মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮
কচ ও দেবযানীর কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কচ ও দেবযানীর কাহিনি
অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশম্পায়ন কুরুবংশের বৃত্তান্ত আদি থেকে বললেন। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতি তাঁর পঞ্চাশটি কন্যাকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা অদিতি থেকে বংশানুক্রমে বিবস্বান (সূর্য), মনু, ইলা, পুরূরবা, আয়ু, নহুষ ও যযাতি জন্মগ্রহণ করেন। যযাতি দেবযানী ও শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করেন।
ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্য যখন দেবাসুরের বিরোধ হয় তখন দেবতারা বৃহস্পতিকে এবং অসুররা শুক্রাচার্যকে গুরুদেব হিসাবে বরণ করেন। এই দুই ব্রাহ্মণ বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্যের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, দেবগণ যে সকল দানবকে যুদ্ধে মারতেন শুক্র মন্ত্রবলে তাদের পুনর্জীবিত করতেন। বৃহস্পতি এই বিদ্যা জানতেন না, সেজন্য দেবপক্ষের মৃত সৈন্য বাঁচাতে পারতেন না। দেবতারা বৃহস্পতির পুত্র কচকে বললেন, তুমি অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে যাও, সেখানে শুক্রাচার্যকে দেখতে পাবে। শুক্রের প্রিয়কন্যা দেবযানীকে যদি সন্তুষ্ট করতে পারো তবে তুমি নিশ্চয় মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করবে। কচ শুক্রের কাছে গিয়ে বললেন, আমি অঙ্গিরা ঋষির পৌত্র, বৃহস্পতির পুত্র, আমাকে শিষ্য করুন, সহস্র বৎসর আমি আপনার কাছে থাকব। শুক্র সম্মত হলেন। গুরু ও গুরুকন্যার সেবা করে কচ ব্রহ্মচর্য পালন করতে লাগলেন। তিনি গীত নৃত্য বাদ্য করে এবং পুষ্প ফল উপহার দিয়ে প্রাপ্তযৌবনা দেবযানীকে তুষ্ট করতেন। সুগায়ক সুবেশ প্রিয়বাদী রূপবান মাল্যধারী পুরুষকে নারীরা স্বাভাবত কামনা করে, সেজন্য দেবযানীও নির্জন স্থানে কচের কাছে গান গাইতেন এবং তার পরিচর্যা করতেন।
এইরূপে বহু বৎসর অতিক্রম হোলে দানবরা কচের মতলব বুঝতে পেরে, একদিন কচ যখন বনে গরু চরাচ্ছিলেন তখন তারা তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কুকুরকে খাইয়ে দিল। কচ ফিরে এলেন না দেখে দেবযানী বললেন, পিতা, আপনার হোম শেষ হয়েছে, সূর্য অস্ত গেছে, গরুর পালও ফিরেছে, কিন্তু কচকে দেখছি না। নিশ্চয় তিনি হত হয়েছেন। আমি সত্য বলছি, কচ বিনা আমি বাঁচব না। শুক্র তখন সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে কচকে আহ্বান করলেন। কচ তখনই কুকুরদের শরীর ভেদ করে সশরীরে উপস্থিত হলেন এবং দেবযানীকে জানালেন যে দানবরা তাকে বধ করেছিল। তার পর আবার একদিন দানবরা কচকে হত্যা করলে শুক্র তাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
