কলমে: সৌরদীপ অধিকারী
(সতর্কীকরণ: এই লেখাটি প্রাপ্তমনস্কদের জন্য। এটি একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত। দুর্বল হৃদয়ের পাঠকের জন্য নয়।)
আমরা যারা সার্থক আর অহনার ঘটনার সামান্যতম সাক্ষী ছিলাম, তারা জানি, আধুনিকতা দিয়ে সব অন্ধকারকে ঢেকে দেওয়া যায় না। টাকা হয়তো একটা আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা এনে দিতে পারে, কিন্তু সেখানে বাস করা আত্মার অধিকার কেনা সম্ভব নয়। আর সার্থক-অহনা এটাই বুঝেছিল—বহু দেরিতে।
আমি অরিত্র। সার্থকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই বিভীষিকাময় কাহিনী হুবহু তুলে ধরছি, যেমনটা সে আমাকে বলেছিল। সে এখন কোথায় আছে, আমি জানি না। শেষবার যখন তার সঙ্গে কথা হয়েছিল, তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা কাঁচে মোড়ানো, কেবলই মুক্তির প্রার্থনা।
সালটা ছিল ২০২৩। সার্থক ও অহনা, দু'জনেই কর্পোরেট পৃথিবীর উজ্জ্বলতম মুখ। সার্থক একটি বৃহৎ টেক ফার্মের সিনিয়র ম্যানেজার, আর অহনা নগরীর অন্যতম সেরা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। তাদের জীবনে সাফল্যের কোনো অভাব ছিল না, কিন্তু একটি স্বপ্ন তাদের তাড়িত করত—একটি "পারফেক্ট অ্যাপার্টমেন্ট"-এর স্বপ্ন।
সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে তারা বেছে নিল শহরের নতুন আইকন—'স্যাফায়ার হাইটস'। নিউ টাউনের প্রান্তে আকাশছোঁয়া কাঁচের তৈরি সেই টাওয়ার, যার ২০ তলার ফ্ল্যাট ২০0৩, ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় এবং আবেগপূর্ণ বিনিয়োগ।
"বিশ তলায় দাঁড়িয়ে পুরো কলকাতাকে পায়ের নিচে দেখা যায়, অরিত্র," সার্থক প্রথম দিন ফোন করে বলেছিল। তার উচ্ছ্বাস ছিল বাঁধভাঙা। "আর জানিস? ফ্ল্যাটটা পুরো সাউথ-ফেসিং, ভেন্টিলেশন অসাধারণ। কেবল একটা বিষয় খটকা লাগছিল—এর দাম একই ফ্লোরের অন্য ফ্ল্যাটগুলোর চেয়ে সামান্য কম ছিল। হয়তো বাস্তু দোষের জন্য।"
কম দামে এত উঁচুতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট? আমার সন্দেহ হয়েছিল। সেই সন্দেহটাই যে এমন মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে, তখন ভাবিনি।
গত বছরের নভেম্বরে তারা ফ্ল্যাটে উঠল। অহনা নিজের হাতে ফ্ল্যাট সাজিয়েছিল। সাদা রং, মিনিমালিস্ট ডিজাইন, প্রচুর কাঁচ—আধুনিক স্থাপত্যের এক চূড়ান্ত নিদর্শন। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকলেই একটা অব্যক্ত শীতলতা অনুভব করা যেত। সার্থকের ভাষায়, "যেন এসিটা সবসময় মাইনাস টেম্পারেচারে সেট করা আছে, যদিও ডিসপ্লেতে সবসময় ২৭ ডিগ্রি দেখাচ্ছে।"
প্রথম দু’মাস খুব শান্তিতেই কেটেছিল, যদি না সেই অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতাকে শান্তি বলা যায়। ২০ তলার ওই উচ্চতায় বাইরের শহরের কোলাহল পৌঁছাত না। সার্থক এটাকে 'নিশ্ছিদ্র নীরবতা' বলত। কিন্তু এই নীরবতাটা ছিল ভয়ংকর। এমন নিস্তব্ধতা যেখানে নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দও কানে আসে।
জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই সমস্যার সূত্রপাত হলো।
সার্থক ছিল প্রযুক্তিতে অন্ধবিশ্বাসী। তার পুরো বাড়ি ছিল স্মার্ট হোম সিস্টেম দিয়ে মোড়া—অ্যালেক্সা, স্মার্ট ডোর লক, মোশন সেন্সর লাইট, এবং একাধিক হাই-ডেফিনিশন সিসিটিভি ক্যামেরা। সে নিশ্চিত ছিল, প্রযুক্তি কোনোদিন তাকে ব্যর্থ করবে না।
এক রাতে, রাত প্রায় আড়াইটা। অহনা ঘুমিয়ে পড়েছে, সার্থক ল্যাপটপে কাজ করছে। হঠাৎ ড্রয়িংরুমের অ্যালেক্সা জ্বলে উঠল।
— "অ্যালেক্সা, মিউট।" সার্থক বলল।
কিন্তু অ্যালেক্সা কোনো উত্তর দিলো না। বরং একটা ক্ষীণ, ভেজা ফিসফিসানি শব্দ ভেসে এলো স্পিকার থেকে। ভাষাটা বোঝা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল কেউ বাতাস কেটে যাওয়ার শব্দ করছে।
সার্থক প্রথমে নেটওয়ার্ক গ্লিচ ভেবেছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন সে ধমকে বলল, "অ্যালেক্সা, অফ," তখন স্পিকার থেকে খুব ধীরে একটা নাম উচ্চারিত হলো।
— "স...আর...থ...ক..."
স্বরটা ছিল নিস্তেজ, ভেজা, যেন কেউ জলের নিচে বসে কথা বলছে। সার্থক লাফিয়ে উঠে অ্যালেক্সার প্লাগ খুলে দিল। তার হাত কাঁপছিল। সে বারবার নিজেকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল—হ্যাকিং? কিন্তু তাদের ওয়াইফাই অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল।
এরপর ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নতা হারাল। অহনা প্রায়ই বলত, মাঝরাতে তার মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। একদিন সে আমাকে ফোন করে জানাল, রান্নাঘরের কাঁচের টেবিল পরিষ্কার করার সময়, প্রতিফলনে সে দেখল, বসার ঘরের মাঝখানে একটা ছায়া স্থির দাঁড়িয়ে আছে। যখন সে ঘুরে তাকাল, সেখানে কিছুই ছিল না—শুধু নিশ্ছিদ্র সাদা দেয়াল।
সবচেয়ে ভয়ংকর প্রমাণ এলো সিসিটিভি ফুটেজ থেকে।
একদিন গভীর রাতের ফুটেজ চেক করতে গিয়ে সার্থক দেখল: রাত ২টো বেজে ১২ মিনিটে ড্রয়িংরুমের অ্যাকসেন্ট চেয়ারের ডান হাতলটা সামান্য নিচে নেমে গেল, যেমনটা কেউ খুব সাবধানে চেয়ারে বসার চেষ্টা করলে হয়। প্রায় দশ সেকেন্ড ধরে চেয়ারটা ওইভাবে দাবানো থাকল, অথচ ক্যামেরার ফ্রেমে কোনো মানুষের উপস্থিতি ছিল না।
এরপর ঘরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা থার্মোমিটারের রিডিং হঠাৎ করে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এলো, যদিও সেন্ট্রাল এসি তখন বন্ধ ছিল। আর ঠিক ওই সময়ে, ফুটেজে চেয়ারের ওপরের বাতাসটা সামান্য কেঁপে উঠল, যেন একটা অদৃশ্য, ভারী শরীর নিঃশ্বাস ফেলছে।
সার্থকের প্রযুক্তি-নির্ভর যুক্তি তখন ভেঙে চুরমার।
দেয়ালের ভেতরের গোপন কথা
এই পর্যায়ে এসে তাদের ঘুম পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অহনার চোখে স্থায়ী কালো দাগ, আর সার্থক যেন এক সপ্তাহ ধরে কফি খেয়ে জেগে আছে। তাদের পেশাগত জীবনও তলানিতে ঠেকছিল।
এক সকালে, অহনা বাথরুম থেকে চিৎকার করে দৌড়ে এলো।
"সার্থক! একটা গন্ধ! সেই একই গন্ধ!"
