চতুর্থ অধ্যায় : সমাজ ও সংগ্রামের পথচলা
নতুন ভোর, নতুন চিন্তা
মেলায় প্রতিজ্ঞা করার পর কৃষ্ণপদের মনে এক অদম্য শক্তি তৈরি হয়েছিল। ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই সে ভাবতে লাগল—
“আমাদের সমাজের অবস্থা কেন এমন? আমরা কেন পিছিয়ে আছি? এর কারণ হলো অশিক্ষা। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নেই। তাহলে আমাদের প্রথম কাজই হবে শিক্ষা।”
সে চোখের সামনে কল্পনা করল গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের, যারা সারাদিন মাঠে ছুটে বেড়ায়, কিন্তু খাতা-কলমের ছোঁয়া পায় না। কৃষ্ণপদ বুঝল—এদের জীবনেই প্রথম আলো জ্বালাতে হবে।
গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে আলাপ
এক দুপুরে কৃষ্ণপদ কয়েকজন সমবয়সী যুবককে ডেকে বটতলায় বসল। তাদের মধ্যে ছিল রমেশ, নিতাই, হরিদাস আর বিনোদ।
কৃষ্ণপদ বলল—
“শোন, ভাইরা। আমরা কি গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতে পারি না? একটু অক্ষর চিনতে শেখাই, হিসেব-নিকেশ শেখাই। এতে ওরা বদলাবে।”
রমেশ একটু অবাক হয়ে বলল—
“কিন্তু কৃষ্ণপদ, এসব করলে তো সময় নষ্ট হবে। জমিতে কাজ করবে কে?”
কৃষ্ণপদ গম্ভীর স্বরে বলল—
“জমির কাজ তো আমরা করবই। কিন্তু শিক্ষা ছাড়া আমাদের জাত চিরকাল পিছিয়ে থাকবে। আমরা চাইলে এক ঘণ্টা সময় দিতে পারি। এতে পেটের ভাত কমবে না।”
নিতাই ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল—
“ঠিক বলেছিস। চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?”
শেষে চারজনই রাজি হলো কৃষ্ণপদের উদ্যোগে সঙ্গী হতে।
সমাজের বিদ্রূপ
কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী কিছু মানুষ খবর পেয়ে হাসাহাসি শুরু করল।
একজন ঠাট্টা করে বলল—
“হা হা হা! আমাদের জাতের ছেলে-মেয়েরা পড়ে কী হবে? ওরা কি বড়বাবু হবে?”
আরেকজন বিদ্রূপ করে বলল—
“কৃষ্ণপদ তো গিয়ে মহাজাগরণ থেকে নতুন বিদ্যা শিখে এসেছে। এবার সে গুরু হবে, তাই না?”
কিছু লোক সরাসরি হুমকি দিল—
“দেখো কৃষ্ণপদ, এসব করলে গ্রামে বিভ্রাট হবে। ভালো করে ভেবে করো।”
কৃষ্ণপদের বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে মনে মনে গুরুচাঁদের বাণী আওড়াল—
“শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নেই।”
এই বাণী তার সাহস বাড়িয়ে দিল।
পাঠশালার সূচনা
একদিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণপদ বটতলার নিচে একটা পুরনো মাদুর বিছিয়ে দিল। পাশে কয়েকটা পুরনো খাতা আর কাঠের খড়ি রাখল।
কিছু বাচ্চাকে ডেকে আনল—
“এসো রে, অক্ষর শেখাব।”
শুরু হলো গ্রামের প্রথম পাঠশালা।
বাচ্চারা ভয়ে ভয়ে বসে খড়ি হাতে নিল। কৃষ্ণপদ তাদের শিখাল—
“অ – আ – ক – খ…”
শিশুরা খাতায় অক্ষর আঁকতে লাগল, যেন আঁকছে ভবিষ্যতের আলো।
দূরে দাঁড়িয়ে মায়েরা বিস্ময়ে দেখছিল—তাদের সন্তানরা শিক্ষা পাচ্ছে!
