দ্বিতীয় অধ্যায়
১
ডায়াবেটিস শরীরের উপর কী প্রভাব ফেলে ?
ডায়াবেটিস – শরীরের নিঃশব্দ শত্রু
ডায়াবেটিস মানে শুধু রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়া নয়।
এটি এমন এক নিঃশব্দ রোগ, যা ধীরে ধীরে শরীরের ভেতরের প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রথম দিকে বোঝা যায় না, তাই অনেকে এটাকে হালকাভাবে নেন।
কিন্তু বছর ঘুরতে ঘুরতে এর ফল হয় ভয়ঙ্কর।
ডায়াবেটিস কীভাবে ক্ষতি করে ?
স্নায়ু (Nerves): রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ স্নায়ুর চারপাশে জমে গিয়ে সংকেত পৌঁছানো বন্ধ করে দেয় → হাত–পা ঝিনঝিনি, অবশ ভাব, ব্যথা।
কিডনি (Kidneys): কিডনির ফিল্টার নষ্ট হয়ে প্রস্রাবে প্রোটিন চলে আসে → কিডনি ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে।
চোখ (Eyes): রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তনালী দুর্বল হয়ে ঝাপসা দেখা শুরু হয় → অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
হার্ট ও রক্তনালী (Heart & Vessels): ধমনী শক্ত হয়ে যায়, ফ্যাটি প্লাক জমে → হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
মস্তিষ্ক (Brain): ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স মস্তিষ্কেও আঘাত করে → ভুলে যাওয়া, ডিমেনশিয়া, টাইপ–৩ ডায়াবেটিস।
পা (Feet): স্নায়ু ক্ষতি ও রক্ত চলাচল কমে গেলে ছোট্ট কাটা–ঘা বড় হয়ে যায় → অনেক সময় অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়।
কেন এটাকে “Silent Killer” বলা হয়?
কারণ শুরুতে কোনো বড় লক্ষণ থাকে না।
হালকা ঝিনঝিনি, সামান্য ঝাপসা দেখা, একটু ক্লান্তি— এগুলোকে আমরা গুরুত্ব দিই না।
কিন্তু আসল ক্ষতি চলতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
একদিন হঠাৎ দেখা যায়— কিডনি অকার্যকর, চোখে আলো নেই, হার্ট অ্যাটাক হলো।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গগুলো
১. স্নায়ু → ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি
২. কিডনি → ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি
৩. চোখ → ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
৪. হার্ট ও রক্তনালী → কার্ডিওভাসকুলার ডিজঅর্ডার
৫. মস্তিষ্ক → কগনিটিভ ডিসঅর্ডার / টাইপ–৩ ডায়াবেটিস
৬. পা → ডায়াবেটিক ফুট
৭. ওয়েট লস বা ওজন কমে যাওয়া
৮. যৌন অক্ষমতা
ডায়াবেটিসকে অবহেলা করা মানেই শরীরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া।
কিন্তু আশার কথা হলো—
আমরা যদি আজ থেকেই সচেতন হই, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনি,
তাহলে এই নীরব শত্রুর আক্রমণকে অনেকটাই প্রতিহত সম্ভব।
ডায়াবেটিস শুধু “সুগার বেড়ে গেছে” এই কথায় সীমাবদ্ধ নয়।
এটি হলো এক নীরব দানব, যে ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে খেয়ে ফেলে।
আর তাই আমাদের লড়াই শুধু সুগারের সংখ্যার বিরুদ্ধে নয়,
বরং সেই সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অঙ্গগুলোর সুরক্ষার জন্যও।
এই অধ্যায়ে আমরা জানতে পারব ডায়াবেটিস আমাদের শরীরের উপর কী ধরণের প্রভাব বিস্তার করে এবং কী কী ক্ষতি করে। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে শত্রুর শক্তি সম্পর্কেও অবগত থাকা প্রয়োজন।
২
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি মানেই স্নায়ুর ক্ষতি। এই বিষয়ে আলোচনা করার আগে জানতে হবে স্নায়ু কী জিনিস এবং মানবদেহে এর কার্যকারিতা কী !