গন্ধটা তখন মৃদু হয়ে এলেও সার্থক চিনতে পারল—পচা মাটি আর ভিজে কাপড়ের মিশ্রণ। তার সঙ্গে মেশানো ছিল অত্যন্ত পুরানো, ঝাঁঝালো একটা পারফিউমের গন্ধ, যা আজকের দিনে কেউ ব্যবহার করে না।
তারা মেইনটেন্যান্সকে ডাকল। পাইপলাইন পরীক্ষা হলো, ভেন্টিলেটর চেক করা হলো। সব ঠিকঠাক। কিন্তু যতবারই তারা বাথরুমের নির্দিষ্ট কোণটায় যেতো, কফিনের ভেতরের মতো সেই শীতল, স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা ফিরে আসত।
অহনা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। "সার্থক, এই ফ্ল্যাটে অন্য কেউ আছে। আমি অনুভব করতে পারছি।"
তারা তখন ফ্ল্যাটটির ইতিহাস খুঁজতে শুরু করল। কেন ফ্ল্যাট ২০০৩ এত কম দামে বিক্রি হলো?
তদন্তে একটা গুরুতর তথ্য উঠে এলো: 'স্যাফায়ার হাইটস’-এর নির্মাণ কাজ শেষ হতে প্রায় চার বছর লেগেছিল। কারণ ছিল একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা।
টাওয়ারের কোর ফ্লোর তৈরির সময়, ১৭ থেকে ২১ তলার মধ্যে কংক্রিটের মিকশ্চারের ড্রাম ভেঙে পড়েছিল। সেই সময় যে শ্রমিকরা কাজ করছিল, তাদের মধ্যে একজন নিখোঁজ হয়ে যায়। তার নাম ছিল রতন।
কোম্পানি দ্রুত ঘটনা চাপা দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের মুখে রটে গিয়েছিল, রতন কংক্রিটের স্ল্যাবের ভেতরে চাপা পড়েছিল। তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, কারণ কংক্রিট শক্ত হওয়ার আগেই খবরটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। রতন সম্ভবত চাপা পড়েছিল ২০ তলার মূল ভারবাহী কাঠামোর ভেতরে।
সার্থক ফ্ল্যাটের প্ল্যান খুলে দেখল। বাথরুমের পেছনের সেই কোণটি, যেখান থেকে পচা মাটির গন্ধ আসে, সেটা ছিল টাওয়ারের কোর ওয়ালের অংশ।
সার্থকের শরীর হিম হয়ে গেল। তার দামি, আধুনিক ফ্ল্যাটটা আসলে এক শ্রমিকের জ্যান্ত কবর।
সত্য জানার পর তাদের পক্ষে আর সেখানে থাকা সম্ভব ছিল না। তারা ঠিক করল, ফ্ল্যাট ছেড়ে আপাতত অন্য বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু তার আগেই সেই চূড়ান্ত রাত এলো।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। বাইরের আকাশ ছিল ঘন কালো। রাত তখন ঠিক ৩টে বেজে ৩ মিনিট।
সার্থক মেঝেতে শুয়ে ছিল, কারণ অহনা একা বিছানায় শুতে পারছিল না।
হঠাৎ সে অনুভব করল, তার কানের পাশ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। অথচ সব জানালা বন্ধ। সে মেঝেতে জল পড়ার শব্দ শুনতে পেল। টুপ... টুপ... টুপ...
