সকালে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে সবে বেড়িয়েছি। হঠাৎ পিছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকাই। আরে, একে তো চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না তো! দিন দিন আমার স্মরণ শক্তি কমে যাচ্ছে যেন। এমন সময়ে জয়ন্তই মনে করিয়ে দেয়। অন্তত কুড়ি বছর পরে দেখা। স্কুলে একসাথে পড়তাম। মাধ্যমিকে ফেল করার পরই হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।
হ্যাঁ, এতদিন বাইরেই ছিল। বছরে একবার করে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি আসত, আবার বাইরে। আসলে মাধ্যমিকে ব্যাক পাওয়াটা জয়ন্ত ঠিক মেনে নিতে পারে নি। তাই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে হাতের কাজ শিখে কিছু উপায়ের আশায় বাইরে যাওয়া। এতদিনে সেসব ইতিহাস হয়ে গেছে। আজকে জয়ন্ত একটা কোম্পানির মালিক। সেখানে অনেক লোক কাজ করে। সবাই যে উচ্চশিক্ষিত তাও নয়। কিন্তু হঠাৎ এতদিন পরে জয়ন্ত এখানে!
জয়ন্তই জানায়, কয়েকদিন হলো বাড়িতে ফিরে এসেছে। বিশ্বস্ত লোকজন আছে, তারাই কোম্পানি চালায়। এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে ঠিক করেছে। সেই মতো এখানকার পুরানো বাড়িটা রিপেয়ার করিয়েছে। এখন বাজারের দিকে যাচ্ছিল, আমার সাথে দেখা হওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। জয়ন্তর সাথে কথা বলতে বলতেই বাজারে পৌঁছে যাই। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটার পর, জয়ন্তকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ফিরি। স্নান সেরে এখনই আবার বেরোতে হবে। অফিসের তাড়া আছে। কালকেই মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সব শেষে কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে, জানা যাচ্ছিল না।
আসলে গতকালই বোর্ডের মিটিংয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের আমাদের অফিসের শাখার কথা জানতে পারি। একেবারে জঙ্গল লাগোয়া জায়গা। এখনো অফিসের সবকিছু রেডি হয়নি। তাই আমাদের অফিস থেকে কোন একজনকে সেখানে যেতে হবে। আর আজকে ডিরেক্টর স্যার আমাকে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেন। যত তাড়াতাড়ি পারবো আমি যেন প্রস্তুত হয়ে নিই। ওখানে কতদিন থাকতে হবে, তা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। তবে দু-তিন মাসের কম যে নয়, তা জোড় দিয়েই বলা যায়।
জায়গাটা পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল থানার মধ্যে পড়ে। একেবারে অজ পাড়া গাঁ বলতে যা বোঝায়, এটাও তাই। বোর্ডে কিভাবে যে পাস হলো, কে জানে! আমার সাথে অফিস থেকে আর কেউ যাবে না। আমাকেই সব কিছু সামলাতে হবে। শুধু আমাকে সাহায্য করার জন্য ওখানে নিযুক্ত সুপারভাইজার থাকবে। তার নাম রাকেশ। সে ওখানে অফিস বিল্ডিং তৈরির সময় থেকে আছে।
অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ি। বাড়ি পৌঁছে সবকিছু গোছ গাছ করে, দুপুরে পশ্চিম মেদিনীপুরে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করব ঠিক করে, একটু ঘুরতে বের হই। এটা ছোটবেলার অভ্যাস। ফাঁকা সময় পেলেই প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো। এতে মন অনেক ভালো থাকে। কত চেনা অচেনা ফুল, নিজের মতো করে সৌন্দর্য দেখিয়ে যায়! তোমার দেখার পরোয়া করে না। শুধুমাত্র দেখিয়েই তারা খুশি।
কত ধরনের যে পতঙ্গ আছে, তাদের সবার নামই জানি না! কিন্তু তারা ফুলের মধু খেয়ে যায়। বাগানে তখন একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুলে ছেয়ে গেছে। কি সুন্দর তাদের রং! লাল হলুদে পুরো গাছটাই রঙিন হয়ে রয়েছে। গাছটার গোড়ায় একটা সিমেন্টের চেয়ার করা আছে। তাতে বসি।
এখানে বসে বসে কতটা সময় কেটেছে ঠিক বলতে পারব না। হয়তো বা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো বা কোন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোর কাটল মায়ের ফোনে।
দুপুরে বেরোবি বললি। কটা বাজছে, কোন হুঁশ আছে?
