Read Blue buffalo raft (Bengali) by Soumen Moulik in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

নীল খামেদের ভেলা (Bengali)

Soumen Moulik

mouliksoumen@gmail.com

... নীল খামেদের ভেলা

(১)

তখন ছিল শীতের সন্ধ্যে। কলকাতায় সেবার বেশ ভালো ঠান্ডা পরেছে| বাইরে অদ্ভুত একটা মেরুদন্ড কাপানো হাওয়া চলছিল সকাল থেকে। রোদ ওঠেনি। একটা ম্যাদামারা ওয়েদার। দরজা জানলা বন্ধ ঘরে সিগারেটের পর সিগারেট উড়িয়ে গা গরম করছিল তুহিন। শীত পড়লে একটু বেশি-ই স্মোক করা হয়ে যায়। সন্ধে ৭ টা। তুহিনের রুম-এর দরজায় টোকা পড়েছিল।

- কে?

- দাদা, আমি শুভঙ্কর।

শীতকালিন আলস্য কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল তুহিনকে। লম্বা, রোগা-পাতলা চেহারার তুহিন। এমনিতে শান্ত স্বভাবের। ভাবুক ও বলা চলে। মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় কথা বলতে বলতে। তাই বোঝা যায় শান্ত হলেও, মনটা খুব চঞ্চল। তবে সেই চঞ্চলতা বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায়না। যারা তুহিনকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে তারা বুঝতে পারে। পাঞ্জাবীর উপরে চাদরটা চাপিয়ে নেয় তুহিন। দরজা খোলে। বয়সে বেশ ছোটো, আপাদমস্তক শীতপোশাকে ঢাকা, মাঝারি হাইটের শুভঙ্কর একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে।

- হাই, আমি শুভঙ্কর। তোমায় ফোন করেছিলাম বিকেলে। আমাকে এই রুম-টা অ্যালট করেছে আজ থেকে।

- অ! হ্যা, ভিতরে এসো, ওয়েলকাম টু ইওর নিউ হোম।

সৌজন্যের হাসিতে তুহিন অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তার নতুন রুমমেটকে। ব্যাগপত্র বিশেষ ছিলনা। প্রথমদিন যেরম সেরম করে কাটিয়ে দেবে বলে বেশী কিছু আনেনি শুভঙ্কর।

- এসো, এইযে এই খাট-টা তোমার। এক্স্ট্রা একটা গদি আছে, ইচ্ছে হলে সেটা পেতে নিতে পারো, নয়তো নতুন গদি কিনতেও পারো। যেটা তোমার ইচ্ছে।

ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছিল চারপাশটা শুভঙ্কর। প্রচন্ড নোংরা না হলেও কিছুটা অপরিষ্কার তো বটেই। তবে সেসব নিয়ে সে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। ঘরে দুটো খাট। একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। এক ঝলক দেখে বলে দেওয়া যেতে পারে যে টেবিলটা ব্যবহার হয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য। দেওয়াল আলমারির ধাঁচে তাক করা আছে দেওয়ালে। সেখানেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়ে থাকে। কিছু হাতের কাজ করা সুন্দর জিনিস রাখা তাকে। কাগজের। বেশ যত্ন করে রাখা সেগুলো। যে যত্ন অন্য জিনিসগুলো অতটা পায় বলে মনে হয়না। হয়তো কারও দেওয়া উপহার। এঘরে তাকগুলোর বেশীরভাগটাই যদিও বইয়ে ঠাসা। একঝলক দেখে সে বুঝতে পেরেছিল সেগুলোর কোনওটাই টেকনিকাল নয়। তাকে রাখা বইগুলো দেখতে দেখতে শুভঙ্কর জবাব দিয়েছিল,

- গদি আছে যখন এটাতেই চালিয়ে দেব... এই বইগুলো সব তোমার?

তুহিনের বেশ ভালো লেগেছিল ছেলেটাকে। বুঝতে পারে সব পরিস্থিতিতেই মোটামুটি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে ছেলেটা। নয়তো প্রথমবার হোস্টেল-এর রুম-এ ঢুকে নাক সেঁটকায়না এরম পাবলিক খুব কম-ই আছে। তুহিন জবাব দেয়,

- হ্যা আমারই। গালিব থেকে মার্ক্স, সবই পাবে... স্মোক করো ?

