Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

কায়া হীন ছায়া - কুঁড়োর আগুন (Mud fire)

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সবাই মিলে বাড়িতে গল্পের আসর বসেছে। যে যার মতো গল্প বলছে। হঠাৎ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে, মৌ বলে, আজকের এই রকম ওয়েদারে অন্য কোনো রকম গল্পই ভালো লাগছে না। তাই এখন ভূতের গল্প শুরু করা যাক। কিন্তু কে ভালো ভূতের গল্প জানে?
আচ্ছা, জ্যেঠুমনি, তুমি কোন দিন ভুত দেখেছো? মিমি প্রশ্ন করে। মৌ আর মিমি দুই বোন। দুজনেই শহরের নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। কিন্তু এই নতুন উৎপাত, করোনার জন্য সমস্ত স্কুল বন্ধ। তার উপরে আবার লকডাউন। সবাই সব সময় বাড়িতে। মৌ আর মিমির আনন্দ সবচেয়ে বেশি। তবে তাদেরই ভাই জিতের মন খারাপ। লকডাউনের জন্য বাইরে খেলতে যাওয়া বন্ধ!
এদের জ্যেঠুমনি কিন্তু হাই স্ট্যাটাস সোসাইটির কেউ নন। এখন সর্বদা নিজের বাগান নিয়েই পড়ে থাকেন। বাগানে কি নেই? কুমড়ো, লাউ, ঝিঙ্গা, টম্যাটো, কাঁচালঙ্কা, বেগুন যেমন আছে, তেমনি পিটুনিয়া, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, বিভিন্ন প্রকার লিলি প্রভৃতিও রয়েছে। আর সব থেকে বেশি করে যে জিনিসটি নিয়ে জ্যেঠুমনি পড়ে থাকেন, তা হল বনসাই।
বিভিন্ন প্রজাতির গাছের একাধিক বনসাই। তাদের জন্য বিভিন্ন আকারের টব। তাদের মাটি তৈরীও জ্যেঠুমনি নিজের হাতেই করেন। নিজেই পাতাপচা সার তৈরী করেন। কেঁচোসারও বাগানের একপাশে তৈরী হয়।
মিমির প্রশ্নের উত্তরে জ্যেঠুমনি বলেন, সে অনেক দিন আগের কথা। তখন সবে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছি। পাড়ায় তখন খুব ছিঁচকে চোরের উপদ্রব। তাই বন্ধু বান্ধবরা সবাই মিলে ঠিক করি, নাইট গার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু নাইট গার্ড হিসেবে থাকবো বললেই তো আর হয় না। চোরের সামনে পড়লে, সে কি ছেড়ে দেবে! তাই, আগে থেকেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই মতো আমরা সবাই মিলে থানায় গিয়ে পুলিশকে সব কথা জানাই। সব শুনে পুলিশের এক অফিসার বললেন, ভালো কথা তো। তোমরা যদি নাইট গার্ড দাও, তো পুলিশের পক্ষ থেকে টর্চ, লাঠি, বাঁশি, তোমাদের দেয়া হবে। সেই থেকেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের পাড়ায় নাইট গার্ড দেওয়া শুরু করি।
কিন্তু জ্যেঠুমনি, ভূত কোথায় গেল? মিমি আবার প্রশ্ন করে।
মৌ বলে, ধৈর্য্য ধরে শোন, নিশ্চয়ই ভূত বেরোবে।
আচ্ছা, জ্যেঠুমনি, ভূতেদের কি বড় বড় দাঁত থাকে?
