তবুও বৃষ্টি আসুক
তবুও বৃষ্টি আসুক
বহুদিন পর আজ
বাতাসে বৃষ্টির আভাস,
মাটির সোঁদা অমৃত গন্ধ-
এখনই বুঝি বৃষ্টি আসবে
সবারই মনে উদ্বেগ-
তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার ব্যস্ততা।
তবু আমার মনে নেই বৃষ্টি ভেজার উদ্বেগ-
আমার চলার নেই কোনো লক্ষণীয় ব্যস্ততা।
দীর্ঘ নিদাঘের পর
আকাঙ্খিত বৃষ্টির সম্ভাবনা
অলক্ষ্য আনন্দ ছড়ায় আমার তপ্ত মনে --
আর আমি উন্মুখ হয়ে থাকি
বৃষ্টির প্রতীক্ষায় -
এখনই বৃষ্টি নামুক
বহুদিন পর আজ বৃষ্টি আসুক।
দীর্ঘ পথে না থাকে না থাকুক বর্ষাতি -
বৃষ্টির জলে যদি ভিজে যায় আমার সর্বাঙ্গ
পরিধেয় পোশাক-আশাক-
তবুও বৃষ্টি আসুক -
সমস্ত আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামুক
বৃষ্টি নামুক মাঠ-প্রান্তর ডুবিয়ে।
সে অমিতব্যয়ী বৃষ্টিজলের বন্যাধারায়
তলিয়ে যায় যদি আমার ভিটেমাটি
তলিয়ে যাই যদি আমি
ক্ষতি নেই।
তবুও বৃষ্টি নামুক
ইথিওপিয়ায়, সুদানে
খরা কবলিত, দুর্ভিক্ষ-পীড়িত
দুর্ভাগ্য জর্জরিত আফ্রিকায়-
সবুজ ফসল সম্ভারে ছেয়ে যাক
আফ্রিকার উদার বিরান প্রান্তর।
তার ও আগে বৃষ্টি নামুক
আমাদের বিবেকের মরুভূমিতে
সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক,
আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা, হৃদয়ের গ্লানি।
মানুষের জন্য মানুষের মমতা
ঝর্ণাধারা হয়ে যাক
বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে -
সব পিপাসার্ত প্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
বয়ে যাক অনন্ত ধারাজল হয়ে।
বহুদিন পর আজ
অজস্র ধারায় অঝোরে বৃষ্টি নামুক
আজ আমাদের ধূলি ধূসরিত
মলিন হৃদয়ের মাঠ-প্রান্তর জুড়ে ॥
প্রিন্সেস ডায়না স্মরণে
ডি, তুমি চলে গেছ
তোমার চলা থেমে গেছে চিরতরে --
নদীর গতি কি তাই থেমে গেছে
পৃথিবীর সব কোলাহল কি
নীরব হয়ে গেছে ?
পৃথিবীর সৌর প্রদক্ষিণ কি থেমে গেছে
থামেনি, জানি থামবে না।
ডি, তুমি চলে গেছ
আমার হৃদ-স্পন্দন থেমে গেছে
আমার কন্ঠ অজানা ব্যথায়
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে -
আর মনে হচ্ছে আমিই মৃত
আর তুমি ক্রমশ জেগে উঠছ
আমার অন্তরে অন্তরে।
আমার ভেতরে
অদৃশ্য ভূকম্পনে
যেন আজ এক বিশাল শূন্যতার
গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে।
ডি, এই পৃথিবীর কোলাহলে
এক দিন তুমি কন্ঠ মিলিয়েছিলে -
এই পৃথিবীর রাজপথে
তোমার অমূল্য পদচিহ্ন পড়েছিল-
সময়ের ধারাজলে কালের ঝাপটায়
ক্রমে ক্রমে মুছতে মুছতে
একদিন হয়তো অপসৃত হয়ে যাবে --
কিন্তু আমার হৃদয়ে
তোমার যে অনন্য ছবি এঁকে গেছ
পৃথিবীর কোনো রৌদ্র-জলে
তা মুছে যাবে না জানি।
ডি, তুমি আজ অমৃত লোকের বাসিন্দা-
একদিন ভুল করে নেমে এসেছিলে
আমাদের দীন মর্ত্যলোকে-
আমাদের ভালোবেসে।
তুমি তো চলে যাবেই
তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি
সে আমাদের ব্যর্থতা -
সুন্দরের কাছে আমাদের
শোচনীয় পরাজয়।
অমর্ত্যলোকবাসিনী ক্ষণিকের অতিথি
তোমার স্মৃতিই এখন আমাদের অমূল্য সম্পদ -
যেতে যেতে চলার পথে
অকৃপণ হাতে ছড়িয়ে গেছ
তোমার কুসুমাস্তীর্ণ যৌবনের
যে অমৃত সৌরভ -
তাই আজ আমাদের সম্বল
তোমার দেয়া মহার্ঘ উপহার।
ডি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে
প্রবহমান বাতাসে মিশে আছে
তোমার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ -
প্রভাতে পূর্বাকাশের
রক্তিম আভায় মিশে আছে
তোমার রাঙা অধরের হাসি --
আর নব প্রস্ফুটিত
রক্ত গোলাপের মাঝে
মিশে আছে তোমার গোলাপি ত্বকের আভা।
তোমাকে হারিয়ে তোমাকেই আজ
খুঁজে পেয়েছি আমরা মোহনীয় বেশে
নবতররূপে আমাদের মাঝে -
তোমাকে আমাদের অনন্ত অভিবাদন।
রাজপ্রাসাদের রাণী হিসেবে
হয়তো আর তোমাকে দেখতে পাব না-
হাজার ভক্তের মাঝে তোমার
হাসিমাখা সগৌরব উপস্থিতির আনন্দ
আমরা আর উপভোগ করতে পারব না -
আজ থেকে তুমি আমাদের হৃদয়ের রাণী হয়ে গেলে
হৃদয়ের আসনে ॥
একজন বীরযোদ্ধা
একজন বীরযোদ্ধা
যিনি স্বদেশের স্বাধীনতা
ছিনিয়ে এনেছিলেন শত্রু সৈন্যদের হাত থেকে
নিজের জীবনটাকে বাজি রেখে
একজন বীর সেনানায়ক
যিনি রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটেছেন
সহযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয়
দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্য -
বিশ্রামের পাননি যিনি এতটুকু অবকাশ।
সারাক্ষণ যিনি গোলাগুলির শব্দ
আর বারুদের গন্ধের ভেতর
প্রিয় স্বদেশের মুক্তির স্বপ্ন
চিত্তে জাগ্রত রেখেছিলেন -
শুধুমাত্র দৃঢ়-আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে
একদিন সত্যি সত্যি বিজয়
ছিনিয়ে এনেছেন প্রিয় স্বদেশের জন্য -
বিশ্বের মানচিত্রে যিনি স্থান করে দিয়েছেন
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই ভূখন্ডকে -
সেই বীরযোদ্ধা মুক্তি সেনানী
একদিন কিনা নিহত হলেন তারই অধীনস্থ
কৃতঘ্ন উদ্ধত সেনা বাহিনীর হাতে
নিরস্ত্র অবস্থায়।
না, কোনো শত্রুসেনার গুলিতে নয় -
তারই প্রিয় সহযোদ্ধাদের গুলিতে
তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল -
যে স্ফীত বুকে তিনি ধরে রেখেছিলেন
তার স্বদেশের জন্য
তার দেশবাসীর জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা -
যে প্রশস্ত চওড়া লোমশ বক্ষদেশ ছিল
প্রিয় মাতৃভূমির দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যুহ-
সেই বিশাল বক্ষদেশ
বুলেট-বিদীর্ণ করে একদিন কিনা
বেরিয়ে এল অবিরল রক্তের ধারা
বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে।
বুকের তপ্ত তাজা রক্তে
সেই সেনানী স্বদেশের মাটি
রক্ত রঞ্জিত করে গেলেন।
একজন বীরযোদ্ধা যিনি সৈন্যসারির অগ্রভাগে থেকে
‘আক্রমণ করো, ঝাঁপিয়ে পড়’
বজ্র-গর্জনে জানাতেন আক্রমণের আহ্ববান -
উদ্ধুদ্ধ করতেন অচেতন দেশবাসীকে।
সেই তাঁর বজ্র কন্ঠস্বর আজ
নীরব হয়ে গেছে চিরতরে -
মধ্যরাতের নিঃশব্দে আসা
হিংস্র ঘাতকের অতর্কিত নির্মম অস্ত্রের গর্জনে।
যে বীরযোদ্ধা কোনোদিন পরাস্ত হননি
সম্মুখ যুদ্ধে -
সেই তিনিই আজ পরাজিত হলেন
চক্রান্তকারী ঘাতকের পশ্চাতভাগের আক্রমণে -
অস্ত্রহীন, প্রস্তুতিহীন এক অসম যুদ্ধে।
আমরা তো জানি
চক্রান্তকারী ঘাতকের দল
পশ্চাতে আক্রমন করে তাকে হত্যা করেছে--
অথচ যাকে কোনো শত্রু সৈন্য পরাভূত
করতে পারে নি
পারবেও না কোনো দিন।
সম্মুখ যুদ্ধে যিনি চির-অজেয়-বীর,
যোদ্ধার বেশে যিনি রণাঙ্গন
রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গন কাঁপানো বীর --
তোমাকে আমাদের নতশিরে সশস্ত্র অভিবাদন।
সেই রণজয়ী শত্রুজয়ী অজেয় বীর
তোমাকে আমাদের লাল সালাম।
আমাদের হৃদয়ে তিনি
চিরদিন বিজয়ী বীর-
যুদ্ধ-ফেরত শত্রু-বিজয়ী-বীর ॥
মায়ের কথা মনে হলেই
মায়ের কথা মনে হলেই
আমার ছায়াশীতল
শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত
একটি ছায়াবৃক্ষের কথা মনে পড়ে।
মায়ের কথা মনে হলেই
আমার মায়াবী জোছনার কথা মনে পড়ে
যার আছে আঁধার-নিবারক হিমেল আলো
অথচ উত্তাপ নেই।
মায়ের কথা মনে হলেই
চৈত্রের গরম-লাগা ভরদুপুরে
একটি শান্ত শীতল সরোবরের কথা মনে পড়ে-
যার জলে ঝাঁপ দিলে
মুহূর্তে জুড়িয়ে যায় দেহ-মনের উত্তাপ।
আর মনে পড়ে সেই দুটি চোখ
অফুরন্ত স্নেহ-ঝরা সেই দৃষ্টি-
যা সর্বক্ষণ ছায়ার মতো
আমার যাত্রাপথে নিবদ্ধ থাকত।
সেই শুভ দৃষ্টির অমৃত পরশ
সর্ব বিপদ-আপদ থেকে আমাকে
আগলে রাখত।
মায়ের কথা মনে হলেই
চলার পথে অদৃশ্য বনফুলের
হাওয়ায় মেশা অমৃতময় সৌরভের কথা মনে পড়ে--
যা নিমিষে অস্তিত্বের পরতে পরতে
মোহময় আমেজ ছড়িয়ে
সারাক্ষণ এ মনটাকে মাতিয়ে রাখে
সুমধুর সৌগন্ধে -
আমার চলার পথে নিরন্তর
আমায় ক্লান্তিহীন প্রেরণা যোগায়।
আর আমি একটু একটু করে এগিয়ে চলি
আরো এগিয়ে চলি
এক সময় গন্তব্যে পৌঁছে যাই ॥
সুলতা, বহুদিন পর আজ
সুলতা, বহুদিন পর আজ
তোমার উদ্বেগ-ভরা কোমল হাতের
স্পর্শ পেলাম --
আমার তপ্ত ললাটে
কোমল হাত ছুঁয়ে
তুমি পরখ করে নিলে আমার জ্বরের মাত্রা -
আর তোমার যাদু স্পর্শে
আমি যেন তখন থেকেই
একটু একটু করে আরোগ্য হয়ে উঠলাম।
সুলতা আমাকে তোমার
আঁচল তলে লুকিয়ে ফেলো
তোমার কোমল বুকের উম দাও -
দেখো পথ্যবিহীন কেমন দ্রুত
আমি নিরাময় হয়ে উঠি।
যখন সুস্থ হয়ে উঠার কথা ভাবি
তখন কোন অসুস্থতা ভরা উদ্বেগ
আমাকে পেয়ে বসে -
কেবলই মনে হতে থাকে
আমার সুস্থতা মানে
আরো কটি দিনের তোমার
সুমধুর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া -
তোমার আন্তরিক উদ্বেগ-মিশ্রিত শুশ্রূষা
থেকে আমার অব্যাহতি।
তুমি তো জান না
তুমিহীন সুস্থ জীবনে আমি কতটা অসুস্থ --
তুমি জান না
তোমার সান্নিধ্য সুখের অভাবে
আমি কতটা অসুখী --
তুমিহীন আমার জীবনে
নেমে আসে মৃত্যুহীন মৃত্যু ॥
বাবা, একদিন তোমার যে খোকাটি
বাবা, একদিন তোমার যে খোকাটি
চলার পথে ডানে বায়ে চলার
সঠিক ট্রাফিক নিয়মটি জানত না বলে
তাকে হাত ধরে
জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে --
আজ তোমার সেই খোকাকে
পথের মাঝে একা ফেলে
বল তুমি আজ কোথায় চলে গেলে।
বাবা, তোমার যে খোকাটি
খেলায় মেতে অবেলায়
ভুলে যেত ঘরে ফেরার কথা -
সন্ধ্যে বেলায় অনেক খুঁজে পেতে
শিউলি তলা থেকে
হাত ধরে নিয়ে আসতে
সস্নেহ শাসন করতে করতে --
আজ তোমার সেই খোকাকেও
রাতের বেলা হলেও
ঘরে ফেরার জন্য হাঁকডাক করতে ভুলে গেলে।
বাবা তোমার যে খোকাকে শৈশবে
সাঁতার শেখাতে নদীর ঘাটে নিয়ে যেতে
ছাড়তে না তার হাতটি একা --
পাছে জলের স্রোতে খোকা ভেসে যায় -
আজ জীবনের অথৈ জলে
তোমার সেই খোকা ভাসতে ভাসতে
হাবুডুবু খায় --
আর বাবা বাবা বলে আর্ত চিৎকারে
মাতিয়ে তুলে পরিপার্শ্ব --
আর তুমি কিনা তখনও
হাতটি তোমার বাড়িয়ে দিতে ভুলে গেলে।
এ কোন বিস্মৃতি আজ তোমায় পেয়ে বসেছে -
সব স্মৃতি বিস্মৃতির ওপারে
আজ তুমি চলে গেছ চিরতরে ॥
তিনটি ক্ষতি
মনে পড়ে সেই শৈশব
অনেক শখের বশে
সাধ করে একটি সাদা খেলনা ঘোড়া কিনেছিলাম-
খেলতে গিয়ে একদিন সে ঘোড়ার
দুঘর্টনাজনিত অঙ্গহানি ঘটে --
বহুদিন সে ঘোড়ার
অঙ্গ সংযোজন করে
তার হৃত সৌন্দর্য পুনরুজ্জীবিত
করতে চেয়েছি- পারিনি।
