Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অবচেতনার অন্ধকারে - 11

গ্রহ নক্ষত্রেরা এমনভাবে সংকুচিত এবং সংনমিত যে গ্রহ নক্ষত্রের বাইরে মহাশুন্যের বিশালতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

কোন শয়তানী শিল্পবিদ্যা ঐ দুর্বোধ্য দুঃস্বপ্নকে জন্ম দিয়েছে, হেনরি বুজতে পারে না। এই প্যাটার্ন কোনো মানুষ শিল্পীর সৃষ্টি কিনা তাতেও সন্দেহ হয়। হয়তো দরজার এই মূর্তিটার কোনো ভয়াবহ প্রতীকী তাৎপর্য আছে। হয়তো অদ্ভুত শরীরের পটভূমিকায় এই প্রকান্ড মাথাগুলো মানুষের সব দেবতার অন্তরালে যে গোপন সন্ত্রাস লুকিয়ে থাকে, তারই সাক্ষ দিচ্ছে। যতোই দেখছে হেনরি, ডিসাইনার জটিল গোলকধাঁধায় তার মন জড়িয়ে পড়ছে। মূর্তিটা তার মন কেড়ে নেয়, তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। মূর্তির দিকে খানিক তাকালে জীবনের অর্থ ও তাৎপর্যের চিন্তা মনে আসে, সেইসব ভয়াবহ চিন্তা, যা দর্শনিককে উন্মাদ করে দেয়।

হেনরি এবার দুহাতে মাথা ঝাঁকাতে থাকে, তার মনে পড়ে যায় কয়েকমাস আগের কথা, যখন সে মরুভূমিময় মিশরে অন্নেষণ করছিলো সুপ্রাচীন কুহকিনী বিদ্যার গোপন তন্ত্রাবলী।

যখন সেখানে ক্লারা প্রচন্ড গরমের রাত্রে বালিতে লেপন করেছিল সদ্য মৃত শিশুর রক্ত, দুহাতে সেই রক্ত মেখে উল্লসিত হয়েছিল, তখন আকাশ থেকে কালো বাদুড়ের ঝাঁক অশুভ চিৎকার করতে করতে উড়ে যায়।

এখন তার মনে হচ্ছে সেই বাদুড়ের দল ছিল মূর্তিমান বিভীষিকার মতো।

কিন্তু এখানে কেন ?

এতো পাতাল পুরীর গভীর স্যাঁতস্যাতে ছাতা ধরা পুতি গন্ধময় নির্জন নিস্তব্ধ প্রকোষ্ট নয়। তবু কেন কুঞ্চিত নাকে ভেসে আসে শুধু গন্ধ। কবরখানার লাস পচা তীব্র দুর্গন্ধ যেন। এই গন্ধ বুঝি মৃত্যুর ঘনীভূত নির্যাস, ছাতা ধরা গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলির মিশ্রণ।

চোখের সামনে থেকে আনুবিসের রুপোলি করোটি অদৃশ্য হয় যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঝন ঝন করে ধাতব শব্দ তুলে দরজার পাল্লা ঘোরে। দরজা খোলার শব্দ ভেতরের পাতালপুরীর ছাতা পড়া দুর্গন্ধ গভীরে ধনী প্রতিধ্বনি ছড়ায়।

প্রথম আতঙ্কের রেশ কেটে যেতে হেনরি কথা বলে। কিন্তু তার কথা শুনবে কে ?

তার একমাত্র সঙ্গিনী এখন অচেতন হয় শুয়ে আছে মেজেতে। তবু নিজের মনে বিড়বিড় করে বকতে থাকে আরোপিত বার্ধক্কে শীর্ণ হেনরির বিবর্ণ দুটি ঠোঁট ----শোনো, তোমরা সবাই শোনো, এখনো আমি ডাকিনি বিদ্যার কিছুই শিখতে পারি নি। কিন্ত আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানের সীমানার বাইরে আছে অদৃশ্য ছায়াময় কুহকিনী বিদ্যার জগৎ। সেই জগতে ছেয়ে আছে অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। সারা জীবন ধরে আমি অশুভ আত্মার ঘুম ভাঙিয়ে তার কাছে থেকে জেনে নেবো প্রেত দেবতার দুঃশাসনের ইতিহাস।

আমার এই কাজে সঙ্গী হবে তুমি -----

নিজের কথাকে অসমাপ্ত রেখে হেনরি হটাৎ হাঁটু মুড়ে বসে ক্লারার সামনে, তার শীতল দেহটাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলে -----আমার এই কাজে তুমি হবে সঙ্গিনী। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি দীর্ঘ রাত অতিবাহিত করবো বিবর্ণ প্যাপিরাসের পাতায় লেখা প্রেততত্ত্বের মন্ত্র উচ্চারণে। তোমাকে সাথী করে হেঁটে যাবো পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়ানো রহস্যময় সমাধির সন্ধানে।

----প্রেম, আমি ঘৃণা করি, যে প্রেম অনন্ত জীবনের সন্ধান দেয় না, তার প্রতি আমার সামান্যতম আকর্ষণ নেই। আমি ভালোবাসি মৃত্যু। তোমাকে পশে পেলে আমি সেই মহান মৃত্যুকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করবো।

