Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অগ্নিস্নেহ - পর্ব 1

আগুন চারিদিকে শুধু আগুন। রাতের অন্ধকার কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চোখ ঝলসে দেওয়া এক দাবদাহ। কি প্রচন্ড তার শব্দ, সঙ্গে হাজার মানুষের আর্তনাদ। আর তারই মধ্যে কিছু মানুষ করে চলেছে সময়ের বিরুদ্ধে লড়ে আগুনের হাত থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে আনার এক প্রবল সংগ্রাম। 

এই সব কিছুর মাঝেও এক ক্ষুদ্র গলার ক্ষীণ আকন্ঠ অনুরোধ আজও মনে পড়ে অনির্বাণের, “আমার দাদাভাই কে ফিরিয়ে আনুন….ও ছাদে আসতে পরে না.....ওর তো পা নেই…”

***

জুন মাস, রাত তখন প্রায় ১টা ৪০। অনির্বাণ চ্যাটার্জী নিজের অফিসে বসে গতকালকের খবরের কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, সুঠাম দীর্ঘ চেহারা, মাথার কয়েকটা চুলে পাক ধরা সুরু হয়েছে ঠিকই কিন্তু দেখলে আজও মনেহয় যেনো ত্রিশ এর গণ্ডি পার হয়নি। 

বছরখানেক হলো সে ট্রান্সফার হয়ে এই শান্তিপুর শহরে এসেছে। দমকল দপ্তরের অভিজ্ঞ কর্মী সে, ভাগ্যবশত ট্রান্সফারের পরে কোনো বড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন তাকে হতে হয়নি এই শহরে। দিনগুলো তার বেশ শান্তিতেই কাটছে আজকাল। একটু চেয়ার এ হেলান দিয়ে পাশের টেবিলের দিকে তাকালো সে। তার দুইজন সহকর্মী যথারীতি টেবিল এ মাথা রেখে নাক ডাকছে। মনে মনে একটু হাসল অনির্বাণ, অর্ধেক জীবন তো তার লড়াই করেই কেটেছে, তাই এখন এই শান্তি বেশ ভালই লাগছে। তার স্ত্রী রূপসাও বেশ মানিয়ে নিয়েছে এই শহরটিতে….

“ক্রিং ক্রিং…”

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পাশের টেবিলের ফোনটি রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে প্রচন্ড হুংকার দিয়ে বেজে উঠলো। বুকটা কেঁপে উঠলো অনির্বাণের, এক মুহুর্তে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ফোনটা কানে দিলো সে…

***

রাত প্রায় ১টা বেজে ৩০ মিনিট, ঘুমন্ত শান্তিপুর শহরের পুরনো বাজারপাড়ার 'সুবর্ণ রেসিডেন্সি' নামের চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে হঠাৎ বিকট শব্দে ভেসে আসে বিস্ফোরণের ধ্বনি। মুহূর্তেই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন।

হয়তো AC থেকে বা হয়তো অন্য কোনো ভাবে, কারণটা কেউই জানেনা, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের শিখা ক্রমেই উঠছে ছাদের দিকে, জানালার কাঁচ একে একে ভেঙে পড়ছে নিচে।

ইতিমধ্যে চারদিকে হাহাকার শুরু হয়েছে। পাড়ার লোক জনও জড়ো হচ্ছেন নিচের রাস্তায়। জ্বলন্ত বাড়িটির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক ভয়াবহ দৃশ্য। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ নামার চেষ্টা করছে বারান্দা বেয়ে। কেউবা নিচে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছে না। কাচ আর পুড়ে যাওয়া কাঠের গন্ধ বাতাসে ছেয়ে গেছে। কেউ কেউ সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে—কিন্তু ধোঁয়া এত ঘন যে কোনো পথ বোঝা যাচ্ছে না।


রাত ১টা ৫৩-তে যখন দমকলের লাল ইঞ্জিন এসে দাঁড়ায় গলির মুখে, নিচের তলার লোকজন ততক্ষনে প্রায় বেরিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে। যারা ঝাঁপ দিয়ে আহত হয়েছেন তাদের হসপিটাল এ নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু স্থানীয় লোক রিক্সা, মোটরসাইকেল এনে সাহায্য করছেন। অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দেওয়া হয়েছে তবে সেটা এসে পৌঁছায়নি তখনও। 

দমকলের গাড়ি থেকে সবার আগে নামেন অনির্বাণ। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে টর্চ, পিঠে জলভর্তি সিলিন্ডার। চোখ অবিচল ঠান্ডা স্পষ্ট। যুদ্ধের মাঠে অভ্যস্ত মন আজও আগুনের মুখে শান্ত থাকে।

"তৃতীয় তলা থেকে কেউ নামতে পারছে না, স্যার," বলে ওঠে এক ফায়ারম্যান। "ধোঁয়া সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে।"

অনির্বাণ একবার সিঁড়ির দিকে তাকায়। সে লক্ষ্য করে বাড়ির দক্ষিণ দিকে আগুন কমে এসেছে।

দলের একজন সদস্যকে সেদিকে মই এগিয়ে দিতে ইশারা করে সে। ছাদ থেকে উদ্ধার শুরু করা সহজ হবে, নিচথেকে দেখা যাচ্ছে সেখানেও কিছু মানুষ আটকে আছে এবং সাহায্যের জন্য প্রাণপণ চিৎকার করছে। 

আর এক সেকেন্ড দেরি না করে সোজা যখন মই বেয়ে ছাদের প্রাচীর টপকে অনির্বাণ ওপরে পৌঁছালো সেখানে থাকা ভীত ত্রস্ত লোকগুলো তাকে দেখে কিছু স্বস্তি পেলো। 

জড়ো হওয়া প্রায় ১২-১৫ জন মত লোকের দিকে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলো অনির্বাণ। এরা সম্ভবত তৃতীয় আর চতুর্থ তলার বাসিন্দা। নিচের তলার আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই ছাদে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কাউকে  দেখেই খুব বেশি আহত বলে মনে হচ্ছে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। 

“আপনারা এই দিকটায় চলে আসুন।” জোর গলার নির্দেশ দেয় অনির্বাণ। 

“এদিকে দমকল এর মই লাগানো হয়েছে। আপনারা একজন একজন করে নামবেন। মহিলা ও শিশুদের আগে নামতে দিন।” 

দীর্ঘদিন আর্মি তে কমান্ডার পদে কর্মরত অনির্বাণের কণ্ঠের দৃঢ়তা যেনো মুহুর্তে ত্রস্ত শঙ্কিত মানুষগুলো কে শান্ত করে দিলো। দু একজন যদিও দক্ষিণ দিকে প্রাণপণ ছুট লাগলেন যাতে সবার আগে তারাই নামতে পারেন মই দিয়ে, কিন্তু বাকিরা মহিলা এবং শিশুদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। 

ইতিমধ্যে অনির্বাণ এগিয়ে গিয়েছে সব থেকে ছোটো ছেলেটিকে সাহায্য করতে, ছাদের এক কোণে কুঁকড়ে বসে আছে সে আর অনবরত কেঁদে চলেছে। বছর সাত আটের এর ছেলেটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন অনির্বাণ। 

"কি নাম তোমার?  সাথে কেউ নেই?"

অনির্বাণ এর এই প্রশ্নে ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ে। "আমার নাম নীল... মা….মা আমাকে এখানে রেখে ভেতরে গেছে দাদাভাই কে আনতে…..আমার দাদা….ওর নাম আকাশ...."

বলেই আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো ছেলেটি। আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে অনির্বাণ কোলে তুলে নিলো ছেলেটিকে, ছাদের দেওয়ালে লাগানো মই এর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলো, 

“কোন তলায় থাকো তোমরা? কত নম্বর ফ্ল্যাট?”
ছোট্ট নীল ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলো, “তিনতলা, ফ্ল্যাট এর নম্বর ৩০৩.”

এক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাড়ালো অনির্বাণ। তিনতলা…সেখানেই তো সব থেকে বেশি আগুন আর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত পায়ে শিশুটিকে নিজের এক সহকর্মীর হতে তুলে দিয়ে নিচে নামার সিঁড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। দূর থেকে তার কানে ভেসে এলো একটা অনুরোধ, “আমার দাদাভাই কে ফিরিয়ে আনুন….ও ছাদে আসতে পরে না....ওর যে পা নেই….”

ছাদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে খুলতেই প্রচন্ড আগুনের তাপ আর ধোঁয়াতে শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো অনির্বানের। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা তাড়াতাড়ি আটকে মাথার হেলমেট শক্ত করে নিয়ে মুহুর্তে ভেতরে জ্বলতে থাকা কালো জমাট বাঁধা ধোঁয়া আর লেলিহান শিখার মাঝে অনির্বানের অবয়ব মিশে গেলো। 

চারতলা ফ্ল্যাটের চতুর্থ তলায় কোনো প্রাণের চিন্হ পেলো না অনির্বাণ। বোধহয় সকলেই ছাদে চলে গিয়েছিল।

অযথা সময় নষ্ট না করে দ্রুত তিনতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। সিঁড়ির মাঝে একটা জ্বলন্ত কাঠ রাস্তা আটকে রয়েছে। পিঠের সিলিন্ডার দিয়ে ওই কাঠের আগুন নিমেষে নিভিয়ে ফেললো, তারপর ছুটে চললো তার গন্তব্যের দিকে। 

