Read Non-lakshmi by Kalyan Ashis Sinha in Bengali Fiction Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অ-লক্ষ্মী

★ 01 ★ A ★

কথায় বলে না 'মা গুণে মেয়ে হয়, ' তাই হয়েছে, মাও যেমন যৌবনে পরপুরুষ চড়িয়েছে, মেয়েও তেমনি হয়েছে। কপাল গুণে ভাগ্যও পেয়েছে। বিয়ের চার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুটো বাচ্ছা রেখে বর হাওয়া! তা যৌবন তো আর হঠাৎ উদাও হবার নয়, তাই যা হবার তাই হয়েছে।

ছিঃ! ছিঃ! পাড়াতে আর থাকা যাচ্ছে না। সবার মুখেই একই কথা। নামে লক্ষ্মী হলে কি হবে, ওর মতো অলক্ষ্মীকে পাড়াতে থাকতে দেওয়া যায় না। কিন্তু কে বলবে! পাড়ার সব মাতব্বরই তো ওর সাথে শুয়েছে। এই তো সেদিন, নিমাইকাকা রাতে যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন দেখেছে। রাত তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। শেষ ট্রেন বেড়িয়ে যাবার পর, স্টেশন মাস্টার নিমাইকাকাকে বাড়ি যেতে বললে, কাকা গ্লাসের সবটুকু একঢকে শেষ করে, একটা বাদাম মুখে পুরে বলে, "মাস্টার! আসি তাহলে, কাল আবার আসবো।" -এই বলে আস্তে আস্তে টলতে টলতে বাড়ির দিকে চলে। আসলে এটা কাকার প্রতিদিনের অভ্যাস। প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর হয়ে গেল। যেদিন স্টেশনের উদ্বোধন হয়েছিল, সেদিন থেকেই কাকা স্টেশন ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে, ফুলগাছ লাগায়, জল দেয়। রাতে একপাশে বসে বসে কাঁচা বাদাম আর মহুয়া খায়।

গ্রামাঞ্চলে সূর্য ডুবলো তো রাত শুরু হয়ে গেল। তবু স্টেশনের সরকারি আলোতে পাশের রাস্তায় একটু আলো থাকে। একটু দূরে এলে, চাঁদের আলোই ভরসা। আর স্টেশন থেকে গ্রামে আসতে প্রায় তিন ক্রোশ পথ হেঁটে আসতে হবে। যখন রেলের জন্য জমি নেয়, তখন সবাই নাকি আন্দোলন করেছিল, গ্রামের কাছে একটি স্টেশন করা হোক। আর তার ফলেই, এখানে আমরা পাকটিয়া পি.এইচ. দেখতে পাই। সারাদিনে মাত্র দুটি ট্রেন যায়। একটি সকাল সাড়ে ন'টার সময়, হাওড়ার দিকে যায়। আর রাত এগারোটার দিকে, হাওড়া থেকে পাকটিয়া হয়ে মানিকপাড়া যায়। তবু, এই স্টেশনটাই আমাদের সব।

প্রতি বুধবার আমাদের গ্রামে হাট বসে। সারা সপ্তাহের যা কিছু প্রয়োজন, সবই হাট থেকে কিনে নিতে হয়। আশপাশের গ্রাম থেকেও সবাই হাটে আসে। সারাদিন ধরে বেচাকেনা চলে। তারপর যে যার বাড়ি চলে যায়। ছোটবেলায় একবার পিসতুতো ভাই বিল্টুর সাথে চাষের শিম নিয়ে হাটে গেছি। খুব ভোরে উঠতে হয়েছে। সকালের আলো ফোটার আগেই দিদি, আমি, বিল্টু আর পিসি মাঠ থেকে শিম তুলে জড়ো করে বস্তায় ভরে, মাথায় করে হাটে নিয়ে গেছি। বড়বড় এবং তাজা হওয়ায়, দুপুরের আগেই আমাদের সব শিম বিক্রি হয়ে গেছে। তাই আমরা দুইভাই হাটের চারদিক ঘুরে দেখছি। কত লোকে কত কি রকম জিনিস বিক্রি করছে। যেখানে হাট শেষ হয়ে শ্মশান শুরু হয়েছে, সেখানে সবাই গাছের ছায়ায় বসে আছে।

