Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

হারানো সুর…পর্ব-2

ফ্ল্যাশব্যাক,
স্রোতস্বিনী কুশলপুর গ্রামের প্রধান রাজনীতিবীদ দামোদর বসাক আর ওনার স্ত্রী কৌশিকী বসাকের একমাত্র আদরের মেয়ে। স্রোতস্বিনী বাবার নয়নের মনি একমাত্র মেয়ে বলে কথা,  মায়ের সাথে সারাদিন লেপটে থাকলেও রাতের বেলা বাবার বুকে শুয়ে গল্প না শুনলে মেয়ের আবার ঘুম আসে না। 
মাত্র চার বছর বয়স স্রোতস্বিনীর এখন, কিন্তু তার মা ঠিক করেছে যে তাকে নার্সারি স্কুলে ভর্তি করাবে, মানে ওই এল কেজিতে আরকি । সারাদিন মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে সতস্বিনী এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে।
রাতের বেলা বাড়ি ফিরে দামোদর বাবু মেয়েকে কাঁদতে দেখে প্রথমেই নিজের বাইরের পোশাক ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে এসে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন যে এতক্ষন বিছানায় উল্টে শুয়ে একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছিল ।পিঠে মাথায় হাত বুলতে বুলতে দামোদর বাবু জিজ্ঞাসা করলেন,
দামোদর বাবু -কি হয়েছে আমার সোনা মায়ের ,কাঁদছে কেন সে? আমার সোনাটাকে কে বকেছে? বাবা তাকে খুব বকে দেবে ,ঠিক আছে? আর কাঁদে না সোনা, 
এমন সব কথা বলে ভোলাতে লাগলো মেয়েকে তবে সে মুখে কিছু না বলে কেদেই চলেছে দেখে বিরক্ত হয়ে নিজের স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন,
দামোদর বাবু -কি বলেছো তুমি ওকে? এইভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা আমার?

কৌশিকী দেবী দৃঢ় গলায় বললেন,
কৌশিকী দেবী- আমি ওকে স্কুলে পাঠাবো বলেছি। তাতেই মেয়ের কান্না থামছে না, এবার তুমি ঠিক করো কি করবে। কাল থেকে কিন্তু ক্লাস শুরু হচ্ছে আমি একদমই চাই না ও একটাও ক্লাস মিস করুক। আমি তোমার পিএকে দিয়ে ওর জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করিয়ে নিয়েছি। 

দামোদর বাবু কোনো যুক্তি খুঁজে পেলন না কৌশিকী দেবীকে ভুল বলার জন্য, এটা তো সত্যি কথা মেয়ে বড় হলে তাকে স্কুল যেতে হবে।  তবে, এটা ভেবে উনি অবাক হলেন যে মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার কথা ওনার মাথাতেও আসেইনি ।আসলে উনি ভাবছেন এখনো হয়তো মেয়ে ছোটোই আছে। তবে তার স্কুল যাওয়ার বয়স হয়েছে ভেবে আর কোন কথা বললেন না। তবে মেয়েকে ভোলানোর জন্য বলে উঠলেন,
দামোদর বাবু -কাঁদছো কেন সোনা মা? স্কুল তো কত ভালো? কত বন্ধু হবে তোমার ওখানে, কত খাবারের দোকান আছে ওখানে, টিচাররা কত ভালবাসবে তোমাকে ,

কান্না গলায় স্রোতস্বিনী বলে উঠলো,
-আমি যাব না ,আমাকে ওলা মাপবে, ম্যাডাম তো কত মারে আমাকে? স্কুলে তো আরো কত কত ম্যাডাম থাকবে সবাই মিলে মারবে, আমি যাব না।

 দামোদর বাবু মেয়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে গম্ভীর স্বরে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
দামোদর বাবু -স্রোত কি বলছে ওর মিস ওকে মারে? এই সাহস ওই টিচারকে কে দিয়েছে? আমার ফুলের মত মেয়েটাকে…

কৌশিকী দেবী বিরক্ত হয়ে বললেন,
কৌশিকী দেবী -হ্যাঁ নিজের মেয়ের সব কথা তো তোমাকে শুনতে হবে ,তাই না?তবে জেনে রেখো তোমার মেয়ের এই যে মিথ্যে মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা গুলো তুমি ছাড়া আর কেউ এই পৃথিবীতে বিশ্বাস করবে না,

দামোদর বাবু ভুরু কুঁচকে বললেন ,
দামোদর বাবু -কি বলতে চাইছো তুমি আমার মেয়ে মিথ্যে কথা বলে?

কৌশিকী দেবী -সে আর বলতে ,যার বাবা সারা গ্রাম ময় মিথ্যে বলে বলে বেড়াচ্ছে সে  তো মিথ্যা কথাই শিখবে। সত্যি কথা কি আর তার মুখ দিয়ে বেরোবে,