স্নায়ু (Nerve) হচ্ছে এক ধরনের তারের মতো গঠন, যা মূলত স্নায়ুতন্তু (nerve fibers) দিয়ে তৈরি। এগুলো আসলে আমাদের মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে একে অপরের সঙ্গে সংযোগ করে রাখে।
যেমন বিদ্যুতের তার বিদ্যুৎকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়, তেমনি স্নায়ু আমাদের শরীরে সংকেত (signals) বহন করে।
স্নায়ুর মূল উপাদান
স্নায়ু গঠিত হয় নিউরন (Neuron) নামের বিশেষ কোষ দিয়ে।
প্রতিটি নিউরনের থাকে —
ডেনড্রাইট (Dendrite) → তথ্য গ্রহণ করে
অ্যাক্সন (Axon) → তথ্য অন্য কোষে পৌঁছে দেয়
সেল বডি (Cell body) → শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র
শরীরে স্নায়ুর কাজ
১. সংকেত বহন করা – মস্তিষ্ক ও শরীরের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করা।
যেমন তুমি যদি গরম কিছুকে স্পর্শ করো, সাথে সাথে হাত সরিয়ে নাও → এই দ্রুত প্রতিক্রিয়ার কারণ স্নায়ু।
২. ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি – চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক থেকে প্রাপ্ত তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছে দেওয়া।
যেমন আলো দেখলে "দেখা" অনুভূতি পাও, কারণ চোখের স্নায়ু তথ্য পাঠাচ্ছে।
৩. পেশী চালানো – মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ গিয়ে পেশী নড়াচড়া করে।
যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, কথা বলা—সবই স্নায়ুর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত।
৪. স্বয়ংক্রিয় কাজ – হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস, হজম প্রক্রিয়া ইত্যাদি অটোনমিক স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে, যা আমাদের সচেতনভাবে ভাবতে হয় না।
৫. সমন্বয় – শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে একসঙ্গে সঠিকভাবে কাজ করাতে স্নায়ু মূল ভূমিকা পালন করে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে স্নায়ু হলো শরীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। মস্তিষ্ক হলো “কেন্দ্রীয় কম্পিউটার” আর স্নায়ু হলো সেই কম্পিউটারের তার, যার মাধ্যমে সব আদেশ ও তথ্য শরীরের প্রতিটি কোণে পৌঁছায়।
৩
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি কী ?
কখনো খেয়াল করেছেন, আপনার আশেপাশে অনেক ডায়াবেটিস রোগীর পা কেটে ফেলা হয়েছে ?
হয়তো ভাবেন—“এমনটা কেন হয় ?”
উত্তর হলো—ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি, অর্থাৎ স্নায়ুর ক্ষতি।
আমাদের শরীরে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার লম্বা স্নায়ুর জাল ছড়িয়ে আছে।
এই স্নায়ুই মস্তিষ্কের বার্তা পৌঁছে দেয় শরীরের প্রতিটি অঙ্গে।
কোথাও ব্যথা, গরম–ঠান্ডা বা চাপ পড়লে স্নায়ুই প্রথম খবর দেয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন রক্তে অতিরিক্ত শর্করা থাকলে এই স্নায়ুর জাল ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এটাকেই বলা হয় ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি।
কীভাবে হয় এই ক্ষতি ?
১. রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমে → স্নায়ুর চারপাশে বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকে।
২. স্নায়ু ফুলে গিয়ে সংকেত পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হয়।
৩. স্নায়ুকে পুষ্টি দেওয়ার ক্ষুদ্র রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪. ধীরে ধীরে স্নায়ু দুর্বল হয়ে অবশ বা বিকল হতে শুরু করে।
লক্ষণ:
হাত–পায়ে ঝিনঝিনি বা অবশ ভাব
পায়ে জ্বালা বা সুচ ফোটার মতো ব্যথা
রাতে পা অস্বাভাবিক গরম বা ঠান্ডা লাগা
গরম জল বা ধারালো কিছু লাগলেও টের না পাওয়া
হাঁটার সময় ভারসাম্য হারানো
পায়ের ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
পুরুষদের যৌনশক্তি হ্রাস
হজমের সমস্যা (পেটের স্নায়ু আক্রান্ত হলে)
কেন এত ভয়ঙ্কর ?
