প্রকৃতির কাছ থেকে শিখতে এসেছে। রতনপুরের সবুজ গালিচায় দাঁড়িয়ে অভিরাজ হাসেন, তার চোখে ফুটে ওঠে এক অনাবিল শান্তি। ঐশী বুঝতে পারেন, "সবুজের আহ্বান" শুধু একটি গ্রামের গল্প নয়, এটি প্রতিটি মানুষের আত্মার শান্তি ফিরে পাওয়ার গল্প।

ঐশী শহরে ফিরে গেলেও তার ভেতরে এক গভীর পরিবর্তন ঘটেছিল। সে আর আগের মতো রোবটিক জীবন যাপন করতে পারছিল না। রতনপুরের স্মৃতি, অভিরাজের সরল জীবনধারা আর প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য তাকে প্রতিনিয়ত ডাকছিল। অবশেষে, একদিন সে আবার ফিরে আসে রতনপুরে, তবে এবার একা নয়। সঙ্গে নিয়ে আসে শহরের কিছু কৌতূহলী শিক্ষার্থীকে, যারা প্রকৃতির কাছ থেকে সরাসরি শিখতে আগ্রহী। অভিরাজের চোখে তখন এক অনাবিল তৃপ্তি। রতনপুরের সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে ঐশী অনুভব করে, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া মানে কেবল পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং নিজের আত্মার শান্তি আর জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া। "সবুজের আহ্বান" কেবল একটি গল্প নয়, এটি প্রতিটি মানুষের ভেতরের সেই হারিয়ে যাওয়া সুরকে খুঁজে পাওয়ার এক নিরন্তর যাত্রা।