মায়েদের বিস্ময় ও আশা
একজন মা এগিয়ে এসে বললেন—
“বাবা কৃষ্ণপদ, তুমি সত্যিই বড় সাহস করেছ। যদি আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়তে শেখে, তবে হয়তো তাদের জীবন বদলাবে।”
আরেকজন চোখ মুছতে মুছতে বললেন—
“আমরা তো কিছুই শিখিনি। অন্তত আমাদের সন্তানরা যেন আলোর মুখ দেখে।”
কৃষ্ণপদ অনুভব করল—এটাই তার জীবনের সত্যিকার কাজ।
কৃষ্ণপদের মানসিক দ্বন্দ্ব
কিন্তু রাত নামলেই কৃষ্ণপদ ভাবত—
“আমি কি পারব? সমাজের চাপ, বড়লোকদের বাধা, দারিদ্র্য—এসবের সঙ্গে লড়ে টিকতে পারব তো?”
তার বুক কেঁপে উঠত ভয় আর সংশয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো,
“না, থামা চলবে না। আমি না করলে কে করবে? আমাকে করতেই হবে।”
তার চোখে ভেসে উঠত গুরুচাঁদের মুখ, শোনা যেত সেই অমোঘ বাণী—
“শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নেই।”
সংকল্প
অবশেষে কৃষ্ণপদ নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করল—
“যত বাধাই আসুক, আমি এই পাঠশালা চালিয়ে যাব। একদিন আমাদের সমাজও শিক্ষিত হবে, একদিন আমরাও সম্মান পাব।”
তার হৃদয়ে তখন এক অদম্য আলো জ্বলে উঠল।
গ্রামে গুঞ্জন
বটতলার পাঠশালা চালু হতেই গ্রামে গুঞ্জন শুরু হলো।
কারও চোখে এটি আলোর সূচনা, কারও চোখে আবার একেবারেই অযথা সময় নষ্ট।
গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে কিছু প্রভাবশালী মানুষ বসে কৃষ্ণপদের বিরুদ্ধে কথা বলতে লাগল—
“এই ছেলেটা গ্রাম ভাঙতে চাইছে।”
“আমাদের জাতের বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর মানেই হলো সমাজ উল্টে ফেলা।”
“একে যদি এখনই থামানো না যায়, তবে কাল অন্যরাও মাথা তুলবে।”
এই ফিসফিসানি শিগগিরই হুমকিতে পরিণত হলো।
হুমকি আর ভয়
এক সন্ধ্যায় কৃষ্ণপদ পাঠশালা থেকে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ গ্রামের মোড়ে কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে ধরল।
একজন গম্ভীর গলায় বলল—
“শোনো কৃষ্ণপদ, এসব পড়াশোনা-টড়াশোনা বন্ধ করো। নইলে ফল ভালো হবে না।”
কৃষ্ণপদের বুক কেঁপে উঠল। ভয় তার শরীর গ্রাস করল, কিন্তু সে চুপ করে মাথা নত করল না।
শান্ত গলায় উত্তর দিল—
“আমি কোনো দোষ করছি না। আমি শুধু বাচ্চাদের অক্ষর শেখাচ্ছি। শিক্ষা আমাদের সমাজকে শক্তি দেবে।”
লোকগুলো হেসে উঠল—
“শিক্ষা দিয়ে পেট ভরবে নাকি? সাবধান, কৃষ্ণপদ।”
তারা চলে গেল। কিন্তু কৃষ্ণপদ জানত, এ শুধু শুরু, সামনে আরও বড় বাধা আসবে।
বাচ্চাদের উচ্ছ্বাস
কিন্তু অন্যদিকে বাচ্চারা দিনে দিনে পাঠশালায় আসতে আগ্রহী হয়ে উঠল।
একদিন এক ছোট্ট ছেলে খাতা খুলে গর্ব করে কৃষ্ণপদকে দেখাল—
“দেখো গুরুদা, আমি নিজের নাম লিখতে পারি।”
কৃষ্ণপদের চোখ ভিজে উঠল। সে ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বলল—