হ্যাঁ, এই যাচ্চি মা।
তাড়াতাড়ি আয়।
আমিও উঠে পড়ি। একটু দূরে তখন একটা কুকুর গোল হয়ে শুয়ে রয়েছে। তার মুখটাকে নিজের শরীরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে যেন! আমি উঠে দাঁড়াতে, কুকুরটা একটা কানকে একটু নাড়িয়ে সোজা করে শুধু! তারপর মাথাটা তুলে সামনের পা দুটোকে সামনে আর পিছনের পা দুটোকে পিছনে বাড়িয়ে শরীরটাকে টানটান করে নেয়। আমিও আর দেরি না করে, বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই।
মা বলে, একে বারে একা না বেড়িয়ে, মলয়কে তোর সঙ্গে নিতে পারতিস তো?
মলয় আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। আমি বাইরে কোথাও গেলে, আমার সাথেই থাকে। কিন্তু, সেসব তো দু চার দিনের জন্য যাওয়া। এখানে কত দিন যে থাকতে হবে, তা আমি নিজেই জানি না। দু চার মাস তো বটেই, বছর খানেকও লাগতে পারে! পরের গাড়ি চালায় বলে, এতদিন বাড়ির বাইরে থাকবে কেন!
তবু বলে তো একবার দেখতে পারতিস, তাছাড়া তোর সাথে গাড়িতো থাকছেই, সঙ্গে ড্রাইভার নিয়ে গেলেই বা অসুবিধা কোথায়?
তা ঠিক।
তাহলে একবার ফোন করেই দেখ না।
মায়ের কথা শুনে আমিও মলয়কে ফোন করি।
মলয় যেন রেডি হয়েই ছিল। আমার ফোন পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাড়িতে হাজির। সঙ্গে একটা বিশাল আকারের ব্যাগ। বলে জেঠিমা আমাকে কালকেই বলে রেখেছিল, তাই সবকিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছিলাম। ব্যাগটা একটু বড় হয়ে গেছে।
এত বড় ব্যাগে কি নিয়েছিস?
বেশি কিছু না। আমার কয়েক সেট জামা প্যান্ট, লুঙ্গি-গামছা, বেডশীট, কিছু শুকনো খাবার, কয়েকটা খালি জলের বোতল, একটা স্টোভ, আর খানিকটা কেরোসিন তেল।
এসব কি হবে?
দাদা ওখানে যদি কিছু না পাওয়া যায়!
তোকে নিয়ে আর পারা যাবে না দেখছি!
খাওয়া-দাওয়ার পর স্করপিওটা নিয়ে বেড়িয়ে পরি। খানিকটা গিয়েই আমাদের গাড়ি জাতীয় সড়কে পড়ে। এই রাস্তায় আমাদের গাড়ি হু হু করে এগিয়ে চলে। সামনে থেকে পড়ন্ত রোদ চোখে লাগে। তার মানে আমরা এখন সোজা পশ্চিম দিকে চলে এসেছি।
খড়গপুর পার হওয়ার পর থেকে আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করে। কিছুটা এগিয়ে জাতীয় সড়ক ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকি। তখন সারা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। বাতাসের গরম ভাব কেটে গিয়ে ঠান্ডা আমেজ নিয়ে এসেছে। মলয় বলে, কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে মনে হয়।
হবে হয় তো।
রাস্তার পাশে একটু দাঁড়াবো নাকি?