তোমরা মন দিয়ে শোনো, তাহলে বুঝতে পারবে। এখন যেখানে বাজার বসে, সেখানে তখন মার্টিন ট্রেনের স্টেশন ছিল। আর যে ঢালাই রাস্তা, বাজার থেকে আমাদের বাড়ির দিকে এসেছে, তখন সেখানে মেঠো পথ ছিল। বর্ষাকালে খুব কাদা হত। আমরা একটা দল, মার্টিন ট্রেনের স্টেশন থেকে শুরু করে, প্রথমে দক্ষিণ দিকে, এখন যেখানে স্টেশনে যাবার রাস্তা আছে, সেখান পর্যন্ত যেতাম। তারপর মাটির রাস্তা ধরে জমিদার বাড়ির খামারের উপর দিয়ে খালের ধার পর্যন্ত। ওখান থেকে আমরা বাঁশি বাজিয়ে আমাদের অবস্থান জানাতাম। অন্য একটা দল মার্টিন ট্রেনের স্টেশন থেকে, পশ্চিম দিকের পথ ধরে, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে মাঠের উপর দিয়ে, খালের পাশ পর্যন্ত যেত।
আমাদের দুটি দল তখন খালের দুদিকে। ওখান থেকে আবার উল্টো পথে মার্টিন ট্রেনের স্টেশনে ফিরে আসতাম। প্রথম প্রথম এই কাজটা খুব ভালো লাগলেও, কিছুদিন পর থেকেই আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে। এদিকে আমরা থাকার জন্য চুরি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়ে ছিল। পুলিশের তরফ থেকে নানারকম পুরস্কারও দেওয়া হতো। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।
একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যখন মার্টিন ট্রেনের স্টেশনে উপস্থিত হই, তখনও শেষের আগের ট্রেনটি আসেনি। আসলে তখন তো আর সবার কাছে ঘড়ি, ফোন থাকতো না। বেশির ভাগ সময়ে ট্রেনের যাতায়াত দেখেই সময়ের হিসাব করতে হতো। ভাবলাম তাহলে হয়তো আগেই এসে পড়েছি। তাই আর একটু অপেক্ষা করি। কারন, আমাদের নাইট গার্ড দলের মধ্যে তিন জন উপস্থিত।
আর তিন জনের দুটো দলে ভাগ হওয়ার মানে, কোন একটি দলে একাকী থাকতে হবে। সেদিন আমার সঙ্গে বিমল আর সুবীর ছিল। স্টেশনের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ঘোরাঘুরি ছাড়া আর কি করতে পারি! ক্রমে শেষের আগের ট্রেনটি আমাদের স্টেশনে এসে থামল। ট্রেন থেকে মোটে একজন যাত্রী নামল। আর সে হল তোদের বাবা। তো সব শুনে এইমাত্র ফেরা সত্ত্বেও সে আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইল।
আমরাও দেখলাম চারজন হলে তবুও তো দুজন দুজন করে দুটো দলে ভাগ হওয়া যাবে। সেই মতো আমি আর সুবীর একদিকে, আর তোদের বাবা আর বিমল আর এক দিকে যাবে ঠিক হয়। আমরা দক্ষিণ দিকে যাব, আর ওরা যাবে পশ্চিম দিকে। এটাতে আর একটা সুবিধা পাওয়া যাবে। বাড়িতে দেখা করে নিতেও পারবে।
ট্রেন আমাদের স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার পর, আমি আর সুবীর দক্ষিনে না গিয়ে, প্রথমেই উত্তর দিকে রেল লাইন বরাবর একবার দেখে নেব ভেবে নিই। স্টেশনের আলোয় যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, আমরা ততদূর পর্যন্ত যেতে পারি। সেই মতো রেলের স্লিপারের ওপর দিয়ে, পাথর থেকে পা বাঁচিয়ে, এগিয়ে চলি। যেখানে প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়েছে, সেখান থেকে খুব বেশি দূরেও যাই নি। হঠাৎ সুবীর বলে, এই দাঁড়া, সামনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ!