“তুমি একদিন বড় হবে, সমাজের গর্ব হবে।”
বাচ্চারা প্রতিদিন নতুন অক্ষর শেখার জন্য ছুটে আসত। কেউ খাতার পাতা ছিঁড়ে গেলেও হাল ছাড়ত না।
তাদের চোখে যে আনন্দ, তা কৃষ্ণপদকে প্রতিদিন নতুন করে সাহস জোগাত।
মায়েদের ভরসা
একদিন কয়েকজন মা কৃষ্ণপদের বাড়িতে এলেন।
একজন বললেন—
“বাবা কৃষ্ণপদ, তুমি আমাদের সন্তানদের পড়াচ্ছ। আমরা কিছু দিতে পারব না, তবু চাই তুমি চালিয়ে যাও।”
আরেকজন বললেন—
“আমরা চাই আমাদের মেয়েরাও পড়তে শিখুক। যদি তারা একদিন নিজের নামে চিঠি লিখতে পারে, তাহলেই আমাদের জীবনের স্বপ্ন পূরণ হবে।”
কৃষ্ণপদ বুঝল, তার পাশে সমাজের অর্ধেক শক্তি—মায়েরা—দাঁড়াতে শুরু করেছে।
কৃষ্ণপদের দ্বিধা
তবু রাতে কৃষ্ণপদ একা বসে ভাবত—
“আমি কি পারব? প্রভাবশালী লোকেরা যদি আমাকে একঘরে করে দেয়? মা যদি বিপদে পড়ে? এই ছোট উদ্যোগে কি সত্যিই সমাজ বদলাবে?”
এই দ্বিধা তাকে কুরে কুরে খেত।
কিন্তু ভোর হলেই আবার পাঠশালার বাচ্চাদের হাসিমুখ তার সমস্ত ভয় দূর করে দিত।
নেতৃত্বের প্রথম পরীক্ষা
একদিন হঠাৎ গ্রামের কয়েকজন বড়লোক এসে পাঠশালার সামনে দাঁড়াল। তারা উচ্চস্বরে বলল—
“এই পাঠশালা আজই বন্ধ হবে।”
বাচ্চারা ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছিল। কৃষ্ণপদ উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“না, এই পাঠশালা বন্ধ হবে না। যদি চান, আমাকে শাস্তি দিন। কিন্তু এই বাচ্চাদের পড়াশোনা আমি বন্ধ করব না।”
তার এই সাহস দেখে বাচ্চারা আবার বসে গেল, খাতা খুলে লিখতে শুরু করল।
গ্রামের মায়েরাও এসে পাশে দাঁড়ালেন।
প্রভাবশালীরা চুপ করে চলে গেল।
কৃষ্ণপদ বুঝল—এটাই তার নেতৃত্বের প্রথম পরীক্ষা, এবং সে জিতে গেছে।
কৃষ্ণপদের সংকল্প আরও দৃঢ়
সেদিন রাতে কৃষ্ণপদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল—
“আজ আমি বুঝলাম, ভয় পেলে চলবে না। সমাজের পরিবর্তন আনতে চাইলে লড়াই করতেই হবে। আমি পিছিয়ে যাব না।”
তার চোখে তখন জ্বলজ্বল করছিল প্রতিজ্ঞার আলো।
পরিবর্তনের হাওয়া
গ্রামের আকাশে যেন এক অদৃশ্য স্রোত বইতে শুরু করেছিল। আগে যেখানে দিন কাটত খেতের কাজে, মাছ ধরা আর হাটের লেনদেনেই, এখন সেখানে নতুন নতুন আলোচনার ঝড় উঠতে লাগল। মানুষ কেবল সংসার টিকিয়ে রাখার চিন্তায় ডুবে থাকত না, তারা ভাবতে শুরু করল—“আমাদের পরিচয় কী? আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে?”
মতুয়ার ধর্মীয় গান আর হরিবোল ধ্বনির সাথে সাথে চলছিল এক ভেতরের আন্দোলন। ছোট ছোট বৈঠকি সভা বসত গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে, অথবা কারও উঠোনে। তরুণ প্রজন্ম প্রশ্ন তুলতে শুরু করল—“আমরা কেন বারবার অবহেলিত হব? কেন আমাদের কণ্ঠস্বর শোনা হবে না?”
