১
শুরুর কথা
ছোটবেলায় শুনতাম এমন একটি রোগ আছে যার নাম মধুমেহ। তখন মনে করতাম মানুষ বেশি বেশি মধু খেলে বোধহয় এই রোগটি হয়। তারপর শুনলাম এর আরেকটি নাম হচ্ছে বহুমূত্র রোগ। তখন ভাবতাম, এটা তাহলে মূত্রের সমস্যা জনিত কোনো রোগ। বড় হবার সাথে সাথে এই রোগটির নাম পাল্টে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে “সুগার”। ইংরেজিতে “ডায়াবেটিস”।
আজকের পৃথিবীতে সুগার বা ডায়াবেটিস শুধু একটি রোগের নাম নয়, এটি এক নীরব মহামারী। এটি এমন একটি মহামারী, যা প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনেই ছড়িয়ে পড়ছে— ঘরে ঘরে, পরিবারে পরিবারে। এক সময় যেটাকে “ধনী মানুষের রোগ” বলা হতো, আজ সেটাই আমাদের ভারতবর্ষকে বিশ্বের “ডায়াবেটিস রাজধানী” বানিয়ে ফেলেছে। বর্তমান সময়ের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট ৫৯০ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর শুধু আমাদের দেশেই ২২১ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত। পুরো পৃথিবীতে ডায়াবেটিক মানুষের সংখ্যা যেখানে ৭-৮%, সেখানে ২৫ শতাংশেরও বেশি ডায়াবেটিক মানুষের বসবাস আমাদের দেশেই। এই সংখ্যাটা যখন লেখা হচ্ছে, এর পর থেকেই সংখ্যাটা আবার পাল্টে যাচ্ছে। যদিও চীনের জনসংখ্যা আমাদের থেকে বেশি। কিন্তু সেই দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আমাদের থেকে অনেক কম, মাত্র ১৪০ মিলিয়ন।
আজকের পরিসংখ্যান বলছে— ভারতে আনুমানিক ১০ কোটির বেশি মানুষ বর্তমানে সুগারে আক্রান্ত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ আছেন যারা জানেনই না যে তাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে। কারণ তাঁরা নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করান না, বা প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে বুঝতে পারেন না বা গুরুত্ব দেন না। ফলে তাঁরা “প্রি-ডায়াবেটিস” বা “অজ্ঞাত ডায়াবেটিস” অবস্থায় থেকে গিয়ে অজান্তেই রোগটিকে শরীরের ভেতরে বাড়তে দিচ্ছেন।
চিকিৎসক ও গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন— যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যেই আমাদের দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুগারের কবলে পড়বেন। এর মানে, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অন্তত একজন হলেও ডায়াবেটিস রোগী থাকবেন। আর যদি অজ্ঞাত রোগীদের যোগ করা হয়, তবে সংখ্যাটা আরও ভয়াবহ হবে।
ভাবুন তো— একদিকে তরুণ প্রজন্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না, অন্যদিকে মধ্যবয়সীরা রোগের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। রোগের চিকিৎসার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ওষুধে, হাসপাতালে এবং রক্ত পরীক্ষায়। অথচ জীবনের আনন্দ, হাসি, উচ্ছ্বাস, প্রাণশক্তি— সব কিছুই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে এই মিষ্টি নামের তিক্ত রোগে।
কিন্তু আশা শেষ হয়ে যায়নি।
এখন আমরা জানি ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করাই যায় না শুধু, নিজের একাগ্রতা এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ লাইফস্টাইলের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নামক এই চক্রব্যূহের কবল থেকে মুক্তিও পাওয়া যায়।
শুধু প্রয়োজন— নলেজ, ডিসিপ্লিন আর সঠিক লাইফস্টাইল। নলেজ আমাদেরকে সুগারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সচেতনতা দেবে। আর এই সচেতনতাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
সঠিক জ্ঞান থাকলে, সময়মতো ব্যবস্থা নিলে, জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তন আনলে, আমরা চাইলেই এই রোগের অদৃশ্য শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারি।
এই বিষয় নিয়ে লেখার মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো সেই সচেতনতা সৃষ্টি করা, ডিসিপ্লিন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা, এবং একটি সঠিক লাইফস্টাইল প্রদান করা, যাতে আমরা নিজেরাই নিজেদের লাইফস্টাইল ঠিক করার মাধ্যমে মিষ্টি নামের এই তিক্ত রোগটিকে নিজের শরীর থেকে, নিজের পরিবার থেকে, সর্বোপরি নিজের দেশের পৃষ্ঠভূমি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে পারি।
এখানে ধাপে ধাপে আলোচনা করা হবে—
সুগার কী
সুগার বাড়ার প্রকৃত কারণ কী
সুপারের ফলে শরীরে কী কী ক্ষতি হয়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা কী
ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়ার মানে কী
প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীভাবে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ ও রিভার্স করা যায়
কেমনতর জীবনযাপন করলে কারোর কখনোই সুগার হবে না এবং আরও অনেক কিছু......!