সবচেয়ে বড় বিপদ হলো—পায়ের অনুভূতি কমে যাওয়া।
ফলে পায়ে ছোট্ট কেটে গেলেও রোগী টের পান না।
ঘা বড় হতে হতে সংক্রমণ ছড়ায়, অনেক সময় পা কেটে ফেলতে হয়।
বাস্তব উদাহরণ:
সেলিমবাবুর বয়স পঞ্চান্ন। পেশায় ট্যাক্সি চালক।
অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু ওষুধ খাওয়া আর নিয়মিত টেস্ট করার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন।
একদিন জুতো ঘষে পায়ে ফোসকা হলো। তিনি গুরুত্ব দিলেন না।
কারণ স্নায়ু প্রায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল, তাই ব্যথা টের পেলেন না।
কয়েক দিনের মধ্যে সেই ফোসকা বড় ক্ষতে পরিণত হলো।
সংক্রমণ এতটাই ছড়াল যে আঙুলে গ্যাংগ্রিন শুরু হলো।
শেষমেশ ডাক্তাররা বললেন—“এখন আর কোনো উপায় নেই, আঙুল কেটে ফেলতেই হবে।”
আজ সেলিমবাবু হাঁটেন লাঠির ভরসায়।
তিনি আফসোস করে বলেন—
“যদি সময়মতো সুগার কন্ট্রোল করতাম, প্রতিদিন পা চেক করতাম, তবে হয়তো আজও নিজের পায়ে হেঁটে চলতে পারতাম।”
কারা বেশি ঝুঁকিতে ?
বহুদিন ধরে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস
উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল
ধূমপান ও অ্যালকোহল অভ্যাস
অলস জীবনযাপন
ভিটামিন B12 বা D ঘাটতি
প্রতিরোধ করবেন কীভাবে ?
২. সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা → HbA1c ৬.৫–৭%
২. নিয়মিত ব্যায়াম → রক্ত চলাচল বাড়ায়
৩. প্রতিদিন পা ধোয়া, শুকানো, ক্ষত খুঁজে দেখা
৪. আরামদায়ক পরিষ্কার জুতো ব্যবহার
৫. ভিটামিন B1, B6, B12 নিয়মিত গ্রহণ
৬. ধূমপান–অ্যালকোহল সম্পূর্ণ বাদ
৭. পর্যাপ্ত ঘুম ও স্ট্রেস কমানো
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রথমে সামান্য ঝিনঝিনি বা জ্বালা মনে হলেও, পরে তা অঙ্গহানির মতো ভয়ঙ্কর পরিণতিতে পৌঁছাতে পারে।
তবে আশার কথা হলো—
সময়মতো সতর্ক হলে, শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখলে, সঠিক খাবার–ব্যায়াম–ঘুম মানলে, এই বিপদকে অনেকটাই ঠেকানো যায়।
স্নায়ু একবার নষ্ট হলে আর ফেরানো যায় না,
কিন্তু চাইলে একে আগেই রক্ষা করা যায়।
৩
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি – কিডনির ক্ষতি
হয়তো খেয়াল করেছেন, কারও ব্লাড রিপোর্টে “ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গেছে” লিখলেই পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ?
অনেকে ভাবে— “ক্রিয়েটিনিন বাড়লেই বুঝি কিডনি নষ্ট।”
আসলে বিষয়টা এতটা সরল নয়।
ক্রিয়েটিনিন হলো পেশী থেকে বের হওয়া একটি বর্জ্য পদার্থ, যা কিডনি প্রতিদিন ফিল্টার করে বের করে দেয়।
কিন্তু কিডনির ক্ষতি অনেক সময় শুরু হয় তার বহু আগেই, যখন তখনো ক্রিয়েটিনিন রিপোর্ট একদম স্বাভাবিক থাকে।
এই নীরব ক্ষতির অন্যতম বড় কারণ হলো ডায়াবেটিস।
কিডনির কাজ আসলে কী ?
আমাদের প্রতিটি কিডনিতে আছে প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র ফিল্টার, যাদের বলা হয় নেফ্রন।
তাদের কাজ হলো—
রক্ত থেকে টক্সিন ও বর্জ্য বের করে দেওয়া
শরীরের লবণ জল ও খনিজের ভারসাম্য রাখা
ভিটামিন D সক্রিয় করা
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
অর্থাৎ কিডনি কেবল প্রস্রাবই তৈরি করে না, বরং পুরো শরীরের সুস্থতা রক্ষার আসল সৈনিক।
কীভাবে ডায়াবেটিস কিডনিকে নষ্ট করে ?
১. উচ্চ রক্তে শর্করা কিডনির সূক্ষ্ম ফিল্টারের দেয়াল পুরু করে তোলে, কখনো আবার ফেটে দেয়।
২. এর ফলে প্রস্রাবে প্রোটিন বের হতে শুরু করে – যাকে বলে প্রোটিনিউরিয়া।
৩. দীর্ঘদিন ধরে এই চাপ চলতে থাকলে নেফ্রনগুলো অকেজো হয়ে যায়।
৪. পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও প্রদাহ কিডনির ক্ষতি আরও দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
লক্ষণ – কেন একে “Silent Damage” বলা হয় ?