সার্থক উঠে বসল। বাইরে নিউ টাউনের নিয়ন আলোয় ঘরটা আবছা আলোকিত। সে দেখল, বাথরুমের দিক থেকে একটা কালো, ঘন তরল ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে সাদা মার্বেল মেঝের উপর। সেটা কাদাও নয়, রক্তও নয়। স্যাঁতসেঁতে সিমেন্টের ভেজা জল।
টর্চ হাতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল সার্থক। বাথরুমের দরজা খুলতেই সেই পুরনো, ঝাঁঝালো পারফিউমের গন্ধটা সজোরে এসে ধাক্কা মারল।
টর্চ ওপরে তুলতেই সে দেখল—সিলিংয়ের একটা জায়গায় কংক্রিটের ফাটল ধরেছে। সেই ফাটল বেয়েই কালো তরলটা গড়িয়ে নামছে। সার্থক যখন ফাটলটিতে টর্চের আলো ফেলল, তখন সে দেখল—ফাটলের ভেতরটা শুধু সিমেন্ট নয়। সেখানে কিছু একটা স্থিরভাবে রয়েছে, যা সাদা সিমেন্টের সাথে বেমানান।
সে ভয়ে টর্চ নামিয়ে নিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমের আয়নাতে সে দেখল, তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু আয়নায় তার প্রতিচ্ছবিটা ঠিক তার দিকেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে।
আর সেই প্রতিচ্ছবিটা কথা বলল। তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর কিন্তু অন্য কারো ভাষা।
— "কোথায় পালাবি? এটাই তোর ঘর। আমার ঘর।"
সার্থক এক লাফে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সে দ্রুত অহনাকে জাগাতে গেল।
অহনা তখন বিছানায় বসে আছে, চোখ খোলা, তবে দৃষ্টিহীন। সে যেন সামনের দেওয়াল নয়, দেখছে বহুদূর—২০ তলার নিচে অন্ধকার আর আলোর মিশ্রণকে।
সার্থক তার হাত ধরতেই অহনা ফিসফিস করে বলল, "ও বাইরে..."
সার্থক চমকে পেছনে ফিরল। তাদের মাস্টার বেডরুমের পুরো দেওয়ালটা ছিল ফ্লোর-টু-সিলিং গ্লাস। ২০ তলা থেকে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়।
কিন্তু সার্থক যা দেখল, সেটা কল্পনার অতীত।
কাঁচের দেওয়ালের একদম বাইরের পৃষ্ঠে, ২০ তলার উচ্চতায়, তাদের বেডরুমের ঠিক বাইরে, একটা মানুষের বিকৃত প্রতিকৃতি লেপ্টে আছে।
সেটা কোনো সম্পূর্ণ দেহ ছিল না। বিকৃত, ভাঙা, যেন কংক্রিটের চাপ আর জলের কারণে চামড়া এবং হাড় বাইরে থেকে দৃশ্যমান। শরীরের আকৃতিটা অসম্ভবভাবে লম্বা হয়ে কাঁচের ওপর ছড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন সিমেন্টের ভেতরে ঢুকে থাকা বস্তুকে জোর করে টেনে বের করার চেষ্টা করলে হয়।
তার মুখটা সরাসরি কাঁচের দিকে ফেরানো, আর তার চোখ—যা শুধু দুটো ভেতরের গর্ত—তা দিয়ে সে সার্থক আর অহনাকে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ কাঁচের ওপাশে শরীর চেপে ধরে থাকার কারণে তার ভেজা চামড়া কাঁচের ওপর ছাপ ফেলে দিয়েছে।
আর সেই সময়েই, সার্থক স্পষ্ট শুনতে পেল—একটা ভারী, দীর্ঘশ্বাস, যা কাঁচের ফাটল পেরিয়ে ঘরের ভেতরে এলো। তার সাথে সেই পচা মাটির গন্ধ।
অহনা তখন কাঁচের দিকে হাত বাড়ালো। "ওকে যেতে বল... ওর কষ্ট হচ্ছে..."
