হেঁটে হেঁটে যখন স্টেশনে পৌঁছালাম, তার অনেক আগেই ট্রেন বেরিয়ে গেছে। এখন সবে পাঁচটা পনেরো। আবার সেই আটটা কুড়িতে ট্রেন। হাওড়ায় যখন পৌঁছাবো, তখন বাইরে আর কোন গাড়ি পাব না, ট্যাক্সিতেই ফিরতে হবে। অনেক গুলো টাকা গচ্চা যাবে। 
সেই সকালে বেরিয়েছি। কোম্পানির কাজে এসেছিলাম। সব কিছু ঠিক করে দিয়ে এই ফিরছি। এখানকার স্টেশনের নামটা কি অদ্ভুত! 'সিংদা' - যেন কোন একজনকে দাদা সম্বোধন করে ডাকা হচ্ছে। হাওড়া যাবার টিকিট কাটাতে চাইলে, স্টেশন মাস্টার আমাকে টিকিট দিতে অস্বীকার করে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানায়, এখন ট্রেন নেই, সারে সাতটা থেকে আবার টিকিট দেওয়া হবে। আমিও আর কথা বাড়াই না। 
এখানকার স্টেশনটাও খুব ফাঁকা ফাঁকা। আর হবে নাই বা কেন, ফাঁকা মাঠের মধ্যে স্টেশন। স্টেশন বলতে লাইনের একদিকে একটি মাত্র প্লাটফর্ম, মাঝে একটা লোহার স্টাকচার এখনও জানান দেয়, কোন একদিন এখানে শেড ছিল। প্লাটফর্ম থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, নিচে একটা কল ও দুই কামড়ার একটা একতলা ঘর, যা টিকিট কাউন্টার হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। 
এদিকে খিদেও পেয়েছে খুব। তাই আবার হাঁটতে শুরু করি। একটু আগে এই পথ দিয়েই এসেছি। একটা পায়ে চলা আলপথ। বেশিক্ষণ লাগেনি। মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার পাশে কিছু দোকানপাট আছে। তারই একটাতে দেখি, বড় বড় সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। ঢুকে পরি। 
এখানে আবার ভিতরে বসার জায়গাও আছে। আমাকেও এক জায়গায় বসতে বলে। দেখি, দেওয়ালের সাথে একটা কাঠের পাটাতন লাগিয়ে টেবিল বানানো হয়েছে। পাশে সরু একটা বেঞ্চ রাখা আছে। বসে পরি। 
একজন সঙ্গে সঙ্গেই আমার কাছে চলে আসে। কি দেব ম্যাডাম? 
আপাতত একটা সিঙ্গাড়া দাও, খেয়ে দেখি। 
চাটনি দেব ম্যাডাম? 
দাও। 
প্রায় সাথে সাথেই আমার সামনে একটা প্লেটে করে সিঙ্গাড়া ও চাটনি দিয়ে যায়। গরম গরমই খেতে শুরু করি। চাটনিটা কি কি দিয়ে বানিয়েছে, বুঝতে পারি না। তবে খুব সুন্দর খেতে। এতে তেতুল অবশ্যই আছে, কিন্তু আর কি আছে, বুঝতে পারি না। 
এতো ভালো লাগে যে আরও একটু চেয়ে নিই। আর কি কি পাওয়া যাবে, জিজ্ঞেস করি। 
এখানে সব রকম তেলেভাজা পাবেন ম্যাডাম। সন্ধ্যেবেলায় সব থেকে বেশি চলে সিঙ্গাড়া, ডিমের চপ, মাছের ডিমের বড়া, টম্যাটোর চপ, মোচার চপ, ভেজিটেবল। 
ঠিক আছে, একটা করে দাও, টেস্ট করি। 
এরপর প্রথমেই আমাকে টম্যাটোর চপ দেয়। এটা খাওয়ার পর দেখি, মাছের ডিমের চপ দিয়েছে। সত্যিই, মাছের ডিমের চপটা অদ্ভুত সুন্দর খেতে। 