শুরুর দিকে একেবারেই কোনো লক্ষণ থাকে না।
রোগী ভাবে— “আমার তো শরীর ভালোই আছে।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে নেফ্রনগুলো একে একে মারা যেতে থাকে।
যখন লক্ষণ ধরা পড়ে, তখন ক্ষতি অনেকটাই হয়ে গেছে—
প্রস্রাবে ফেনা (প্রোটিন লিকেজ)
মুখ ও পা ফুলে যাওয়া
প্রস্রাব কমে যাওয়া
সারাক্ষণ ক্লান্তি লাগা
রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
ক্ষুধামন্দা ও বমিভাব
শেষ পর্যায়ে এসে রোগীকে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ডায়ালাইসিস – এক কঠিন বাস্তবতা
ডায়ালাইসিস মানে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো।
সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে মেশিনে রক্ত পরিশোধন করতে হয়।
এটি শারীরিকভাবে ভীষণ কষ্টকর
মানসিকভাবে ক্লান্তিকর
আর্থিকভাবে অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়
তবুও হাজার হাজার মানুষ আজ বেঁচে আছেন কেবল ডায়ালাইসিসের উপর ভর করে।
এটাই প্রমাণ করে— কিডনি একবার নষ্ট হয়ে গেলে জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।
ক্রিয়েটিনিন কেন যথেষ্ট নয় ?
মানুষ ভাবে— “ক্রিয়েটিনিন বাড়লেই কিডনি খারাপ।”
কিন্তু কিডনি অর্ধেকের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত অনেক সময় ক্রিয়েটিনিন বাড়েই না।
অর্থাৎ আপনি যখন প্রথম দেখলেন—“ক্রিয়েটিনিন ২.০ mg/dl”, তখন হয়তো কিডনির প্রায় অর্ধেক কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
তাই আগেভাগে ধরতে হলে দরকার—
মাইক্রোঅ্যালবুমিন টেস্ট (প্রস্রাবে প্রোটিন লিকেজের সূক্ষ্ম চিহ্ন দেখায়)
নিয়মিত ইউরিন রুটিন পরীক্ষা
কারা বেশি ঝুঁকিতে ?
বহু বছর ধরে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস রোগী
উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতা যাদের আছে
ধূমপায়ী ও অ্যালকোহল সেবনকারী
পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে
প্রতিরোধ ও যত্ন
১. সুগার নিয়ন্ত্রণ: HbA1c ৬.৫–৭% রাখা
২. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: ১৩০/৮০ mmHg এর নিচে
৩. প্রস্রাব পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার মাইক্রোঅ্যালবুমিন
৪. খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিন ও লবণ কমানো
৫. পর্যাপ্ত জল: তবে হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী
৬. ওষুধে সতর্কতা: পেইনকিলার (NSAID) বা এলোমেলো ওষুধ দীর্ঘদিন খাওয়া এড়িয়ে চলা
৭. ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দেওয়া
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হলো এমন এক নীরব ঘাতক, যে অনেক সময় ক্রিয়েটিনিন রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে কিডনিকে খেয়ে ফেলে।
আর একবার কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস বা প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকে না।
তাই শুধু রিপোর্টের উপর নির্ভর নয়, নিয়মিত চেকআপ আর সচেতন জীবনযাপনই পারে কিডনিকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে।
৪
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি – চোখের ক্ষতি
লক্ষ্য করে দেখবেন— আপনার চারপাশে কত মানুষ চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পান না, কারও চোখে কুয়াশা নেমে আসে, আবার কেউ বা রাত্রে গাড়ি চালাতে ভয় পান।
অনেক সময় আমরা ভাবি— “বয়স তো হয়েছে, চোখ ঝাঁপসা হবেই।” কিন্তু আসল সত্য হলো— ডায়াবেটিসই নীরবে আমাদের চোখের আলো নিভিয়ে দিতে থাকে।
রেটিনা – চোখের প্রাণকেন্দ্র
আমাদের চোখের ভেতরে একটি সূক্ষ্ম পর্দা আছে, নাম রেটিনা।
ক্যামেরার ফিল্ম যেমন ছবি তোলে, রেটিনাও তেমনি বাইরের আলোকে ধরে নিয়ে মস্তিষ্কে পাঠায়। এই রেটিনার স্বাস্থ্যই নির্ধারণ করে আমরা পৃথিবীটাকে কতটা পরিষ্কার দেখতে পাব।
কীভাবে ডায়াবেটিস রেটিনাকে নষ্ট করে ?