সামনে তাকিয়ে দেখি, কারা যেন আমাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এরা তো আমাদের সামনে রয়েছে। টর্চটা জ্বালাই।
সামনে মার্টিন ট্রেনের লাইন সোজা চলে গেছে। কিন্তু যাদের দেখবো বলে টর্চ জ্বালালাম, তাদের কাউকেই দেখতে পেলাম না। আমি আর সুবীর লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে থাকি।
সুবীর বলে, টর্চটা অফ কর।
আমি টর্চ অফ করি। না! আর কাউকেই দেখতে পাই না। একা একা ভুল দেখা হলেও না হয় কথা ছিল। এমনিতে সুবীর প্রচণ্ড সাহসী। বলে, চল, এগিয়ে দেখি।
কি আর দেখবি! যাদের অন্ধকারে দেখা যায়, আলোতে দেখা যায় না, আলো জ্বেলে তাদের কাছে গেলেও কি আর দেখতে পাবো!
কিন্তু আমাদের দেখতে তো হবে!
হ্যাঁ, তা হবে।
তবে চল, এগোই।
হাঁটতে হাঁটতে আরো অনেকটা পথ এগিয়ে গেলেও, আর কোন কিছু চোখে পড়েনি। শেষে উত্তর দিক থেকে ব্যাক করতে শুরু করি। মাঝে মাঝেই পিছন দিকে ফিরে তাদের খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু বারে বারে অসফল হলেও, পিছন দিকে দেখার লোভ সামলাতে পারি না। একসময় আবারও প্লাটফর্মে এসে পৌঁছাই। তখনকার প্লাটফর্ম কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। ট্রেন যেখানে দাঁড়াবে, তার দুপাশটা একটু বেশি করে পরিষ্কার করা। শুধুমাত্র একটি জায়গায় একটি টিনের শেড। সেখানেই গ্যাসের বাতি জ্বলে।
প্লাটফর্মে পৌঁছে স্টেশন মাস্টারকে ঘটনার কথা জানাই। তিনিও জানান, এই নিয়ে তিন দিন হল। শেষ ট্রেন বা তার আগের ট্রেনেই শুধুমাত্র এরকম ঘটনা ঘটে। আমাদের আগে যে দুবার ঘটেছে, তার একটি আবার জীবন কাকা সাথে ঘটেছে। জীবন কাকা স্টেশনের একপাশে বসে হুঁকো খাচ্ছিল। সেবারে শেষ ট্রেন বেড়িয়ে যাওয়ার পর মাস্টারমশাই জীবনকাকাকে বাড়ি যেতে বললে, জীবন কাকা উঠে পড়ে। তবে সরাসরি পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য লাইন বরাবর উত্তর দিকে এগিয়ে যায়। একটু এগিয়ে লাইন থেকে নেমে পরে, বাগান টপকালেই বাড়ি।
সেদিনও জীবন কাকা দেখে দু তিন জন লোক কিছুটা সামনে লাইনের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। জীবন কাকার হাতে হুঁকোটি ছাড়া আর কিছু নেই। সেই অবস্থাতেই জীবন কাকা, কে, বলে চেঁচিয়ে উঠতেই লোক গুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, জীবন কাকাও বাড়ি চলে যায়। পরদিন সকালে মাস্টারমশাইকে ঘটনাটা জানায়
আর একবার মাস্টারমশাই নিজেই দেখেছেন। সে বারও ঘটনাটা ঘটেছিল শেষ ট্রেনে। শেষ ট্রেন আসার পর শেষের বগি থেকে তিনজন লোক নামে। মাস্টারমশাই তাদের টিকিট চেক করার জন্য উত্তর দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়েও ফিরে আসতে হয়, কাউকেই আর দেখতে পাওয়া যায় নি!
এদিকে স্টেশনে থাকতে থাকতেই আমরা বাঁশির আওয়াজ পাই। মানে ওরা খালের ধারে পৌঁছে গেছে। আমরাও বাঁশি বাজিয়ে জানান দিই এবং মাষ্টার মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরাও খালের ধারে পৌঁছে যাই। অপর দলটি ততক্ষণে সেখান থেকে স্টেশনের দিকে ফিরে গেছে। আমরাও বাঁশি বাজালে উত্তর পাই।
হঠাৎ সুবীর বলে, কি ব্যাপার বল তো! একটু আগেই এই রকম একটা ঘটনা ঘটল, আবার এখনও দূরে খালের পাশে মাঠের মাঝে দেখ!