এখুনি বৃষ্টি নামবে।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে তো আর গাড়ি থেকে নামা যাবে না, তার চেয়ে বরং একটু হাঁটা হাঁটি করে নাও, অনেকটা সময় একভাবে গাড়িতে বসে আছো তো।
একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি থামা তাহলে।
সেই মতো রাস্তার পাশে একটা জায়গায় গাড়ি থামায়। নেমে পড়ি। দূরে মাথায় শুকনো কাঠের বোঝা নিয়ে, দু তিনটে গরুকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে একজন। পরনে, একটি ময়লা ধুতি। কোন এক সময় ধুতিটা যে সাদা ছিল, এইটুকুই বোঝা যায়! খালি গা, কোমরে একটা গামছা বাঁধা রয়েছে। দূর থেকে হলেও এসব গ্রামের দৃশ্য আমার খুব ভালো লাগে।
মলয় গাড়ি থেকে নেমে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার পর ,একটা বিড়ি ধরায়। গাড়ি চালাতে চালাতে ও কিন্তু ধূমপান করে না। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আবার গাড়িতে উঠি। একটু একটু করে হাওয়ার বেগ বাড়তে শুরু করেছে। ঝড় হলেই মুশকিল। গাছপালা ভেঙে রাস্তার ওপর পড়ে থাকে। পরিষ্কার না করা পর্যন্ত যাওয়া যায় না।
এদিকে বেশিরভাগ রাস্তা পার করে এলেও এখনো অনেকটা পথ বাকি আছে। আর গ্রামের এই রাস্তায় জোড়ে যাওয়াও যায় না। তাই সময়ও বেশি লাগে। তার উপরে এই রাস্তায় এই প্রথমবার যাওয়া। এই পথ ধরে ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পর, সাঁকরাইল থানার এরিয়া শুরু হয়। এই রাস্তা যেখানে শেষ হবে সেটাই রোহিণী বাস স্ট্যান্ড।
সেখানেই আমার সাথে রাকেশের দেখা করার কথা। রাকেশ আমার থাকার ব্যবস্থা করে রাখবে। পরদিন আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবে। তারপর থেকে শুরু হবে আমার কাজ।
মলয় যখন গাড়ি স্টার্ট দেয়, হাওয়ার বেগ তখন অনেকটাই বেড়ে গেছে। আর দক্ষিণ দিকে বেশ বিদ্যুতের চমক শুরু হয়েছে। আর আমরাও এখন ক্রমশ দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছি। আকাশে মেঘের জন্য সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে আছে।
ঝড় বৃষ্টির আগের মুহূর্তের মেঘের এই সাদাকালো ছবি, দিগন্ত রেখার সাথে মিলে একটা কঠিন সৌন্দর্য তুলে ধরে। যা প্রকৃতিকে ভালো লাগার কারনে আমার চোখকে আনন্দ দিয়ে যায়। দিগন্তরেখার নিচের কালো অংশ আর পৃথিবীর সুউচ্চ গাছপালাগুলো যেন মেঘের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইছে! আর কালো মেঘের মধ্যে, তুলনায় কম কালো মেঘ যে আবছা সাদা অংশ তৈরী করে, তা সব সময় আমাদের মনে ভয় ও সৌন্দর্য একসাথে তুলে ধরে।
সামনে কাচের উপর ছোট ছোট বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করেছে। আমাদের গাড়ির পিছনের সব কাচ গুলো তুলে দেওয়া আছে কিনা জিজ্ঞাসা করি। একটাই অথচ আঁকাবাঁকা পথে আমাদের গাড়িটা এগিয়ে চলেছে। চার পাঁচ কিলোমিটার ছাড়া ছাড়া একটা করে বসতি এলাকা রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে।
হয়তো বা আগে থেকেই বসতি গুলো ছিল! রাস্তা, পরে তৈরী হয়েছে! কোনটা যে সঠিক তথ্য, তা এই ধরনের গ্রাম্য পরিবেশে বড়ই বেমানান। যাই হোক, বসতি এলাকা গুলিতে রাস্তার দু'পাশে কয়েকটা করে ছোট ছোট দোকানপাটও রয়েছে। একটা জায়গায় দোকানপাট ও ঘর তৈরীতে তালপাতার আধিক্য চোখে লাগার মতো।