.....আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর মানুষের পরিচিত চেতনার বাইরে বিরাজ করে অতি প্রাকৃত জগৎ।

তাদের সন্ধান আমরা জানি না। কিন্তু আজ সময় এসেছে, সেই অজ্ঞাত জগতের সম্রাট হবার ডাক এসেছে।

...ক্লারা, শোনো হয়তো ঐ সমাধির আড়ালে আমরা এমন কোনো রহস্য খুঁজে পাবো, যা আমাদের পৃথিবীর অধীশ্বর করে দেবে, হয়তো আমরা পাবো মৃত্যুবহ কোন রশ্মি, মারাত্মক অথচ ধীরে ধীরে কাজ করে এমন কোনো বিষ, এমন কোনো শক্তিশালী মন্ত্র যা উচ্চারণ করলে সেই আদিম প্রেত দেবতাদের শাসন ফিরে আসবে।

ক্লারা, ভেবে দেখো, একবার এমনি সব রহস্যের খোঁজ পেলে আমরা কি না করতে পারি। আমরা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবো, রাজ্য শাসন করবো, আমাদের নবলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে শত্রুদের ধংস করব। এছাড়া আমরা পাবো মণিমুক্তো, কল্পনার অতীত ঐশর্য, সহস্র সম্রাটের সঞ্চিত ধন !

তখনো উন্মাদের মতো ক্লারার দেহটি ঝাঁকিয়ে চলেছে হেনরি।

একবার তার মনে হয়, উন্মত্ত আবেগের তাড়নায় সে ভাবে এই পাতাল ঘর থেকে সে পালিয়ে যাবে। কেননা দীর্ঘদিন এখানে বন্দী থেকে, কুহকিনী বিদ্যার দুর্বোধ মন্ত্রের মধ্যে নিজের সমস্ত সময়কে আবদ্ধ রেখে হেনরি যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে পালিয়ে যাবে স্বাভাবিক মাটির পৃথিবীতে। যেখানে এখনো জ্বলছে সূর্যের আলো। এখনো তার তপ্ত কপাল ছুঁয়ে যাবে মরু বাতাস, যে বাতাস অজস্র মৃত শতাব্দীর ধুলোয় দূষিত নয়।

কিন্তু সে কি আর পালতে পারবে ? মনে হয় আর কোন দিন সে ফিরতে পারবে না সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ?

কেন না সে যে দেখেছে সম্মোহিত আত্মাকে। তাই সরল মানুষ হওয়া আর সম্ভব হবে না।

আনুবিসের শৃগাল মুখের দিকে চোখ পড়ে যায়। সে বিড় বিড় করে বলে ---আমি জানি এখন আমাকে কি করতে হবে। নিজেকে আমি সম্মোহিত করবো, আমি, আমার সমাধিস্থ আত্মা বা চেতনা স্ট্যাচুর পাথরের শরীরে ঢুকবে। পাথর জেগে উঠবে, স্ট্যাচু ঘুরবে, আমাদের রাস্তা খুলে যাবে ------

কিন্তু অভিশাপ ? হেনরি অব্যক্ত স্বরে বলতে থাকে, আমি জানি এ জীবন অভিশপ্ত। .....

.....ড্রাগনের চোখ জ্বলে .....আনুবিসের চোখে আলো পড়ে .....নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে হেনরি দেখছে, বারো ফুট উঁচু স্ট্যাচু, শিয়ালের মতো মুখ, বিস্তারিত দুটি পাথরের চোখ, যে চোখের আড়ালে গোপনে জীবনে ইঙ্গিত তাদের মনে আতঙ্ক জাগিয়েছে।

সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। মাটির নীচে নিকষ কালো পাতালপুরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুটি মানুষ এবং অশুভ মিশরীর প্রেত দেবতার সামনে সাইক্রিয়াটিস্ট হেনরির ঠোঁট দুটো কাঁপছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মিশরের প্রেত পুরোহিত তার অশুভ দেবতার উদ্দেশ্যে যে ভাষায় প্রার্থনা জানাতো, সেই একই ভাষায় বিড়বিড় করে প্রার্থনা জানাচ্ছে হেনরি। লণ্ঠনের আলোয় একটা ছায়াঘেরা বৃত্ত দেবতার শৃগাল মুখের ওপরে পড়েছে। সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে বুড়ো মানুষটা।

আস্তে আস্তে তার চোখের তারা দুটো ঘষা কাছের মতো হয়ে যায়। শকুনের চোখের মতো বুড়োর চোখেও পলক পড়ছে না। দুচোখের মনিতে যেন আগুনের লেলিহান শিখা ধিক ধিক জ্বলছে। দেখতে দেখতে হেনরির শরীর শিথিল হয়ে আসে। যেন অদৃশ্য এক হিংস্র ভ্যাম্পায়ার তার শরীরের সব রক্ত শুষে নিচ্ছে।

মিনিটের পর মিনিট নিঃশব্দে কেটে যাচ্ছে, মৃত্যু যেখানে সম্রাট, সময় সেখানে মূল্যহীন।

হেনরি আর ভাবতে পারে না। রুদ্ধ আবেগে থর থর করে কাঁপছে তার চেতনা।