সে না পারার দুঃখ
ও ঘোড়ার অঙ্গহানিজনিত
দৈহিক সৌন্দর্য হানির ক্ষতি
বহুদিন ভুলতে পারিনি -
একদিন সে ঘোড়াও
কোথায় হারিয়ে গেছে -
শৈশবের সেই দুঃখ ভুলে
আনমনে হাতে অন্য খেলনা
উঠে এসেছে কখন মনে রাখিনি।
তারপরে কৈশোরে এসে
প্রিয় খেলা ক্রিকেটের অতি প্রিয়
ক্রিকেটের বল নিয়ে মাঠে খেলতে গেলে
আমারই দুর্দান্ত ব্যাটের আঘাতে
কখন যে বলটি গড়াতে গড়াতে
খাদের জলে তলিয়ে গিয়ে
সলিল সমাধি লাভ করে --
বহুদিন খোজাখুঁজি করার পরও
আমার সে খেলার ছোট্ট সঙ্গী
সবুজ ক্রিকেট বলটি
আজ ও খুঁজে পাইনি -
কৈশোরের সেই ক্রিকেট বল
হারানোর দুঃখ বহুদিন বুকে পুষে
রেখেছিলাম -
একদিন কৈশোরের সে দুঃখ ও
ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেছে
কালের গর্ভে,
কখন অন্য খেলায় মেতে উঠেছি,
পেছন ফিরে আর তাকাইনি।
আজ যৌবনে এসে
তোমাকে হারানোর ক্ষতি যেন
কিছুতেই ভোলা যায় না -
তোমার বিচ্ছেদ জনিত শূন্যতা
আর কিছুতেই যেন পূরণ হবার নয় -
তোমার তুলনা যে তুমি শুধু তুমি
তুমি ছাড়া তোমার শূন্যস্থান
শূন্যই থেকে যায় -
তোমায় হারানোর ক্ষতি
স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে জেগে থাকে
এ বুকের মধ্যখানে ॥
কদিন থেকেই বুকের মধ্যিখানে
কদিন থেকেই বুকের মধ্যিখানে
চিন চিন ব্যথা করছে -
সব বক্ষ-ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ব্যর্থ এখানে --
এক্সরে রিপোর্ট আর
কার্ডিওগ্রাফের সীমা ছাড়িয়ে
এ ব্যাধি বুকের অনেক গভীরে প্রসারিত...
ওরা জানবে কি করে
কার হৃদয়হীনতায়
এ কোমল বুকে কঠিন হৃদরোগ বাসা বেঁধেছে -
কার অনুপস্থিতিতে
এ ক্ষুদ্র হৃদয়ে বিশাল শূন্যতা
সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ একদিন তোমার মোহনীয় সান্নিধ্যে
এই বুকের হৃদ-স্পন্দন
আরো সজীব হওয়ার কথা ছিল-
অথচ আজ নষ্ট ঘড়ির বন্ধ কাঁটার মতো
এক জায়গায় এসে
আমার হৃদ-স্পন্দন থেমে গেছে
ব্যস্ত জীবনের মাঝে
তোমারই বিরহে ॥
তুমি কাছে ছিলে এতদিন
তুমি কাছে ছিলে এতদিন
বুঝতে পারিনি কতটা মন জুড়ে ছিলে আমার-
আজ এত বড় বাড়িটা
খাঁ খাঁ শূন্য বলে মনে হয় তোমার বিহনে-
যেদিক পানে তাকাই -
তোমার স্মৃতির আভাস পাই....
আলনায় হ্যাঙ্গারে ঝুলানো শার্টটা
শোকেসের উপরে রাখা ভাঙা চশমাটা
সাইড টেবিলে রাখা
পুরোনো মরচে পড়া হাত ঘড়িটা -
টিপয়ের উপরে
আধপড়া কবিতার অচেতন গ্রন্থটা -
সবকিছুতে তোমার স্মৃতি কথা বলে
নিঃশব্দ মুখরতায়...
আজও বাতাসে যেন
তোমার ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ
উষ্ণ সুবাস ছড়ায় -
অথচ তুমি চলে গেছ কতদিন আজ।
কিছু খুঁজতে গিয়ে খুঁজে না পেয়ে
তোমার মু-মু মৌ বলে হাঁকডাক তুলে
বাড়ি মাথায় করা সংলাপ --
‘কোথায় তুমি, কোথায় থাক?’
আদর মাখা বিরক্ত কন্ঠস্বর আজও শুনতে পাই --
কান পাতলে আজও শোনা যায়
সারা বাড়িময় তোমার অস্থির পদধ্বনি -
একদিন তোমার জীবনে
আমাকে এতটাই প্রয়োজন ছিল তোমার।
আর আজ আমি যেন ছাইদানিতে
তোমারই ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত জ্বলন্ত
সিগারেটের অবশিষ্টাংশ-
জ্বলে জ্বলে কেবলই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি -
আমার খোঁজ তুমি নিচ্ছ না বহুকাল -
ভুলে আছ, এই আমাকে বহুকাল ধরে ॥
সুলতা, বাসনার ফাগুনে
সুলতা, বাসনার ফাগুনে
ধরা যদি নাই দেবে
আকাঙ্খার আগুনে কেন পুড়ালে এ হৃদয় -
ভালবেসে ঘর বাঁধে নীড়ে পাখি
আর নদী ছুটে যায় সাগরে -
আমি কেন তবে ভালবেসে
ঘর ছাড়া বিবাগী ?
আমাকে তুমি দিলে না ঘর
দিলে বর --
বিরহ বিধুর বিষাদ-স্মৃতি।
যন্ত্রণার অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাই
আর ভাবি কেবল ভাবি
বিরহের এ তিক্ত গরল শেষে
তোমার মিলন-অমৃত সুধা
আমি কি পাব না
পাব না এ জীবনে?
যখন তোমার কথা ভাবি
যখন তোমার কথা ভাবি
মনে পড়ে দূর মহাশূন্যের
অন্তহীন মহাশূন্যতা -
মনে পড়ে নিঃসঙ্গ নির্জন
অন্তহীন সাগরের
ভেঙে ভেঙে পড়া ঢেউ -
আর আমি ভাসমান
একটি শূন্য ভেলায় -
চারিধারে কেউ নেই, কিছু নেই।
যখন তোমার কথা ভাবি
মনে পড়ে অনন্ত মরুতে
পথ হারানো
উদভ্রান্ত পথিকের আর্তচিৎকার -
মূক দিগন্তে বারবার
ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসা ॥
বিচলিত আকাঙ্খারা
হে বিচলিত আকাঙ্খারা
বুকের ভেতর
তোমরা কেন অস্থির হয়ে কাঁদো --
যখন বঞ্চনা আর ব্যর্থতাকে
আমি আমার অমোঘ সুকৃতি
বলে মেনে নিয়েছি
নিরুপায় চিত্তে --
তখন কেন তোমরা বারবার
প্রতারিত হয়েও আত্মপ্রতিষ্ঠা চাও।
কেন স্বপ্নের মাঝে এসে বারবার কথা কও।
তোমাদের জন্য হৃদয় আবেগ
প্রকাশ করা ছাড়া
যখন আর আমার দেবার কিছু নাই -
তবু কেন বারবার সমুখে এসে দাঁড়াও।
হে অবুঝ আকাঙ্খারা
আমাকে এবার মুক্তি দাও
বাসনার কারাগার হতে -
স্বপ্নের মায়াডোরে আর বন্দি করে রেখ না ॥
মনে পড়ে মা
মনে পড়ে মা
একদিন তুমি বলেছিলে,
মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায় --
মা তুমি নেই আজ -
অবেলায় আমাদের ছেড়ে
চলে গেছ তুমি চিরতরে
নিষ্ঠুরের মতন --
তুমি ও কি আজ দূর আকাশের তারা হয়ে গেছ ?