কিছুটা এগিয়ে আবার বাঁশের চাঁচের ঘর। এবং প্রায় সব বসতিটাই মাটির ঘর, না হয় চাঁচের ঘর। তার গায়ে কালো রং করা! মাথায় খড়ের চাল। আর সামনে একটা ফাঁকা বারান্দা। মাঝে কয়েকটা বাঁশের খুঁটি।
এখন আর রাস্তার পাশের একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। একেই অন্ধকার, তার উপর বৃষ্টি, চারিদিক একেবারে ঝাপসা করে দিয়েছে। পিচের রাস্তা, না শুধু পাথর দিয়ে তৈরী, বোঝা দায়! রাস্তার উপর জলের জন্য গাড্ডা গুলোকেও ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। যদিও এই ধরনের রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য মলয় বেশ দক্ষ। তাই গাড়ির ভিতরে খুব যে অসুবিধা হচ্ছে, তাও নয়।
চলতে চলতে এক সময় রোহিনী বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হই। এটি একটি বড় জনপদ। এখানে দোকানপাটও অনেক। কিন্তু, বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ দেখছি! ঝড় বৃষ্টির জন্য বোধ হয় বন্ধ করে দিয়েছে। বাসস্ট্যান্ডের একদিকে কয়েকটা ছোট ছোট রেস্তোরাঁ। সেগুলোর বেশির ভাগটাই মদ বিক্রির উপর ভিত্তি করে তৈরি।
খুব সহজেই রাকেশকে পাওয়া গেল। একটা বর্ষাতি পড়ে, বাইক নিয়ে রেডি হয়েই ছিল। আমাদের গাড়িটাকে দেখেই এগিয়ে আসে। এখনো বেশ জোড়েই বৃষ্টি পড়ছে। মলয় গাড়ির জানালার কাচ নামানোর সাথে সাথে নিজের পরিচয় দিয়ে তার সাথে আসতে বলে। রোহিনী বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখেই মিলিটারি ক্যাম্প।
ক্যাম্পের সামনে একবার দাঁড়াতে বলে, যে মিলিটারি অফিসার ক্যাম্পে ছিল, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যে কোনরকম বিপদে যাতে তাড়াতাড়ি সাহায্য পাওয়া যায়, তাই এই ব্যবস্থা। এরপর রাকেশ বাইক নিয়ে এগিয়ে চলে, আমরা তার পিছনে চলি।
প্যাচপ্যাচে লাল মাটির রাস্তা। রাস্তার দু'পাশে কোথাও মাঠ, কোথায় বাড়ি, কোথাও বাগান, সবই গ্রাম্য। রাস্তাটি বড় বেশি এঁকেবেঁকে চলেছে যেন। একটা জায়গায় এসে রাস্তাটি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমরা বাঁদিকের পথ ধরে আরো কিছুটা যাওয়ার পর, একটা ছোট ফাঁকা জায়গা। গাড়িটাকে রাখতে বলে। বৃষ্টি ততক্ষণে অনেক কমে এসেছে। যে বাড়িটার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা একটা মাটির দোতলা বাড়ি। উপরে নিচে দুই পাশে মিলিয়ে ঘরের সংখ্যা অনেকগুলোই। তবে বেশিরভাগই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। নিচে সামনের বাঁ দিকের একটা ঘরে লোক থাকে। ওরাই এই বাড়ির সব কাজ করে।
নিচে ডান দিকের একটা ঘরে আমি থাকতে পারবো। দোতলায় ডানদিকের আর একটা ঘরে মলয় থাকবে। আমাদের জন্য আজকে রাতে ভাত আর মুরগির মাংস আয়োজন করেছে। খাওয়ার পর যে যার রুমে।
গ্রামাঞ্চলে বড় তাড়াতাড়ি রাত্রি হয়ে যায়। আমাদের পৌঁছে দিয়ে রাকেশ বিদায় নিয়েছে। কাল সকালেই চলে আসবে। এখান থেকে ওর বাড়ি কিলোমিটার পাঁচেক দূরে। এখানে থাকার সময় কোন কিছু প্রয়োজন হলে যেন মোহনদাকে জানাই। মোহনদা আর ওর বোন, বোনের ছেলে মেয়ে, সবাই এই বাড়িতেই থাকে।
রাত্রি তখন বোধ হয় ন'টা মত হবে। সবাই যেন ঘুমে আচ্ছন্ন। একি রে বাবা! এখানে সময় কাটাবো কিভাবে! দিনের বেলায় কাজ থাকবে, কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই যে এখানে গভীর রাত!
