অধ্যায়- ৪
সময় ব্যবস্থাপনায় সাফল্য
ভূমিকা : কেন সময় সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
আমরা জীবনে অনেক কিছু হারাই, আবার অনেক কিছু অর্জন করি। টাকা হারালে তা আবার উপার্জন করা যায়। স্বাস্থ্য খারাপ হলে যত্ন নিলে আবার সুস্থ হওয়া যায়। কিন্তু সময় একবার চলে গেলে তা আর কখনও ফিরে আসে না। এই কারণেই সময়কে বলা হয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—যে জিনিস সবচেয়ে মূল্যবান, মানুষ সেটির ব্যবহার নিয়েই সবচেয়ে বেশি অসচেতন। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায় অযথা কাজ, বিলম্ব, অমনোযোগ আর অলসতায়। পরে আমরা আফসোস করি—“আরও একটু আগে শুরু করলে, আরও একটু পরিকল্পনা করলে আমি আজ অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম।”
বাস্তবে, যে মানুষ তার সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, সেই মানুষই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের কাছাকাছি যায়।
সময় ব্যবস্থাপনা আসলে কী?
সময় ব্যবস্থাপনা মানে শুধু ঘড়ি দেখে কাজ করা নয়। বরং এটি হলো:
অগ্রাধিকার ঠিক করা – কোন কাজ আগে করব, কোনটা পরে।
পরিকল্পনা তৈরি করা – দিনের, সপ্তাহের বা মাসের জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা।
মনোযোগী থাকা – বিভ্রান্তি এড়িয়ে নির্দিষ্ট কাজে ফোকাস করা।
শৃঙ্খলা বজায় রাখা – কাজ শুরু করার অভ্যাস তৈরি করা এবং শেষ পর্যন্ত করা।
এটা একটা দক্ষতা, যেটি চর্চার মাধ্যমে উন্নত করা যায়।
কেন মানুষ সময় নষ্ট করে?
১. অলসতা (Procrastination):
আমরা অনেক সময় ভাবি, “আরে এটা কালকে করব।” কাল আবার বলে, “আরও একদিন পর।” এভাবেই দিন কেটে যায়। ফলস্বরূপ কাজ জমে যায় এবং শেষে চাপ বেড়ে যায়।
২. পরিকল্পনার অভাব:
কোনো পরিকল্পনা ছাড়া জীবন কাটানো মানে দিকনির্দেশনা ছাড়া নৌকা চালানো। বাতাস যেখানে নিয়ে যায়, সেখানে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
৩. অতিরিক্ত মোবাইল বা টিভি ব্যবহার:
আজকের দিনে সবচেয়ে বড় সময় নষ্ট করার যন্ত্র হলো মোবাইল ফোন। অযথা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, অথচ আমরা খেয়ালও করি না।
৪. না বলতে না পারা:
অনেক সময় আমরা নিজের অগ্রাধিকারের কাজ বাদ দিয়ে অন্যের ছোটখাটো অনুরোধে সময় নষ্ট করি। ফলে দিনের বড় অংশ অন্যকে খুশি করতে গিয়ে শেষ হয়ে যায়।
বাস্তব গল্প – আব্রাহাম লিঙ্কনের শিক্ষা
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন একবার বলেছিলেন—
“যদি আমাকে একটি গাছ কাটতে ৬ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়, আমি প্রথম ৪ ঘণ্টা কুড়াল ধার করতে ব্যয় করব।”
এ কথার মানে হলো—কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি নিতে হবে। এটাই সময় ব্যবস্থাপনার আসল পাঠ।
একজন সাধারণ ছাত্রের গল্প
কলকাতার সায়ন নামের এক সাধারণ কলেজ ছাত্রের জীবন থেকে আমরা বড় শিক্ষা নিতে পারি। সায়ন পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো ছিল, কিন্তু মোবাইল গেমস আর ইউটিউবে সময় নষ্ট করতে করতে পরীক্ষার আগে সবসময় চাপের মধ্যে পড়ে যেত। একবার তার শিক্ষক তাকে একটি ছোট পরামর্শ দেন—
“দিনে ২৪ ঘণ্টা সবার সমান। পার্থক্য শুধু তুমি সেই ২৪ ঘণ্টা কীভাবে ব্যবহার করছো।”