তৃতীয় বারে দানবরা কচকে আগুনে পুড়িয়ে তার ভস্ম সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রকে খাইয়ে দিলো। কচকে না দেখে দেবযানী বিলাপ করতে লাগলেন। শুক্র বললেন, অসুররা তাকে বার বার বধ করছে, আমরা কি করব? তুমি শোক ক’রো না। দেবযানী সরোদনে বললেন, পিতা, বৃহস্পতিপুত্র ব্রহ্মচারী কচ আমার প্রিয়, আমি তাকেই অনুসরণ করব। তখন শুক্র আগের মতো কচকে আহ্বান করলেন। গুরুর পেটের ভিতর থেকে কচ বললেন, ভগবান, প্রসন্ন হন, আমি আপনাকে প্রণাম জানিয়ে বলছি যে, দানবরা আমাকে ভস্ম করে সুরার সঙ্গে মিশিয়ে আপনাকে খাইয়েছে। শুক্র দেবযানীকে বললেন, তুমি কিসে সুখী হবে বল, আমার উদর বিদীর্ণ না হলে কচকে দেখতে পাবে না, আমি না মরলে কচ বাঁচবে না। দেবযানী বললেন, আপনার আর কচের মৃত্যু দুইই আমার পক্ষে সমান, আপনাদের কারও মৃত্যু হলে আমি বাঁচব না। তখন শুক্র বললেন, বৃহস্পতির পুত্র, তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ, দেবযানী তোমাকে ভালোবাসে। যদি তুমি কচরূপী ইন্দ্র না হও তবে আমার সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ কর। বৎস, তুমি পুত্ররূপে আমার উদর থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমাকে বাঁচিয়ে দিও, গুরুর নিকট বিদ্যা লাভ করে তোমার যেন ধর্মবুদ্ধি হয়।
শুক্রের দেহ বিদীর্ণ করে কচ বেরিয়ে এলেন এবং গুরুর থেকে দ্য শেখা বিদ্যার দ্বারা তাঁকে পুনর্জীবিত করে বললেন, আপনি বিদ্যাহীন শিষ্যকে বিদ্যামৃত দান করেছেন, আপনাকে আমি পিতা ও মাতা জ্ঞান করি। শুক্র পুনর্জীবন লাভ করে সুরাপানের প্রতি এই অভিশাপ দিলেন যে মন্দমতি ব্রাহ্মণ মোহবশে সুরাপান করবে সে ধর্মহীন ও ব্রহ্মহত্যাকারীর তুল্য পাপী হবে। তার পর দানবগণকে বললেন, তোমরা নির্বোধ, কচ সঞ্জীবনী বিদ্যায় সিদ্ধ হয়ে আমার তুল্য প্রভাবশালী হয়েছেন, তিনি আমার কাছেই বাস করবেন।
সহস্র বৎসর অতীত হলে কচ স্বর্গলোকে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দেবযানী তাকে বললেন, অঙ্গিরার পৌত্র, তুমি বিদ্বান, সুশীল তপস্বী ও সংযমী, তোমার পিতা আমার মাননীয়। তোমার ব্রতপালনকালে আমি তোমার পরিচর্যা করেছি। এখন তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে বিবাহ কর। কচ উত্তর দিলেন, ভদ্রে, তুমি আমার গুরুপুত্রী, তোমার পিতার মতো তুমিও আমার পূজনীয়, অতএব ও কথা বলো না। দেবযানী বললেন, কচ, তুমি আমার পিতার গুরুপুত্রের পুত্র, আমার পিতার পুত্র নও। তুমিও আমার পূজ্য ও মান্য। অসুররা তোমাকে বার বার বধ করেছিল, তখন থেকে তোমার উপর আমার প্রীতি জন্মেছে। তুমি জান তোমার প্রতি আমার অনুরাগ আর প্রেম আছে, তুমি আমাকে বিনা দোষে প্রত্যাখ্যান করতে পার না।
কচ বললেন, দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী, অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ কর যেন পথে আমার মঙ্গল হয়।
দেবযানী বললেন, কচ, যদি আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান কর তবে তোমার বিদ্যা সফল হবে না। কচ উত্তর দিলেন, তুমি আমার গুরুকন্যা, গুরুও সম্মতি দেননি, সেজন্যই প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি ধর্মসংগত কথাই বলেছি, তথাপি তুমি কামের বশে আমাকে অভিশাপ দিলে। তোমার যে কামনা তাও সিদ্ধ হবে না, কোনও ঋষিপুত্র তোমাকে বিবাহ করবেন না। তুমি বলেছ আমার বিদ্যা নিষ্ফল হবে; তাই হোক। কিন্তু, আমি যাকে শেখাব তার বিদ্যা সফল হবে। এই কথা বলে কচ ইন্দ্রলোকে প্রস্থান করলেন।
______________
(ক্রমশ)