কথাটা বলে জোর করে দামোদার বাবুর কোল থেকে স্রোতস্বিনীকে বের করে আনতে চাইলেন তবে সে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে আছে নিজের বাবার সাথে সে কিছুতেই মায়ের কাছে যাবে না।নিজের বাবার কাছে  ধরা পড়ে গেছে তারপরেও ওর বাবাই ওর কাছে এখন সেভজোন তাই জন্য সে মায়ের কাছে যেতে রাজি হচ্ছে না যে করেই হোক স্কুল যাওয়াটা বানচাল করতে হবে, এটাই এখন ঘুরছে স্রোতস্বিনির মাথায়। টিচার না মারলেও প্রচুর বকে ,ধমক দেয় যেগুলা স্রোতের একদম পছন্দ নয় তার থেকে তো এই ভালো যে সে চিরটাকাল বাবার কাছে থাকবে আর গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে, আবার সকাল বেলা উঠে মায়ের সাথে সাথে ঘুরবে মা ওকে আদর করে খাইয়ে দেবে এ ছাড়া আর কি চাই, কি দরকার এসব পড়াশোনার, স্কুলে যাওয়ার এটাই ঘুরতে থাকে স্রোতস্বিনী ছোট্ট মাথাটায়।
কিন্তু ওর বাঁধা ধোপে টিকল না ওর মা ওর বাবার কাছ থেকে ওকে নিয়ে নিয়ে জোর করে খাইয়ে দিলেন ভাতগুলোকে ভালো করে সিদ্ধ করে পিষে রেখেছেন আগে থাকতে। যাতে খাওয়ার সময় গলায় না বেঁধে যায় ,নইলে এরকম কাঁদতে কাঁদতে ভাত গালে দিলে গলায় বেঁধে গিয়ে আরেক কান্ড বাধাতে স্রোতস্বিনীর দুবার ভাবতে লাগেনা।খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন স্রোতস্বিনীকে কৌশিকী দেবী, কিন্তু নিজের বাবার বুকে শুতে না পেরে ঘুম আসে না স্রোতস্বিনীর তাই সে উসপাস করতেই থাকে।তার মা তাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন কিন্তু তারপরেও তার কটা কটা চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই ,আধ ঘন্টা যাবৎ এই ঘটনা ঘটার পর কৌশিকী দেবী ভারী গলায় বললেন, 
কৌশিকী দেবী -কি হচ্ছে কি স্রোত ঘুমাও, নইলে কিন্তু কালকে স্কুলে রেখে দিয়ে চলে আসবো আর নিয়ে আসবো না বাড়ীতে।

স্রোতস্বিনী মৃদু গলায় বলল, 
-বাবার কাছে শোবো তো আমি ,বাবা কোথায়?

কৌশিকী দেবী- বাবা আজকে কাজে গেছে, আসতে পারবেনা রাতে, ঘুমাও চুপচাপ।
মায়ের ধমক শুনে স্রোতস্বিনী মায়ের বুকেই মুখ গুঁজে জড়িয়ে ধরলো মাকে।কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়ল বেচারী , মাসের দু তিনবার এমন দিন আসে যখন বাবা বাড়িতে থাকে না রাতের বেলা, তখন স্রোতস্বিনীকে কষ্ট করে ঘুমিয়ে পড়তে হয় মায়ের সাথে। গল্প শোনা আর হয় না ,মা গল্প বললে সে আনন্দটা স্রোতস্বিনী উপভোগ করতে পারে না যেটা বাবা বললে করে। তার মানে এমনটা নয় যে মা গল্প বলে শোনায় না ,মায়ের কাছ থেকেও গাদা গুচ্ছের গল্প সারাদিনে শোনে স্রোত তবে বাবা গোয়েন্দার গল্প শোনায় যেগুলো স্রোতের বেশি ভালো লাগে।


---

মুখার্জী বাড়ির ছোট ছেলে সমুদ্র এখনো নিজের রং পেন্সিল গুলো নিয়ে আঁকিবুকি কেটে চলেছে ড্রয়িং খাতাটায় এমন সময় একটা গম্ভীর গলা শোনা গেল যেটা শুনে সমুদ্রের হাত থেকে রং পেন্সি টা পড়ে গেল।

-এত রাতে জেগে আছো কেন তুমি ?
গলাটা ছিল সমুদ্রের বাবা প্রশান্ত বাবুর । বাবার গম্ভীর গলা শুনলেই সমুদ্রের গলা শুকিয়ে আসে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দেয় এটা কেন হয় সেটা সমুদ্র নিজেও জানেনা, তবে এমনটাই হয়ে আসছে ।তেমনভাবে খুব ভালো সম্পর্ক সমুদ্রের সাথে প্রশান্তবাবুর গড়ে ওঠেনি এটাই কি মূলত কারণ নাকি অন্য কিছু সেটা জানা নেই ।কিন্তু ,প্রতিবার এমনটাই হয় ।সমুদ্র মাথা নিচু করে নিজের আঁকাটাকেই পর্যবেক্ষণ করছিল, মাথা তুলে তাকানোর সাহস তার এই মুহূর্তে হচ্ছে না।আবারো প্রশান্ত বাবু বলে উঠলেন, 
প্রশান্ত বাবু -আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করলাম তো জেগে আছো কেন এখনো, কাল থেকে স্কুল যেতে হবে এখনো জেগে জেগে এসব করে যাচ্ছ কেন?

সমুদ্র আমতা আমতা করে বলল,
-এইতো বাবা শুয়ে পড়ছি,কথাটা বলে বিছানার মাঝখানে যে ছোট্ট বালিশটা ওর জন্য বরাদ্দ সেই বালিশটার উপর উল্টে শুয়ে পড়ল, 

বিছানার মধ্যে ড্রয়িং বুক কালার পেন্সিল সব ছড়ানো ছেটানো রয়েছে । ছেলেটা তার গাধা হচ্ছে দিন দিন এটাই প্রশান্ত বাবুর মনে হল। সবেমাত্র প্রশান্ত বাবু কিছু বলতে যাবেন তার মধ্যেই ওনার স্ত্রী গঙ্গা দেবী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন উনি ঘরের বাইরে থেকেই নিজের স্বামীর গম্ভীর গলা শুনতে পেয়েছেন সমুদ্রের গলা অবশ্য এতটাই মৃদু ছিল যে শোনা যায়নি। 
.
.
.
ক্রমশ…

গল্পটা পড়ে মন্তব্য করার আর ভালো লাগলে অনুসরণ করে পাশে থাকার অনুরোধ রইল।