অনেকগুলি তেলেভাজা খেয়ে পেট ভর্তি করি। রাতে যদি আর কিছু পাওয়া না যায়, তাই দুটো মাছের ডিমের বড়া ও খানিকটা মুড়ি কিনে ব্যাগে রাখি। এখনও অনেকটা সময় আছে। তাই রাস্তার পাশে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। 
সবে সারে ছ'টা বাজে। এখানে এই এতো দূরে কিভাবে সময়টা কাটাবো, বুঝতে পারি না। সূর্যও ডুবে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হয়, স্টেশনের রাস্তা যদি অন্ধকারে চিনতে না পারি! তার থেকে বাবা, স্টেশনে গিয়েই ওয়েট করবো। 
তাই আবার স্টেশনের দিকেই অগ্রসর হই। আবার সেই ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে যেতে হবে। ভয় হয়, সাপ খোপ থাকবে না তো! আলো একেবারেই কমে এসেছে। তবু এগিয়ে চলি। 
এই পথটাও একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি ছাড়া আর কেউ এই পথে আসার কারণও দেখছি না। আবার যখন ট্রেন আসবে, তখন এই পথে কেউ আসতে পারে। কিন্তু ট্রেনের তো এখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি আছে। কি আর করা যাবে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলি। 
কোম্পানির কাজ দূরে এ্যাটেণ্ড করতে আসা, এই প্রথম নয়। এমনিতে কাছে কাজ করলেও, মাসে অন্তত চারটে দূরে এ্যাটেণ্ড করি। প্রতিবার দূরে আসার জন্য পাঁচশো টাকা এক্সট্রা পাওয়া যায়। আর মাসে চারটে করতে পারলেই মাইনের উপর দুহাজার এক্সট্রা। মায়ের শরীরটাও কদিন ভালো যাচ্ছে না, কালকে বলছিল। 
একা একা ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলি। মোটামুটি মাঝামাঝি চলে এসেছি। দূর থেকে স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখেই এগিয়ে চলেছি। দেখি, কাকলী ফোন করেছে, কোথায় আচিস? 
আমি এখন উড়িষ্যায়। 
আজকে ফিরবি না? 
আটটা কুড়িতে ট্রেন, বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে। 
বাড়িতে ফোন করেচিস? 
হ্যাঁ, একটু আগে মা'র সাথে কথা হয়েছে। এই জানিস, আমি এখন যেখানে যাচ্ছি, সেই স্টেশনটার নাম সিংদা! 
এ্যাঁ! এ আবার কি নাম! 
তবেই বোঝ! আর শুনবি, একটু আগে একটা তেলেভাজার দোকানে খাচ্ছিলাম, দুটো বয়স্ক লোক এমন ভাবে দেখছে, যেন এখনি গিলে খাবে! কোনদিন যেন মেয়ে দেখেনি। 
তারা আবার তোর পিছু পিছু আসছে না তো! 
এলে ক্ষতি নেই, আগের বারের মতো এদেরকেও মেরে তাড়াবো। 
থাক, অত দূরে আর মারপিট করতে হবে না। তার থেকে এড়িয়ে যাস। কি দরকার, ঝুট ঝামেলায় জড়ানোর। 
তা যা বলেচিস। এই তোর ও'র খবর কি? 
তুই শুনিস নি! 
কি? 
এবারে এস.এস.সি.তে লাগিয়েছে। 
ভালো খবর তো তাহলে। কবে মিষ্টি খাওয়াচ্ছিস বল। 
তুই যেদিন খেতে চাইবি। 
তাহলে সেই শুভদিনটি কবে? 