তাই আজ তারা ভরা
আকাশের দিকে তাকিয়ে
আমার যে আর ঘুম আসে না কিছুতে -
তোমার কথাই মনে পড়ে বারবার -
সমস্ত রাত জেগে কাটিয়ে দেই
খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে -
আর আকাশ ভরা হাজার তারার মাঝে
তোমায় খুঁজে বেড়াই।
মা, তুমি নেই
আজ ঘরের আলনায় রাখা
তোমার খোকার বিশৃঙ্খল পোশাক আশাক -
দিনের পর দিন অগোছালোই পড়ে থাকে -
পড়ার টেবিলে, শোবার বিছানায়
যত্রতত্র তোমার খোকার বই পত্তর
এলোমেলো পড়ে থাকে-
কেউ এগুলো সাজিয়ে রাখে না সযত্নে
নিঃস্বার্থ আন্তরিকতায়।
রান্না ঘরে এঁটো থালাবাসন
আজ আর কেউ পুকুর ঘাট থেকে
ঝকঝক তকতক করে নিয়ে আসে না।
ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরে এলে
আজ কেউ আর ললাটের ঘাম
মুছিয়ে দেয় না স্নেহ ভরা আঁচলে -
বলে না- কাপড় ছেড়ে খেতে আয় খোকা,
দেরি করিসনে যেন-
ব্যস্ত হয়ে পড়ে না কেউ
খাবার টেবিল সাজানোর আয়োজনে।
রাতে অসুস্থ শরীরে
বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লে
অতি সন্তর্পণে কেউ এসে
রোগজীর্ণ ললাটে উদ্বিগ্ন হাত রেখে
অসুস্থতার মাত্রা করে না পরিমাপ-
শরীর থেকে অলক্ষ্যে
পাশে এলিয়ে পড়া কাথাটা
কেউ আর খোকার শরীরে টেনে দেয় না
সস্নেহ সতর্কতায় -
পাছে খোকার ঘুম যেন ভেঙে না যায়।
পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া খোকার
আধখোলা বইটা বন্ধ করে
ঘরের জ্বালানো বাতিটা
আজ আর কেউ এসে নিভিয়ে দিয়ে যায় না -
তেমনই জ্বলতে থাকে বাতিটা
সমস্ত রাত্রি ধরে।
মা আজ তোমার নিষ্ঠুর অনুপস্থিতিতে
তোমার খোকার জীবনের সর্বত্র
বিশৃঙ্খলা আর অনিয়ম --
শুধু অবহেলা আর পরাজয়।
মা তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
আমিও একদিন আকাশের তারা হয়ে যাব -
আমিও দেখো একদিন
তারাদের দেশে হারিয়ে যাব
তোমায় খুঁজতে খুঁজতে -
সেদিন আমায় কিন্তু
মানা করতে পারবে না তুমি ॥
সুলতা, এখনও সময় আছে
সুলতা, এখনও সময় আছে
এখনও ফিরে আস এই বুকে
নইলে যে একটি হৃদয়ের হাহাকারে
এই পৃথিবী নিমেষে
একটি বিষণ্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে যাবে -
একটি হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসে
এই পৃথিবীর বাতাস
ভারী হয়ে যাবে বিপজ্জনক মাত্রায় -
একটি হৃদয়ের দুচোখের জলে
সাগর জলের উচ্চতা
বেড়ে গিয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করবে।
সুলতা, সুন্দর একটি পৃথিবীর জন্য
একটি হৃদয়কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য
ফিরে এসো, তুমি ফিরে এসো।
ভালোবাসা চিরদিনই অপরাজেয়-
এই ধ্রুব সত্যের সত্যতা রক্ষার জন্য
না হয় তুমি ফিরে এসো।
সুন্দর একটি পৃথিবীর নামে
আমি তোমাকে আহ্বান করছি -
একটি মুমূর্ষু হৃদয়কে বাঁচানোর নামে
আমি তোমাকে আহ্বান করছি --
একটি সুন্দর আগামীর নামে
আমি তোমাকে আহ্বান করছি -
তুমি ফিরে এসো -
আর কোনো দ্বিধা নয় -
চলে এসো তুমি
এই ভালোবাসাকে ভালোবেসে ॥
জানি আজ তুমি সবই ভুলে গেছ
জানি আজ তুমি সবই ভুলে গেছ
তবু ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলো বারবার
ভুল করে মনে পড়ে যায়....
হয়তো এখন তুমি
শেষ বিকেলের ছায়ায়
বারান্দায় বসে দেখছ নীল আকাশ,
সাদা মেঘের ভেলা -
তোমার মনের এক পাশে পড়ে আছে
অবহেলায়-অযত্নে
আমরাই অবহেলা-লাঞ্ছিত স্মৃতি।
কে জানতো তোমার ভালোবাসা
নদীর মতো শতবার গতি বদলায় -
জীবনের বহুমুখী বেদনাধারা
আজ এসে মিশেছে আমার জীবনে।
চলে গেছো বলে যদি মনে করো
একা, বড়বেশি একা হয়ে গেছি
তবে ভুলই করবে -
তোমার সুবর্ণ স্মৃতি
নিয়ে আমি পড়ে আছি -
আর বুকে নিয়ে ভালোবাসার ব্যথা
নদীর মতো বহুদুর
আমি ভেসে গেছি একা একা ॥
সুলতা তুমি নেই
সুলতা তুমি নেই
আজ আর এই ঘরে কেউ আসে না -
নষ্ট পাখির বাসার মতো
পরিত্যক্ত এই ঘর
বিষণ্ন শূন্যতা নিয়ে কাঁদে।
সুলতা তুমি নেই -
এ ঘরে আর কারো
কাঁকন-বিনিন্দিত কন্ঠস্বর
মুখরিত হয়ে উঠে না যখন তখন --
শুধু এক জমাট বাঁধা
অখন্ড নীরবতা
আকাশের মতো ঘিরে থাকে সারাক্ষণ
এই ঘর এই আঙিনা।
চঞ্চল বাতাস
জানালার পর্দা কাঁপিয়ে
দৃষ্টি ফেলে এ ঘরে -
তোমায় খুঁজে না পেয়ে
কোন সুদূরে হারিয়ে যায়
মুখ ভার করে।
জোছনা ঝরা রাতে
পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিয়ে খুঁজে
তোমায় না পেয়ে চুপ করে চেয়ে থাকে -
সুলতা তুমি নেই ॥
ইচ্ছে হলেই আমি যেতে পারি
ইচ্ছে হলেই আমি যেতে পারি
যেদিক খুশি সেদিকে যেতে পারি -
এই সর্ষে ক্ষেত ছাড়িয়ে
এই পথের মোড়টা পেরিয়ে
কাজল দীঘির টলটলে জল
আর কৃষ্ণচূড়ার শ্যামল হাতছানি এড়িয়ে-
ইচ্ছে হলেই আমি যে-কোনো দিক চলে যেতে পারি।
পারি না শুধু তোমাকে ছেড়ে যেতে
তোমার কাছেই ফিরে আসি বারবার-
এখানে ওখানে কতখানেই তো যাই -
সব ছেড়ে গেলে ও
কিন্তু শেষ পর্যন্ত
আমি তোমার কাছেই রয়ে যাই ॥
আকাশের মেঘও এক সময়
আকাশের মেঘও এক সময়
বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায় -
নদীর জল এক সময় শুকিয়ে যায়
পাথরও এক সময় ক্ষয়ে যায় -
স্মৃতি কেন তবু হয় না নিঃশেষ?