দীর্ঘদিন রক্তে শর্করা বেড়ে থাকলে—
১. চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালী ফুলে গিয়ে দুর্বল হয়ে যায়।
২. রক্ত ও তরল পদার্থ বের হয়ে রেটিনায় জমে → ফোলা ও ক্ষত তৈরি হয়।
৩. নতুন অস্বাভাবিক রক্তনালী গজায়, কিন্তু এগুলো ভীষণ ভঙ্গুর → ভেঙে রক্তক্ষরণ হয়।
৪. ধীরে ধীরে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় → দৃষ্টি ঝাপসা, অবশেষে অন্ধত্ব।
চুয়াল্লিশ বছরের সুবীরবাবু সব সময় ভাবতেন— “আমার তো শুধু সুগার একটু বেশি, ওষুধ খাই, বড় কিছু হবে না।”
কিন্তু একদিন সকালে পত্রিকা পড়তে গিয়ে অক্ষরগুলো ঝাঁপসা লাগতে শুরু করল। রাতে গাড়ি চালানোর সময় রাস্তার আলোও যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। চোখের ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারলেন— ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।
এই মুহূর্তে সঠিক চিকিৎসা না করলে তার চোখের আলো সম্পূর্ণ নেভে যেতে পারত।
লক্ষণ – শুরুতে নীরব, পরে ভয়ঙ্কর
প্রথম দিকে কোনো লক্ষণই থাকে না। তাই একে বলা হয় Silent Thief of Sight।
তবে পরে দেখা দেয়—
চোখে ঝাপসা দেখা
সামনে ভাসমান কালো দাগ (Floaters)
রাতে গাড়ি চালাতে কষ্ট হওয়া
হঠাৎ চোখে রক্তপাত
পড়তে বা লিখতে অসুবিধা
কারা বেশি ঝুঁকিতে ?
বহু বছর ধরে যাদের সুগার নিয়ন্ত্রণে নেই
যাদের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বেশি
ধূমপায়ী ও অলস জীবনযাপনকারীরা
গর্ভবতী ডায়াবেটিক নারী
প্রতিরোধ ও যত্ন
১. সুগার কন্ট্রোল – HbA1c ৬.৫–৭% এর মধ্যে রাখুন।
২. চোখ পরীক্ষা – প্রতি বছর একবার বিশেষজ্ঞের কাছে ডাইলেটেড আই এক্সাম করান।
৩. চাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ – রেটিনার রক্তনালী সুরক্ষিত থাকে।
৪. লাইফস্টাইল পরিবর্তন – ধূমপান–অ্যালকোহল বাদ, নিয়মিত ব্যায়াম।
৫. চিকিৎসা – প্রয়োজনে লেজার থেরাপি, ইনজেকশন বা অপারেশন করা হয়।
চোখ হলো আমাদের প্রাণের আলো।
ডায়াবেটিস সেই আলো নিভিয়ে দিতে পারে— কিন্তু আপনি চাইলে এই বিপদকে রুখতে পারবেন। নিয়মিত পরীক্ষা, সচেতনতা ও সঠিক জীবনযাপনই পারে চোখকে বহু বছর সুস্থ রাখতে।
মনে রাখবেন, “ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ মানে শুধু রক্তের রিপোর্ট ভালো রাখা নয়, চোখের আলোও বাঁচিয়ে রাখা।”
৫
ডায়াবেটিক কার্ডিওভাসকুলার ডিজঅর্ডার – হৃদয়ের নীরব খুনি
সুগারকে আমরা সাধারণত শুধু “রক্তের শর্করা বেড়ে যাওয়া” বলে হালকা করে দেখি।
কিন্তু আসল সত্য হলো—এটি নীরবে আমাদের প্রাণের কেন্দ্র হৃদয়কে আঘাত করতে থাকে।
চোখের আলো নিভে গেলে মানুষ কষ্ট পায়, কিডনি বিকল হলে যন্ত্রণা হয়, কিন্তু হৃদয় একবার থেমে গেলে সব শেষ।
ডায়াবেটিস সেই হৃদয়কেই ধীরে ধীরে নিঃশব্দে দুর্বল করে দেয়।
কেন হৃদয় এত বিপদে পড়ে ?