সার্থক ততক্ষণে বুঝেছে, সেই রতন, যার দেহ সিমেন্টের ভেতরে মিশে গিয়েছিল, সে আসলে এই ফ্ল্যাটেরই অংশ হয়ে গিয়েছিল। তার আত্মা এই কাঁচের বিলাসবহুল খাঁচা ছেড়ে যেতে পারছে না। তারা কোনোমতে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। সূর্যের আলো কাঁচ ছুঁলো, আর সেই কদাকার প্রতিকৃতিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। শুধু কাঁচের ওপর একটা স্যাঁতসেঁতে জলের দাগ রয়ে গেল, যা সহজে মোছা যায় না।
সার্থক আর অহনা পরদিনই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল। তারা জানে, তারা আর কোনোদিন ফ্ল্যাট ২০0৩-এ ফিরবে না। তারা ফ্ল্যাটটা বিক্রি করার চেষ্টা করেনি, কারণ তারা অন্য কাউকে এই নরকের মধ্যে ঠেলে দিতে চায়নি। তারা শুধু ভাড়ার ফ্ল্যাটে চলে গেল, যেখানে পুরোনো দিনের মতো ইট-সিমেন্টের দেয়াল আছে, কাঁচের আধুনিকতা নেই।
সার্থক আমাকে বলেছিল, "অরিত্র, আমি যখন ওই ফ্ল্যাটে ছিলাম, তখন ভয় পেতাম। কিন্তু যখন বেরিয়ে এলাম, তখন যা দেখলাম, সেটা আরও ভয়ংকর।"
সে আমাকে একটা স্ক্রিনশট দেখালো। এটা ছিল তাদের পুরনো ফ্ল্যাট ২০0৩-এর সিসিটিভি ফুটেজের রিমোট সার্ভার। সে চেক করছিল, ফ্ল্যাটের ভেতরে সব ঠিক আছে কিনা।
রিমোট সার্ভারে দেখা গেল, ২০0৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি সম্পূর্ণ খালি। আলো নেই, আসবাবপত্র নেই।
কিন্তু ফুটেজটা ছিল তাদের প্রধান দরজার বাইরের করিডোরের। রাত ঠিক ২টো ৩০ মিনিট। সার্থক আর অহনা তখন প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে তাদের নতুন ফ্ল্যাটে ঘুমাচ্ছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দরজার সামনে কেউ নেই। করিডোরের লাইট টিমটিম করছে।
হঠাৎ, স্পিকার থেকে একটা খুব ক্ষীণ শব্দ ভেসে এলো। কলিং বেলের শব্দ, যা কেউ খুব ধীরে টিপে ধরছে।
ডোরবেলের এলইডি লাইটটা একবার জ্বলে উঠল।
এরপর, সেই আওয়াজটা আবার এলো। কলিং বেলের ক্ষীণ, একটানা গুঞ্জন।
আর তারপর, সেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সার্থক আমাকে বলল, সে তখন স্পষ্ট দেখল, তার দরজার ফ্রেমের নীচে, বাইরে থেকে একটা কালো, ভেজা আঙুল গলে এলো।
এবং সেই আঙুলটা ধীরে ধীরে মুভ করে তাদের নাম লেখা ডোর-নেমপ্লেটের ওপর উঠে গেল।
ফিসফিস করে একটা স্বর এলো, যা ক্যামেরার মাইক্রোফোন অত্যন্ত ক্ষীণভাবে ধরেছে।
— "চেঞ্জ...অ্যা...ড্রেস..."
সার্থক আমাকে ফোন করে সব শোনাল, তার গলা কাঁপছিল। "অরিত্র, ও ২০ তলায় নেই। ও জানে আমরা নতুন কোথায় আছি। ও বেরিয়ে এসেছে। ও এবার আমাদের নতুন দরজায় কড়া নাড়বে।"
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, "সার্থক, তুই এখন কোথায়?"
সার্থক দীর্ঘশ্বাস নিলো। "আমি ফোনটা সুইচ অফ করে দিচ্ছি। আমি জানি না। আমি শুধু চাই, ও যেন আমাকে খুঁজে না পায়।"
এরপর ফোনটা কেটে গেল।
দু’দিন আগে, আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা আননোন নাম্বার থেকে একটা ছবি এসেছিল। ছবিটা ছিল সার্থকদের বর্তমান ভাড়ার ফ্ল্যাটের দরজার ফ্রেমের।
আর ফ্রেমের নিচে, সেই সিমেন্টের মতো ভেজা, কালো আঙুলের ছাপটা স্পষ্ট ছিল।
তার ঠিক পরের মেসেজে শুধু দুটো বাংলা শব্দ লেখা ছিল:
"ভেতরে ঢুকবো?"