- হ্যা করি। তবে দাদা, আমি অনেক ছোটো। তুমি টা ঠিক নিতে পারছিনা।

এতটাও সহজভাবে হোস্টেল লাইফ শুরু হবে সেটা ও ভাবেনি। গোল্ডফ্লেক-এর প্যাকেটটা তুহিন বাড়িয়ে দিয়েছিল শুভঙ্কর-এর দিকে। একটা সিগারেট বের করে শুভঙ্কর বাথরুম-এ ছুটেছিল। ‘ঠ্যাঙ্ক-ইউ’ বা তার উত্তরে ‘ওয়েলকাম’ – ইত্যাদি ফর্মালিটির প্রাচীর ভেঙ্গে গিয়েছিল তখনই।

(২)

তারপর প্রায় মাসদুয়েক কেটে যায়। শুভঙ্কর সঙ্কুচিত হয়ে ‘শুভ’ তে পরিণত হয় আর তুহিন দাদা থেকে ‘বান্টিদা’। বান্টি তুহিনের ডাকনাম। এই নামেই ক্যাম্পাসে সে বেশী পরিচিত। যদিও পরিচিতি তার খুব অল্পজনের মধ্যেই। কিছু মানুষ হয়ই এরম একটু অন্তর্মুখী প্রকৃতির। তাদের নিজেদের একটা জগৎ, মানে একান্তই নিজেদের একটা জগৎ তারা বানিয়ে নেয়, তা সে যেখানেই যাক। বইপত্র, গান শোনা ইত্যাদি নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে তুহিন। এদিকে ইতিমধ্যে নুতুন প্রেম শুরু হয়েছে শুভর। পৃথা। শুভদেরই ব্যাচমেট। তুহিনকে সেকথা অবশ্য লোকায়নি শুভ। সিনিয়র রুমমেট দাদা, একরকমের লোকাল গার্জেন-ই হয়ে ওঠে। কাল পৃথার জন্মদিন গিয়েছে। বন্ধুবান্ধব দের মধ্যে একচোট পার্টি হয়ে গিয়েছে। আজ একটা স্পেশাল পার্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুধু পৃথা, শুভ আর তুহিন। সাধারণতঃ তুহিনের দিনলিপিতে পার্টি জিনিসটি বিরল। তবে আমন্ত্রণ যখন খোদ রুমমেটের থেকে তখন না করাও যায়না। আর এটা ঠিক সে অর্থে পার্টি-ও না। টুকটাক সান্ধ্যভোজন বলা যেতে পারে। এই সুযোগে পৃথার সাথে তুহিনের আলাপ করাবে ঠিক করে রেখেছে শুভ। করানোটা দরকার-ও। তুহিন যেমন পৃথার কথা জানে, সেরম পৃথাও গল্পে গল্পে ‘বান্টিদা’ কে চিনেছে। এবার সাক্ষাৎ-এর সময়। কমলদার ফাস্ট-ফুড এর দোকান আর তারপর বটতলায় আড্ডা – আপাতত সেরমটাই ঠিক হয়েছে।

- স্যরি! একটু লেট হয়ে গেল।

শুভ বলে ওঠে অ্যাট লিস্ট আজ একটু তাড়াতাড়ি...

- স্যরি, স্যরি, স্যরি।

এদের ছেলেমানুষী দেখে তুহিন মুচকি হাসে। শুভ আলাপের উদ্যোগ নেয়,

- বান্টিদা, এই হল পৃথা। অ্যান্ড পৃথা, এই হল বান্টিদা।

তুহিন আর পৃথা দুজনেই হেসে ওঠে। তুহিন বলে,

- ভাই! ভাগ্যিস বললি। নয়তো আমরা চিনতেই পারতাম না।

সকলে হেসে ওঠে।

চা আর টুকটাক খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটিয়ে নিয়ে তিনজনে বটতলার দিকে যায়। বটতলার ধাপিতে বসে তুহিন শুনতে থাকে কিভাবে ওদের আলাপ হল, কে কবে কিভাবে আগে প্রোপোস করল। অন্যজনের মুখ-টা সেসময় কিরম হয়েছিল – ইত্যাদি ইত্যাদি। পৃথাকে বেশ মিশুকে বলেই মনে হয়। খুব কথা বলতে ভালোবাসে। আর মন খুলে হাসে। শুভ ছেলেটাও মিশুকে। এদের জুড়ি টা বেশ ভালো লাগে তুহিনের। কোথায় যেন তুহিন পড়েছিল যে সমবয়স্ক ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে মেয়েরা বেশী ম্যাচিওরড্‌ হয়। তথ্যের সত্যি-মিথ্যে তুহিন জানেনা, তবে এক্ষেত্রে পৃথার সাথে প্রথম আলাপে ব্যাপারটা সত্যি বলেই মনে হল।