কি দেখব, ফাঁকা মাঠ, শুধু ধূ-ধূ করছে, চাঁদের আলোতে খুব ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না।
ভালো করে দেখ, মাঝে মাঝে একটা আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেখ আলোটা মনে হচ্ছে এগিয়ে চলেছে!
সত্যিই আজকে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম!
কার আবার, সকালে প্রথমে আয়না দেখেছিলি।
এইরকম পরিস্থিতিতেও দুজনে হেসে উঠি। হঠাৎই সুবীর বলে, চল দেখব।
কিভাবে যাবি? আমরা তো খালের এপারে আছি।
ওঃ! বুঝতে পারিনি, যে তুই সাঁতার কাটা ভুলে গেছিস!
চল।
দুজনে খাল টপকে উল্টোদিকের মাঠে নামি, ততক্ষনে আলোটা অনেক দূরে চলে গেছে। তবুও ভিজে কাপড়ে, আমরা টর্চ বন্ধ করে এগিয়ে চলেছি। এগিয়ে চলেছি বললে হয়তো ভুল বলা হবে। বলা যায় আমরা ছুটে চলেছি। দূরের জ্বলা-নেভা আলোটার সাথে আমাদের দূরত্ব ক্রমেই কমছে। যখন আলো নিভে যাচ্ছে, তখনও একটা হালকা আলোর রেখা থেকে যাচ্ছে।
এটাই কি তবে নিশি পাওয়া! আমরা কি তবে নিশির ডাকে ছুটে চলেছি! জানি না! দূরের আলোটা এখন আর অত দূরে নেই। সামনেই বড় খাল। আলোটা যেন একটা মূর্তির আকার নিচ্ছে! একটা মানুষের আকারের মতোই লাগছে! কিন্তু জ্বলা-নেভা ভালোর উৎস যে কি, বুঝতে পারি না! তবে কি আমরা কোন ভূতের পাল্লায় পড়েছি! যে আমাদের প্রথমে উত্তরে, তারপরে দক্ষিণে, আর এখন পশ্চিমে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে?
দূরে আবার আলোটা জ্বলে উঠলো। সেই আলোতেই বড় খালের পাড় দেখতে পাই। এতদূরে এসেও জানতে পারবো না! হারিয়ে যাবে! মনটা খারাপ হয়ে আসে। সুবীর আর আমি অনবরত ছুটে চলি। আমাদের জানতেই হবে। যদি নিশি পাওয়াও হয়, তাও তো জানা যাবে। আলোটা খালের পাড়ে উঠতে থাকে। আমরা তখনও খালের পাড় থেকে মোটামুটি 200 মিটার দূরে!
এক সময় আমরাও বড় খালের পাড়ে পৌঁছাই। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই, খালের উল্টোদিকে জ্বলা-নেভা আলোটা পাড় থেকে নেমে, মাঠের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আমরা যত জোড়ে যেতে পারি, তার চেয়ে অন্তত দ্বিগুন বেগে এগিয়ে চলেছে। তবে কি আমাদের অস্তিত্বের কথা বুঝতে পেরে, নিজেই গা-ঢাকা দিতে চাইছে! আর এগোনো ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে ফেরার পথ ধরি।
পরদিন পুলিশকে সব কথা জানাই। পুলিশ দিনের বেলায় জায়গাটা একবার দেখতে চায়। আমরাও পুলিশকে নিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে আনি। পুলিশ জায়গাটার চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। শেষে সব কিছু অধরা রেখে, আবার বাড়ির পথ ধরি।
জ্যেঠুমনি, তাহলে তোমরা ভূতের পিছনে ছুটছিলে? তোমাদের ভাগ্য ভালো, যে ভুতটা তোমাদের কিছু করেনি!
