Read Election by Prabhakar Bhangar in Bengali Classic Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
  • আয় কে ধরবি

    আয় কে ধরবি? পিচপিচে রোগা শীর্নকায় একটু বেঁটে কিন্তু সে ছিল...

  • আগুনের ছোঁয়া - পর্ব 3

    ভালোবাসা তখনই সত্যি, যখন তা ছুঁয়ে যায় তোমার সমস্ত দুর্বলতা...

  • নির্বাচন

    রুদ্রনীল ছোটবেলা থেকেই ‘ভাল ছেলে’ হিসেবে বড় হয়েছে। মা-বাবার...

  • ফুলবানু - 1

    বাসন্তী নদীর পাড়ে শিমুল নামের গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা পাক...

  • মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 94

    মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৪ নারদ বর্ণিত বিশ্বামিত্র, গালব, যয...

বিভাগ
শেয়ারড

নির্বাচন

রুদ্রনীল ছোটবেলা থেকেই ‘ভাল ছেলে’ হিসেবে বড় হয়েছে। মা-বাবার কথা মেনে চলা, পড়াশোনায় ভালো, ধর্মীয় আচার মানা, কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করা—সব মিলিয়ে আদর্শ। সমাজে তার একটা সম্মান ছিল, প্রশংসার পাত্র ছিল সে। কিন্তু রুদ্রনীলের নিজের ভেতরে একটা অসম্পূর্ণতা ছিল, যেটা সে কখনো কাউকে জানায়নি। তার মনটা মেয়েদের প্রতি নয়, বরং ছেলেদের প্রতিই এক গভীর টান অনুভব করত। এই টান ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত, এক নিভৃত কোণে লুকিয়ে রাখা সত্য।
সে চেষ্টাও করেছিল এটা "ঠিক" করার। ভেবেছিল হয়তো এটা শুধুই একটা সাময়িক মতিভ্রম, যা সময় গেলে কেটে যাবে। সে বিয়ে করেছিল সীমাকে—একজন মেধাবী, সুন্দর, সহানুভূতিশীল নারীকে। সীমা তার জীবনে এক ঝলক টাটকা বাতাস হয়ে এসেছিল, আর রুদ্রনীল মনে করেছিল এটাই তার স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু যত সময় গড়াতে থাকে, সে বুঝতে পারে সীমা তার জীবনে একজন “চেষ্টা” ছাড়া কিছুই নয়। ভালোবাসার সেই উষ্ণতা নেই, স্পর্শে নেই কোনো গভীর অনুভূতি। তাদের সম্পর্কটা যেন একটা অভ্যস্ত নীরবতা, যেখানে দুটো শরীর পাশাপাশি শুয়ে থাকে কিন্তু মন দুটো থাকে বহু দূরে।
রুদ্রনীল বারবার নিজেকে বোঝায়, “এটা একটা পর্ব, সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। সব দম্পতিরই হয়তো এমন হয়।” সে নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে চাপা দিতে চেষ্টা করে, সমাজের চোখে 'ভালো ছেলে' হয়ে ওঠার এই নিরন্তর লড়াই তাকে ক্লান্ত করে তোলে।
মোড়ঃ
একদিন রুদ্রনীল তার পুরনো বন্ধু অভিষেকের সঙ্গে দেখা করে। অভিষেক সেই ছেলে যে বরাবরই নিজের যৌন পরিচয় গোপন না করে বাঁচতে চেয়েছে। সমাজের চোখে সে হয়তো 'অন্যরকম', কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি আর আত্মবিশ্বাস। সমাজের কোনো চাপ তাকে চুপ করাতে পারেনি, বরং তাকে আরও সাহসী করে তুলেছে।
অভিষেক রুদ্রনীলের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “তুই একটা জীবন কাটাচ্ছিস, যেটা তোর না। সীমারও না। শুধু সমাজের।” অভিষেকের এই কথাগুলো রুদ্রনীলের কানে যেন নতুন করে বাজতে শুরু করে। একটা গভীর ধাক্কা লাগে তার ভেতরে। এতদিন ধরে পুষে রাখা সব মিথ্যে যেন কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
সেদিন রাতে রুদ্রনীল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। নিজের প্রতিবিম্বে সে যেন এক অচেনা মানুষকে আবিষ্কার করে। আর পারছে না। এই অভিনয় আর সহ্য হচ্ছে না। সীমার দিকে তাকিয়ে তার অপরাধবোধ আরও বেড়ে যায়। সীমার প্রতি তার এই নীরব অন্যায়, এই ভালোবাসাহীন সম্পর্ক তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।