এই বৈঠকগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাণ ছিলেন শিবনাথ। বয়সে তরুণ হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট। তিনি বলতেন—
“আমরা কেবল উৎসব পালন করব না, আমাদের অধিকার নিয়েও ভাবতে হবে। গুরুচাঁদের বাণী শুধু ধর্ম নয়, তিনি শিখিয়েছিলেন সামাজিক ন্যায়ের কথা। আমরা যদি নিজের শক্তিকে চিনতে না পারি, তাহলে অন্যরা আমাদের জায়গা কেড়ে নেবে।”
তার কথা শুনে অনেকে চুপ থাকলেও, ভেতরে ভেতরে আলোড়ন জাগতে লাগল। কৃষ্ণপদ দাদু, যিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবীণদের মধ্যে একজন, তিনি ধীরে ধীরে বললেন—
“বাবা শিবনাথ, তোমার কথা ঠিক। আগে আমরা ভাবতাম শুধু টিকে থাকার কথা। কিন্তু এখন সময় এসেছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। তবে মনে রেখো, ভাঙন যেন না ঘটে সমাজে। এক হতে হবে, তাহলেই শক্তি।”
এই আলোচনার পর থেকে গ্রামের পরিবেশ পাল্টাতে লাগল। যুবকরা শুধু হরিসংকীর্তনেই নয়, পড়াশোনার দিকেও নজর দিল। কয়েকজন কলকাতা গিয়ে চাকরি করার চেষ্টা করল। মেয়েরা, যারা আগে ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তারাও আস্তে আস্তে স্কুলে যেতে শুরু করল।
তবে এই পরিবর্তনের হাওয়াকে সবাই সমর্থন করল না। গ্রামেরই এক শ্রেণির মানুষ ভয় পেল—“এভাবে যদি সবাই সচেতন হয়ে যায়, তবে আমাদের আধিপত্য টিকবে কীভাবে?” ফলে ভেতরে ভেতরে বিরোধের সুরও বাজতে লাগল।
একদিন সন্ধ্যায়, হরিসভা শেষ হওয়ার পর, রমলা নামের এক তরুণী দাঁড়িয়ে বলল—
“আমরা কেবল গান গেয়ে আনন্দ করব, আর মেয়েরা শুধু রান্না-বাড়ি করবে—এটা কি ঠিক? গুরুচাঁদ তো বলেছিলেন—সবাই সমান। তবে কেন আমরা মেয়েরা সুযোগ পাব না?”
তার কথা শুনে অনেকেই চমকে উঠল। আগে কখনও মেয়ে এভাবে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করেনি। শিবনাথ এগিয়ে এসে বলল—
“রমলা ঠিকই বলেছে। আজ থেকে মেয়েরাও পড়াশোনা করবে, আলোচনায় যোগ দেবে। এটাই আমাদের প্রকৃত জাগরণ।”
এই দৃশ্য গ্রামের সমাজে নতুন আলো ছড়িয়ে দিল। একদিকে প্রথা আঁকড়ে ধরা মানুষ, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন—দুয়ের টানাপোড়েনে গ্রাম যেন নতুন মোড়ে এসে দাঁড়াল।
সেদিনের পর থেকে মতুয়ার গান আর ধর্মীয় আলোচনার পাশাপাশি “অধিকার”, “শিক্ষা” এবং “সমতা” শব্দগুলোও প্রতিদিন উচ্চারিত হতে লাগল।
এ যেন ছিল পরিবর্তনের এক শুরু, যেখানে বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হল আত্মমর্যাদা আর সংগ্রামের সঙ্কল্প।
সংঘাত ও সংগ্রাম
পরিবর্তনের যে হাওয়া গ্রামে বইতে শুরু করেছিল, তা আর শান্তভাবে থেমে থাকল না। ধীরে ধীরে সেই হাওয়া ঝড়ের রূপ নিল। যেখানে একদিকে মতুয়া সমাজের তরুণ-তরুণীরা সমতার দাবি জানাতে শুরু করল, অন্যদিকে গ্রামের প্রভাবশালী কিছু মানুষ অস্থির হয়ে উঠল।
১. বৈঠকের দিন
এক সন্ধ্যায় গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে সবাই জড়ো হয়েছিল। মাটির প্রদীপের আলো, বাতাসে ভেসে আসা ধূপের গন্ধ, আর চারপাশে ভক্তিমূলক কীর্তনের ধ্বনি। কিন্তু আজকের বৈঠক ছিল ভিন্ন স্বাদের। ধর্মীয় গান গাওয়া শেষ হওয়ার পর শিবনাথ দাঁড়িয়ে বলল—