মনের পিঞ্জরে কেন তার স্মৃতি
অক্ষয় ছবি হয়ে ভাসে।
সেই কবে দেখা হয়েছে
এরই মাঝে কত যুগ শতাব্দী
যেন পেরিয়ে গেছে....
এখনও মনে পড়ে যেন
অবিকল তার চেহারা -
সেই হুবহু মুখের আদল
ভ্রু-ভঙ্গিমা, পটলচেরা চোখ
গোলাপ পাপড়ির মত
রাঙা ঔষ্ঠরেখা,
শাওন-মেঘ-কালো চুলের বন্যা-
সবই মনে পড়ে
দাড়ি-কমা সেমিকোলন
প্রতিটি যতিচিহ্নসহ।
তার প্রতিটি কথা যেন
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতার
এক-একটি পঙক্তি --
তার কন্ঠস্বরের উত্থান পতন
যেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত -
তার যৌবনভরা সুগঠিত দেহ
যেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য-
তাকে কি ভোলা যায়, যায় না।
তাকে ভুলে থাকা দায় ॥
প্রিয়তমা বল কি করে
প্রিয়তমা বল কি করে
আমি তোমার প্রসঙ্গ পাল্টাই -
তুমিই যে আমার প্রিয় প্রসঙ্গ,
তোমাকে বাদ দিলে আমার আর থাকে কি ?
আমার দুচোখ জুড়ে সারাক্ষণ
তোমারই মুখচ্ছবি ভাসে-
আমার বুক জুড়ে তুমি শুধু তুমি।
তোমার দেহের প্রতিটি বাঁক
অঙ্গের ভাজে জমে থাকা এতটুকু মেদ
সবই আমার মুখস্থ -
সারাক্ষণ তোমার সৌন্দর্য আমি আবৃত্তি করি।
আয়নার সামনে যেয়ে যখন দাঁড়াই
আমার ছবি ঢেকে গিয়ে
কখন তোমার ছবি প্রতিচ্ছবি হয়ে ভাসে
সমস্ত আয়না জুড়ে
টের পাই না।
মন্দিরে যখন পূজো দিতে যাই
মন্দিরের বিগ্রহ কখন
তোমার আদলে পাল্টে যায়
টের পাই না -
আর আমি তোমাকেই পূজো দিয়ে চলে আসি ॥
আজ নব বসন্তে
আজ নব বসন্তে
পুষ্প সৌরভ আমোদিত চারিদিক -
পাখির গানে আর ভ্রমরের গুঞ্জনে কলরব মুখর-
অথচ যার জন্য বসন্ত দিনের জন্য
আমার এ ব্যাকুল প্রতীক্ষা -
বসন্তের প্রথম ফুলে
যার জন্য আমার এই মালা গাঁথা -
সে আজ কোথায় ?
যে ছিল আমার এই হৃদয়ের কাছাকাছি
যে ছিল আমার স্বপ্নের একান্ত কাছাকাছি
একান্ত সাধনার ধন -
সে আজ কোথায় ?
আজ এই নব বসন্তে
আমার হৃদয় আকাশে কেন অঝোর শ্রাবণ -
আমার চোখ জুড়ে কেন
ঘন-কৃষ্ণ শ্রাবণের মেঘমালা -
নব বসন্তের পাখির আর
ভ্রমরের গুঞ্জন ছাপিয়ে
আমার হৃদয়ে বাজে এ কোন ক্রন্দন ধ্বনি?
আজ প্রকৃতি জুড়ে বসন্তের সমারোহ
আজ আমার হৃদয় জুড়ে শ্রাবণ -
বসন্ত ফিরে এলে
ফিরে আসে কোকিলের গান
ফিরে আসে নব পুষ্পমালা -
তুমি না আসলে
আমার জীবনে কোনোদিনই বসন্ত আসবে না -
একটি শ্রাবণ নিয়ে
কেটে যাবে আমার সমস্ত জীবন ॥
পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল
পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল
অথচ আমার জীবনে এক ভাগও স্থল নেই -
পুরো চার ভাগই জল -
আজীবন দুঃখ আর নিঃসঙ্গতাই
আমাকে সঙ্গ দিয়েছে -
অশ্রুজলকে উপজীব্য করে
আমি আজও বেঁচে আছি।
অশ্রুজলের সমুদ্রে হাবুডুবু খাই -
আঁখি কোণ হতে এত জল ঝরে
তবু কেন আমার কন্ঠ জুড়ে থাকে
আজীবন আকুল পিপাসা।
চোখের জলে আমার নয়নের কাজল
কেবল মুছে যায়,
বারেবারে মুছে যায়।
ঝাপসা চোখে
অবিরল-নেমে-আসা চোখের জলের ঝাপটায়
স্বপ্নগুলো কেবল অদৃশ্য হয়ে যায় -
স্বপ্ন দেখার সাধ
স্বপ্নই থেকে যায় ॥
বাবা, কেমন করে তুমি চলে গেলে
বাবা, কেমন করে তুমি চলে গেলে
এমন করে হঠাৎ অবেলায় -
বিনা নোটিশে, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই -
সহজাত সৌজন্যতাবশত প্রদত্ত
কোনো প্রকার বিদায়-সম্ভাষণ ছাড়াই -
নিজ সন্তানের মুখে স্নেহের চুম্বন ছাড়াই....