- বান্টিদা, আমাদের কথা তো অনেক হল। এবার তোমার গল্প শুনব।

পৃথার দাবীতে সম্বিত ফেরে তুহিনের। পাশ থেকে শুভ একগাল ফচকেমি হাসিতে বলতে শুরু করে,

- বান্টিদা, চেপে গেলে চলবে না। প্রায়রাতেই শুনি আমি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি ফোনে কথা বলছ। এই ঠান্ডাতেও যখন এত কৃচ্ছসাধন, তখন সে ব্যক্তিবিশেষ স্পেশাল না হয়ে যায় কিকরে? আর ঘরের তাকে ঐ হাতের কাজ করা কাগজের গিফট্‌-গুলো। সেগুলো তুমি বানিয়েছ বলে তো মনে হয়না। নির্ঘাৎ বৌদি গিফট্‌ করেছে ওগুলো তাইনা? তাই বেশ যত্ন-আত্তি করে রাখা। সুতরাং, চাপাচুপি না করে আজ একটু খোলসা করে বলতেই হবে কিন্তু।

তুহিনের হাসি সবসময়ই সীমিত। পৃথার ঠিক উল্টো। কদাচিৎ-ই হাসবার সময় দাত দেখা যায়। গালের চামড়া বাদ দিয়ে বাকি শরীরের কোথাও খুব একটা উত্তেজনা তৈরী হয়না। অবশ্য চোখগুলো কথা বলে তুহিনের। খুব এক্সপ্রেসিভ চোখদুটো।

- রাতে না ঘুমিয়ে, জেগে জেগে এইসব করা হচ্ছে তাহলে আজকাল।

- আরে না না! মাঝেমাঝে কানে আসে তাই বললাম। রাগ করলে নাকি আবার?

- হাহা! ধুর! রাগের কি আছে। হ্যা, ওগুলো ওর-ই বানানো। খুব সুন্দর হাতের কাজ করে। আমার রুমালে একটা নকশা করা আছে দেখিস। ওটাও ওর করা। আমার মত বে-গুণ নয়। আমাদের তো অনেকদিনের প্রেম। সেই স্কুল থেকে। তাই তোদের এখন যে উচ্ছাস টা দেখি, সেরমটা অনেকদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি। এখন শান্ত-ধীর-স্থীর একটা ব্যাপার। তোদের দেখে এখন বেশ ভালো লাগে। নিজের পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পরে। তোদেরও যখন ৬-৭ বছর পেরিয়ে যাবে তখন অনুভব করবি। তবে তার মানে এরম নয় যে পুরনো প্রেম একঘেয়ে হয়ে যায়। আসলে বয়সের সাথে সাথে প্রেম বস্তুটাও একটা অদ্ভুত আকার নেয়। প্রেম টা কখনও পুরনো হয়না, শুধু রূপ টা বদলাতে থাকে। স্কুল লাইফের প্রেম টা একরকম। লুকিয়ে দেখা করা, টিউশন ফেরৎ অচেনা গলি দিয়ে সাইকেল নিয়ে ফেরা, পথ হারিয়ে ফেলা, দেরী করে বাড়ি ফেরার জন্য বকুনি, আবার পরদিন দেখা হবে সেটা ভেবে একটা উত্তেজনা। আবার আরেকটু বড় হলে যখন চিন্তাভাবনা বদলায়, তখন বিশ্বাসের জায়গাটা আরও পোক্ত হয়। কিছুক্ষেত্রে দূরত্ব বারে, পড়াশোনার খাতিরে, চাকরির খাতিরে। কিন্তু কদিন পরপর আবার যখন কথা হয় তখন মনেও হয়না যে ও অনেকটা দূরে আছে। মনে হয় যেন এইতো পাশেই কোথাও আছে। আবার ধর, বিয়ের পরেও প্রেম টা একটা অন্য রূপ নেয়। দায়িত্ব, সংসার সব মিলেমিশে একটা অন্য স্বাদ। কি বুঝলি?

