Read Shadows without body - first seen by Kalyan Ashis Sinha in Bengali Horror Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

কায়া হীন ছায়া - প্রথম দেখা

তখন গহলা পুকুরে পাশ চলছে। সারাদিন অনেকে পুকুরের পাড়ে থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকেই লোকজন কমতে থাকে। আর একটু রাত বাড়লেই বুঝতে পারা যায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা। শুধু মাঝে মাঝে পাশের রাস্তা দিয়ে হুশ হুশ করে গাড়ি ছুটে যায়।
তখন সবে সন্ধ্যে হয় হয়। রাজু সবকটা সুইচকে অন করে দিয়ে মাদলের থেকে দেশলাই চায়। সেটি নিয়ে ও এখন সন্ধ্যাবাতি দিতে যাবে। এটি এখন শুধু পাস চলছে বলে নয়, অনেক ছোট থেকেই রাজু গহলা পুকুর শ্মশানে সন্ধ্যাবাতি দেয়। আজও এর ব্যতিক্রম হয় না।
প্রথমে একটা গামছা পড়ে পুকুরে স্নান করে নেয়। তারপর শরীর থেকে শুদ্ধ হয়ে ভিজে কাপড়ে চারিদিকে বাতি জ্বেলে দেয় ও ধূপ দেয়। কালী মন্দির থেকে শুরু করে। তারপর শিব মন্দির, তারপর চলতে থাকে। একে একে সব ক'টি জায়গায় ধুপবাতি দিতে প্রায় মিনিট পনের মতো সময় লাগে।
রাজুর সন্ধ্যাবাতি দেওয়া চলার মাঝেই আজকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। আজ রাতে মনে হয় ভালো কষ্ট হবে। গতকালের মত আজ আর তাঁবুতে পড়ে পড়ে ভিজলে হবে না। বৃষ্টির জল তাঁবুর ভিতরে এলেই তাঁবু ছেড়ে বেড়িয়ে মন্দিরের দালানে গিয়ে ঢুকবো। রাজু সন্ধ্যে দিয়ে ফিরলে রাজুকে বলতে হবে।
এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাদল কম্বলটাকে টেনে নিয়ে পায়ে চাপা দেয়। শুধু শুধু এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে পুকুর পাড়ে পড়ে থাকা! মাস্টারদা কেন যে পাশ বন্ধ করে দিচ্ছে না, কে জানে? একটা শিট কোন দিন হয়, তো কোন দিন হয় না। এদিকে পাশ চালানোর জন্য আমাদের লেবার চার্জ হিসাবে অনেক খরচ তো আছে।
রাজু ফিরেই একটা বিড়ি ধরায়। বলে, শিব মন্দিরে যাওয়ার সময় গায়ে বৃষ্টির জল পড়তেই কেঁপে গেলুম যেন। কোনদিন এমন হয় না তো! কত বৃষ্টিতে ভিজেছি।
গায়ে জল পড়লে এমন হয়। আজকে মাস্টারদা এলে বলবি। কি বলে শুনবি?
মাস্টারদা তো! আমাকে কি সব বলে, এমন বুঝিয়ে দেবে, যে আসল জিনিসটাই ভুলে যাব। সেই জন্য আমি বেশি কিছু বলি না তো!
যাইহোক, এখনো দুটো বাংলা আছে, আমি আর এখান থেকে কোথাও বের হচ্ছি না।
রাতে কিছু খাবি না?
এই শ্মশানে মুড়ি তো হ্যায়!
শুধু মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিবি!
শুধু খাবো কেন, আধখানা চপ আর ওই বাটিটায় একটু তরকারি আছে, হয়ে যাবে।
মাস্টারদা শুনলে কিন্তু রেগে যাবে।
ও সে সব ম্যানেজ করে নেব! তুমি কি আজ আর বাড়ি যাবে?