এছাড়াও এখানে থাকবে থাকবে এমন কিছু হেলদি রান্নার রেসিপি, যেগুলো আপনার সুগার রিভার্সাল জার্নিকে করে তুলবে একদম পুষ্টিকর ও আনন্দময়।
আশা করি, এই লেখার প্রতিটি পর্ব পাঠকের মনে সঠিক জ্ঞানের আলো জ্বালাতে সক্ষম হবে। অজ্ঞতার অন্ধকারকে অপসারিত করে নতুন দীপ্তিতে জীবনের শক্তিকে ফিরিয়ে দেবে।
এই ধারাবাহিক লেখায় দেওয়া গাইডলাইন ফলো করে একদিন হয়তো আপনি নিজেই বলবেন—
“হ্যাঁ, আমি সুগারের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়েছি।”
এই বিশ্বাস, এই আশাই হলো আপনাদের কাছে আমার প্রথম অঙ্গীকার।
২
সুগার বা ডায়াবেটিস কী ?
রাজেশ নামের একজন সাধারণ মানুষ। বয়স ৩৮। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিনের ব্যস্ততা, অফিসের টেনশন, আরেকটু সময় বাঁচাতে ফাস্টফুডে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজের সম্পর্কে ভাবতেন—
“আমার তো কোনো সমস্যা নেই, আমি তো এখনও তরুণ, শরীরে শক্তিও আছে।”
কিন্তু একদিন অফিসের হেলথ চেকআপে দেখা গেল—
ফাস্টিং ব্লাড সুগার: 145 mg/dl
PPBS: 240 mg/dl
HbA1c: 7.8%
ডাক্তার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন— “আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।”
সেই মুহূর্তে রাজেশের ভেতর কেমন যেন এক ঝড় বয়ে গেল। হঠাৎ মনে হলো— জীবন থেমে যাবে নাকি ? এতদিন যে ইচ্ছে মতো খেয়েছেন, চলেছেন, সব শেষ ? মনে ভয় ঢুকে গেল—
“এবার বুঝি ইনসুলিন নিতে হবে সারাজীবন....! আমার আয়ু কি কমে যাবে ?”
এই প্রশ্নগুলোই প্রথমবার সুগার ধরা পড়া অধিকাংশ মানুষের মনে ঘুরপাক খায়।
কিন্তু আসল সত্য হলো— ডায়াবেটিস কোনো মরণব্যাধি নয়।
বরং এটা হলো আমাদের লাইফস্টাইলের একটি ব্যর্থতা বা ডিজঅর্ডার, যাকে আমরা ইংরেজি বর্ণমালার তিনটি অক্ষরের মাধ্যমে বদলাতে পারি।
K.D.L = Knowledge, Discipline & Lifestyle
Knowledge (জ্ঞান): সুগার সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে ভয় নয়, সমাধান খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।
Discipline (শৃঙ্খলা): সময়মতো খাওয়া-ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, রিপোর্ট টেস্ট করা— এগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন তৈরি করে।
Lifestyle (জীবনযাত্রা): খাদ্যাভ্যাস থেকে মানসিক চাপ— সবকিছুই আমাদের লাইফস্টাইল গড়ে তোলে। সঠিক লাইফস্টাইল মানেই সুগারের শিকল ভাঙা।
সুগার হচ্ছে আমাদের শরীরের প্রধান জ্বালানি। গাড়ি যেমন পেট্রোল, ডিজেলের জ্বালানি দিয়ে চলে, আমাদের দেহটাও সুগার বা গ্লুকোজ নামক জ্বালানি দিয়ে চলে।
খাদ্য হিসেবে আমরা যে সকল শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করি, সেগুলো ভেঙেই গ্লুকোজ তৈরি হয়। সেই গ্লুকোজ ইনসুলিন নামক হরমোনের সাহায্যে কোষের মধ্যে যায় এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে শক্তি উৎপাদন করে।
কোনো কারণে রক্তের গ্লুকোজ যদি কোষের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করতে না পারে তাহলে সেই গ্লুকোজ রক্তের মধ্যেই ঘুরতে থাকে। এই গ্লুকোজের মাত্রা যখন একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি হয়ে যায় তখন এটাকেই সুগার বলে সনাক্ত করা হয়।
সুগারের প্যারামিটারসমূহ
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার ব্যবহার করা হয়—
১. ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS):
স্বাভাবিক: 70–99 mg/dl
প্রিডায়াবেটিস: 100–125 mg/dl
ডায়াবেটিস: ≥126 mg/dl
২. পোস্ট-প্রান্ডিয়াল ব্লাড সুগার (PPBS):
স্বাভাবিক: <140 mg/dl
প্রিডায়াবেটিস: 140–199 mg/dl
ডায়াবেটিস: ≥200 mg/dl
৩. HBA1c (গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন):
স্বাভাবিক: <5.7%