এই কথাটা সায়নের মাথায় গেঁথে যায়। সে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে পরের দিনের জন্য একটি টু-ডু লিস্ট বানাতে শুরু করে।
সকালে ২ ঘণ্টা শুধু পড়াশোনা
বিকেলে ১ ঘণ্টা শরীরচর্চা
৩০ মিনিট মোবাইল বিনোদন
বাকি সময় ক্লাস আর প্রজেক্ট
এই ছোট্ট অভ্যাস তার জীবন বদলে দেয়। কয়েক মাসের মধ্যে সে শুধু পরীক্ষায় ভালো করে না, বরং আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
এখান থেকে বোঝা যায়—সময় ব্যবস্থাপনা শুধু বড় বড় মানুষের নয়, একজন সাধারণ ছাত্রের জীবনেও বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
সময়ের শত্রু – অলসতার ফাঁদ
অলসতা বা Procrastination আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
আমরা কাজ শুরু করতে চাই, কিন্তু ভাবি “আরে, আরেকটু পরে।”
কাজ যত দেরি হয়, তত ভয় বেড়ে যায়।
শেষে যখন সময় একেবারেই ফুরিয়ে আসে, তখন তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে মান কমে যায়।
বাস্তব উদাহরণ:
ভারতের মহান বিজ্ঞানী ডঃ এ.পি.জে. আবদুল কালাম সবসময় বলতেন—“যা আজ করা সম্ভব, তা কাল পর্যন্ত ফেলে রেখো না।” তিনি যখন মিসাইল প্রোজেক্টে কাজ করছিলেন, তখন প্রতিদিনের প্রতিটি ঘণ্টা হিসাব করে কাজ করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—“অলসতা মানেই সুযোগ নষ্ট।”
সময় ব্যবস্থাপনার কিছু কৌশল
১. টু-ডু লিস্ট তৈরি করুন:
প্রতিদিন ঘুমানোর আগে পরের দিনের জন্য ছোট ছোট কাজের তালিকা লিখে ফেলুন। এতে মাথায় চাপ কমবে এবং কাজ স্পষ্ট হবে।
২. অগ্রাধিকার (Priority) ঠিক করুন:
সব কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন—পরীক্ষার আগে পড়া টিভি দেখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. Pomodoro টেকনিক ব্যবহার করুন:
২৫ মিনিট কাজ + ৫ মিনিট বিরতি। এতে মনোযোগ বাড়ে, কাজের ক্লান্তি কমে।
৪. ডিজিটাল ডিস্ট্র্যাকশন এড়ান:
সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য আলাদা সময় রাখুন। পড়াশোনা বা কাজের সময় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।
৫. ছোট পদক্ষেপ নিন:
একসাথে বড় কাজ করতে গেলে ভয় লাগে। বরং কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে করুন।
বাস্তব অনুপ্রেরণা – ধীরু ভাই আম্বানির গল্প
ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি ধীরু ভাই আম্বানি জীবনের শুরু করেছিলেন এক সাধারণ গ্যাস স্টেশনের কর্মচারী হিসেবে। খুব সামান্য বেতন পেতেন। কিন্তু তিনি কখনও সময় নষ্ট করতেন না। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি ব্যবসা শেখার পেছনে ব্যয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন—“ছোট ছোট সময়ের সঠিক ব্যবহারই বড় অর্জনের পথ।”
আজ তাঁর তৈরি Reliance শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে একটি বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান।
সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভাবি—“আমার তো সময় নেই।” কিন্তু আসলে সময় কারও নেই, আমরা তৈরি করি। যে মানুষ তার সময়কে সবচেয়ে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, সাফল্য তার কাছেই ধরা দেয়।