বাড়ি না গেলেও, ইস্কুলে তো একবার যেতে হবে! প্রভুর ওখানে একবার ঢুকবো।
ওই সবই করো। আর যদি বাজারে যাও তো কিছু কিনে এনো। কাল সকালের মতো আলু আছে। পরে শিট ভর্তি হলে দেখা যাবে। এই ওয়েদারে কে আসবে?
কি আনব?
যাই হোক একটা কিছু।
পাঁচ টাকার ছোলা নিয়ে নেব?
রাতে ছোলা দিয়ে মুড়ি খাবো!
তবে কি আনব, সেটা বলতে হবে তো?
তুমি কি এতক্ষণ মদের সঙ্গে কি খাবো, জিজ্ঞাসা করছিলে?
কি আনব তুইই বল না?
আচ্ছা, পাঁচ টাকার ছোলা নিয়ে নেবে। রাতে তোমার খাবার আনবে তো, তার সাথে একটু বেশি করে তরকারি নিয়ে নেবে।
এটা বললেই তো হয়। আজ আর মদ আনতে হবে?
হ্যাঁ, রাতে যদি কেউ আসে। কিম্বা ভোরে যদি বৃষ্টি না হয়। যদি পাশে কেউ আছে। সে তো চাইতেই পারে।
তা যা বলেছিস! এরা ছিপ ফেলতে আসে, না মদ খেতে আসে, বোঝা মুশকিল। কটা নেব বল তো?
খান পাঁচেক নিয়ে নিও না।
তাহলে তুই এখানে থাক, আমি একটু ঘুরে আসছি।
এই বৃষ্টি বাদলায় একা একা শ্মশানে পড়ে থাকবো!
তাহলে তুই যা।
এই বৃষ্টিতে আবার বাইরে বের হচ্ছে। তারচেয়ে বরং মদ ঢালো। একটু করে খেয়ে নিই।
দাঁড়া আগে বাজার থেকে ঘুরে আসি, তারপরে হবে।
তাহলে দেরী করছ কেন? তুমি গেলে এখনও একা থাকতে হবে, পড়ে গেলেও একা থাকতে হবে।
যদি অমরদা আসে।
এই বৃষ্টিতে অমরদা আর বেড়োবে বলে মনে হয় না। যাও যদি বেরিয়ে পড়ো। না হলে মদ ঢালো।
তুই থামত! শুধু মদ আর মদ! একটু আগেই তো খেলি।
সে তো, দুপুরে। একটু মদ না খেলে শরীরটা যেন ঠিক হয় না। শরীর ঠিক রাখতে গেলে একটু করে মদ খাওয়া ভালো।
তাহলে তুই বোস। মাঝেমাঝে একবার করে চারপাশে টর্চ মারবি।
এই ওয়েদারে কেউ বেড়োবে না, তুমি এখন একবার চারপাশ টর্চ মেরে দেখে নাও, আর আমি এখান থেকে উঠছি না।
ঠিক আছে বোস।
বলে রাজু লুঙ্গিটাকে একটু তুলে পরে। একটা গামছাকে ভাঁজ করে মাথায় দিয়ে নেয়। হাতে ছাতাটা নিয়ে তাঁবুর ভেতর থেকেই পুকুরের চারপাশে টর্চ মেরে দেখে নেয়। তারপরে টর্চটা মাদলের পাশে রেখে, সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে মাদলও কম্বলটা সারা শরীরে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ে।
স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতেই সন্ধ্যা। একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আবার অন্য ডিউটি! পুকুরে পাশ চলছে। সারাদিনটা রাজু আর মাদলদা সামলায়। রাতে দেখা করতেই হয়। আজকে বৃষ্টির জন্য পাশ চলেনি। আসলে কেউই এই বৃষ্টিতে আসেনি। বৃষ্টি এখনও ঝির ঝির করে পড়েই চলেছে। রেনকোটটা চাপিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। বাড়ি থেকে পাশ পুকুরে যেতে, বাইকে মিনিট পনেরোও লাগে না।
রাস্তা থেকেই গহলা পুকুরের তাঁবুর আলো দেখতে পাওয়া যায়। পাশ চলছে বলে চারপাশে আরো বেশি আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দূর থেকে দেখতে একটু ভয় ভয়ই লাগে। পিচের রাস্তার পাশে খেলার মাঠ, তারপরেই পুকুর। আর একদিকে শ্মশান। শ্মশান এর সামনে, পুকুরের বাঁধানো ঘাট ও কালী মন্দির। আবার মাঠের উল্টো দিকে কালী মন্দিরের সামনে একটু বাঁদিক ঘেঁষে শিব মন্দির।
আমাদের তাঁবুটা কালী মন্দির এর পিছনে মন্দিরের গা ঘেঁষে বানানো। সামনেই ঘাট। তবে তাঁবুটা বানানোর ভুলের জন্যই বোধ হয়, মন্দিরের ছাদের সব জল তাঁবুর ভিতরে পড়ে। ভিতরে যে ইট পাতা হয়েছিল, তার কয়েকটা তুলে দিয়ে রাজু কালকে জল বের করার ব্যবস্থা করে ছিল। আজকে কি হবে, কে জানে!