একে ভোরে ওঠা, তার উপর দুপুর পর্যন্ত গরমের রোদে থাকলেও, একফোঁটা জল জোটেনি। শ্মশানের পাশে গাছের ছায়ায় আসতেই, শরীরটা যেন আরও বেশি করে জল চাইল। বসে পড়তেই আমার আর বিল্টুর হাতে একটা করে গ্লাস ধরিয়ে দিল। পিপাসার কারণে একঢকে শেষ করে ফেললাম। কিন্তু, গ্লাসে কি ছিল জানি না, তবে গলা দিয়ে নামার সময় জ্বালা জ্বালা করছিল। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই। এখানে ছায়ার মধ্যে আরও অনেকে বসে আছে। তাদেরই একজন বলল, বেশি গরম পড়েছে তো, তাই প্রথমবার গলায় লাগল।

গরমের সময় ছায়ায় বসে থাকতেই মন চাইছিল। সেখানে বসে বসেই সকলের কথা শুনছিলাম। মাঝে মাঝেই একজন আমাদের সকলের গ্লাসে সরবত ঢেলে দিচ্ছিল। আমরাও পিপাসা মেটাচ্ছিলাম। গরমের দুপুরে এই জায়গায় বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল। গাছের চোখগুলো যেন বুজে আসছিল। আস্তে আস্তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।

হঠাৎ বিল্টুর ডাকে ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে দেখি, চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। তবে তার থেকেও বেশি ভয়, ঝড়কে নিয়ে। একে তো শ্মশানের পাশে মাত্র এই গাছকটিই ভরসা। কিন্তু ঝড়ের সময় আবার, গাছের নিচেও থাকা যায় না। এখান থেকে যে বাড়ির দিকে যাব, তাও প্রায় দুই ক্রোশ হবে! এতটা পথ! তাই সকলের সাথে স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি।

স্টেশনের একটি মাত্র প্লাটফর্মে একটা টিনের শেড আছে। সেখানে সকলের সাথে আম‍রাও ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে এতো লোকের দাঁড়াবার জায়গাটুকুও নেই। ততক্ষণে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তীব্র হাওয়ায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গায়ে তীরের মতো লাগছিল। কিন্তু এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকতে শরীরে যেন কোন অসুবিধাই হচ্ছিল না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেছি, ঠিক বলতে পারবো না। তবে শেষে একসময় সব থামলো।

বৃষ্টি থামার পর, বাড়ির দিকে ফিরতে থাকি। তখন প্রচণ্ড শীত পাচ্ছিল। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে থাকি। বৃষ্টির পরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। অনেক তারাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তারাদের দেখতে পাওয়া গেলেও, এখনো চাঁদ ওঠেনি। তবে তারার আলোতে পাথুরে জমির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না, মাঝে মধ্যে একটু আধটু হোঁচট খেতে হচ্ছে, এই আর কি! একবার তো বিল্টু, হোঁচট খেয়ে পা ধরে বসেই পড়ল। ঠাণ্ডায় কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল।

বিল্টুই প্রথম কথা বলল। যেখান থেকে চাঁদনী যাবার পথ আলাদা হয়ে গেছে, সেখানে এসে থামলাম। বিল্টু বলল, নদীর পাড় ধরে গেলে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া যাবে। নদীর পাড় এক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। সেখানে একটু সাবধানে পা ফেলে যেতে হবে। কিন্তু এই পথে গেলে প্রায় পনের মিনিট সময় বাঁচবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যে, ভিজে কাপড়ে, আর এক মুহূর্তও ভালো লাগছিল না। তাই ওর পিছন পিছন নদীর পাড় ধরলাম।

শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আবার সব চুপচাপ। মাঝে মধ্যে দূর থেকে বুনো জীবজন্তুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। ডানদিক দিয়ে ডুলুং নদী বয়ে চলেছে। নদীর জলে তারার আলো পড়ে চিকচিক করছে। আমরা খুব সাবধানে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলেছি। সাধারণত এই সময়ে, নদীতে হাঁটুজল থাকে। কিন্তু এইরকম সময়েই, পাড় ধসে পড়ে। কোথাও কোথাও নদীর পাড় প্রায় তেতলা সমান উঁচু। সেখান থেকে নীচে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। তাই দুই ভাই একটু বেশিই সাবধানতা অবলম্বন করে চলেছি।

যখন বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছি, তখন স্টেশন থেকে ট্রেনের হর্ণ শুনতে পেলাম। বাড়িতে যখন পৌঁছালাম, তখন আমাদের জামাকাপড় প্রায় শুকনো হয়ে গেছে। তবুও পিসি আমাদের ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলতে বললেন। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পাল্টিয়ে, পরিষ্কার হয়ে পিসিকে খেতে দিতে বলি। ততক্ষণে পিসিও আমাদের জন্য গরম ভাত আর ডিমের ঝোল নিয়ে বসে আছে। আমরাও দুই ভাই খেতে শুরু ক‍রি।

হঠাৎই দিদি নুন আর শনের দরির খবর জিজ্ঞেস করে। এই রে! এটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। পিসি বারবার বলে দিয়েছিল। বাড়িতে নুন শেষ হয়ে গেছে। একসপ্তাহ পরে আবার হাট! তাই এই হাটবারেই যেন নুন নিয়ে আসি, না হলে এক সপ্তাহ নুন ছাড়া খেতে হবে। কিন্তু হাট ঘুরে দেখার পর, আমরা যে শ্মশানের পাশে গাছের ছায়ায় বসেছিলাম, তারপরেও তো নুন কেনা হয়নি! এটা শুনে পিসি রেগে আগুন। এতটুকু ছেলে, এখনই তোরা মহুয়া খাওয়া ধরেচিস! তোদের যা হবার হয়ে গেছে। এবার থেকে শুধু মহুয়া খা, আর পড়ে পড়ে ঝিমো!

আমি আর বিল্টু যত বলি যে আমরা মহুয়া খাই নাই। কিন্তু কে কার কথা শোনে! দিদি তখন শিম বিক্রির পয়সা কোথায় গেল জিজ্ঞেস করে।

আমার প্যান্টের পকেটে আছে।

দিদি জানায়, আমাদের ভিজে কাপড়ের সবকটি পকেটই খুঁজছেন, নুনের প্যাকেট পাওয়ার আশায়। কোথাও কিছু পায়নি।

বুঝতে পারি, আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন কেউ একজন আমাদের পকেট থেকে সব টাকাপয়সা বের করে নিয়েছে। আমাদের সেই ভোর থেকে উঠে সমস্ত পরিশ্রম বৃথা গেল। শুধু তাই নয়, এর ফল স্বরূপ আমাদের সকলকে এক সপ্তাহ নুন ছাড়া খেতে হবে। নিজের উপরই খুব রাগ হচ্ছিল। আর আমাদের না জানিয়ে মহুয়া খাওয়ানোর জন্য, হাটের লোকগুলোর উপর আরও বেশি চটেছিলাম।

একটু আগেও গরমের সময় জল দেবার জন্য যাদের মন থেকে কৃতজ্ঞতা জানাবো ভাবছিলাম, তাদের উপর হঠাৎই যেন মনটা বিষিয়ে উঠল। এতো খারাপ লোক তারা! দুটো বাচ্ছাছেলেকে একা পেয়ে, তেষ্টার সময়ে মহুয়া খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, তাদের পয়সা হাতানো! এটা শুধু অন্যায় বললেই হবে না, এটা জঘন্য! এটা আরও কিছু! -এই কাজ যারা করে, তারা পাপী, -মহাপাপী!

রাতেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে, শুধুই এদিক ওদিক করতে থাকি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখ বুজলেই আজকের সব ঘটনাগুলো একটার পর একটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আর আপনা থেকেই চোখ খুলে যায়। মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা গ্রাস করে। শেষে আর শুয়ে থাকতেও পারি না। উঠে পরি। রান্নাঘরে গিয়ে কুঁজো থেকে জল নিয়ে চোখে মুখে দিই, খেয়েও নিই খানিকটা। আবার বিছানায় যাই।

★ 01 ★ B ★

আমাদের বাড়িতে লোক বলতে ছয়জন। আমি সৌরভ, আমার দিদি সৌমিলি, আমার থেকে দশ বছরের বড়। বাবা, ঠাকুমা, পিসি আর পিসির ছেলে বিল্টু। আমি জন্মানোর সময়ই মা মারা যায়। তখন থেকেই আমি পিসির কাছে মানুষ। পিসেমশাই মারা যাবার পর থেকে পিসিও বিল্টুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকে। আমাদের কিছু জমি জায়গা আছে, চাষাবাদ করেই সংসার চলে যায়। আমি আর বিল্টু দুজনেই মানিকপাড়া হাইস্কুল থেকে সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।

আমি তখন খুব ছোট। একটা বড় ঘর দেখে, দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়েতে অনেক সোনাদানা ও নগদ টাকা পন হিসাবে চায়। এদিক ওদিক থেকে চেয়ে চিন্তে প্রায় সবটাই জোগাড় হয়েছিল। কিন্তু নগদের কুড়ি হাজার টাকা জোগাড় করতে পারলেও, বাকি পাঁচ হাজার টাকা আর জোগাড় করতে পারেনি। অনেক কান্নাকাটির পর, হাতে পায়ে ধরে সেদিন দিদির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকেই চলে দিদির উপর অত্যাচার। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, দিদি অত্যাচারের জ্বালায় পালিয়ে আসে।

সেদিন আমাদের বাড়িতে আর রান্না হয়নি। বাবা এবং ঠাকুমা দিদিকে আবার শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চাইলেও, পিসিই সেদিন দিদিকে আগলে দাঁড়ায়। বলে, শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে আমার মেরে ফেলবে, আর ওখানে যেতে হবে না, এখানে ঠিক দুমুঠো ভাত জুটে যাবে। সেই থেকে দিদিও একসাথেই থাকে। এখন তো দিদির শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর কোন সম্পর্কই নেই। শুনেছি যে কালো মতো লোকটার সঙ্গে দিদির বিয়ে হয়েছিল, সে নাকি আবার বিয়ে করেছে। এবং মোটা টাকা পনও নিয়েছে।

আমাদের বাড়ির সামনেই, নিমাইকাকাদের বাড়ি। নিমাইকাকার কোন ছেলেমেয়ে নেই। কাকা সকালে স্টেশনে চলে যায়। আর প্রতিদিনই শেষ ট্রেন চলে যাবার পর বাড়ি ফেরে। তাই কাকিমা বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়িতেই থাকে। যখন রেলের লাইন পাতার কাজ হচ্ছিল, তখন থেকেই নিমাইকাকা রেলের কন্ট্রাক্টরের ফাইফরমাস খাটত। পরে যখন স্টেশন হল, তখন ঐ কন্ট্রাক্টর স্যারই কাকাকে স্টেশন ঝাঁট দেওয়ার কাজে ঢুকিয়ে দেয়। আর তখন থেকেই কাকা ঐ কাজ করে। কাকার সাথে আমরাও মাঝে মাঝে স্টেশনে যেতাম। স্টেশন মাস্টার সুবীর জেঠুও আমাদের খুব ভালবাসত। আমরা গেলেই টিনের কৌটো খুলে আমাদের বিস্কুট খেতে দিত। আমরাও জেঠুর সাথে কত গল্প করতাম। তবে সব থেকে বেশি ভালো লাগত, যখন জেঠু বেড়াতে যাবার গল্প বলতেন। আর ছোটবেলার সেই ভাললাগাই এই স্টেশনকে আমাদের কাছে অনন্য করে তুলেছে।