তা হয়তো ঠিক, তবে পরে বুঝেছি, আমাদের ওভাবে এগোনো ঠিক হয়নি। আগে অপর দলকে সংবাদ দিয়ে তারপরে যাওয়া উচিত ছিল।
কেন জ্যেঠুমনি, ততক্ষনে তো আলোটা হারিয়ে যেতে পারত!
হ্যাঁ, তা হয়তো পারতো। আবার আমাদের অন্যরকম বিপদও তো আসতে পারত। তখন আমরা সাহায্যের জন্যও তো কাউকে পেতাম না! তাই সর্বদা প্লান অনুযায়ীই চলা ভালো। এর কদিন পরের ঘটনা। একদিন বিকাল বেলায় থানা থেকে অফিসার দলবল সহ হাজির।
কি ব্যাপার! গ্রামাঞ্চলের পুলিশ, একপ্রকার ভয়ের প্রাণী! তার উপর দলবলসহ! আমরা তো ভয়েই মরি! তবু নাইট গার্ড দেওয়ার জন্য, পুলিশের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। পাড়ার অনেকেই পুলিশ দেখে, সেই যে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, একেবারে পরদিন সকালে।
এবারে আসল ঘটনায় ফিরে আসি। আমাদের পাশের গ্রামের শ্রীধর। ছোট খাটো হাত সাফাই যার পেশা! আমাদের গ্রামে নাইট গার্ড চলার জন্য যার খুব অসুবিধা হচ্ছে। এটি তারই কাজ। স্টেশনে সবাইকে ডেকে নিয়ে পুলিশ ঘটনাটা জানায়।
রাত হলেই শীধর বেড়িয়ে পরে। একমাত্র লক্ষ্য, কিছু ছোট খাট জিনিস চুরি করে পরের দিনের খাবার জোগাড় করা। এদিকে চুরি করা তো দূরের কথা, নাইট গার্ডের জন্য যেখানেই যায়, শুধু বাঁশির আওয়াজে চমকে ওঠে। কদিন আর না খেয়ে চলতে পারে! শেষে ঠিক করে, মাঠ পেড়িয়ে, খাল পেড়িয়ে, উল্টোদিকে গ্রামে ঢুকবে। কিন্তু মাঠের মাঝে পড়বে "হেঁদোল তলার বিল"! সেখানে সন্ধ্যের পর থেকেই ভূতেরা ঘোরা ঘুরি করে! তা যাবে কিভাবে?
শ্রীধর শুনেছে, ভূতেরা আলোর কাছে আসে না! সেই মত বুদ্ধিও বার করে ফেলে। একটা মালসায় কাঠকয়লার আগুন তৈরী করে, আর সঙ্গে রাখে কুঁড়ো। একটু করে কুঁড়ো আগুনে ছড়িয়ে দিলেই জ্বলে ওঠে। শ্রীধরও একটু করে এগিয়ে যায়। কিন্তু মালসা গরম হয়ে যায় বলে সমস্যায় পড়ে। শেষে কলাপেটো দিয়ে বেঁধে মাথার ওপর তুলে ধরে। এতেও শেষ রক্ষা হয় নি। প্রথম দিনেই তোমাদের চোখে পরে যায়। খাল টপকানো সময়ে কোন দুজন লোক ওকে ফলো করছে, বুঝতে পেরে যায়। তাই সেদিনের মতো চুরির পরিকল্পনা ত্যাগ করে, পালিয়ে বাঁচে।
কিন্তু স্যার, ওটা যে শ্রীধরই ছিল, আমরা বুঝব কি করে, বিমল প্রশ্ন করে।
খুবই বুদ্ধিমান প্রশ্ন করেছো। আমরা পরদিনই তোমাদের সাথে খালের পাড়ে গিয়ে কুঁড়ো এবং ছাই পড়ে থাকতে দেখি। তখনই বুঝতে পারি এটা কোন মানুষের কাজ! তাই যে কয়জন দাগী চোর আছে, তাদের সবাইকে থানায় ডেকে পাঠাই। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর তখনই শ্রীধর স্বীকার করে নেয়। তবে এও বলেছে, এই কদিনে ও কোন চুরি করতে পারে নি। কদিন খেতেও পায় নি। এখন পুলিশ এখানে এসেছে, আমাদের পুরষ্কৃত করার জন্য।