“ভাই-বোনেরা, আমরা অনেকদিন ধরে মাথা নত করে বেঁচে আছি। কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন—মানুষ সমান। জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে আমাদের এগোতে হবে। মেয়েরা শিক্ষা পাবে, ছেলেরা কর্ম খুঁজবে, সবাই একসাথে গড়ে তুলব আমাদের সমাজ।”
তার কথা শুনে অনেকেই হাততালি দিল। কিন্তু এক কোণে বসা হরিচরণ, গ্রামের ধনী জমিদারের অনুগত লোক, হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলল—
“তুমি তো বেশ বড় বড় কথা বলছ শিবনাথ! কিন্তু ভাবছ কি, যদি সবাই সমান হয় তবে আমাদের শ্রেণির মান কোথায় যাবে? সমাজে যদি উল্টেপাল্টে যায় সব, তবে গ্রামের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে।”
কৃষ্ণপদ দাদু শান্ত গলায় বললেন—
“হরিচরণ, শৃঙ্খলা মানে কি? কারো গায়ে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, না কি সবার মধ্যে সমান অধিকার? গুরুচাঁদ ঠাকুর তো শৃঙ্খলার নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।”
কথা বাড়তে লাগল। একদিকে তরুণরা—শিবনাথ, রমলা, নিতাইরা সমতার পক্ষে দাঁড়াল। অন্যদিকে প্রভাবশালী কয়েকজন ভয় দেখাল—“এভাবে চলতে থাকলে গ্রামের শান্তি ভেঙে যাবে।”
২. নারীর কণ্ঠস্বর
বৈঠকের মাঝে রমলা আবারও দাঁড়াল। তার চোখে আগুনের ঝিলিক।
“আমাদের মা-ঠাকুমারা সারাজীবন গৃহকর্মে কাটিয়েছেন। কিন্তু আজ যদি আমি পড়াশোনা করি, তবে আমি আমার সন্তানদের ভিন্ন শিক্ষা দিতে পারব। আমরা শুধু রান্না করব কেন? আমরা লিখব, শিখব, সমাজের কাজে যোগ দেব।”
তার এই কথা শোনার পর অনেক নারীও চুপ করে থাকতে পারল না। কারো চোখ ভিজে উঠল, কেউ মৃদু মাথা নাড়ল। প্রভাবশালী শ্রেণির কয়েকজন বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরিবর্তনের আগুন তখন আর থামানো যাচ্ছিল না।
৩. সংঘাতের সূচনা
এরপর থেকেই গ্রামে বিভাজন শুরু হলো।
একদল শিবনাথ-রমলাদের পাশে দাঁড়াল—তারা চাইত শিক্ষা, সমতা আর আত্মমর্যাদা।
অন্যদল বলল—“এগুলো সব অশান্তি ডেকে আনবে, আগের নিয়মে থাকলেই ভালো।”
এই বিভাজনের প্রভাব পড়ল গ্রামের দৈনন্দিন জীবনে। হাটে গেলে একদল আরেকদলের সঙ্গে কথা বলত না। কারও বাচ্চা স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে প্রতিবাদ উঠত। এমনকি হরিসভায় বসার সময়ও আলাদা হয়ে যেত দুপক্ষ।
৪. পুলিশের ছায়া
এমন সময় গ্রামের পাশ দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির প্রভাবও ঢুকে পড়ল। কিছু রাজনৈতিক দল বুঝতে পারল, মতুয়া সমাজ যদি একসাথে দাঁড়ায় তবে তা ভোটের মাঠে বড় শক্তি হবে। তারা চুপচাপ গ্রামে ঢুকে বিভেদ আরও বাড়িয়ে দিল। কেউ শিবনাথদের পাশে টাকা আর প্রতিশ্রুতি দিল, কেউ আবার প্রভাবশালীদের পাশে থেকে ভয় দেখাল।
একদিন গ্রামের বৈঠক চলাকালীনই থানা থেকে দুজন পুলিশ এলো। তারা বলল—
“শান্তি বজায় রাখতে হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, গ্রামের ঐক্য নষ্ট করা হচ্ছে। যদি গোলমাল হয়, তবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গ্রামের মানুষ বুঝল—এখন সংঘাত শুধু ভেতরের নয়, বাইরের চোখও এই জাগরণের দিকে পড়েছে।
৫. সংগ্রামের সংকল্প
এই চাপের মধ্যেও শিবনাথ হাল ছাড়ল না। এক রাতে সে যুবকদের নিয়ে মিটিং ডাকল। মাটির প্রদীপের আলোয়, উঠোনে বসে সবাই প্রতিজ্ঞা করল—
“আমরা ভয় পাব না। আমরা আমাদের অধিকার চাই। আমরা গুরুচাঁদের বাণী মেনে চলব। সমাজকে বদলাব।”
রমলা সেখানে বলল—
“আমাদের লড়াই শুধু পুরুষদের নয়, নারীরাও সমানভাবে অংশ নেবে। শিক্ষা, স্বাধীনতা আর সম্মান—এই হবে আমাদের লক্ষ্য।”
সেদিন রাতেই গ্রামের আকাশে ধূপ-ধুনোর গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল দৃঢ় কণ্ঠের প্রতিজ্ঞা।
৬. দ্বন্দ্বের ভিতরে আশা
সংঘাত যত বাড়ল, ততই স্পষ্ট হলো—পরিবর্তন থামানো যাবে না। মানুষ ভয় পেলেও ভেতরে ভেতরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। কেউ ভাবল ছেলেকে কলেজে পাঠানোর কথা, কেউ মেয়ের জন্য নতুন খাতা-কলম কিনে রাখল।
যদিও বিরোধ এখনো আছে, কিন্তু সংগ্রামের পথ ধরে সমাজ ধীরে ধীরে এক নতুন দিগন্তের দিকে এগোতে শুরু করল।
জাগরণের আলো
সংঘাত আর দ্বন্দ্বের মাঝেই গ্রাম এগিয়ে চলল নতুন পথের দিকে। ভয়, শঙ্কা, প্রতিবন্ধকতা সবই ছিল, কিন্তু তার ভেতর থেকে ফুটে উঠতে শুরু করল আশার আলো।
১. ভোরের স্নানযাত্রা
একদিন ভোরে গঙ্গাস্নানের আয়োজন হলো। মতুয়া সমাজের মানুষজন ছোট ছোট দলে দলে নদীর ঘাটে নামল। চারিদিকে “হরিবোল” ধ্বনি উঠতে লাগল। নারীরা শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে, পুরুষরা কাঁধে গামছা নিয়ে, শিশুরা কৌতূহলী চোখে সবাই এগোলো জলে।
কিন্তু আজকের স্নান ছিল অন্যরকম। শিবনাথ বলল—
“এই জলে আমরা শুধু শরীর পরিষ্কার করব না, মনকেও নতুন করে গড়ব। আজ থেকে আমরা সংকল্প করব—সমাজে আর কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।”
রমলা হাত ভিজিয়ে বলল—
“মেয়েরাও সমান অধিকার পাবে। এই জল হোক আমাদের সাক্ষী।”
স্নানযাত্রা যেন এক প্রতীকি জাগরণে রূপ নিল। পুরুষ-নারী, বৃদ্ধ-যুবক, সবাই একসাথে নামল জলে। আর সেই মুহূর্তে মানুষ টের পেল—সংঘাতের ভেতর থেকেও জন্ম নিতে পারে ঐক্য।
২. পাঠশালার সূচনা
গ্রামের বাঁশবাগানের পাশে একটি ছোট মাটির ঘর ফাঁকা পড়ে ছিল। শিবনাথ ও তার সাথীরা সেই ঘর পরিষ্কার করে সেখানে শুরু করল পাঠশালা। কাঠের তক্তা, মাটির দোয়াত, পাটির ওপর বসে পড়াশোনার আয়োজন হলো।
প্রথম দিনে মাত্র আটজন বাচ্চা এল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে লাগল। বিশেষত মেয়েরা, যারা আগে কখনো খাতা-কলম হাতে নেয়নি, তারা লাজুক হাসি মুখে এসে বসল।
একদিন রমলা নিজেই বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করল। তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা—
“তোমরা শিখবে, কারণ শিক্ষা হলো মুক্তির পথ। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছিলেন—বিদ্যা ছাড়া মুক্তি নেই।”
পাঠশালা দ্রুত গ্রামের আশার প্রতীকে পরিণত হলো।
৩. বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
এই পরিবর্তন সহজভাবে মেনে নিতে পারল না প্রভাবশালী শ্রেণি। তারা বলল—
“এভাবে চললে শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে। মেয়েদের স্কুলে পাঠানো কি দরকার? কাজকর্ম কে করবে?”