আমাদের বাড়ি থেকে মানিকপাড়া প্রায় পাঁচ ক্রোশ পথ। এতটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হতো বলে এবং আমি আর বিল্টু একই ক্লাসে পড়ার কারণে, আমরা একদিন ছাড়া স্কুলে যেতাম। যেদিন বিল্টু স্কুলে যেত, আমি সেদিন বাড়ির সকলের সাথে চাষাবাদের কাজ করতাম। আর পরদিন বিল্টু বাড়িতে থাকতো, আমি স্কুলে যেতাম। বাড়িতে দুজনে একসাথেই পড়তাম। স্কুল ছাড়া অন্য সব জায়গায় দুজনে একসাথেই থাকতাম। রাতে ওর আলাদা ঘর থাকলেও, বেশিরভাগ দিন একই বিছানায় ঘুমাতাম।

পরদিন সকালে দিদির ডাকে যখন ঘুম ভাঙলো, তার অনেক আগেই সূর্য উঠে পড়েছে। পাশে বিল্টুও নেই। দিদিই বলে, বিল্টু জমিতে গেছে। আমাকে একবার শ্মশানের পাশে যেখানে আমরা বসেছিলাম, সেখানে গিয়ে খুঁজে দেখতে বলেছে। ও নাকি কালকে নুন কিনেছিল। প্লাস্টিকের প্যাকেটে নুন ছিল। তাই বৃষ্টিতে ক্ষতি হবে না। যদি পাওয়া যায় যেন নিয়ে আসি। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে, ঝড়বৃষ্টি দেখে, কালকে ভুলে গিয়েছিল।

যাইহোক, যদি পাওয়া যায় এই আশায় আমিও বেড়িয়ে পড়ি। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই গরমের সকালের ফুরফুরে হাওয়ায় একটু জোড়েই হাঁটতে থাকি। চারপাশের জমিতে সবুজের সমারোহ। আসলে এখন তো জমিতে ধান রোপণ করা হয়ে গেছে। বেশিরভাগ জমিতে ঘাঁটান দেওয়াও হয়ে গেছে। তাই ধানগাছও গোছে বাড়তে শুরু করেছে। আর এই সবুজের মাঝে, পোকার খোঁজ করতে সাদা বক নেমেছে। এতো সুন্দর লাগে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জমির মাঝের আলপথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। আমার সারা পেয়ে একটা ফিঙেপাখি উড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বসলো। এই পাখিটা অন্য সব পাখির থেকে আলাদা। কোথাও কোন বিপদ দেখলেই, অন্যকে সতর্ক করার পর, বিপদে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। যেন বিপদ থেকে পালিয়ে যেতে শেখেনি।

ও সৌরভদা, এমন হনহন করে, অন্য দিকে তাকিয়ে কোথা যাচ্ছ? কাদায় পরে যাবে যে।

চমক ভাঙে লক্ষ্মীর ডাকে। এতক্ষণ দেখিনি, লক্ষ্মীও আমার পিছু পিছু আসছে।

হাটতলায় যাব।

বেস্পুতবারে হাটে যাবে! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! আজ সেখানে কিছু পাবে? চলো, আমিও বরং তোমার সঙ্গে যাই। দেখি তুমি বেস্পুতবারে হাট থেকে কি পাও!