টেবিলে রাখা ঘড়িটা,
আলনায় ঝোলানো পাঞ্জাবিটা
আর খাপখোলা পুরু লেন্সের চশমাটা
তেমনি পড়ে রইল যেখানে ছিল -
আর অবেলায় এ কোন অলক্ষুণে
চির-দিবা-নিদ্রা তোমায় পেয়ে বসল।
মনে হয় যেন কত যুগ-যুগান্তের ক্লান্তি
তোমার সর্বাঙ্গে।
তোমার আধবোজা দুটি চোখে
অনাদিকালের রাত-জাগা- শেষে
নেমে-আসা-ঘুমে ভারী
চোখের পাতার ঘুম।
সারাক্ষণ বাড়িময় হাকডাকে
মাতিয়ে রাখা কোলাহলমুখর তুমি
আজ কোন গোপন অভিমানে
নীরব হয়ে গেলে চিরতরে আকস্মিক-
তোমার মুখ থেকে আর কোনোদিন
শুনতে পাব না প্রতিদানের প্রত্যাশাবিহীন
অকৃপণ সাবধানের বাণী -
‘খুব সাবধানে পথ চলিস খোকা,
একেবারে ডানে-বায়ে তাকিয়ে
রাস্তা পার হবি’।
বাবা, আজ চলার পথে
অসহনীয় যানজট -
রাস্তা উপচে পড়া চলতি যানবাহনের
বিষাক্ত ধোয়ায় তোমার খোকার
নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে-
অদৃশ্য আততায়ী আর ছিনতাইকারী
আর ছদ্মবেশী অপহরণকারী
ওঁৎ পেতে থাকে পথের বাঁকে যত্রতত্র।
ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকার গলিতে -
আর দ্রুতগামী অমানবিক
যানবাহনের প্রকাশ্য বৈরিতায়
যখন তখন নিস্পিষ্ট হয়ে যাওয়ার
নিশ্চিত আশঙ্কা তো আছেই।
বাবা, আজ এই চলার পথের
কঠিনতম জটিলতার মধ্যে
কে আমাকে পথ দেখাবে
কে আমাকে মুক্তির সন্ধান দেবে
কে দেবে বরাভয়।
বাবা, বল তুমি কোন গভীর অভিমানে
তুমি আজ নীরব হয়ে গেলে চিরতরে,
কোন গোপন গভীর ক্ষত
আজ অবেলায় তোমার এ অবাঞ্চিত বিদায়
ডেকে আনলো।
বল কোন অব্যক্ত অভিমানে
জীবনের দিকে পিঠ ফিরে তুমি আজ
শুয়ে আছ চিরতরে -
কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছ না
কারো ডাকে পাশ ফিরে তাকাচ্ছ না -
উঠতি বেলায় ও কেন তুমি
গভীর ঘুমে অচেতন -
তোমার খোকাকে জাগিয়ে রেখে
অনন্তকাল ধরে ॥
সুলতা তোমার মতো
সুলতা তোমার মতো
এক দিন আমিও হারিয়ে যাব
যে পথ ধরে তুমি চলে গেছ
একদিন আমাকে ছেড়ে।
চেনা শোনার এই বৃত্ত ভেদ করে
আমিও হারিয়ে যাব একদিন
তোমার পদচিহ্ন লক্ষ্য করে ;
যে পথে তুমি চলে গেছ
সে পথে পথে তোমায় খুঁজে
আমি কাটিয়ে দেব বাকিটা জীবন।
সুলতা যে দিন তুমি
আমায় ছেড়ে চলে গেলে
তখন থেকে এ ঘর
আমার কাছে কারাগার-
আমার সমস্ত দিন
কখন নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার রাতে
পর্যবসিত হয়ে যায়
তুমিহীনতায় ॥
যেখানেই যাও বন্ধু
যেখানেই যাও বন্ধু
কাছে কিংবা দূরে
আমি আকাশের মতো তোমায়
ছায়া দিয়ে রাখব -
আর দূর হতে তোমায় বারেবারে
হাতছানি দিয়ে ডাকব।
শরতে, বর্ষায়, হেমন্তে, বসন্তে
আমি বিচিত্র নববেশে সাজব -
অন্তরে আমি সেই তোমারই হয়ে থাকব।
আমি সাগর,
চৈত্রের দাবদাহে
যখন তোমার শীর্ণ জলের স্রোতস্বিনী ও
শুকিয়ে যাবে মিলিয়ে-
সেদিন ও আমি বুক ভরা জল নিয়ে
তোমায় সাগর সঙ্গমে আহ্বান জানাব -
যে দিন তুমি আমায় আর ভালোবাসবে না,
সেদিনও আমি তোমায় ভালোবাসব ॥
আমার ভুবনে এত যে অন্ধকার
আমার ভুবনে এত যে অন্ধকার
আকাশটাই অদৃশ্য -
তবু তো আমি চাঁদের স্বপ্ন দেখি -
একদিন ঝলমল পূর্ণিমার চাঁদে
আমার আকাশ উদ্ভাসিত হবে
সেই আশায় বসে থাকি -
বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজি।
জানি আমার বিরান মরুভূমিতে
নেই উদ্যান -
তবু ভাবি একদিন এই মরুভূমি
মরুদ্যান হবে -
একদিন আমার জীবনে
ফুলেল বসন্ত আসবে
আর ফুলেরা হাসবে।
বেঁচে থাকতে স্বপ্নের প্রয়োজন -
আগামী দিনকে স্বাগত জানাবার জন্য
স্বপ্নের প্রয়োজন -
তাই আমি স্বপ্ন দেখি
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি
জেগে জেগে আরও বেশি স্বপ্ন দেখি।
জানি এই কূল-কিনারাবিহীন
অকুল সাগরে
শুধু জল আর জল
কোথায় কুল--
তবু ভাবি এই আকুল পাথারে
কুল খুঁজে পাবই একদিন -
তোমার ঘাটে একদিন
এই জীবনের তরী নোঙর ফেলবেই ॥
সুলতা তোমার কাছে
সুলতা তোমার কাছে
আমার অনেক অপরিশোধিত ঋণ --
তোমার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো
আমার জীবনে অমূল্য সম্পদ -
তোমার কাছে আমার অসীম দায়বদ্ধতা।
শত জনমের আঁখিজলে
এ ঋণ ফুরাবে না জানি।
তাই অশ্রুজলে তোমার স্মৃতিচারণ করি -
তোমার স্মৃতিই বয়ে বেড়াই
সারাটি জীবন
দুঃখিত, একাকী ॥
মহাকাল সবই হরণ করে নেয়
মহাকাল সবই হরণ করে নেয়
হৃদয়হীন লোভী দস্যুর মতো,
জীবন, যৌবন, আয়ু
হৃদয়-আবেগ...