সবে পিচের রাস্তা থেকে শ্মশানের দিকে ঢুকছি। সব আলোগুলো একসাথে নিভে গেল। লোডশেডিং! হওয়ার আর সময় পেলি না! যাইহোক, বাইকে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলি। বাঁ দিকে মাঠ আর ডানদিকে সরকারি টিউবওয়েল পেড়িয়ে কালী মন্দিরের সামনে দিয়ে শ্মশানের সামনের ঘাটের পাশে বাইকটা দাঁড় করাই।
একটাও আলো জ্বালে নি। বাতি তো আছে। আসলে এইমাত্র লোডশেডিং হলো তো। বাতি জ্বালতেও তো সময় লাগবে! কিন্তু কাউকে দেখছি না তো! ঘুমিয়ে পড়েছে হয় তো! তাঁবুর ভেতরে ঢুকে, পকেট হাতরে লাইটার বের করে জ্বালাই। ওই তো ব্যাগ। একটা মোমবাতি বের করে জ্বালাই। একটা ইটের উপরে বাতিটা বসাই।
বিছানা গোটানো। একটা কম্বল মেলা পড়ে রয়েছে। সব গেল কোথায়? ওই তো রাজুর টর্চও আছে। টর্চটা নিয়ে আবার তাঁবুর বাইরে ঘাটে এসে বসি। বটগাছের নিচে এখন আর বৃষ্টির জল পড়ছে না। রেনকোটটা খুলে ফেলি। বাইকটা তাঁবুর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে হয়। ভিতরে একটা সাইকেল রয়েছে। ওটাকে আগে তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে রাখতে হবে। আগে কাজ মিটিয়ে বসি।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাইক তাঁবুর ভিতর রেখে একটা বাতি ঘাটেও জ্বালি। বাতির আলো ঘাটে বটগাছের নিচটাকে যেন আরো বেশি ভৌতিক করে তুলেছে। কতক্ষণ এই নির্জন পরিবেশে একা থাকতে হবে, কে জানে! কিন্তু, দুজনে একসাথে বেড়িয়ে গেল! হয়তো শ্মশানে একা থাকতে ভয় পেয়েছে!
বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। আজ কিন্তু বৃষ্টি থামলেও আকাশের মেঘ কমেনি। তাই সামনের জবা গাছটাকে অন্ধকারে নিরেট পাথরের মত লাগে। ঘাটে বসে বসে জলের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও কি যেন খুঁজে চলেছি!
হঠাৎ তাঁবুর ভেতর থেকে কাশির শব্দ। তাহলে কি তাঁবুর ভিতরে কেউ রয়েছে? বাইরে থেকেই মাদলদা, বলে ডাকি। আবারও সব চুপচাপ।
তবে কি আমি ভুল শুনলাম! ভালো করে দেখি তো একবার। তাঁবুর ভিতরে ঢুকি।
মাদলদা ও মাদলদা।
এবারে কম্বলটা যেন একটু নড়ল। হ্যাঁ, ওই তো। কম্বল সরিয়ে একটা হাত বেড়িয়ে আসছে।
মাদলদা!