ওর জয়েনিং হয়ে গেলেই হয়ে যাবে। তোকেও বলি, এবারে কারোর গলায় ঝুলে পর। 
চাইলেই বা পাচ্ছি কই! সবাই তো শুধু মধু খেতে আসে। 
না রে, সবাই ও রকম নয়। 
এই জানিস, কেউ মনে হয় আমার পিছনে আসছে। অন্ধকারে ঠিক মতো বুঝতে পারছি না, তবে মনে হয় যেন একটু লুকিয়ে লুকিয়ে আসছে। এখন ফোনটা রাখছি, বুঝলি। পরে ফোন করবো। 
মারামারি করবি না। 
আমার উপর বিশ্বাসটা রাখ। শুধু শুধু কিছু করবো না, তবে সেরকম কিছু হলে, ওদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো। 
ফোনটা কেটে দিই। যেভাবে হাঁটছিলাম, সেভাবেই হেঁটে চলি। তবে অতিরিক্ত সচেতন ভাবে। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিই। ওরা তিনজন আছে। আর কিছুটা গেলেই স্টেশন। তাই আমিও হাঁটার বেগ বারিয়ে দিই। শেষে টিকিট কাউন্টারের সামনে উপস্থিত হই। 
একি! এখানে যে বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। কি করবো বুঝতে পারি না। এদিকে পিছনের তিনজনও ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। কিছু করা মানেই তো আবার সেই মারপিট! ভালোও লাগে না। তার চেয়ে বরং লুকিয়ে পরি। ভেবে টিকিট কাউন্টারের পিছনের দিকে এগিয়ে যাই। লুকিয়ে চুপ করে লক্ষ্য করতে থাকি। 
দেখলি! তখন বিশ্বাস করছিলি না। আর এখন নিজের চোখকে কিভাবে অস্বীকার করবি! 
এইমাত্র আমাদের সামনে আসছিল, আর আলোতে এসেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! 
রতন কালকে সন্ধ্যে বেলায় দেখেছে। মোড় থেকে একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে স্টেশনের দিকে গেল। রতনও পিছু পিছুই আসছিল। আর পিছন থেকে দেখছিল। শেষে যেই স্টেশনের আলোয় এলো, আর তার দেখা নেই! 
মনে মনে হাসতে থাকি। ওদের ভুতের ভয় দেখাতে পেরেছি। 
তাই তো দেখছি! তোরা আচিস বলে এদিকে এলুম। না হলে সন্ধ্যের পর এই পথে, আসতামই না। 
তাহলে গোপী যেতিস কিভাবে? 
দিনের বেলায় যেতাম। তুইই বল, এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে যদি তোর সামনে একটা পরে, কাউকে ডাকলে পাবি! 
কিন্তু সাহাদা গেল কোথায়! 
ভুতের ভয়ে পালিয়েছে। তিনজনেই হেসে ওঠে। 
বুঝতে পারি, এভাবেই এরা ভয় কাটানোর চেষ্টা করছে। জোরে জোরে কথা বলছে। এদেরকে আরও একটু ভয় দেখানোর দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপে। 
চল প্লাটফর্মের উপরে যাই। 
ওখানে সব জায়গায় আবার আলো নেই। 
চল, একবার ঘুরে দেখে আসি। সেরকম বুঝলে আবার এখানেই ফিরে আসবো। 
তিনজনেই সিঁড়ি দিয়ে প্লাটফর্মে উঠে যায়। আমিও বেরিয়ে আসি। লুকিয়ে ওদের লক্ষ্য করতেই থাকি। একটা ভালো জায়গা পেয়ে যাই। প্লাটফর্মের পাশে পাঁচিলটা জায়গায় জায়গায় ভেঙে আছে। আর পাঁচিলের পিছনে অনেক বড় বড় গাছ চারিদিকটা অন্ধকার করে রেখেছে। 
আমি পাঁচিলের আড়ালে লুকিয়ে ওদের দেখতে থাকি। ওদের কথাবার্তায় বুঝে যাই, ওরাও ট্রেন ধরবে, এবং গোপী না কোথায় যাবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ওরা এসেছে কেন! 