আমাদের মধ্য থেকে সুবীরকে পুরষ্কার নেওয়ার জন্য ডাকা হয়। অফিসারের হাত থেকে পুরষ্কার নেওয়ার সময় জানতে পারে, পুলিশ এখন অর্থমূল্যে পুরস্কার দিচ্ছে। একটা খামে করে 100 টাকার একটা নোট! মনে হতে পারে, 100 টাকার একটা নোট আর কি এত মূল্যবান! কিন্তু যখনকার সময়ের কথা বলছি, তখন এই 100 টাকাই আজকের লাখ টাকার সমান।
অফিসারের হাত থেকে পুরষ্কার নেওয়ার পর, সুবীর কেঁদে ফেলে। কারন জিজ্ঞাসা করলে জানায়, যে শুধু মাত্র তার জন্যই শ্রীধর তিন-চার দিন খেতে পায়নি। তাই সবাই যদি অনুমতি দেয় তো, এই টাকাটা শ্রীধরদের মতো লোকেদের খাওয়া-পরার জন্য ব্যায় করা হোক।
এটা শোনার পর পুলিশ অফিসার সুবীরকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমাদের বুকটাও আনন্দে ভরে ওঠে। তাড়াতাড়ি আমাদের থেকে একজন শ্রীধরকে ডাকতে পাশের গ্রামে ছুটে যায়। এত কিছুর ফাঁকে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বুঝতেই পারি নি। এই আনন্দের দিনে স্টেশনে একটা ফিস্টের আয়োজন হয়েছে। পুলিশও দলবলসহ রয়ে গিয়েছে।
সন্ধ্যার ট্রেনও চলে গিয়েছে। আজকেও জীবন কাকা স্টেশনের এক পাশে হুঁকো হাতে বসে রয়েছে। শেষের আগের ট্রেন আমাদের স্টেশনে এসে থামে। একেবারে সামনের কামরা থেকে একজন যাত্রী ট্রেন থেকে নামে। যার পরনে একটা লম্বা মতো পোশাক! ট্রেন থেকে নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এলে জানতে পারি, যাকে লম্বা মতো পোশাক ভেবেছিলাম, ওটা আসলে একটা ছেঁড়া বিছানার চাদর। আর চাদর পরিহিত অবস্থায় আমাদের সামনে শ্রীমান শ্রীধর! শুধুমাত্র খাওয়ার কথা শুনে আমাদের স্টেশনে চলে এসেছে!
প্লাটফর্মে সবাই একসাথে খেতে বসা হয়েছে। লাইন দিয়ে সবাই বসেছে। ভালো লাগে এই দেখে, যে এখানে যেমন শ্রীধর আছে, তেমনি পুলিশও আছে, মাস্টারমশাই আছেন। সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ। এবার সবাই বাড়ি যাবে। কিন্তু শ্রীধরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সবার সামনে থেকে একে বারে ভ্যানিশ হয়ে গেছে যেন! এমন সময়ে বিমল পাশের গ্রাম থেকে একটা দুঃসংবাদ নিয়ে ফেরে।
স্টেশনে ফিরে, মাস্টারমশাই এবং পুলিশকে বিমল জানায়, প্রতিদিন না খেয়ে থেকে ক্রমে জীর্ণ হয়ে ছিলই, তার ওপর গত কয়েকদিনে যা ধকল গেছে, তা আর সহ্য করতে পারে নি। আজ সকালে শ্রীধর মারা গেছে! পাড়ার লোকেরা তার সৎকাজ করে এসেছে। এই পর্যন্ত শুনে, আমরা সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করি।
দূরে তখন শেষ ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, ওই তো, লাইনের উপর দিয়ে চাদর গায়ে কেউ যেন এগিয়ে চলেছে.......