প্রিডায়াবেটিস: 5.7%–6.4%
ডায়াবেটিস: ≥6.5%
HbA1c হলো ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি শুধু একদিনের রিপোর্ট নয়, বরং গত ৩ মাসের গড় অবস্থা দেখায়।
ডায়াবেটিস মূলতঃ দুই প্রকার। টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস:
এটি একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার।
শরীর ইনসুলিন তৈরিকারী কোষ ধ্বংস করে দেয়।
সাধারণত শিশু ও কিশোরদের মধ্যে দেখা যায়।
রোগীকে সারাজীবন ইনসুলিন নিতে হয়।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস:
এটি মূলতঃ লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার।
ইনসুলিন তৈরি হলেও শরীর সেটাকে ব্যবহার করতে পারে না (Insulin Resistance)।
অতিরিক্ত ওজন, ব্যায়ামের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাবার, মানসিক চাপ এটির মূল কারণ।
প্রায় ৯০% ডায়াবেটিস রোগী টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
এই বইয়ের ফোকাস: এই বইয়ে মূলতঃ টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়েই আলোচনা করা হবে। কারণ বিশ্বের ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী টাইপ ২-এ ভুগছেন। আর সুখবর হলো— টাইপ ২ ডায়াবেটিস অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ রিভার্স করা সম্ভব।
একসময় ডায়াবেটিসকে বলা হতো “বড়লোকদের রোগ।” কারণ, আগেকার দিনে যাদের হাতে টাকা থাকতো, তারাই বেশি বেশি খেত। সে হোক মিষ্টি, চাল-আটা বা মাংস। তারা পরিশ্রম করতো কম, গাড়ি-ঘোড়ায় চলাফেরা করতো, অলস জীবনযাপন করতো।
অন্যদিকে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুররা সারাদিন মাঠে কাজ করতো, প্রচুর কষ্ট করতো, ফলে তাদের শরীর সুগারকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ফেলতো— জমতে দিতো না।
এখান থেকেই প্রমাণিত হয়— সুগার কোনো রোগ নয়, বরং লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার।
আজকের দিনে ফাস্টফুড, সারাদিন বসে কাজ, টেনশন— এগুলোই আমাদের নতুন “বড়লোকদের জীবন” বানিয়ে দিয়েছে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো— ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। যখন আমরা বারবার অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খাই, শরীর প্রচুর ইনসুলিন নিঃসরণ করে। কিন্তু ধীরে ধীরে কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি অসংবেদনশীল হয়ে যায়।
এর ফলে—
রক্তের গ্লুকোজ সম্পূর্ণভাবে কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। মাত্রার অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তের মধ্যেই থেকে যায়।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে কোষের মধ্যে সুগার না ঢুকতে পারায় শরীরের কোষগুলো অপুষ্টির শিকার হয়ে হাহাকার করতে থাকে। ফলে বার বার ক্ষুধা লাগে।
ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করার জন্য মানুষ বেশি বেশি করে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খায়। আর যত বেশি কার্বোহাইড্রেট তত বেশি সুগার, যত বেশি সুগার তত বেশি ইনসুলিন। যত বেশি ইনসুলিন তত বেশি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। এভাবেই শরীরের মধ্যে একটা ডিজঅর্ডারের সার্কেল চলতে থাকে। ইনসুলিন লেভেল বাড়তেই থাকে। শরীরে চর্বি জমতে থাকে এবং একসময় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ভাঙার চাবিকাঠিই হলো সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, উপবাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন। ( এই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। )
কীভাবে বুঝবেন আপনার রক্তে সুগার বেড়েছে কিনা !