আমি এক বার ঘর থেকে বাইরে বের হই। বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চারিদিকে জোছনায় ভরে আছে। স্করপিওটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হালকা ঠান্ডা হওয়া, শরীরে একটা শিরশিরানি ভাব নিয়ে আসে।
কবে এলে?
প্রশ্নটা শুনে পিছনের দিকে ঘুরে তাকাই। না, চেনা বলে তো মনে করতে পারছি না। সাদা কাপড় পড়ে কে আমাকে প্রশ্নটা করলো, বুঝতে না পেরে বলি, চিনতে পারলাম না তো!
আমি এখানেই থাকি, এখানকার একটা ছোট্ট স্কুলে পড়াই। দিনের বেলা স্কুলে সময় কেটে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে একেবারে একা! তাই একা একাই ঘুরে বেড়াই। নতুন কেউ এলে, তার সাথে আলাপ করি।
এখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা না বলে, চলুন না আলোতে বসে গল্প করা যাবে।
আজ দুপুর থেকে যা ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আজকে আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না। নতুন এসেছেন তো, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবেন। তার চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলি, তারপর চলে যাব।
যা ভালো মনে করেন।
আমি যে অফিসের কাজে এখানে এসেছি, প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না। কোন কোম্পানি এইরকম অজ পাড়া গাঁয়ে অফিস খুলতেই পারে না, এটাই অপর্ণাদির ধারণা। অপর্ণাদি বললাম, কারণ এই রকম গ্রামাঞ্চলে এটাই সবচেয়ে সহজ সম্বোধন।
এতক্ষণ অপর্নাদির সাথে কথা বলে চলেছি, কিন্তু এখনো উনি দেখতে কেমন, বা বয়স কত, বোঝার মত জায়গায় যায় নি। ওনার সম্পর্কে যে আমার খুব আগ্রহ আছে, তেমন কিছুও না। তবু এই রকম পরিবেশে যেখানে কথা বলার জন্য কোন লোক পাওয়া যায় না, সেখানে আগ্রহ না দেখানোর মত কোন কারনও পাই না।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর অপর্ণাদি কালকে সন্ধ্যার পর আবার আসবে জানিয়ে বিদায় নেয়। আমিও শুধু পাশ ফিরেছি। এই রে, বাড়িটা কোথায় জানা হলো না তো। সাথে সাথে ঘুরেও দেখতে পাই না। যেন একেবারে হাওয়ায় মিশে গেছে! যাইহোক কালকে সন্ধ্যার পর তো আবার আসবে, তখন জেনে নেয়া যাবে। আমিও ঘরে ঢুকে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ফ্রেশ হওয়ার আগেই দেখি টিফিন রেডি হয়ে গেছে। গরম গরম লুচি, আলুর তরকারি, বেগুন ভাজা, চা খেয়ে রাকেশের সাথে বেড়িয়ে পড়ি। সারাদিন সাইটে ঘোরাঘুরি করে, অপর্ণাদির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। দুপুরে আবারও সেই বিশাল বাড়িতে রাকেশ আমাকে ছেড়ে দিয়ে যায়। দরকারে ফোন করলেই চলে আসবে, জানায়।