কিছুদিন পর এক রাতে পাঠশালার মাটির ঘর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হলো। খড়ের ছাউনি উড়িয়ে দিল কেউ। কিন্তু গ্রামের যুবকেরা আবার গড়ে তুলল ঘরটি।
শিবনাথ বলল—
“তারা যত ভাঙবে, আমরা তত গড়ব। কারণ এটি শুধু ইট-মাটির ঘর নয়, এটি আমাদের স্বপ্ন।”
৪. উৎসব ও ঐক্য
বছর ঘুরে এল বার্ষিক মহোৎসবের সময়। গ্রামে হাজার হাজার মানুষ জমল। ঢোল, করতাল, শঙ্খের ধ্বনিতে আকাশ মুখর হলো।
সেই মহোৎসবে শিবনাথ সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল—
“আজ আমরা শুধু ভক্তি নয়, ন্যায়ের প্রতিজ্ঞা করব। আমাদের সমাজে আর ভেদাভেদ থাকবে না। নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেবে, সবাই শিক্ষা পাবে, সবাই মর্যাদার সঙ্গে বাঁচবে।”
ভিড় থেকে গর্জে উঠল স্লোগান—
“হরিবোল! জয় গুরুচাঁদ ঠাকুর!”
এই ঐক্যের দৃশ্য দেখে বিরোধীরা স্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ তারা বুঝল—এই জাগরণকে আর আটকানো যাবে না।
৫. মানসিক মুক্তি
গ্রামের মানুষ যেন ভেতর থেকে বদলে গেল। আগে যারা ভয় পেত, তারা এখন গর্বে মাথা তুলল। যে মা নিজের মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ইতস্তত করত, সে-ই এখন অন্যদেরও উৎসাহ দিল।
কৃষ্ণপদ দাদু একদিন শিবনাথকে বলল—
“বাবা, আমি বহুদিন বেঁচে আছি। অনেক অন্যায় সহ্য করেছি। কিন্তু আজ তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে—আমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। সমাজ সত্যিই জাগছে।”
শিবনাথ নতজানু হয়ে বলল—
“দাদু, এই জাগরণ কারো একার নয়। এটা সবার সম্মিলিত সংগ্রাম। আমরা শুধু সেই পথ দেখাচ্ছি, যা গুরুচাঁদ ঠাকুর বহু আগেই দেখিয়েছিলেন।”
৬. নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন
গ্রামের আকাশে তখন অন্যরকম আলো। হরিসভা আর কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাতার আওয়াজও শোনা যায়। মাঠে কাজ করার ফাঁকে যুবকেরা আলোচনা করে অধিকার আর সমতার কথা। মেয়েরা রান্নাঘরের বাইরে এসে সমাজের কাজে যোগ দেয়।
সংঘাত এখনো শেষ হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সমাজ—যেখানে মানুষ আর শুধু “অবহেলিত” নয়, তারা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ছে।