Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অবচেতনার অন্ধকারে - 8

এই কি মানুষ ? না কি মানুষের নামধারী কোন এক অজ্ঞাত প্রাণী ? তারপর সেই অশরীরী আত্মা লুসির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার ক্ষুধার্ত হাত।

ভয়ে বিস্ময়ে লুসি দেখলো সেই মানবিক হাতে নেকড়ের সুতীক্ষ্ণ নখর। আরেকটু হলেই টেনে চিরে টুকরো টুকরো করে দেবে লুসিকে।

সে ছুটতে থাকে, পায়ের নিচে ছুটছে ছড়ানো হাড়ের তীক্ষ্ণ ফলা, মানুষের কঙ্কাল হাসছে তার চারপাশে, লুসি ছুটছে।

এই জীবন হারা জীবন্তদের আস্তানা থেকে তাকে এখুনি পালাতে হবে প্রাণের জন্য।

প্রাণ তাকে ডাকছে। পৃথিবীর প্রথম প্রাণ, হিংস্র বিধস্ত বিশ্বাসঘাতক সেই জীবন স্রোতে ভাসতে না পারলে আজ এখানেই সমাপ্তি ঘটবে তার জীবনের।

ঝনঝন করে যেন কাঁচ ভেঙে গেলো। সুদূর অরণ্যের মধ্যে হায়নার হাসি শোনা যাচ্ছে। আর সেই ডাকিনি আগুনের মধ্যে উড়তে উড়তে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে তার দিকে ধেয়ে আসে। কি বিরাট তার চেহারা। দুটি চোখে জ্বলছে আগুন।

ছুটছে লুসি, যেন আর পারছে না। ঠিক এক পা পিছনে ভাসতে ভাসতে উড়ে আসছে সেই মায়াবিনী।

সে কি শুধু মায়া? মরণ ছায়া ? না কি তার অন্তরে প্রোথিত আছে এমিলির মতো হাজার হাজার অভিশপ্ত রমণীর পিপাসার্ত আতঙ্ক ?

ছুটতে ছুটতে লুসির অচেতন দেহটা ছিটকে পড়ে পথের ধরে। সেখানে কাঁটা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রুগ্ন গাছেরা, তারা রক্তাত্ত দংশনে লুসির যন্ত্রনা বাড়িয়ে দিলো।

ভীত সন্ত্রস্ত শিহরিত দুটি চোখের পাতায় এবার যেন ঘুম আসছে।

একটু ঘুম তার দরকার, ভীষণ দরকার। না হলে সে ডুবে যাবে ওই কোলাহলের মধ্যে।

শব্দ, শব্দ তাকে সর্বদা তাড়া করছে। এই পৃথিবীর সমস্ত শব্দকে সে যেন তার মনের মধ্যে শুনতে পাচ্ছে। সেই শব্দ আছে তার চেতনার মধ্যে নয়, আছে অবচেতনার মনে, সে শব্দ সাধারণ মানুষের মনে প্রবেশ করে না সেই রহস্যময় শব্দের অতলে ডুবতে বসেছে লুসি। ঘুম, ঘুম নেমে আসে, লুসি যেন ক্যাকটাসের বিছানায় কুয়াশার মলিন চাদর গায়ে অবিরাম তুষারের মধ্যে পৃথিবীর আদিকন্যা হয়ে ঘুমোতে চায়।

কিন্তু ওরা তাকে শান্তি দেবে না, নিদ্রা দেবে না। ওরা সর্বদা তার বিদ্ধস্ত চেতনাকে শব্দের আক্রমণে উত্তেজিত করবে। যাতে সে প্রতিমুহূর্তে অশান্ত আলোড়নে ছটপট করে মরে।

কি শব্দ ?

যে সব মানুষ হারিয়ে গাছে পৃথিবী থেকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কুটিল অভিসন্ধি, জঘন্য ষড়যন্ত্র আর লোভী লালসার ফিস্ ফিস্ শব্দ। আছে শিশু হত্যাকারীর দল, যারা রক্তের লোভে হত্যা করে নবজাতক, যারা অবৈধ সঙ্গমে জন্ম দেয় জারজ সন্তান, যারা ক্ষমতার লোভে বিচরণ করে কালো বাতাসের মধ্যে। যারা সুখের সন্ধানে প্রিয়জনের ঠোঁটে তুলে দেয় মৃত্যু বিষ, তাদের শব্দ লুসিকে গ্রাস করে।

ভূগর্ভের অতল হতে, বাতাসহীন রৌদ্র বিহীন প্রকোষ্ঠ থেকে মন্ত্রিত আত্মার কথা শোনা যায় .....লুসি, গত জন্মে তুমি ছিলে আগাথা। নিজের বিকৃত ইচ্ছাতে নিরপরাধ স্বামীর মুখে পরম বিশ্বাসে তুলে দিয়েছিলে বিষাক্ত মদের পাত্র।

এ অভিযোগ অস্বীকার করার মতো ক্ষমতা আছে কি লুসির ?