গতকাল রাতে বুঝতে পারেনি, বাড়িটার সামনে ফাঁকা মাঠ, যেখানে আমাদের গাড়িটা রাখা আছে। পিছনের দিকে পুকুর, ডান দিকে বাঁশ বাগান, আর বাঁদিকে আম কাঁঠালের বাগান। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই বাগানে কাটিয়ে দিই। আমার এখানে বেশ ভালই লাগে।
সন্ধ্যার পরই মোহনদা ডাকাডাকি করে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়তে বলেন। আর বারবার বারণ করে দেয়, সন্ধ্যার পরে আমবাগানের দিকে যেন না যাই। কারণ জিজ্ঞাসা করলেও এড়িয়ে যায়।
কি আর করা যায়! গ্রামাঞ্চলে এদের বিশ্বাসকে তো আর ছোট করা যায় না। এখানে আমার মানা, না মানার কোনো প্রশ্নই নেই। তারচেয়ে খেয়ে নিয়ে ঘরে ঘুমানো অনেক ভালো। এমনটাই মোহনদার মত। এখানের খাওয়ার সময়টাকে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে।
খাওয়ার পর আজও আবার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াই। সামনের লালমাটির রাস্তাটাই আম বাগানের পাশ দিয়ে চলে গেছে। কালকে মনে হয় অপর্নাদি ওই দিক থেকে এসে ছিল। আজকের চাঁদের আলো কালকের চেয়ে অনেক বেশি। চাঁদের আলোতেই চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।
এসে গেছি, অপর্ণাদির গলা।
সত্যিই এখন অদ্ভুত লাগলো। কোন দিক থেকে এলো, বুঝতেই পারলাম না। মনে হলো, আমার পিছনের দিক থেকে এলো। তাহলে তো আমবাগানের দিক! তবে যে মোহনদা আমাকে আম বাগানের দিকে যেতে বারন করল!
আচ্ছা, অপর্ণাদি, কতদিন এখানে আছো?
সে অনেক বছর হবে। হোমে মানুষ হয়েছি, বাবা-মা কাউকে চিনতাম না। এখানে যে স্কুলে পড়াতে শুরু করি তার বাচ্চাদের এত ভালো লেগে গেল যে আর অন্য কোথাও যেতে পারেনি। সেই থেকেই এখানে রয়ে গেছি।
এটা ওটা নানা কথাবার্তায় সময় কেটে যায়। অনেক রাতে আমাকে বিদায় জানিয়ে অপর্ণাদি বাড়ি চলে যায়। আমিও ঘরে ঢুকে ঘুমানোর চেষ্টা করি।
পরদিন রবিবার। ছুটি। সারাদিন শুধু গ্রাম ঘুরে দেখব। সেই মত আমি আর রাকেশ বাইকে করে ঘুরছি। বাইকে যেতে যেতেই রাকেশ সবকিছু বলে দেখিয়ে চেনানোর চেষ্টা করে।
একটা ভাঙা ইটের বাড়ি। চারিদিকে গাছপালা গজিয়ে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, রাকেশকে এই বাড়িটা কোথা থেকে এলো জিজ্ঞাসা করি।
একসময় এইটাই আমাদের গ্রামের একমাত্র স্কুল ছিল। একজন সিস্টার এখানে আসেন। তারপর এই স্কুলটা ছোট থেকে অনেক বড় হতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে, জমিদারবাড়ি থেকে স্কুলে খরচের টাকা আসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পরেও ওই সিস্টারদিদি নিজের চেষ্টায় নিজের সবকিছু দিয়ে স্কুল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তাহলে এমন দশা হলো কি করে?