ডায়াবেটিস হঠাৎ করে আসে না। ধীরে ধীরে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা দেয়—
বার বার ক্ষিদে পাওয়া
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
অতিরিক্ত তৃষ্ণা পাওয়া
হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
ক্ষত শুকোতে দেরি হওয়া
চোখে ঝাপসা দেখা
এই লক্ষণগুলির মধ্যে যদি দুইটি বা তার বেশি কারো মধ্যে দেখা যায়, তাহলে একটুও দেরি না করে রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত। কারণ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, তত সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
তাহলে “সুগার কী” এই প্রশ্নের উত্তর হলো—
অন্যান্য রোগের মতো সুগার কোনো আলাদা রোগ নয়, বরং এটি একটি লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার, যার মূল কারণই হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
এবং এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান অস্ত্র হলো জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও সঠিক জীবনযাত্রা।
নিজেকে বদলাও— সুগার নিজে থেকেই তোমার জীবন থেকে সরে যাবে।
৩
টাইপ-২ ডায়াবেটিস আসলে কী ?
টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলো মূলত একটি "মেটাবলিক ডিসঅর্ডার" (শরীরের খাদ্য, বিশেষত কার্বোহাইড্রেট → গ্লুকোজ → শক্তিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার গণ্ডগোল)।
এখানে শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধী (insulin resistance) হয়ে যায়।
অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন বের হয় ঠিকই, কিন্তু কোষ সেটাকে গ্রহণ করতে চায় না। ফলে রক্তে শর্করা থেকে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে শরীরকে ভুল খাদ্য, অলস জীবনযাপন, অতিরিক্ত স্ট্রেস ও বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে রাখলে এই অবস্থা তৈরি হয়।
অর্থাৎ এটি সর্দি-কাশির মতো কোনো সংক্রমণজনিত রোগ নয়। বরং এটি এক ধরণের “লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার”।
তাহলে ওষুধ খেলেও কেন ভালো হয় না ?
ডায়াবেটিসের ওষুধ (বা ইনসুলিন ইনজেকশন) লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে, রোগের মূল কারণ নয়।
ওষুধের কাজ:
১. কেউ লিভারকে কম গ্লুকোজ ছাড়তে বলে।
২. কেউ কিডনিকে শর্করা বের করতে বাধ্য করে।
৩. কেউ ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কিছুটা বাড়ায়।
৪. কেউ পাকস্থলীর খাবার হজম ধীরে করে।
এগুলো সবই “ম্যানেজমেন্ট” — কিন্তু মূল সমস্যা (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, ফ্যাটি লিভার, ক্ষতিগ্রস্ত গাট মাইক্রোবায়োম, অতিরিক্ত ভিসেরাল ফ্যাট) ঠিক করে না।
তাহলে আসলে একে কীভাবে দেখা উচিত ?
টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে “রোগ” না বলে বরং একটি অবস্থা (condition) বলা অনেক বেশি যৌক্তিক।
যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা স্থূলতা — এগুলো কোনো ভাইরাসের মতো হঠাৎ আসা রোগ নয়, বরং জীবনযাপনের কারণে তৈরি হওয়া বিপর্যস্ত অবস্থা।
ডায়াবেটিসকে কি রিভার্স করা সম্ভব ?
বেশ কিছু গবেষণা ও প্রমাণ বলছে, যদি কেউ—
সঠিক ডায়েট (low refined carb, anti-inflammatory food),
ওজন কমানো ও ভিসেরাল ফ্যাট কমানো,
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা দীর্ঘ ফাস্টিং,
ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম,
স্ট্রেস কন্ট্রোল ও গাট হেলথ ঠিক রাখা,
— এগুলো নিয়মিত করে, তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস পুরোপুরি রিভার্স করা সম্ভব।
অর্থাৎ ওষুধ ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে রক্তের মধ্যে শর্করার মাত্রা বজায় রাখা যায়।
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে ?