সকলই হারিয়ে যায়
মহাকালের দুরন্ত স্রোতে ;
কালের গর্ভে একে একে সবই হয় লীন
না হয় হয় ধূলি-ম্লান।
ভালোবাসা শুধু জেগে থাকে
চির নতুনের বেশে
সমস্ত হৃদয় জুড়ে পুরাতন এ অন্তরে ॥
সুলতা এই জীবনে
সুলতা এই জীবনে
এ পথ সে পথ কত পথই তো ঘুরি দিনমান-
মানুষ দেখি, গাছপালা দেখি
সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখি -
অবশেষে দিনের শেষে
তোমার কাছেই ফিরে আসি -
তোমার পথই যে আমার পথ -
তুমিই আমার চূড়ান্ত গন্তব্য।
ভালোলাগার কথা যদি বল,
আর যদি বল
ফুল ভালো লাগে কিনা,
চাঁদ ভালো লাগে কিনা,
অকপটে বলব ভালো লাগে ;
তবে সবকিছুর আগে
তুমিই আমার প্রথম ভালো-লাগা
তুমিই আমার ভালো লাগার শেষ।
তোমাকে বাদ দিলে
ভালো লাগার মতো এই পৃথিবীতে
আমার আর কিছু নেই।
বেঁচে থাকার জন্য
আলো চাই, বায়ু চাই
আরো কত কিছু চাই -
তার ও আগে প্রথম তোমাকে চাই -
তুমিই আমার প্রাণ-ভোমরা
কৌটোয় লুকিয়ে রাখা
রূপকথার গল্পের মতো।
দিনমান আমি
সংগ্রামের কথা বলি,
বিপ্লবের কথা বলি,
ভালো-লাগার কথা বলি,
ভালোবাসার কথা বলি -
সব কথার মাঝে তোমার কথাই
বারবার উঠে আসে -
অতঃপর তুমিই আমার
জীবনের শেষ কথা ॥
প্রিয়তমা, যখন দেখি তুমি নেই
প্রিয়তমা, যখন দেখি তুমি নেই
আমার দুচোখ জুড়ে,
তখনও তুমি থাক এই বুক জুড়ে -
যখন তোমার ত্রস্ত পদধ্বনি মুহূর্তে জেগে উঠে
মুহূর্তে মিলিয়ে যায়-
তখনও কান পাতলে শোনা যায় -
তোমার নুপুর-পরা-পায়ের পদধ্বনি
সারাক্ষণ আমার চতুর্পাশ্বে বাজছে।
যখন চোখ মেলে তোমায় দেখি না
বন্ধ চোখে তোমায় খুঁজি -
দেখি তুমি আছ আমার কাছাকাছি
আমার অনুভবে -
প্রতিটি শিরা উপশিরা, রক্ত-কণিকায়।
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে
তোমার ছোঁয়া পাই।
নয়ন জুড়ে তুমি নাই
হৃদয় জুড়ে আজ তোমার আসন পাতা -
আঁচল বিছিয়ে বসে থাক তুমি
রানীর মতন হৃদয় সিংহাসন জুড়ে।
তোমাকে হারাবার তাই
নেই কোনো অবকাশ।
তুমি বিশাল আকাশ হয়ে
আমার পৃথিবী ঘিরে আছ -
তুমি নদীর স্রোতধারার মতো অবিচ্ছেদ্য
ঢেউয়ের মতো অভিভাজ্য আমার জীবনে।
আমার জীবন আর তুমি
নদীর জল আর তীরের মতো
এক হয়ে মিশে আছ-
আমার প্রেম আর কবিতার মতো
এক হয়ে মিশে আছো তুমি
আমার চিত্তে ॥
তুমি চলে গেছ আজ বহুদিন
তুমি চলে গেছ আজ বহুদিন
তবু ঘুমের ঘোরে আজ ও যেন শুনতে পাই
তোমার কাঁকনের রিনিঝিনি
কান পাতলেই আজও যেন শুনতে পাই
নূপুর শিঞ্জিত তোমার পদধ্বনি।
বাতাসে তোমার গায়ের গন্ধ
আজ ও যেন অদৃশ্য সৌরভ ছড়ায় -
আকাশ জুড়ে যেন
তোমার ডাগর আখির চাওয়া -
সবই রয়ে গেছে শুধু, তুমি শুধু নাই।
সবুজ নিসর্গ
আজ তোমার ছাপা শাড়ির
আচল হয়ে দুলে-
নদী তরঙ্গ তোমারই
চলার ছন্দে বয়ে যায় -
পাখির গানে যেন তোমারই
কন্ঠস্বর ভেসে আসে -
তুমি আর প্রকৃতি কখন
একাকার হয়ে গেছে
আমার হৃদয়ে ॥
সুলতা, আজ তুমি কোথায় জানি না
সুলতা, আজ তুমি কোথায় জানি না
অথচ একদিন আমার জীবনে
তুমি ছিলে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ -
তোমাকে বাদ দিয়ে এ জীবন চলে
কোনদিন দিন ভাবতে ও পারিনি।
অথচ আজ তুমি পাশে নেই
আমি একা বেঁচে আছি -
আমি ভাবতেও পারি না
এ কেমন বেঁচে থাকা।
যে তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত ও
আমার চলে না
সেই তুমি আজ নেই -
কত সকাল, দুপুর বিকেল গড়িয়ে গেল-
একা একা কীভাবে কেটে যাচ্ছে সময়
নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকে।
সুলতা তীর ছাড়া নদী
আকাশ ছাড়া মেঘ,
বাসা ছাড়া পাখিকে
কল্পনা করা যায় ?
যায় না।
সুলতা তেমনি তোমাকে ছাড়া
আমার অস্তিত্ব অকল্পনীয়
আমার জীবন দুর্বিষহ বিপন্ন।
তোমার ভালোবাসার আশ্রয়ে
এ হৃদয় একদিন মুক্তি খুঁজেছিল
আজ তুমি নেই-
বেদনার বিষণ্নতার কারাগারে
নির্জন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে
আমি যেন অন্তরীণ
আত্মদন্ডিত বন্দী এক আসামি-
সুলতা তুমি এসে আমাকে
মুক্ত করে আলোতে নিয়ে যাও -
অনন্তকাল আমি তোমারই -
প্রতীক্ষায় আছি ॥
জীবনের শুভ মুহূর্তগুলো
জীবনের শুভ মুহূর্তগুলো
কখন যে হারিয়ে যায়
কেউ জানে না।
একদিন আকাশে চাঁদ ছিল
বাতাসে ফুলের গন্ধ ছিল
আর আমি ছিলাম,
আর আমার পাশে শূন্য আসন ছিল
তোমার জন্য -
সেদিন তুমি ছিলে না
আমি একা ছিলাম।
আজ তুমি এসেছ
জীবনের ভরা সাঁঝে -
আঁধারে ছায়াতে তোমাকে
এত যে দেখার ইচ্ছে
তবু দুচোখ মেলে দেখতে পারছি না
তোমার পরিপূর্ণ রূপ ;
অষ্পষ্ট ছায়াবৎ মনে হচ্ছে।
জীবনের বসন্ত দিন বিগত
আশার মুকুল হয়ে আজ
ফুটেছ তুমি অবেলায় আমার জীবনে -
আজ অবেলায়
বৃথাই বাসন্তী আমেজ খুঁজি
তোমার মাঝে ॥
নন্দিতা, এখন কোথায় থাকো তুমি
নন্দিতা, এখন কোথায় থাক তুমি
কেমন আছো
কার ঘরের ঘরণী হয়ে,
জানি না, আমি জানি না।
কলেজের সেই করিডোরে, ক্যাম্পাসে
কিংবা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠার ফাঁকে ফাঁকে
কতবার চোখে চোখ রেখেছি আমরা --
নীরব চোখে হয়েছে মনের কথা বিনিময়।
নন্দিতা, পৃথিবীর কোন দুই মেরুপ্রান্তে
আমরা এখন আছি, কেউ জানি না -
মাঝখানে শুধু ভালবাসার স্মৃতি
ধু ধু হয়ে আছে..