শুভ, পৃথার হাতটা ধরে। আঙ্গুলের ফাকে আঙ্গুল, অঙ্গীকারবদ্ধ, যেন নীরবে শপথ করে যায় যে তারাও একদিন এই অনুভূতি- টার সাক্ষী হবে, আজ যেটা ওদের বান্টিদা অনুভব করছে। মুহুর্তের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পৃথা জিগগেস করে,

- কি নাম তার বললেনা তো বান্টিদা। ফেসবুকে আছে?

- টুকাই। ডাকনাম। ওর ভালোনাম নন্দিনী। নন্দিনী রায়। আছে ফেসবুকে।



(৩)

খুটখাট আওয়াজে রাতে ঘুম-টা ভেঙ্গে যায় শুভর। হালকা ঠান্ডা এখনও আছে। কম্বল থেকে বেরিয়ে খাট থেকে নেমে আলো জ্বালার মত পাপকাজ করার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। একবার শুধু ও মাথাটা কম্বল থেকে বের করে দেখার চেষ্টা করে তুহিন কি করছে। বিছানাটা খালি দেখতে পায়। ব্যালকনি থেকে ভ্যাজানো দরজার ফাক দিয়ে আবছা আলো আসছে। তুহিনদা তবে কথা বলছে ফোন-এ। মনে মনে হেসে আবার শুয়ে পরার উদ্যোগ নেয় শুভ। তারপর ভাবে একটু কানপেতে শুনবে।

- আমার তো ইচ্ছা পরের বছর শীত-এ। বিয়ে-থা শীতকালে করাই ভালো।

- ()

- শীতকালে লোকজন খেয়েও তৃপ্তি পাবে। কি বুঝলে?

- ()

- হাহা! আরে সে হানিমুন-এ কোথায় যাওয়া যায় সেটা অন্তত তুমি ভাবো। সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে?

- ()

- আচ্ছা বাবা আচ্ছা! আমি-ই ঠিক করবো। উমমমমমম... লাক্ষাদ্বীপ টা যাওয়াই যায় কি বলো?

- ()

- পাহাড়ে যাবে? তুমি কি সুইজারল্যান্ড ভাবছো নাকি। অত বাজেট কিন্তু সামলানো যাবেনা।

- ()

- আচ্ছা বাবা! আপাতত তাহলে লাদাখ টা ঠিক থাক। বাকিটা তো দেখছি। সুইজারল্যান্ড তো আমারও ড্রিম।

- ()

- আমি ভালোবাসিনা? হেহে... মাথায় গাট্টা খেয়েছো?

- ()

- এইতো আসবো বাবা...

চোখদুটো বুজে আসে শুভর। অদ্ভুত একটা স্বস্তি লাগে ওর এই কথাগুলো শুনে। কি সুন্দর খুনসুটি। আর কদিন পর বিয়ে। হানিমুন। ওর নিজের সম্পর্কটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরে।

(৪)

পরদিন সকালে যখন ক্লাস-এ বেরোয় শুভ, তখন তুহিন ঘুমাচ্ছিল। যেদিন যেদিন রাতে ও কথা বলে তার পরের দিনগুলো বেলা করে ওঠে। সেটা শুভ জানে, তাই আর ডাকেনি। সারাদিন ক্লাস-এর পর পৃথার সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় কাল রাতের ঘটনাটা হাসতে হাসতে বলে শুভ।

- তুই এরমভাবে কান পেতে শুনলি? সত্যি, তুই পারিস বটে। বান্টিদা জানতে পারলে কি ভাববে?

- আরে কিছুই ভাববে না। বান্টিদা এসব ব্যাপারে কুল।

- তাও! অন্যের কথা আড়ি পেতে শোনা ঠিক না। অন্যের চিঠি পড়া যেমন ঠিক না, সেরমই।

- আচ্ছা বাবা আচ্ছা... ঠিক আছে।

- বাব্বা! কবে থেকে এরম বাধ্য হলিরে!