তিনজনেই বেশ সুন্দর পোশাক পরেছে, বলা যায়। মনে হয়, কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে যোগ দিতে চলেছে। 
জানিস, আমরা যখন প্লাটফর্মে উঠলুম, তখন যেন মনে হল, সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তখনই তো বলবি। 
ভয়ে বলতে পারিনি। 
চল একবার, গিয়ে দেখি। 
ওরা প্লাটফর্ম ধরে সিঁড়ির দিকে হেঁটে চললে, পাঁচিলের আড়ালে থেকে দেখতে থাকি। যখন ওরা প্লাটফর্ম থেকে সিঁড়িতে নামে, ঠিক তখনই আমি পাঁচিলের ভাঙা অংশ দিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে পরি। ফলে ওরা এখনও কিছু দেখতে পায় না। এদিকে ফোনের ভাইব্রেশনে বুঝতে পারি, ফোন এসেছে। দেখি, কাকলী ফোন করেছে। কেটে দিয়ে, ম্যাসেজে এখনকার ঘটনা জানাই। পরে বাকিটা বলবো। দেখি, ওরা তিনজনে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়। আরও একজন আসছে বলে মনে হয়। 
হেঁটে হেঁটেই আসছে। এটা আবার কে! এতো রাতে এখানে কি করতে আসছে! 
ওই তো, সাহাদা এসে গেছে। জানো সাহাদা, একটু আগে এখানে ভুত দেখলাম! 
কি! 
একটা মেয়ে, আমাদের সামনে সামনে হেঁটে আসছিল, আলোতে এসেই একেবারে কপ্পুরের মতো উবে গেল! 
কথা বলতে বলতেই কাউন্টারের চাবি খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। 
ভুল দেখিসনি তো? 
আমরা তিনজনেই দেখেছি। 
আমার কাছেও সন্ধ্যে বেলায় একটা মেয়ে এসে হাওড়ার টিকিট চাইছিল। ভাগিয়ে দিয়েছি। কোথা থেকে হয়তো পালিয়ে এসেছে। 
আমাদের তিনটে গোপীর টিকিট দাও। কত গো সাহাদা? 
একুশ টাকা। 
কুড়ি টাকা দিলে হবে? 
তাহলে তো আমাকে পকেট থেকে এক টাকা দিতে হবে! 
তবে তুমি একুশ টাকাই নাও। কখন ট্রেন আসবে গো সাহাদা? 
আধ ঘণ্টার মধ্যেই এসে পরবে। 
আবার ছাড়বে কখন? 
এখানে ঢোকার পনেরো মিনিট পরেই ছেড়ে দেবে। এই নাও, তিনটে গোপীবল্লভপুরের টিকিট। 
দাও, তবে আমরা প্লাটফর্মে গিয়েই দাঁড়াই। 
তাই যাও। 
আমি আবার লুকিয়ে পরি। কিন্তু ট্রেন এলে, যখন অনেক লোক থাকবে, তখন তো আর লুকিয়ে থাকা যাবে না। সে পরে দেখা যাবেক্ষণ। লোক তিনটে আমার সামনে দিয়ে এগিয়ে যায়। যেখানে একটা সিমেন্টের বেঞ্চ করা আছে, সেখানে বসে পরে। আমিও পাঁচিলের পিছনে অপেক্ষা করতে থাকি। 
ওই তো, দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। ক্রমে আলোটা বাড়তে থাকে। না! আমাকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। ট্রেনের হর্ণ শোনা যায়। ট্রেনটাও স্টেশনে ঢুকে পরে। কিন্তু দেখে মনে হয়, ট্রেনটা এইমাত্র কারশেড থেকে এলো। একজন প্যাসেঞ্জারকেও নামতে দেখলাম না। শুধু ড্রাইভার ও গার্ড, নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করল। আমি কাউন্টারের সামনে চলে আসি। 
একটা হাওড়ার টিকিট দিন। 
স্টেশন মাস্টার আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হয়, ভুত দেখছে যেন। তাই ঘোর কাটানোর জন্য আর একবার বলি, কি হল, বললাম যে হাওড়ার একটা টিকিট দিন। 
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিচ্ছি, দিচ্ছি। 
আমার দিকেই তাকিয়ে কিবোর্ডে টাইপ করে। প্রিন্টার থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। যেন আমার হুকুম তামিল করার জন্যই রয়েছে। 
কত? 
