Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা কাহিনী সিরিজ - 1

হোস্টেলে হত্যা

পর্ব - ১


মেরিন ড্রাইভের কাছেই একটা আরামপ্রদ হোটেলের সাত তলার সুইটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের লীলাখেলা দেখার ফুরসতে কত বিশ তিরিশ ভাবছিলো মন্দিরা। শীত পড়ব পড়ব এমন ঋতুতে আরব সাগর যতটা শান্ত থাকবে ভাবা গিয়েছিলো তেমনটি নয়। বরং ঢেউ গুলো মস্ত ফনা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো বালুকাবেলায়। হয়তো এটা ভাটার সময়। তাই বিদায় নিতে না চাওয়া জলের এমন দৌড়াত্মপনা। তবে এমন অশান্ত না হলে সমুদ্রকে মানায় না।

জানলা দিয়ে কি যেন দেখে মন্দিরা লাফিয়ে উঠলো উচ্ছাসে, দেখে যাও, কি সুন্দর জাহাজ একটা, মনে হচ্ছে একটা বিশাল ঈগল উড়ে এসে বসলো সমুদ্রের উপর।

সুমিত যথারীতি ব্যাস্ত তার কাজে। মুম্বাইতে অবশ্য বেড়াতে আসেনি সুমিত, ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে এসেছে। কাজটা উপলক্ষ, উদ্দেশ্য মন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে দু তিনদিন নির্ভেজাল বেড়ানো। সেই ছোট্ট কাজটির গভীরে ডুব দিয়েছে ভোরে উঠেই, এখন মন্দিরার ডাকাডাকিতে তার সাড় ভাঙে, ঘাড় তুলে বললো, এখনো জাহাজ দেখার বয়েস আছে?

- বাহ্, জাহাজটা কি সুন্দর ! জানালায় এসে দেখলে তবেই বুঝবে বয়েস আছে কি না ! যে কোনো সুন্দর জিনিস যে কোনো বয়েসে দেখা যায়।

মন্দিরার তৃতীয়বার ডাকে আর সাড়া না দিয়ে পারলো না সুমিত, তার হাতের গুচ্ছের কাগজ সেন্টার টেবিলে উপুড় করে রেখে এসে দাঁড়ালো জানলায় চোখ রেখে, জাহাজটা কিছুক্ষন অপলক দেখে বললো, নাহ্, আমার বউটা বেশ রোমান্টিক তাতে সন্দেহ নেই।

মন্দিরা হাসি হাসি মুখে বললো, কাল তুমি তো কমলা নেহেরু পার্কে যেতেই চাইছিলে না ! অথচ গিয়ে বুজতে পারলে মেরিন ড্রাইভ এমনিতেই সুন্দর, কিন্তু মালাবার হিলসের উপর কমলা নেহেরু পার্ক যেমন সুন্দর, সেখান থেকে মেরিন ড্রাইভ আরো কি চমৎকার দেখায় !

সত্যিই মুম্বাইয়ের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ এই মেরিন ড্রাইভ। আরব সাগরের কিনারে এখানে একেবারে তৃতীয়ার চাঁদের মতো আশ্চর্যভাবে বাঁকানো। কিনারে রাতের বেলা সার সার আলো থাকায় মেরিন ড্রাইভকে দেখায় যেন লতিয়ে পড়ে আছে একটা দীর্ঘ সোনার বিছেহার। মালাবার হিলসে উঠে দেখলে সেই সৌন্দর্য আরো বহুগুন। মুম্বাইবাসী তাই মেরিন ড্রাইভকে আদর করে নাম দিয়েছে কুইন্স নেকলেস।

সেই কুইন্স নেকলেস দেখে সুমিতের মতো কেজো মানুষও কাল বলেছিলো, চমৎকার !

রথদর্শন ও কলাবিক্রয় এমন রৌপসুযোগ পেয়ে সুমিত বেশ খুসমেজাজে আছে সান্তাক্রজ বিমানবন্দরে নামা ইস্তক। মন্দিরার রোমান্টিকতার সঙ্গে চেষ্টা করছে তাল মেলানোর। মন্দিরা তাতে বেশ উল্লসিত বোধ করছে, কারণে অকারণে হাসছেও বারবার।

সুমিতের সঙ্গে হটাৎ মুম্বাই উড়ে আসাটা মন্দিরার কাছে একেবারেই অভাবনীয়। কলকাতার ব্যস্তসমস্ত জীবনে অবসর বলতে কি বোঝায় তা মন্দিরারা ভুলতেই বসেছে। রোজ সকালে উঠে সেই একই রুটিন। সকালে উঠে বাড়ির কাজ সেরে অফিসে যাওয়া, সারাদিন অসংখ্য ফাইলে সই, মিটিঙের পর মিটিং, তারপর সন্ধেয় ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে সোফায় বা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কাজগ বা ভালো বইপত্র পেলে তাতে চোখ পাতা। কখনো ফিরতে রাত সাড়ে নটা-দশট। ততক্ষনে লুনা ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের অপেক্ষায় থেকে থেকে। কাজের মেয়ে গীতার জিম্মায় কেটে গেলো তার তিন বছরের জীবন। বাবা মাকে কাছ পাওয়া তার কাছে তাজমহল দেখার মতো। ঘুমন্ত লুনাকে আদর করার সময়ও নেই তাদের। তখন ক্রমাগত হাই তুলতে তুলতে কোনো ক্রমে খাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