আজ কতদিন আমাদের দেখা নেই -
কালের টানে কক্ষচ্যূত নক্ষত্রের মতো
কে কোথায় ছিটকে পড়েছি জানি না।
সময় আমাদের মাঝে
করে চলেছে দুরূহ দূরত্ব রচনা -
সব গেছে জানি-সব
তবু রয়ে গেছে সেদিনের স্মৃতি
আজও অমলিন ॥
তোমার সব দাবীই
তোমার সব দাবীই
যখন আমি মেনে নিয়েছি নিঃশর্তে
তখনও কেন তুমি মিছেমিছি
করছ আমার বিরুদ্ধাচরণ,
নীরব অসহযোগ।
মাধবী এখনও শেষ সময়
অতিক্রান্ত হয়ে যায়নি -
এখনও হৃদয়ে আবেগ আছে
প্রীতি আছে,
আছে উষ্ণ অনুরাগ -
মাধবী এখনও ফিরে আসো
আমার ভালোবাসার বুকে ফিরে আসো।
এসো দুজনে মিলে
এ দ্বৈত ভালোবাসাকে অর্থবহ করে তুলি -
আমাকে বঞ্চিত করে
তুমিও পাবে না কিছুই বঞ্চনা ছাড়া।
এসো বন্ধু এসো
এই চাঁদ আর এই জোছনা
বিকশিত ফুলের হাসিকে
আমরা অর্থবহ করে তুলি -
আমাদের ভালোবাসার সঙ্গীতে ॥
সুলতা, একদিন তুমি ছিলে তাই
সুলতা, একদিন তুমি ছিলে তাই
এই বুকে স্বপ্ন ছিল,
আজ তুমি নেই
এই বুকে তাই খাঁ খাঁ শূন্যতা।
যেমন খাঁচার পাখি বাসা ছেড়ে
পালিয়ে গেলে
শূন্যতার হাহাকারে ভরে থাকে
খাঁচার নীরব হৃদয়।
সুলতা তুমি চলে গেছ
এ হৃদয় আজ
নির্জন কোলাহলবিহীন
নিভৃত প্রান্তর।
যেমন করে ট্রেন চলে গেলে
ষ্টেশনের প্লাটফর্ম বিষণ্ন শূন্যতা নিয়ে
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে-
ক্ষণিকের জন্য
উৎসব-সুলভ সব হৈচৈ থেমে যায়,
সুলতা তেমনি আমার হৃদয়
উৎসব ভেঙে যাওয়া নীরবতায়
বোবা বেদনায় কাঁদছে -
সুলতা তোমার অনুপস্থিতিতে।
আজ আমার কবিতার প্রতিটি পঙক্তি
আমার শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুবিন্দু -
সুলতা আমার নীরব দৃষ্টিতে
অশ্রুবিহীন নিঃশব্দ ক্রন্দন।
সুলতা আজ তুমি নেই
বিরহ ব্যথিত হৃদয়ে
কেবলই বেদনার পঙক্তি মালা লিখে যাই --
যদি তাতে কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায়,
যদি তাতে ভুলে থাকা যায়
ক্ষণিকের জন্য হলেও
তোমাকে না পাওয়ার অন্তর্গত অন্তর্জ্বালা --
কবিতার আশ্রয়ে আমি
আজ মুক্তি খুঁজি ॥
একাই বসে থাকি
একাই বসে থাকি
একরাশ ভাবনার মুখোমুখি হয়ে-
নিজের সাথে নিজেই কথা বলি -
নদী আর নারী কোনোদিন
পিছু ফিরতে জানে না -
বৃথাই অপেক্ষায় বসে থাকা
আর আখিজলে মালা গাঁথা।
একাই পড়ে থাকি
বিষণ্ন নিরালায়-
হৃদয়ে নিয়ে শুধু ধুধু বালুচর -
আর অন্তহীন শূন্যতা।
নদী আর নারীকে ভালবেসে
বুকের ভেতর খুব গোপনে বইতে হয়
ব্যথার অন্তঃশীল ফল্গুধারা ॥
প্রদীপের আলো জানি সবার জন্য
প্রদীপের আলো জানি সবার জন্য,
প্রদীপের দহন জ্বালা
সে শুধু জানি পতঙ্গের অপমৃত্যুর জন্য।
তোমার ভালোবাসাও তেমনি জানি
আর সবার হৃদয়ে আলো জ্বালাতে-
আর আমাকে শুধু দহন করতে।
সবার জন্য জানি তোমার প্রেম
সবার জন্য ভালোবাসা -
শুধু আমার জন্য জানি
তোমার অবহেলা -
আমার জন্য জানি শুধু
এই নিষ্ঠুর বঞ্চনা ॥
সুলতা, যেদিন আমি আর
সুলতা, যেদিন আমি আর
থাকবো না এই পৃথিবীতে
নিখিল পৃথিবীর সব বিরহী আত্মার মাঝে
আমার বিরহ বেদনা
সেদিনও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজবে।
সেদিন ও নিঃশব্দে
ঝরে যাওয়া ফুলের মাঝে,
রাতের আঁধারে সংগোপনে
ঝরে পড়া শিশিরের মাঝে,
আমার না পাওয়ার বেদনা
নিঃশব্দে অনুরণিত হবে -
হঠাৎ ছুটে আসা দমকা হাওয়ার মাঝে
আমার সকরুণ দীর্ঘশ্বাস
আর অতৃপ্তির হাহাকার মিশে রবে -
ঘন শ্যাম-মেঘ-কজ্জল
শ্রাবণ আকাশ
আমার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে
পাঠক চিত্তে ছায়া ফেলবে।
জানি সেদিনও তোমার
পাথররূপী পাষাণ চিত্ত
করুণার ঝর্ণাধারা হয়ে ঝরবে না।
হে জীবন, একদিন তুমি ছিলে
হে জীবন, একদিন তুমি ছিলে
স্বপ্ন আর দুরূহ কল্পনার
অভাবনীয় আর অসম্ভবের -
আর আজ -
জীবন প্রণোদিত সংগ্রামে
আমরা প্রতি মুহূর্তে
ক্ষত-বিক্ষত. রক্তাক্ত
ক্লান্ত...
হায় জীবন
তুমি কেন হলে না
ছোট্ট একটি মিষ্টি সঙ্গীতের মতো
ছন্দোবদ্ধ একটি কবিতার মতো ॥
আজ কতদিন ধরে
আজ কতদিন ধরে
হাসপাতালের কেবিনে আমি শয্যাশায়ী
মনে হয় হাসপাতালই যেন আমার নিবাস -
সুস্থ হবার ক্ষীণ আশাটুকুও
বুঝি অবশিষ্ট নেই -
শেষ দিনটির অপেক্ষায়
এখন আমার দিন যাপন।
তবুও অসুস্থ রোগ শয্যায়
কখনও কখনও তোমার স্মৃতি মনে আসে
মুহূর্তে তখন প্রাণ ফিরে পাই -
আর ও একটি দিন আমার বাচতে ইচ্ছে করে-
আরও একটি দিন তোমায় দেখতে পাবো বলে।
সম্ভাব্য মৃত্যু শোকে আমি ততটা অসুখী নই -
তোমাকে আর দেখতে পাব না
তোমার কথা আর ভাবতে পারব না -
এর চেয়ে বড় শোক আমার জীবনে নেই।
দেখো আজ আমার চারপাশে
কত ওষুধের শিশি, কত পথ্য
আর ঘন্টায় ঘন্টায়
পোশাকি চিকিৎসকের অযাচিত পরামর্শ -
কিছুই আমার সারিয়ে তুলতে পারেনি
পারবে না কোনোদিন,
কেবল তোমার ভালবাসাই
আমাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।
প্রিয়তমা, আজ তোমার ভালোবাসা দিয়ে
আমাকে সারিয়ে তুলো -
তোমার কোমল বুকের উম দিয়ে
আমার মৃত্যুশীতল দেহে
প্রাণ ফিরিয়ে দাও -
তোমার গাঢ় আলিঙ্গনে
আমায় বন্দী করো -
মৃত্যু ও আমাকে পারবে না
ছিনিয়ে নিতে কোনোদিন ॥
এই গান এই সুর
এই গান এই সুর
এই ফুল এই পাখি
নদী আর নিসর্গ
সবই সুন্দর-
শুধু তুমি আছো বলে।
এই দুঃখ, এই হতাশা
এই বঞ্চনা, এই মৃত্যু
আজ ও সুমধুর-
শুধু তুমি ভালোবাসো বলে ॥
***