আসলে হয়তো এমন কেউ ছিল, যিনি চাননি, স্কুলটা চলুক।
সিস্টার দিদি তো প্রশাসনের সাহায্য নিতে পারতেন।
নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেই তো তিনি খুন হয়ে যান। ডাক্তারি রিপোর্ট অবশ্য অন্য কথা বলে। ডাক্তারি রিপোর্টে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে লেখা থাকলেও এখানকার কেউ তা মানে না। সবাই জানে, এখানকার জমিদার মানিক ঘোষই রয়েছে সিস্টার দিদির হত্যার পিছনে। সন্ধ্যার পর এখনো অনেকেই এখানে সিস্টার দিদিকে দেখতে পান।
রাকেশ, তুমি দেখেছো।
না, আমি কোনদিন দেখিনি। আর আমাকে কেনই বা দেখা দেবেন! এমনিতে ভূত-প্রেত আমি খুব একটা মানি না। সবাই বলে, শুনেছি, এই পর্যন্তই।
আচ্ছা, এই সিস্টার দিদির নাম কি ছিল?
সিস্টারদিদির নাম ছিল অপর্ণা ডি'সুজা। এখানকার সবাই অপর্ণাদি বলেই ডাকতো।
আর কোথাও ঘুরতে ইচ্ছা করে না। শরীরটা কেমন যেন অবশ অবশ লাগে। তাই রাকেশকে বলে বাড়ি চলে আসি। সারাটা দিন শুধু চিন্তা করে সময় কাটাই। গত দুদিন রাতে যার সাথে দেখা হয়েছে, সেই অপর্ণাদিই অপর্ণা ডি'সুজা নন তো!
এও কি করে সম্ভব! কোনো দিক থেকে হিসাব মেলাতে পারিনা। শুধু সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকি। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। আম বাগানে এসে বসি। আজও আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। আজও ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।
এক সময় সন্ধ্যা নামে। মেঘ জমলেও আজ আর ঝড় বৃষ্টি হয়নি। আজ সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়ির সামনে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করতে থাকি। আজকে সমস্যার সমাধান করতেই হবে। এমন সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়। মোহনদা বাইরে থাকতে মানা করে। বারবার নানা অছিলায় ঘরের ভিতরে ডেকে নিতে চায়। আমিও কোন না কোন কারন দেখিয়ে বাইরে অপেক্ষা করি।
একসময় মোহনদা, জোড় করে আমাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসে। এরপর সবাই যখন খেতে বসেছি, আম বাগান থেকে একটা চিৎকার শুনতে পাই। মোহনদা জানায়, এই জন্যই তো সন্ধ্যার পর আম বাগানে যেতে নিষেধ করেছিলাম।
কিন্তু এ কিসের আওয়াজ?
আসলে আজকে দোসরা জুন, এই তারিখেই আমবাগানে সিস্টারদিদি খুন হন। তারপর থেকেই এমন হয়।
খাবার রইল পড়ে, আমি ছুটে আমবাগানের দিকে যাই। সেখান থেকে এখনো সেই চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, এটা তো অপর্ণাদিরই গলা! আমিও অপর্ণাদি, অপর্ণাদি, বলে চিৎকার করতে করতে ছুটিতে থাকি।
আমার কথা ইকো হয়ে বারেবারে ঘুরে আসে। অপর্ণাদিকে আর খুঁজে পাই না। আমার পিছু পিছু মলয় আর মোহনদাও আমবাগানে আসে। তারাই আমাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন জ্বরে বেহুশ ছিলাম। তাদের সেবাতেই সুস্থ হয়ে উঠি। তবে রোহিনীর কাজ আর আমার শেষ করা সম্ভব হয়নি। বাড়ি ফিরে আসতে হয়। আর অপর্ণাদিও আমার কাছে অধরা থেকে যায়!