- হেহে, আরে কাল রাতে বান্টিদার থেকে আমদানী।

- বান্টিদাই পারে তোকে শোধরাতে। জংলী একটা। পাগোল।

খুনসুটি করতে থাকে দুজনে। বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে এই কদিনে। কখন যে দুটো আলাদা জীবন এভাবে একপথে চলে আসে... ম্যাজিক এর মতো। একটা ঘোর। এই ঘোর-টা নেশার মত আচ্ছন্ন রাখে এদের দুজনকে।

- শুভ। একদিন বান্টিদাকে বলনা। সবাই মিলে ঘুরতে যাই। আমরা চারজনে। খুব মজা হবে।

- হ্যাঁ বলাই যায়। নন্দিনীদির সাথে আলাপও হয়ে যাবে। হ্যারে নন্দিনীদি ফেসবুকে তোর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা অ্যাক্সেপ্ট করেছে রে?

- না রে। খুব একটা ফেসবুকে থাকেনা বোধহয়। অনেকদিন হতে চলল পাঠিয়েছি। এখনও করেনি।

- আরে আমারটাও করেনি। বান্টিদার মুখে আমাদের কথা শোনেনি সেটা তো আর হতে পারেনা। শুনেছি আমি বান্টিদাকে, আমাদের কথা বলছে নন্দিনীদিকে। ফোনে।

- কবে শুনলি, কাল?

- নানা। কাল নয়। মাঝে একদিন শুনছিলাম। একজ্যাক্টলি মনে নেই। আমার না নন্দিনীদিকে কিরম নাকউচু নাকউচু মনে হয়।

- মানে?

- মানে, আমার মনে হয় ইচ্ছে করেই অ্যাক্সেপ্ট করেনি।

- ধুর! তা কেন হবে।

- জানিনা। তবে দিদিকে আমার কেন জানিনা একটু ঘ্যানঘ্যানে টাইপ-এর মনে হয়।

- কেন বলছিস এরম? তুই কখনও কথাও বলিসনি, দেখিসনি সামনাসামনি। তাহলে?

- আরে, একতরফা কথা শুনেও তো কিছু বোঝা যায়।

- কিরম শুনি?

- বান্টিদা আর নন্দিনীদির কথা বলার টপিকগুলো কিরম যেন একই। মানে, একই ব্যাপার নিয়েই কথা বলতে দেখি। এই ধর, বিয়ে, হানিমুন, এগুলো নিয়ে আগেও অনেকবার শুনেছি। কালকের মত এতটা মনোযোগ দিয়ে শুনিনি হয়তো। কিন্তু একতরফা কথা শুনে কিরম যেন মনে হয় যে ওপাশ থেকে একই ব্যাপার নিয়ে একজন রোজ ঘ্যানঘ্যান করে, আর এদিক থেকে বান্টিদা ধৈর্যসহকারে সেগুলোর উত্তর দিয়ে যায়।

- এটা তো তোর ভুল-ও হতে পারে। বান্টিদাকে কদিন-ই বা হল আমরা চিনেছি। আর নন্দিনীদি-কে তো চিনিইনা সেভাবে। যেটুকু শোনা, বান্টিদার মুখেই।

- সেটা ঠিক। তাও আরকি। বান্টিদা যতই বলুক যে একঘেয়েমি আসেনা, আমার তো মনে হয় যেন এরা দুজনেই নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে এখন একঘেয়েমিতে ভোগে। হয়তো কেউ-ই আর একে-অন্যকে আগের মত সিরিয়াসলি ট্রিট করেনা।

- এসব কি আবোল-তাবোল বলছিস বলত?

- আবোল-তাবোল? ...তাই যেন হয়।

- তুই আবার বান্টিদা কে এসব নিয়ে কিছু বলেছিস নাকি?

- নানা। পাগোল নাকি। এরম বলা যায় এগুলো !

- হুম্‌। এত জলদি একজন সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। কি বুঝলে?

- বান্টিদা থেকে আমদানী?