ক্রমে হাতটা কম্বল সরায়। ভিতর থেকে মালদার মাথা বেড়িয়ে আসে।
মাস্টারদা, কখন এলে?
এইমাত্র এলাম।
কারেন্ট অফ হল কখন? বুঝতেই পারিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাজু বাজারে গেল।
আজ রাতে এখানে থেকে যেতে পারি।
তাহলে তো ভালোই হয়। কিন্তু, এই বৃষ্টিতে পাশের কি হবে? এই রকমই চললে পাশ বন্ধ করে দিতে হবে।
তা হবে। তবুও কদিন দেখো।
মাস্টারদা টিফিন করেছ? না হলে রাজুকে একবার ফোন করতে হবে।
আমার জন্য চিন্তা করো না। তার চেয়ে বাইরে এসো গাছের নিচে ভালো লাগবে।
মাস্টারদার সাথে আমিও বাইরে বেড়িয়ে পড়ি। ওহঃ, কি ভয় যে পেয়েছিলাম! ভাগ্যিস মাস্টারদা এল, না হলে হয় তো রাজু এসে দেখতো, আমি মরে কাঠ হয়ে গেছি।
বুঝলে মাস্টারদা, এই শ্মশানে একা থাকা খুব ভয়ের ব্যাপার! কালকে রাতে তো খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল।
কেন, কি হয়েছিল?
বৃষ্টি তখনও শুরু হয়নি, রাতে একবার বাইরে উঠেছি। বাথরুম সেরে ফিরে পড়বো, তাই হাতে টর্চও ছিল না। দেখি, বট গাছের গোড়ায় কে যেন বসে রয়েছে! বাথরুম সাড়া রইল পড়ে, তাড়াতাড়ি তাঁবুতে ঢুকে রাজুকে ডাকি। টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। কিন্তু না! আর, কেউ কোথাও নেই! যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কি আর করব! কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে আবার তাঁবুর ভিতরে চলে আসি।
তাঁবুর ভিতরে আমি আর রাজু মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। রাজু জিজ্ঞেস করে, তুই ঠিক দেখেছিলি তো? কি আর বলব। তবে সেই ঘটনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ তার পর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। আর তাবুর ভিতরে জল ঢুকে বিছানা ভেজাতে শুরু করে।
মন্দিরের দৌড়ে উঠে যাওনি কেন তোমরা?
উঠবো উঠবো করে আর ওঠা হয়নি। শেষে রাজু আর আমি প্রায় বসে বসেই কাটিয়ে দিই।
এতে আমার কিছু করার নেই। তোমরা যদি ইচ্ছা করে কষ্ট পাও তো, আমি কি করবো?
না, না, তোমায় কিছু করতে বলছি না। আজকে তাবুতে জল ঢোকা শুরু হলেই মন্দিরে গিয়ে উঠব, রাজু আর আমি ঠিক করেই রেখেছি।
যা ভালো বোঝো, বলে মাস্টারদা ঘাটে এসে দাঁড়ায়। আমিও আর কি করি। তাই একটা বিড়ি ধরিয়ে ঘাটের কাছে যাই। দুটো চটের থোলে নিয়ে যাই। রকের ওপর পেতে বসা যাবে। কালকে রাতে প্রথমবার দেখার পর থেকেই মনটাও ভালো নেই। একটু আগেও তো ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম। ভাগ্যিস মাস্টারদা এল, না হলে যে কি হতো কে জানে!
এত বৃষ্টিতেও মশার উৎপাত কমেনি। চারদিক থেকেই শুধু হুল ফোটায়! বসে বসে কি বলব ভাবছি। এমন সময়ে রাজু ফিরে আসে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বৃষ্টি নামে। আমরাও আর বাইরে বসে না থেকে মন্দিরের দালানে আশ্রয় নেই।