ঠিক এরকম ব্যাস্তসমস্তটার মধ্যে মুম্বাই থেকে এই আমন্ত্রণপত্রটি এসে পৌঁছতে সুমিত একদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে ঝিঙে পোস্ট দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললো, চলো, সামনের সপ্তাহে মুম্বাই যাই।

মন্দিরার গলায় ভাত আটকে যাচ্ছিলো আর একটু হলে। ভূতের মুখে রামনাম উপমাটা ব্যবহার করতে গিয়েও বেধে গেলো। সুমিত সম্পর্কে এহেনো অভিধা না দিয়ে বললো, এভারেস্ট কি তিরিশ ডিগ্রী হেলে গেলো আজ ?

না, এভারেস্ট হেলে না গেলেও সুমিত ঠিক করেছে এই আমন্ত্রণটি সে রাখবেই। তার সব এপয়েন্টমেন্ট কিছুটা এগিয়ে পিছিয়ে মন্দিরাকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে মুম্বাইতে। কিন্তু ছোট্ট লুনাকে সঙ্গে আনেনি। সোনালিচাঁপার খুবই ন্যাওটা হয়েছে লুনা। সেই বললো, এরকম হারিকেন ট্যুরে ওকে নিয়ে গেলে খুব ধকল যাবে ওর ওপর দিয়ে। এখনো ভ্রমণের আনন্দ বুঝতে শেখেনি ও। তা ছাড়া তোমাদের কোথায় কখন থাকতে হয়, ছুটতে হয় তার ঠিক কি ! আমি আর গীতাদি দুজন মিলে সামলে রাখবো ওকে। তোমরা ঘুরে এস, দিদি।

সোনালিচাঁপার প্রাজ্ঞতাকে তারিফ করে দুজনে দীর্ঘ আলোচনান্তে সেইরকম সাব্যস্ত করেছে অতএব। কিন্ত তবু মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। প্লেনে ওঠা ইস্তক লুনার অনুপস্থিতি একটা আলপিন ফোটাচ্ছে মনের কোথাও। কিন্তু দিন চারেকের ব্যাপার। তার মধ্যে প্রচুর ঘোরাঘুরি। লুনার কষ্টই হতো মা বাবাকে কাছে পেতে গিয়ে।

মোটামুটি তিন চার ঘন্টা পরপর একবার করে ফোন করে খবর নিচ্ছে লুনার। লুনার সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছে বার দুই। লুনা মোটেই বুঝতে পারছে না তার মা বাবা ঠিক কত দূরে আছে। প্রিতিদিন তো এভাবেই দুজনে অফিসে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাতে। শুধু রবিবারই যা একটু সময় দিতে পারে ওকে। লুনা সেরকম হিসেবে করেই ফোনে জিজ্ঞাসা করছে, এখনো অফিসে শেষ হয়নি? আর একটু পরেই চলে আসবে তো?

সোনালিচাঁপাও বলছে, তোমাদের কোনো চিন্তা নেই, দিদি। ও দিব্যি খেলছে ওর একশো খেলনা নিয়ে। আমি তো সারাক্ষন ওর সঙ্গেই খেলছি।

মন্দিরার চিন্তা তাতে কিছুটা কম। সোনালিচাঁপা ভারী চমৎকার মেয়ে। ওর জীবনের শুরুতে একটা বড় ধরনের আঘাত পাওয়াতে নিজেকে স্থিতধী করে তুলেছে ক্রমশ। মন্দিরার সঙ্গে গামষ্টিকের মতো ঘোরে। অবসর কাটায় লুনাকে নিয়ে।

মুম্বাই পৌঁছে কোম্পানির নির্দিষ্ট হোটেলে উঠে মন্দিরা কিছুটা নিশ্চিন্ত। মেরিন ড্রাইভের কাছে এই হোটেলটা যেমন চমৎকার দেখতে, তেমনি বিলাসবাহু। দামও আকাশছোঁয়া। সুবিধে এই যে, সব খরচ আমন্ত্রকদের। খুবই আরামদায়ক সুইটে দিন চারেকের বসবাস। সুমিতকে একটা পেপার পড়তে হবে মাঝের দিনটায়। ঘন্টা তিনেকের উপস্থিতি। ব্যাস। বাকি সময়টা শহরের দ্রষ্টব্য দর্শন।