আমি আর কোন কথা বলি না। এমনিতেই কালকের ঘটনা এখনো মনে জ্বালা ধরাচ্ছে। তার ওপর আজ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই মাথাটা কেমন যেন ভারী মতো হয়ে আছে।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমার পিছনে পিছনে আসতে আসতেই লক্ষ্মী বলে, আমি সব জানি।

একটু রাগ দেখিয়ে বলি, কি জানিস তুই?

সৌমি পিসি আমাকে সব বলেছে। কাল দাদু হাটে যায়নি। তুমি আর বিল্টু কাকা হাটে গিয়েছিলে। সেখানে তোমাদের সব টাকা কেউ নিয়ে নিয়েছে।

দেখলাম ও সবই জানে। তাই আর কথা বাড়াই না। শুধুই নিচের দিকে মুখ করে হাঁটতে থাকি।

তারপর আবার চুপচাপ। সবুজ ধানের উপর ফু্রফুরে হাওয়া লেগে পাতার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

আচ্ছা সৌরভদা, মহুয়া কেমন খেতে গো! শুনেচি মহুয়া খেলে নাকি খিদে পায় না।

এবারে আমি খুব রেগে যাই। ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ি।

তুই থামবি এবার!

জানো, আমি না, তিনদিন কিছু খাইনি। তিনদিন আগে সৌমিপিসিই লুকিয়ে তিনটে বাসি রুটি আর একটু আমের আচার দিয়েছিল।

তা এই কথাটা তুই আমাকে না বলে দিদিকে বলতে পারতিস তো। তুই এখন যা দিকি। আমার কাছে কি খাবার আছে? আমি মরছি আমার জ্বালায়!

ওসব ছাড়ো তো। আমার আর এখন খিদেই পায় না! তার চেয়ে বরং চলো, তোমার সঙ্গে হাটতলায় গিয়ে খুঁজে দেখি।

আচ্ছা, তুই সবাইকে ঠিক সম্পর্কে ডাকলেও, আমাকে দাদা বলিস কেন? কাকা বলতে পারিস না? তোকে না কতবার বলেছি।

কি জানি! তোমাকে সৌরভদা বলতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

না, তুই আমাকে দাদা বলবি না।

বেশ করবো, বলবো। আমার যা ভালো লাগে, আমি তাই বলবো।

আমিও থেমে যাই। এর সাথে তর্ক করা বৃথা। এইজন্য কতবার ও ওর মায়ের কাছে মার খেয়েছে। তবু বদলায়নি। আবার হাঁটতে শুরু করি।

কিছুক্ষণ পরে হাটতলায় পৌঁছে যাই। কালকের ঝড়ের দাপট, এখনো চারিদিকে ফুটে রয়েছে। এদিকে ওদিকে কাদার মধ্যে মাখামাখি হয়ে হাটের নোংরা ছড়িয়ে রয়েছে। আমি আর লক্ষ্মী চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। হঠাৎ লক্ষ্মী দুটো বাঁশের চুবড়ি আবিষ্কার করে। বুঝতে পারি, কালকের ঝড়ে এই দুটোকে ফেলেই ওর মালিককে চলে যেতে হয়েছিল।

এবারে শ্মশানের দিকে এগিয়ে যাই।

একি!

কাল যেখানে বসেছিলাম, সেখানে একটা গাছ ঝড়ে ভেঙে পড়ে রয়েছে। এটা দেখেই বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। ঝড়ের আগে এখানেই বসেছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর আজ, গাছটাই মাটি থেকে উপড়ে পরে রয়েছে। একটা শিয়াল ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে পালালো। আমি এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে -

কাল কোথায় বসেছিলে গো?

আমি চুপ থেকে শুধু হাতের ইসারায় দেখিয়ে দিই।

লক্ষ্মীই কি একটা দেখে এগিয়ে গিয়ে ডালের ভিতরে ঢোকে। তারপর প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে একটা কাদামাখা প্যাকেট বের করে আনে। প্যাকেটের ভিতরে কি আছে, আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরপর আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি।