Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

তুমি পারবে - 2

অধ্যায় ২ : ছোট পদক্ষেপের বড় জয়

বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিল অরিন্দম। গ্রামের নাম কালীগঞ্জ। চারিদিকে সবুজ ধানক্ষেত, কাঁচা রাস্তা, ছোট ছোট কুঁড়েঘর। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসে, আবার যায়। শীতের রাতে কুয়াশার আস্তরণে গ্রাম ঢেকে যায়, আর গ্রীষ্মকালে খরার তাপে ফসল শুকিয়ে যায়।
অরিন্দমের বাবা ছিলেন একজন কৃষক। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেতে কাজ করতেন। মা ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু সংসারের ভার তাঁর কাঁধে ছিল অসীম। একসাথে তিন বেলা খাবার জোগাড় করাই ছিল বড় লড়াই। সংসারে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না।
তবু বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে যেন পড়াশোনায় মানুষ হয়। তারা প্রায়ই বলতেন,
“অরিন্দম, আমরা তো খেটে খাই, কিন্তু তোমাকে চাই আমরা আলোর পথে দেখতে। তুমি যদি মানুষ হও, আমাদের কষ্ট স্বার্থক হবে।”
এই কথাগুলো ছোটবেলা থেকেই অরিন্দমের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল—বই কিনে পড়ার মতো সামর্থ্য বাবার ছিল না। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করত সে। সেখানেই শিক্ষকেরা তাকে প্রেরণা দিতেন।
অরিন্দমের শৈশবটা ছিল নানা কষ্টে ভরা। বই-খাতা কিনতে না পেরে সে পুরনো খাতার খালি পাতায় লিখত। কখনো কখনো বন্ধুরা মজা করে বলত,
“তুই তো গরিবের ছেলে, তোর দিয়ে বড় কিছু হবে না।”
কথাগুলো তার মনে ব্যথা দিত, কিন্তু সে জবাব দিত না। বরং সে মনে মনে বলত,
“দেখিস, একদিন প্রমাণ করব।”
তার স্কুলের এক শিক্ষক ছিলেন অমলেন্দু বাবু। তিনি একদিন ক্লাসে বলেছিলেন,
“বাচ্চারা, মনে রেখো—বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে হবে। এক লাফে কেউ পাহাড় টপকাতে পারে না, কিন্তু ধাপে ধাপে উঠতে পারলেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো যায়।”
অরিন্দম এই কথাটি মনে রাখল।
স্কুল শেষে সে প্রায়ই গ্রামের লাইব্রেরিতে যেত। ওখানে পুরনো বই ছিল, যেগুলো ধুলোয় ভরা। অন্যরা যখন খেলতে যেত, অরিন্দম বইয়ের পাতায় ডুবে থাকত।
প্রথমে দিনে অল্প পড়তে পারত, কিন্তু ধীরে ধীরে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলল।
সে ভাবল—
“আজ যদি দু’পাতা পড়ি, কাল চার পাতা পড়ব। একদিন পুরো বই শেষ করতে পারব।”
এই ছিল তার প্রথম ছোট পদক্ষেপ।
দশম শ্রেণির পরীক্ষার সময় সে ভয় পেল। সিলেবাস বিশাল, আর সময় খুব কম। পরীক্ষায় সে ভালো করতে পারল না, এবং ফেল করল।
গ্রামের লোকেরা বলল—
“এই ছেলের দিয়ে কিছু হবে না।”
অরিন্দম খুব কষ্ট পেল। মনে হল সব শেষ। কিন্তু তখনই অমলেন্দু বাবুর কথা মনে পড়ল—
“এক লাফে জেতা যায় না, ছোট ছোট পদক্ষেপই সাফল্যের সিঁড়ি।”
তখন থেকে সে নতুন পরিকল্পনা করল। প্রতিদিন এক ঘণ্টা মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করল। বড় সিলেবাসকে ছোট ছোট ভাগে ভেঙে ফেলল।
এক বছর পর সে আবার পরীক্ষা দিল। এইবার সে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করল। যদিও বড় রেজাল্ট নয়, কিন্তু এটি তার জীবনের বড় শিক্ষা ছিল—ছোট পদক্ষেপেই সাফল্যের পথে হাঁটা যায়।
উচ্চমাধ্যমিকে উঠতেই সংসারের সমস্যা আরও বেড়ে গেল। বাবার চাষাবাদে ক্ষতি হল, ফসল ফলল না। সংসারে তখন প্রতিদিন চিন্তা—আজ খাবার আসবে কি আসবে না।
অরিন্দম ভাবল, এখন হয়তো পড়াশোনা চালানো কঠিন হবে। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। সে গ্রামের এক মুদির দোকানে পার্টটাইম কাজ নিল। দিনে স্কুল, রাতে দোকান, আর ভোরে পড়াশোনা।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে পড়তে বসলে চোখ ঝাপসা হয়ে যেত। কিন্তু সে নিজের মনে বলত—
“আজ যদি দশ মিনিটও পড়ি, তবুও এটা একটা ছোট পদক্ষেপ। কাল হয়তো বিশ মিনিট পড়ব।”
এই ছোট অভ্যাসই তাকে ধীরে ধীরে বড় লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিকের পর অরিন্দম ভর্তি হল শহরের কলেজে। গ্রাম থেকে আসা এক সাদাসিধে ছেলের জন্য শহরের ভিড়, প্রতিযোগিতা ভয়ঙ্কর লাগল।
সহপাঠীরা আধুনিক, ইংরেজিতে সাবলীল। অরিন্দম প্রথমে কথা বলতে সংকোচ বোধ করত। অনেকেই তার উচ্চারণ নিয়ে হাসত।
কিন্তু সে আবার ছোট পদক্ষেপ নিল। প্রতিদিন নতুন একটি ইংরেজি শব্দ শিখত, প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করত। প্রথমে হাসাহাসি হলেও ধীরে ধীরে তার ভাঙা ইংরেজিই সাবলীল হয়ে গেল।
কলেজ শেষ করে সে ঠিক করল, সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু প্রতিযোগিতা ভয়ঙ্কর। লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রী সেখানে চেষ্টা করছে।
সে ভেবেছিল—“আমি কি পারব?”
কিন্তু মনে পড়ল তার শিক্ষকের কথা।
সে আবার ছোট ছোট টার্গেট বানাল—
প্রতিদিন ২০টি অঙ্ক সমাধান করবে।
প্রতিদিন ১০টি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করবে।
প্রতিদিন ২ পৃষ্ঠা সাধারণ জ্ঞান পড়বে।
প্রথমে কাজ কঠিন লাগত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সিলেবাস শেষ করে ফেলল।
প্রথমবার চাকরির পরীক্ষায় বসে সে ব্যর্থ হল। মন খারাপ হল, কিন্তু সে বলল—“ব্যর্থতা মানে আবার নতুন সুযোগ।”
সে আবার চেষ্টা চালিয়ে গেল।
দ্বিতীয়বার আরও ভালো করল, কিন্তু মেধা তালিকায় নাম এল না। এইবারও সে ভাঙল না।
তৃতীয়বার পরীক্ষার ফল বেরোল। গ্রামে তখন পুজো হচ্ছিল। ঠিক সেইদিন খবর এল—অরিন্দমের নাম মেধা তালিকায় আছে।
পুরো গ্রাম আনন্দে মেতে উঠল। যারা একসময় বলত—“এ ছেলের দিয়ে কিছু হবে না”—তাদের চোখে বিস্ময়।
অরিন্দম সরকারি চাকরিতে যোগ দিল। সংসারের অভাব ঘুচল। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটল।
কিন্তু সে ভুলে গেল না তার সংগ্রামের দিনগুলো। প্রায়ই গ্রামের ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে সে বলত—
“আমি যদি বড় স্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঝাঁপ দিতাম, হয়তো অনেকবার পড়ে যেতাম। কিন্তু আমি প্রতিদিন ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়েছি। আজকের আমি সেই ছোট পদক্ষেপেরই ফল।”
অরিন্দমের গল্প আমাদের শেখায়—
বড় স্বপ্ন পূরণ হয় ছোট ছোট পদক্ষেপে।
ব্যর্থতা শেষ নয়, বরং শেখার সুযোগ।
নিয়মিত চেষ্টা করলে অসম্ভবও সম্ভব হয়।
অরিন্দমের জীবনের প্রতিটি ছোট প্রচেষ্টা মিলে এক বিশাল সাফল্যের গল্প গড়ে তুলেছিল। তার কাহিনি প্রমাণ করেছে—
“হাজার মাইলের পথও শুরু হয় এক ছোট পদক্ষেপ দিয়ে।”