১. ধমনীর দেয়ালে ক্ষত
রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রতিদিন ধমনীর ভেতরে অদৃশ্য আঁচড় কাটতে থাকে। বছর ঘুরতে ঘুরতে দেয়াল শক্ত ও সরু হয়ে যায়।
২. চর্বি জমে ব্লক
চিনি ও ফ্যাটের বোঝা নিয়ে ধমনীর ভেতর জমে যায় মারাত্মক প্লাক। একসময় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক।
৩. রক্ত ঘন হয়ে ক্লট জমে
উচ্চ শর্করা রক্তকে আঠালো করে তোলে। সামান্য ক্লটই তখন প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়।
৪. হৃদপিণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে
দিনের পর দিন এই অতিরিক্ত চাপ টেনে একসময় হৃদপিণ্ড হার মানে— শুরু হয় হার্ট ফেইলিউর।
মফস্বলের স্কুলশিক্ষক রমেশবাবু বছর দশেক ধরে সুগারে ভুগছিলেন।
ওষুধ খেতেন নিয়ম করে, কিন্তু ডায়েট–ব্যায়াম–ঘুমের দিকে তেমন নজর দেননি।
ভাবতেন—“যতদিন রিপোর্টে বড় অংকের সমস্যা না আসে, ততদিন কিছু হবে না।”
কিন্তু এক ভোরে হঠাৎ বুকের বাম দিকে প্রবল ব্যথা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
ডাক্তার জানালেন—তিনটি ধমনী ৯০% পর্যন্ত ব্লক।
সামনের টেবিলে বসা ডাক্তার বললেন, “এখনই বাইপাস না করলে বাঁচানো কঠিন।”
রমেশবাবু বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেললেন—
“আমি যদি আগে একটু সচেতন হতাম, হয়তো আজ এ পর্যায়ে আসত না।”
এই গল্প শুধু রমেশবাবুর নয়—এটা হাজারো মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
কী ধরনের সমস্যা হয় ?
করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD): ধমনীর ব্লক → বুক ব্যথা, এনজাইনা, হার্ট অ্যাটাক।
হার্ট ফেইলিউর: হৃদপিণ্ড দুর্বল → শ্বাসকষ্ট, অবসাদ, হাত–পা ফুলে যাওয়া।
স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ → পক্ষাঘাত, কথা আটকে যাওয়া।
পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD): হাত–পায়ে রক্ত না পৌঁছানো → ক্ষত শুকাতে দেরি, কখনো অঙ্গ কেটে ফেলার পরিস্থিতি।
হৃদয়কে বাঁচানোর পথ
১. সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা – HbA1c ৬.৫–৭%।
২. রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমানো – ১৩০/৮০ এর নিচে চাপ, এলডিএল যত কম তত ভালো।
৩. খাবারের পরিবর্তন – ভাত, রুটি, আলু কমিয়ে আঁশযুক্ত খাবার, মাছ, বাদাম।
৪. শরীরচর্চা – প্রতিদিন হাঁটা, যোগব্যায়াম।
৫. ধূমপান–অ্যালকোহল ছাড়া – এগুলো হৃদয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু।
৬. স্ট্রেস–ঘুম নিয়ন্ত্রণ – কর্টিসল কমালে হৃদয়ও স্বস্তি পায়।
৭. নিয়মিত চেকআপ – ইসিজি, ইকো, লিপিড প্রোফাইল বছরে অন্তত একবার।
হৃদয় আমাদের প্রাণের ইঞ্জিন।
ডায়াবেটিস সেই ইঞ্জিনকে নিঃশব্দে মরচে ধরিয়ে দেয়।
যেদিন সেটা থেমে যায়, সেদিনই থেমে যায় আমাদের জীবন।
কিন্তু এই ভাগ্য আমরা নিজেরাই বদলাতে পারি।
আজ যদি আমরা ঠিক করি—
“আমি সুগারকে অবহেলা করব না, আমার হৃদয়কে বাঁচাবো,”
তাহলেই ডায়াবেটিস আর আমাদের হারাতে পারবে না।
কারণ জীবনটা খুবই মূল্যবান।
হৃদয়ের স্পন্দন যদি বাঁচে, তবেই বাঁচবে আমাদের স্বপ্ন, আমাদের প্রিয়জন, আমাদের আগামী।