তিনতলায় পৌঁছতেই তার কানে এলো আর্তনাদের শব্দ। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই জায়গায় অনেকে আটকে পড়েছেন। পেছন থেকে আসা সহকর্মীদের পায়ের শব্দে একটু আশ্বাস পেলো অনির্বাণ। একটু এগোতেই দেখতে পেলো একজন বয়স্ক দম্পতি সিঁড়ির দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। মহিলার পায়ে রক্তের ছাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি গুরুতর ভাবে আহত। 

দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে অনির্বাণ তাদের দুজনকেই মাস্ক পরিয়ে দিল। আহত মহিলার একটি হাত নিজের ঘরের ওপর দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে। ওপর থেকে সহকর্মীরা এগিয়ে এলো তাকে সাহায্য করতে। তাদের হাতে বৃদ্ধ দম্পতিকে তুলে দিয়ে অনির্বাণ এগিয়ে গেলো ৩০৩ নম্বর ফ্ল্যাট এর খোঁজে। 

খুব বেশি সময় লাগেনি ফ্ল্যাটটি খুঁজে পেতে। একটু এগোতেই অনির্বাণ দেখতে পেলো মাটিতে পড়ে থাকে দুটো মানুষ। একজন মাঝ বয়সী মহিলা এবং তার পিঠে একটি ১১-১২ বছরের ছেলে। ছেলেটি ক্রমাগত কশির মধ্যেও মহিলাকে ডেকে চলেছে। ছুটে ছেলেটির মুখে একটি মাস্ক পরিয়ে দিল

অনির্বাণ। একবার মহিলার গলায় হাত রেখে পালস দেখে নিলো সে। না বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে আসতে। 

“তোমার ভাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” মৃদু গলার বলে অনির্বাণ। “চলো নিচে যাই।” 

কিন্তু দুই পা না থাকা ছেলেটি প্রাণপণে আকড়ে ধরে তার মায়ের নিথর দেহ। “মাকে ছাড়া আমি কোথাও যাবনা! আগে আমার মাকে নিয়ে যাও।” 

এদিকে নিচের তলা থেকে গোঙানির আওয়াজ কানে আসে অনির্বাণের। তার হাতে সময় বড় কম। প্রতিটি মুহুর্ত একজনের জীবন মৃত্যুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সজোরে ছেলেটিকে কোলে তুলে নেয় অনির্বাণ। তার চিৎকার ও কান্নাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। 

আগুনের উত্তাপে চারপাশ ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, একটি অংশে মেঝে দুলে ওঠে, নিচে ফাটল—তবে অভিজ্ঞ পা পিছলে পড়ে না। ছেলেটিকে তার সহকর্মীর হাতে তুলে সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে ভেসে আসা গোঙানির দিকে।

ছেলেটি রক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ধোঁয়া আর আগুনের মাঝে মিশে যাওয়া লোকটির পিঠ এবং তার মায়ের মাটিতে পরে থাকা শরীরের দিকে। একফোঁটা জল ও তার চোখে দেখা যায়না যেনো আগুনে সব টুকু জল বাষ্প করে দিয়েছে। 

প্রায় কুড়ি মিনিট পরে আরো তিনজন লোককে সঙ্গে নিয়ে যখন অনির্বাণ নিচে এলো, ছোট্ট নীল ছুটে এসে তার পা জড়িয়ে ধরলো। 

“থ্যাংক ইউ। আমার দাদাভাই কে ফিরিয়ে আনার জন্যে” সে শিশুসুলভ সরল গলায় বলে ওঠে।

শিশুটির ছাইয়ে ভরা চুলে আলতো হাত রাখে অনির্বাণ। তার নজর পড়ে অ্যাম্বুলেন্স এর স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা ছেলেটির দাদার দিকে। তীব্র অভিমান আর রাগের চোখে তারই দিকে তাকিয়ে আছে সে। অব্যক্ত এক অভিযোগ তার দৃষ্টি তে স্পষ্ট। কেন তাদের মা কে বাঁচালো না অনির্বাণ? 

কেউ কিছু বলে না। অনির্বাণ ধীরে ফিরে দাঁড়ায়, চোখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই, শুধুই ক্লান্তি। সে আবার ফিরে যায় জ্বলন্ত ফ্ল্যাটের দিকে—আরও কেউ বেঁচে আছে কি না দেখতে।

ছেলেটি, আকাশ, স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ে ছাদের দিকে তাকায়। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে। সে জানে এই আগুন তার সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি তার মাকেও নিজের চোখের সামনে পুরে যেতে দেখেছে সে। 

এখন এই বিশাল পৃথিবীতে শুধু সে আর তার ছোটো ভাই নীল ছাড়া নিজের বলতে তাদের কেউ নেই। 

এরপর ওই দুটো শিশুর কি হতে চলেছে? কোথায় যাবে তারা? অনির্বাণকে কি ক্ষমা করতে পারবে আকাশ? 

চলবে...