টাইপ-২ ডায়াবেটিস আসলেই কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি জীবনযাপনজনিত অবস্থা।
ওষুধ কেবল এর লক্ষণগুলোকে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু মূল কারণ (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও মেটাবলিক ক্ষতি) দূর করে না।
জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমেই এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
৪
সুগার বা ডায়াবেটিস কেন হয় ?
ডায়াবেটিস আজ আর শুধু একটি রোগ নয়—এটি আধুনিক সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ।
আজকাল প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একজন না একজনকে এই রোগে ভুগতে দেখা যায়।
অনেকে ভাবে—
“শুধু বেশি মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হয়।”
আবার কারও ধারণা—
“পরিবারে কারও ডায়াবেটিস থাকলে এটা এড়ানো যায় না, কারণ এটা বংশগত।”
আসলে এগুলো আংশিক সত্য হলেও পুরো ছবিটা নয়।
ডায়াবেটিস হঠাৎ করে একদিনে হয় না।
বরং বছরের পর বছর ধরে শরীরের ভেতরে চলতে থাকা ভুল অভ্যাস, খাদ্য, মানসিক চাপ আর জীবনযাত্রার গোলমাল ধীরে ধীরে এই রোগকে ডেকে আনে।
এটিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য আমাদের গভীরে যেতে হবে।
কারণ, ডায়াবেটিস হলো বহু স্তরের জটিল সমস্যা।
কেবল “চিনি খাওয়া” বা “বংশগত” বললে মূল সত্য আড়াল হয়ে যায়।
ডায়াবেটিসের আসল কারণগুলো হলো—
১. গাট বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়া (Microbiome imbalance)
২. শ্লো মেটাবলিজম বা ধীর বিপাকক্রিয়া
৩. ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স
৪. মানসিক চাপ বা স্ট্রেস
৫. ভুল খাদ্যাভ্যাস
৬. স্লিপ ডিজঅর্ডার বা অনিয়মিত ঘুম
৭. বংশগতিকে ট্রিগার করার মতো জীবনযাপন
৮. ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন বা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ
৯. টক্সিন ও দূষণ (Pollution)
১০. ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি (বিশেষত ভিটামিন D, ম্যাগনেসিয়াম, ক্রোমিয়াম)
১১. শারীরিক কার্যকলাপের অভাব (Sedentary lifestyle)
১২. হরমোনাল ইমব্যালান্স (থাইরয়েড, PCOS, মেনোপজ ইত্যাদি)
১৩. বয়সজনিত দুর্বলতা (Aging factor)
১৪. কিছু ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
এই চৌদ্দটি কারণ বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে আমাদের শরীরকে ক্ষয় করে।
কিছু কারণ আমরা নিজেরাই তৈরি করি, কিছু আবার আসে পরিবেশ ও বয়সের প্রভাবে।
তাহলে কি মুক্তি সম্ভব ?
উত্তর হলো—অবশ্যই সম্ভব।
কিন্তু তার জন্য দরকার প্রথমে আসল কারণগুলো জানা।
যতদিন না আমরা বুঝতে পারছি কেন এই রোগ হলো,
ততদিন এর থেকে মুক্তি পাওয়াও প্রায় অসম্ভব।
অতএব—
ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি চাইলে,
প্রথমে জানতে হবে ডায়াবেটিস কেন হয়।
আমরা যদি বুঝতে পারি কোথায় কোথায় ভুল করছি,
তাহলেই সচেতনভাবে আমাদের জীবনযাত্রা বদলানো সম্ভব হবে।
আর সেই পরিবর্তনই আমাদের মুক্তি দেবে
“সুগার” নামের এই নীরব ঘাতকের অভিশাপ থেকে।
আজ থেকে আমরা একে একে এই কারণগুলো গভীরভাবে জানব।
প্রথমেই শুরু করব গাট হেলথ বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে—
কারণ শরীরের প্রায় সব সমস্যার মূল শিকড় লুকিয়ে আছে সেখানেই।