.....তার আগের জন্মে তুমি ছিলে ইরাকের কুৎসা কলঙ্ক কেচ্ছা দিয়ে গড়া জগতের মক্ষীরানী।

লুসি জানে এই অভিযোগের সত্যতা। তাই সে নীরবে তার পরাজয় মেনে নেয়। শুধু বলে, কাতর স্বরে, অনুনয়ের অসহায় ভঙ্গিমাতে -----দোহাই তোমাদের, যুগ যুগান্ত ধরে বহমান অভিশপ্ত আত্মার দল, তোমরা আমাকে একটু ঘুমোতে দাও।

হয়তো ওরা তার আকুল আকুতি শুনে স্তব্ধ হয় যায়। কিন্তু লুইজা ? লুসি কি জানে কি প্রচন্ড যন্ত্রণাতে ১৫০ মাইল বেগে ধাবিত মোটরের তলায় দলিত লুইজার দেহ এখন কাতরাচ্ছে ?

আজ সেই ছোট্ট শিশুটি তার তর্জনী তুলে সমস্ত অভিশাপ ঢেলে দিচ্ছে লুসির দিকে। সেই অভিশাপ বিষের মতো আক্রমণ করবে লুসিকে। ক্রমস সে নীল হয় যাবে।

লুসির ক্ষণস্থায়ী তন্দ্রা ভেঙে গেলো, অবাক হয় সে দেখলো যেখানে তার বিধস্ত দেহটা আছড়ে পড়ে ছিল সেখানে শায়িত আছে সেই অদৃশ্য কবর, যেখানে পাথরের চোখে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।

ধীরে ধীরে সেই বিন্দু বিন্দু রক্ত জমাট বেঁধে পরিণত হয় একটি রক্তরেখায়। সেই রক্ত রেখা গড়িয়ে পড়ে তৃষিত পিছল মাটিতে।

অযত্নে বর্ধিত আগাছাতে ঢেকে গেছে কবর। লুসির মনে হলো সে যেন এগিয়ে গেছে কয়েক শতাব্দীর পরের পৃথিবীতে।

একহাতে তার কোদাল, অন্য হাতে একটি মোমবাতি। সে মাটি কেটে প্রবেশ করছে বহু বছর আগে মৃত লুইজার সমাধিতে। সেই কালো কাঠের কফিন, যার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রনা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে একটি অতৃপ্ত মেয়ে।

লুসি ডালা খুলে দিলো। মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখা গেলো শ্যাওলা ধরা কুঠুরি আর তার মধ্যে শায়িত একটি ছোট্ট মেয়েকে।

লুইজা তার প্রথম শিকার। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিলো লুসি, পিপাসার্ত, সহসা রক্ত পানে উৎসুক হয়ে উঠেছে।

লুসির মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে সে গ্রাস করবে, তার অস্থি মজ্জা মাংসকে আত্মস্থ করবে। তারপর ফেলে দেবে তার রক্ত বিহীন দেহটাকে। ধীরে ধীরে লুসি তার মুখ নামিয়ে আনে। দুজনের মধ্যে ব্যাবধান ক্রমশ কমে আসে, এক দমকা বাতাসে মোমবাতিটা হটাৎ নিভে যায়, কিন্তু সেই কফিনের ডালা সশব্দে আছড়ে পড়ে লুসির মাথায়।

অন্তিম মুহূর্তে সে আর্তনাদ করে ওঠে। কাঠের কফিন যেন তাকে বন্দি করেছে । সে লাথি মারে, বেরিয়ে আসতে চায়, পারে না।

অবশেষে ছোট্ট কাঠের কফিনে শিকার আর শিকারি পাশাপাশি শায়িত থাকে মৃত্যু সজ্জায়। ধীরে ধীরে তারা পরিণত হয় জীবনহীন কঙ্কালে।