Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

পেইন্টার - পর্ব 1

–“ নেন তিনশো টাকা হইসে। ”
–“ পেইন্টিং আমার পছন্দ হয়নি। রেখে দাও ওটা। ”
–“ কিন্তু আপনার জন্যিই তো আঁকলাম। টাকাটা দেন। ”
–“ বললাম তো পছন্দ হয়নি। যতসব! ”

বলেই লোকটা বেরিয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নিমাইবাবু। অপ্রত্যাশিত এক ঝটকা লেগেছে তার।

শ্যামবাজার মোড়ে পেতলের দোকানের সামনে বসে নিমাই। পাড়ার লোকে ওকে নিমাইদা বলেই ডাকে। ওর আঁকার হাত এত সুন্দর যে, কোনটা আঁকা আর কোনটা আসল – মানুষ হামেশাই গুলিয়ে ফেলে। সরঞ্জাম বেশি কিছু না। কয়েকটা প্যালেট, জল রং, ব্রাশ, কালার ডাস্ট আর ক্যানভাস। এই কটা জিনিস দিয়েই সে এমন এমন পেইন্টিং তৈরি করে, যে দেখলেই তাক লেগে যায়। কারোর পকেটে বেশি পয়সা থাকলে সেও নিমাইয়ের থেকে পেইন্টিং বানিয়ে নিয়ে যায়।

তবে নিমাইয়ের অবস্থা যে খুব ভালো তা কিন্তু নয়। গত বছর তার বাবা গত হয়েছে আর গত মাসে তার মা। আপনজন বলতে দুই কূলে কেউ ছিল না। কুড়ি বছরের বেকার নিমাই তাই রাস্তায় বসে পেইন্টিং বানায়। পেট তো চালাতে হবে…

ছোটো থেকেই নিমাই আঁকতে খুব ভালোবাসে। স্কুলে তারই বানানো পোট্রেট টাঙিয়ে রাখতো টিচাররা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলতো ওকে। কিন্তু নিমাইয়ের বাবা এইসব বিষয়ে তার সময় নষ্ট করাতে চাইতো না। এইসবে টাকা কোথায়? আর টাকা ছাড়া সংসার চলবে কীকরে? কিন্তু ছোটো নিমাই আঁকা ছাড়তে চায় না। বাবার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হারিয়ে যেত সে রং তুলির দুনিয়ায়। না পেরে ওর বাবা একদিন ক্যানভাস বোর্ড ভেঙে দিয়েছিল। রংগুলো মিশিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। নিমাই খুব কষ্ট পেয়েছিল সেইদিন।

তাদের অবস্থা এমনিতেও ভালো ছিল না। উপরন্তু হার্টের ব্যামো ছিল তার বাবার। এই পরিস্থিতিতে “ সবার আগে ছেলেটার একটা চাকরি পাওয়া দরকার ” বলে মনে করত তার বাবা। নইলে তার অবর্তমানে ছেলেটা সংসারের হাল ধরবে কীকরে?

বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের থেকে বায়না করে আঁকার সরঞ্জাম কিনে আনে নিমাই। উচ্চমাধ্যমিকে টেনেটুনে পাশ করা ছেলেকে কে কাজ দেবে? বাবার মতন রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয় সে। কিন্তু বাপ মরার পর সেখান থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। নিমাইয়ের কাছে উপায় ছিল না রাস্তায় বসা ছাড়া। বাবা তো কিছু রেখে যায়নি তাদের জন্য। সব টাকা মদে উড়িয়েছে। তাই নিমাই বাধ্য হয়ে শ্যামবাজার মোড়ে তার ট্যালেন্ট বেঁচতে বসে।

প্রথম প্রথম নিমাই কুড়ি টাকায় ফিগার আর পঞ্চাশ টাকায় মানুষের পোট্রেট বানাতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বাজার বুঝে দাম বাড়ায়। আশি টাকায় ফিগার আর দুশো টাকায় নরমাল পোট্রেট। ফলে আগের তুলনায় কাস্টমার একটু কমে যায় বটে, তবে তাতে ওর ইনকামে প্রভাব পড়ে না।

এমনভাবে এক বছর চালানোর পর ওর একটু নাম হয়। লোকজনের অর্ডার বাড়তে থাকে। পথচলতি যাত্রীরা অত সুন্দর পেইন্টিং দেখে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ আবার নিজের, নিজের বউয়ের পোট্রেট আঁকিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। নিমাই আবার বয়স্কদের একটু ছাড় দিতো। ফলে ওরা কখনো কখনো একটার বদলে দুটো ছবি আঁকতে দিতো। এই করে নিমাইয়ের আঁকার ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন তার দেখা হয় বাদামী কোটওয়ালা একটা জাঁদরেল লোকের সাথে।