- হাহা... একদম ঠিক বলেছিস। এই ‘কি বুঝলে’ টা বান্টিদার মুখে দারুণ লাগে।

আড্ডা, হাসি, গল্প, আবার হাসি – সারাদিনের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেয় ওরা রোজকারের মতো। মায়ের মতো পৃথার ধরে ধরে বোঝানোটা খুব ভালো লাগে শুভর।

(৫)

সাধারণতঃ উল্টোটাই হয়ে থাকে। সেদিন কোনও এক কাজে বোধহয় তুহিন সকাল সকাল বেরিয়েছে। জানালার পর্দা সরানো ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তীব্রতা বাড়ায় একসময় আলস্য কাটিয়ে উঠতেই হয় শুভকে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে ঘড়িটা দ্যাখে। অনেক লেট হয়ে গিয়েছে। এখন ক্লাস-এ যাওয়ার থেকে না যাওয়া ভালো। মোবাইল টা হাতে নিয়ে খেয়াল করে পৃথার এস-এম-এস। সাইলেন্ট থাকায় বুঝতে পারেনি। ক্লাস চলছে এখন। তাই শুভ কল্‌ না করে একটা এস-এম-এস ই করল। জানালো আজ শরীরটা ভালো নেই, তাই যাবেনা। এদিকে ল্যাপটপ এ চার্জ ও নেই আর লোডশেডিং। চূড়ান্ত বোর হওয়া থেকে একমাত্র বাঁচার উপায় বান্টিদার ল্যাপটপ। কিন্তু বান্টিদার অবর্তমানে কখনও সেটা ব্যবহার করেনি শুভ। আর পাসওয়ার্ডও সে জানেনা। বান্টিদাকে ফোন করাটাই বেটার বলে মনে করল ও।

- হ্যালো, বান্টিদা, বলছি লোডশেডিং, আর আমি বাঙ্ক মেরেছি। তোমার ল্যাপির পাসওয়ার্ডও টা একটু বলবে। একটু অকাজ করব নেট এ।

- ()

- ওকে। আর টাটা ফোটন টাও নিচ্ছি একটু।

- ()

- ওকে। ঠ্যাঙ্কু। তুমি ফিরবে কখন?

- ()

- আচ্ছা। ঠিক হ্যায়। চলো টাটা। বাই।

তুহিনের ল্যাপটপ-এ যা চার্জ আছে তাতে টুক করে একবার মেল আর ফেসবুক টা আরামসে চেক করা হয়ে যাবে। টাটা ফোটন টাও ব্যবহার করা যাবে যখন তখন কাজে লাগানো যাক। মেল চেক করার পর ফেসবুকে বেশ কিছুক্ষণ এটা-ওটা করে শুভ। তারপর হঠাৎ কি মনে হওয়ায় ও নন্দিনীর প্রোফাইল টা সার্চ করে। বেশী বেগ পেতে হয়না। নন্দিনী রায়। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দের মধ্যে কেবল একজন-ই। বান্টিদা। এখনও নন্দিনী রিকোয়েস্ট টা অ্যাক্সেট করেনি। স্ক্রল করতে করতে নন্দিনীর প্রোফাইল-এ খানাতল্লাশী করতে থাকে। লাস্ট পোস্টগুলো বেশ পুরনো। শুভ আপন মনে জিভ কাটে। তাহলে পৃথাই হয়তো ঠিক বলেছিল। দিদি ফেসবুক খুব একটা ব্যবহার করেনা তাহলে। যদিও আজকাল পোস্ট হাইডও করা যায়। দুমদাম দিদিকে নাকউঁচু ভাবাটা ঠিক হয়নি। মনে মনে একটু লজ্জাও বোধ করল। একজনের সম্বন্ধে না জেনেই হয়তো অনেক বিরূপ কিছু ভাবা হয়ে গিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই ল্যাপটপ-টা বন্ধ হয়ে যায়। চার্জ শেষ। এখন আর রুম-এ বসে থাকার কোনও মানে হয়না। পৃথাকে একটা এস-এম-এস করে বটতলায় অপেক্ষা করতে বলে ও বের হয়।

আড্ডা মেরে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যের মুখে। রুমের দরজা খোলাই ছিল। শুভ রুমের বাইরে একটা অপরিচিত জুতো দেখতে পায়। শুভ ঘরে ঢুকতেই তুহিন ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়।

- কি রে? কোথায় ছিলি? প্রেম করছিলি নাকি? আয়, বোস। তোর সাথে আলাপ করিয়ে দি। আমার বন্ধু সৌম্য। স্কুলফ্রেন্ড। ক্যাম্পাসে এসেছে একটা কাজে। আজ থাকবে। জমিয়ে আড্ডা মারব।

সৌম্য হাত বাড়ায় শুভর দিকে।

- হ্যালো। তোর কথাই হচ্ছিল। বসে পর। জোড়দার আড্ডা চলছে।

আড্ডার সাথে মিশে যায় শুভ। সে কত গল্প। ওর বান্টিদার ছোটোবেলার গল্প, সৌম্যর বর্তমান চাকরিজীবনের গল্প, ইত্যাদিতে মশগুল হয়ে যায় ধীরে ধীরে। নিজের অনেক কেচ্ছা-কীর্তির কথাও বলে। বেশ জমে ওঠে।



(৬)

রুমের মধ্যে খাটগুলো দুটো দুদিকে ছিল। সৌম্যদা থাকবে। তাই রাতে খাটগুলো জোড়া লাগিয়ে নেয় শুভ। সন্ধ্যে থেকে প্রচুর মদ খাওয়া হয়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিগারেট। শুভর হোস্টেল-এ এসে এই প্রথম মদ খাওয়া। তাও আবার বয়সে বড় দাদাদের সাথে। কিন্তু খুব ভালো লেগেছে ওর। বান্টিদা, সৌম্যদা, এরা কি সুন্দর মিশে যেতে পারে সব বয়সীদের সাথে। পুরো বন্ধুর মত। এর আগে ও এক-দুবার মদ খেয়েছে, তবে সেটা পাড়ার কালীপুজোয়, বা কোনও উৎসব-এ। তবে এতটা স্বাধীনভাবে, চিন্তাহীনভাবে খাওয়া এই প্রথম। তুহিন শুয়ে পড়েছে। অনেকটা খেয়ে নিয়েছে আজ ও, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে। শুভ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌম্যর সাথে গল্প করতে থাকে। কথাপ্রসঙ্গে ওর নন্দিনীর কথা মনে আসে। পুরোপুরি সুস্থ থাকলে হয়তো জিগগেস করতে পারতনা। কিন্তু এখন নেশা করার জন্য কৌতূহল টা যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। হঠাৎ ওর মনে হয়, সৌম্যদা কে জিগগেস করলে কেমন হয় !

যেমন ভাবা তেমন কাজ। এক মুহুর্ত নষ্ট করেনা শুভ।

- আচ্ছা সৌম্যদা, বান্টিদার কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে?

- কেন বলতো? হঠাৎ এই কথা।

- না, আমাদের বান্টিদা বলেছিল আছে। ডাকনাম টুকাই। ভালোনাম নন্দিনী রায়।

- আচ্ছা। ও নিজে বলেছিল?

- হ্যা। আমিওতো শুনি রাতে বান্টিদাকে কথা বলতে, ফোনে।

- আচ্ছা।

- কিন্তু আমরা, মানে আমি আর পৃথা ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম অ্যাক্সেপ্ট করেনি। কোনদিন কথাও হয়নি যদিও। অবশ্য সে নিয়ে বান্টিদা কে কিছু বলিনি।

- আচ্ছা। আর কি বলেছে ও টুকাই সম্বন্ধে?

- আর কিছু সেরম বলেনি। ঐ বলেছিল স্কুল-লাইফের প্রেম। আর ফোনে মাঝেমাঝে কথা শুনে মনে হয় পরের বছর শীতে বিয়ে হবে। এই আর কি।

- ফোনে ওদের কথা কিকরে শুনলি?

- না মানে, ঐ একতরফা কথা আরকি। বান্টিদা কি বলে সেটাই শুধু শুনতে পাই। তবে একটা কথা বলব? তুমি বান্টিদা কে আবার বোলোনা প্লিজ। আমি আর পৃথা দুজনেই ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। কারোরটাই অ্যাক্সেপ্ট করেনি। আমরা না কিছুই বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। আসলে বান্টিদার সাথে এতটাই ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে, তাই আর কি... পৃথার আসলে খুব ইচ্ছা একদিন সবাই মিলে ঘুরতে বেরোই। আমি, পৃথা, বান্টিদা, নন্দিনীদি – সবাই মিলে।

এক নিশ্বাস-এ শুভ বলে যায়। ওর বলা শেষ হলে কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে। শুভ ভাবতে থাকে এই কথাগুলো নেশার ঝোঁকে সৌম্যদা কে বলে সে ভুল করল কিনা। মুচকি হাসে সৌম্য, কিরম একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। অতঃপর সৌম্যই নীরবতা ভাঙে।

- অনেক রাত হল। চল শুয়ে পড়ি।

- হুম্‌। রাত তো হল। কিন্তু কিছু বললেনা যে!

- কি বলব?

- নন্দিনীদির ব্যাপারে।

আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌম্য বলে,

- আর-ও-সি-ডি সম্বন্ধে কিছু জানিস?

- সেটা আবার কি?

- রিলেশনশিপ-অবসেসিভ-কম্পালসিভ-ডিসঅর্ডার। কোনও সম্পর্ক-কে ঘিরে কোনও ব্যক্তির মোহাচ্ছন্নতা যখন একটা চূড়ান্ত মাত্রায় পোঁছে যায় তখন সেটা একটা মানসিক সমস্যার আকার নেয়।

- তার সাথে নন্দিনীদির কি সম্পর্ক? নন্দিনীদির কি কোনও...

- উঁহু... তুই যেটা ভাবছিস সেটা না।

- তাহলে? বান্টিদা? বান্টিদা-তো দিব্যি ঠিকঠাক। মানিসিক অবসাদে ভুগছে বলেও তো মনে হয়না। আর এই তো সেদিনও নন্দিনীদির সাথে ফোন-এ কথা বলছিল। ঠিকঠাক-ই তো আছে মনে হল সব।

- মানসিক সমস্যা মানেই সেটাকে অবসাদ হতে হয়না।

- তাহলে?

- আজ থেকে প্রায় মাসদশেক আগে একটা গাড়ী-দূর্ঘটনায় টুকাই মারা যায়। ও যে আর এই পৃথিবীতে নেই ভাই।

- কিসব বলছ?

- হ্যা। ওদের তো বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। বিয়ের কমাস আগেই এরমটা ঘটে। তারপর থেকেই বান্টি এই সমস্যায় ভোগে, যেটা হয়তো বাইরে থেকে দেখলে কোনও সমস্যাই নয়। টুকাই মারা গেলেও, বান্টি, তার দৈনন্দিন রুটিন থেকে কখনও বেরতে পারেনা। ওর মনের মধ্যে একটা বিরাট স্থান জুড়ে টুকাই বিরাজ করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাই এখনও ও টুকাই-এর সাথে কল্পনায় চ্যাট করে, কল্পনায় কথা বলে ফোন-এ, ওর একটা নিজস্ব জগৎ আছে, সে জগৎ-এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ টুকাই। সেটা ওর থেকে কোনদিন-ই কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সেই চেষ্টা করলে হয়তো হিতে বিপরীত-ও হতে পারে। মানসিক সমস্যাটা, মানসিক অবসাদে পরিণত-ও হতে পারে। ওর কাছের মানুষেরা ব্যাপারটা জানে। তাই সেটা নিয়ে অযথা আমরা ওকে বিব্রত করিনা। তাই, ওকে ওর মতো থাকতে দিস ভাই। ভালোবাসা বস্তুটা বড় দুর্লভ রে আজকাল। ও ভালোবাসতে চায়। ওকে ভালোবাসতে দে...

চল, অনেক রাত হল। এবার শোয়া যাক।

পাথরের মত শুনে যায় শুভ। ওর ঠোট ফুটে আর কোনও কথাই বের হয়না। জোড়া লাগানো দুটো খাটের একপাশে তুহিন আগে থেকেই শুয়ে ছিল। সৌম্য মাঝে শুয়েছে। আর শুভ আরেক ধারে শুয়ে পড়ে। এনিয়ে আর কোনও কথা বলেনা, বা বলতে পারেনা। ঘুমিয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। মাঝরাতে কিছু শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আবার শুভর। মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করে। বিছানায় তুহিনকে দেখতে পায়না। ব্যালকনি থেকে ভ্যাজানো দরজার ফাক দিয়ে আবছা আলো আসছে। কানপেতে শুনতে থাকে শুভ...

- আমার তো ইচ্ছা পরের বছর শীত-এ। বিয়ে থা শীতকালে করাই ভালো।

- ()

- শীতকালে লোকজন খেয়েও তৃপ্তি পাবে। কি বুঝলে? ............

- সৌমেন মৌলিক