সিদ্ধান্তঃ
কয়েকটা রাত নির্ঘুম কাটার পর রুদ্রনীল এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে সে সীমার সঙ্গে সব খুলে বলে। তার দীর্ঘদিনের লুকানো সত্য, তার ভেতরের আসল অনুভূতি—সবটাই সে সীমার সামনে উন্মোচন করে। সীমা প্রথমে চমকে যায়, চোখদুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে ঘরে। তারপর শুধু একটাই কথা বলে সীমা, “তুমি আমার জীবনের সত্যিটা বললে, এটা অনেক মেয়ের স্বামী করতে পারে না। আমি কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু তোমার সত্যটাও বুঝি।” সীমার এই পরিণত মানসিকতা রুদ্রনীলকে আরও বেশি অভিভূত করে তোলে। তার মনে হয়, সে এতদিন এই মানুষটার সঙ্গেই সবচেয়ে বড় বেইমানি করেছে।
রুদ্রনীল সীমার সম্মতি নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ নেয়। তাদের বিচ্ছেদটা কোনো ঝগড়া বা তিক্ততা দিয়ে হয়নি, হয়েছিল এক গভীর বোঝাপড়া আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে। কিছুদিন পর রুদ্রনীল অভিষেকের সঙ্গে নতুনভাবে জীবন শুরু করে। এবার সে আর কিছু লুকায়নি, কোনো মুখোশ পরেনি।
শেষঃ
মানুষ এই সম্পর্ককে মানতে পারেনি। বন্ধু, আত্মীয়—সবাই তাদের বর্জন করেছে। কটূক্তি, সমালোচনা আর তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। কিন্তু রুদ্রনীল প্রথমবারের মতো সত্যিকারের হাসে। তার সেই হাসি কোনো সামাজিক প্রতিপত্তির হাসি নয়, বরং নিজের আত্মাকে মুক্ত করার হাসি। কারণ সে প্রথমবার নিজের মতো করে বাঁচছে। এই বাঁচা হয়তো সমাজের চোখে 'বেমানান', 'অনৈতিক', কিন্তু এটাই তার নিজস্ব সত্য। তার নিজের পৃথিবী, যেখানে সে আর কোনো মিথ্যের ভার বয়ে চলে না।
বার্তাঃ
এই গল্প হয়তো সকলের জন্য নয়। কেউ একে ‘বেমানান’ বলবে, কেউ বলবে ‘অনৈতিক’। কিন্তু এটাও একটা জীবন। একটা মন। একটা সত্য।
সব সত্য কি গ্রহণযোগ্য হয়? না।
তবু সে সত্যই, মিথ্যে নয়।
এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কিছু সত্য আছে যা হয়তো সমাজের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলে না, কিন্তু তবুও সেগুলো ব্যক্তিগত জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেগুলো ছাড়া নিজের সঙ্গে সততা বজায় রাখা অসম্ভব। এই সত্যগুলো কখনো কখনো কঠিন পথ তৈরি করে, কিন্তু সেই পথেই প্রকৃত মুক্তি মেলে।
রুদ্রনীলের গল্পটা কেবল তার ব্যক্তিগত সত্যের অনুসন্ধান ছিল না, বরং সমাজের বেঁধে দেওয়া অদৃশ্য শেকল ভাঙার এক নীরব বিদ্রোহ ছিল। তার এই যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের ভেতরের সত্যগুলো প্রায়শই জটিল ও বহুমুখী হয়, যা প্রচলিত ধ্যানধারণার সাথে নাও মিলতে পারে। রুদ্রনীল হয়তো সমাজের চোখে 'ভালো ছেলে'র তকমা হারিয়েছিল, কিন্তু সে তার নিজের কাছে সৎ থাকতে পেরেছিল। তার এই 'নির্বাচন' কেবল নিজের মুক্তির পথই দেখায়নি, বরং সীমাহীন ভালোবাসার এক নতুন সংজ্ঞাও তৈরি করেছে – যেখানে সম্পর্ক কোনো প্রথা বা বাধ্যবাধকতার নাম নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান আর আত্মিক সংযোগের নাম। রুদ্রনীল ও অভিষেকের জীবন হয়তো অনেকের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যাবে, কিন্তু তাদের হাসিতে যে সত্যিকারের আনন্দের ঝলক ছিল, তা প্রমাণ করে যে আত্মসম্মান আর সত্যের পথে চলার শান্তি সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। এই গল্প আমাদের শেখায়, সত্যিকারের ভালোবাসা আর শান্তি খুঁজে পেতে হলে মাঝে মাঝে কঠিনতম সিদ্ধান্তগুলোও নিতে হয়।