সাধারণই একটা দিন ছিল। সকাল থেকে দুটো পোট্রেট অলরেডি এঁকে ফেলেছিল সে। রোদ্দুরের মধ্যে তরতর করে ঘামছিল নিমাই। জলের বোতলটা খুলে জল খেতেই যাবে, অমনি এক বাদামী রঙের কোট পড়া ভদ্রলোক নিমাইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে নিমাইয়ের মনে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। লোকটার গলায় সোনার চেন, হাতে সোনার ব্রেসলেট, ব্র্যান্ডেড টুপি।
~“ আজ একটা বড়সড় হাত মারা যাবে। পাঁচশোর কমে তো বেঁচবই না। ” ভেবে মনে মনে খুশি হয় সে।

–“ নমস্কার স্যার, বলুন কেমন পেইন্টিং চাই? সেলফ পোট্রেট নাকি ওয়াল হাঙ্গিং? ”
–“ যেমন চাইবো তেমন আঁকতে পারবে তো? ”
–“ আপনি এক্কেরে বলেই দেখুন না, এই নিমাইদার আঁকার উপরে কোনো কথা হবে না। হেহে। ”
–“ তাহলে বেশ, আঁকো দেখি… ”

নিমাই লোকটাকে বসিয়ে লোকটার থেকে ছবিটার ব্যাপারে ছোটো থেকে ছোটো ডিটেইলস শুনে নেয়। তারপর পুরো মনোযোগ দিয়ে আঁকতে শুরু করে। খুব একটা সহজ আঁকা দেননি তিনি। অবিরাম দেড় ঘণ্টা ওই একটা পেইন্টিংয়ে লাগানোর পর অবশেষে সে কমপ্লিট করে। নিঃসন্দেহে এই পেইন্টিংটা ছিল এখনও অবধি তার বেস্ট পিস। রঙের এত সূক্ষ কাজ রয়েছে ওতে, যে একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। নিমাই একটা ছবি তোলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না। তারপরে সেই বাদামী কোটওয়ালা লোকটাকে পেইন্টিংটা দেখিয়ে নিমাই বলে,
–“ কিরাম হইসে? বলেলাম না কোনো কথা হবে না। আপনার হইসে সাতশো টাকা। ”

লোকটা বিরক্তিসুচক দৃষ্টিতে নিমাইয়ের দিকে তাকায় আর বলে,
–“ কি বিচ্ছিরি লাগছে! এর দাম সাতশো টাকা? ”

নিমাই আশ্চর্য হয়ে যায়। আজ অবধি কেউ তার আঁকায় অসন্তুষ্ট হয়নি। হ্যাঁ দরদাম করেছে সবাই কিন্তু অবজেকশন তো করেনি। সে দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
–“ আপনার পসন্দ হয়নি? আমি ভালো করেই তো আঁকলাম। আচ্ছা আপনি ছশো দিয়েন। ”
–“ একদম না। এই ড্রয়িংয়ে ছশো টাকা ইনভেস্ট করা স্রেফ বোকামো। ”
–“ সাড়ে পাঁচশো, লাস্ট প্রাইজ। ”
–“ আমি কিনবো না। ”
–“ কিনবেন না মানে? এত খারাপও হয়নি। যে কেউ হাজার টাকায় কিনবে। আপনি বলুন কত দেবেন? ”
--“ আমার ভালো লাগেনি তাই কিনবো না। তুমি রেখে দাও তোমার আঁকা। ”

এরকম সমস্যা নিমাই আগে কোনদিনও ফেস করেনি। পেইন্টিং অপছন্দ হওয়া তো দূরের কথা, বরং টিপস পেয়েছে সে। এমনটা কোনবারই হয়নি যে কাস্টমার ছবি আঁকার অর্ডার দিয়ে কেনেননি।

–“ স্যার আপনি তো অর্ডার দিয়েছেন। আপনাকে কিনতেই হবে। আপনি বলুন কত দেবেন। ”
–“ আমি এক পয়সাও দেব না। ”
–“ নেন তিনশো টাকা হইসে। এবার আর মানা করবেন না। আপনার জন্য স্পেশালি ছশো টাকার জিনিস তিনশো টাকাই দিচ্ছি। ”
–“ বললাম তো পেইন্টিং আমার পছন্দ হয়নি। রেখে দাও ওটা। ”
–“ আপনের জন্যিই তো বানালাম সাহেব। আপনি যা দেবেন দিয়েন, কিন্তু পেইন্টিংটা কিনুন। ”

লোকটা আর কথা বাড়ায় না। গট গট করে হেঁটে চলে যায় সামনে। নিমাই জিনিসপত্র গুছিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত লোকটার পেছনে দৌঁড়ায়। সে পাক্কা দেড় ঘণ্টা দিয়েছে ছবিটা আঁকার জন্য। মনে মনে খুব খারাপ লাগছিল ওর। কিন্তু লোকটাকে সে খুঁজে পায় না। কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছিল লোকটা।

#ক্রমশ প্রকাশ্য…

#গল্প: পেইন্টার
#পর্বঃ১

কলমে: সায়নী পাল…