চুপ করে থাকে। তাই টিকিট থেকে আমিই দেখে নিই। একশো সাতাশ টাকা। আমি একশো ত্রিশ টাকা বারিয়ে দিই। এদিকে ট্রেনও হর্ণ দিয়ে দিয়েছে। আমিও লুকিয়ে মাঝের একটা কামড়ায় উঠে পরি। 
আরও একবার হর্ণ দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। পুরো ট্রেনটায় ড্রাইভার ও গার্ড বাদে, মোটে চারজন যাত্রী আছে। ওরা তিনজন যে কামড়ায় আছে, আমি তার দুটি কামড়া পিছনে আছি। কামড়ার একেবারে পিছনে, একটি কোনে বসে আছি। ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখেছি। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। অন্ধকারের জন্য বাইরের কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। এই একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। 
একবার ভাবি, প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওদের কামড়াতেই উঠি। তারপরে নিজেকে শান্ত করি। ট্রেনও ছেড়ে দেয়। 
একি! ওরা তিনজন যে এই কামড়াতেই চলে এসেছে। আমি ওদের দেখেই, এককোনে লুকানোর চেষ্টা করি। কামড়াটির সামনের দিক থেকে মাঝখানে আসতেই একজন আমাকে দেখতে পায়। সাথে সাথে বাকিদের ডেকে দেখায়। 
ভয়ে ভয়ে, আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসে। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে, কে তুমি? এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ? 
তোমরা কারা? 
আমরা বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু এতো রাতে, একা একটা মেয়ে, কোথায় যাচ্ছ? 
আমি বাড়ি ফিরছি। 
বাড়ি ফিরছো তো এতো রাতে একা কেন? 
একা ফিরবো না তো, সঙ্গে আবার কে থাকবে! কাজে বেরিয়েছিলাম, কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছি। 
কি কাজ করো? 
তা জেনে তোমাদের লাভ কি? 
না, মানে, একা একা যাচ্ছ, তাই এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। 
ও তাই বলো। 
আসলে কদিন এখানে একটু অন্য রকম হচ্ছে কিনা। 
কি হচ্ছে এখানে? 
মাঝে মাঝে কেউ কেউ দেখেছে। 
ও। তুমি কখনও দেখেছ? 
না, সেভাবে দেখিনি। তবে আজকে সন্ধ্যে বেলায় একজনকে স্টেশনের দিকে আসতে দেখেছি, তার পর থেকে আর দেখিনি। 
তা আমি কি করবো! দেখোনি ভালো হয়েছে, না হলে ভয় পেতে। 
আমরা তিনজনে একসাথে আছি, ভয় পাব কেন! তোমার ভয় করে না? 
না! এখন আর ভয় করে না। 
এখন আর ভয় করে না, মানে? 
মানে আবার কি! আগে করতো, যখন তোমাদের মতো ছিলাম। 
দেখি, তিনজনেই একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়। তাই বলি, তোমরা গোপীবল্লভপুর যাবে তো? 
ওরা তো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। আমরা কোথায় যাব জানলে কিভাবে! 
আমি সব জানি। 
এদিকে দেখি, ট্রেনও একটা বড় স্টেশনে ঢোকে। নিয়ন লাইটের আলোয় দেখতে পাই, গোপীবল্লভপুরে ঢুকছে। ট্রেনও আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে পরে। ওরা তিনজনে চুপ করে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এবার যে ট্রেন ছেড়ে দেবে। তাই আদেশের সুরে বলি, তোমরা এখুনি ট্রেন থেকে নেমে পর। তারপর সুর নরম করে বলি, গোপীবল্লভপুর এসে গেছে। 
ওদের যেন সম্বিত ফেরে। তিনজনে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে দাঁড়িয়ে পরে। 
আমি ট্রেন থেকেই বলি, সবসময় ভয় পেতে নেই। সব ভুতই খারাপ না! 
ট্রেনও ছেড়ে দেয়। আমি জানালার মধ্যে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ট্রেনের গতি বেড়ে গেলে, হাসি আর চেপে রাখতে পারি না। হাসতে হাসতেই কাকলীকে ফোন করি। পুরোটা শুনে কাকলী বলে, ওটা যে কোন ভুত ছিল না, কোন দিন ওরা বিশ্বাস করবে না। 
সত্যিই। দুজনে একসাথে হেসে উঠি।