অধ্যায় ১: আগমনী
বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, চারপাশে ঘন জঙ্গল আর পুরনো নদী। সেই গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি—যার দেয়াল জুড়ে সময়ের ছাপ, আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় অজানা কাহিনির গন্ধ।
অন্বেষা, কলকাতার মেয়ে, লোককথা আর পুরনো গল্পের প্রতি তার গভীর টান। বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের জন্য সে এসেছে এই রাজবাড়িতে। তার গবেষণার বিষয়—গ্রামবাংলার লোককথা ও অভিশপ্ত প্রেমের গল্প।
রাজবাড়িতে এসে সে পরিচিত হয় বৃদ্ধ কেয়ারটেকার হরিপদর সঙ্গে। হরিপদর মুখে শোনা যায় এক রহস্যময় কাহিনি—"ছায়াছবি প্রেম"। প্রতি পূর্ণিমার রাতে, নাকি রাজবাড়ির পেছনের লেকের ধারে দেখা যায় এক নারীর ছায়া, শোনা যায় বাঁশির সুর।
অন্বেষা প্রথমে এসবকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু রাত বাড়তেই ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা—আয়নায় ছায়া নড়ে ওঠে, ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পায় নিজেকে এক শতাব্দী আগের মেয়ের রূপে। নাম—মেঘলা।
একদিন রাজবাড়ির বাগানে হঠাৎ দেখা হয় ইশানের সঙ্গে। ইশান রহস্যময়, চোখে অদ্ভুত এক দুঃখের ছাপ। তার কথায়, আচরণে যেন লুকিয়ে আছে কোনো অতীতের গল্প। অন্বেষা টের পায়, ইশানের প্রতি তার অজানা এক আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছে।
দিন গড়াতে থাকে, অন্বেষা খুঁজে পায় পুরনো ডায়েরি, যেখানে লেখা আছে রুদ্রনীল ও মেঘলার প্রেম, তাদের পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা, আর সেই অভিশপ্ত রাতের কথা—যেদিন মেঘলাকে হত্যা করা হয়, আর রুদ্রনীল নিখোঁজ হয়ে যায়।
অন্বেষা বুঝতে পারে, ইশান আসলে রুদ্রনীলের আত্মা, যে শত বছর ধরে মুক্তির অপেক্ষায় আছে। সে বিশ্বাস করে, অন্বেষাই তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা মেঘলার পুনর্জন্ম।
এবার অন্বেষার সামনে দুটি পথ—সে কি এই অতিপ্রাকৃত প্রেমে নিজেকে সঁপে দেবে? নাকি পালিয়ে বাঁচবে, যাতে তার জীবনও অভিশপ্ত না হয়?
অধ্যায় ২: ছায়ার হাতছানি
পূর্ণিমার রাত, রাজবাড়ির উত্তর প্রাঙ্গণ
অন্বেষার ঘামে ভিজে গেছে কপাল। চাঁদের আলো যেন বিষের মতো জমেছে তার শয্যায়। কান পাততেই শুনতে পেল—কে যেন বাজাচ্ছে বাঁশি। সুরটা মর্মভেদী, যেন কোনো হারানো স্মৃতির টান।
"মেঘলা... এদিকে এসো..."
নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল তার। আওয়াজটা এসেছে রাজবাড়ির পশ্চিম দিকের অন্ধকার করিডোর থেকে। পা নিজে থেকেই এগিয়ে যায়।
দেয়ালে টাঙানো পুরনো ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল অন্বেষা। ১৯০২ সালের এক ফটো—তাতে রুদ্রনীল, যার মুখ ইশানের মতো অবিকল! পাশে দাঁড়িয়ে এক তরুণী, তার গলায় সিঁদুরের দাগ। অন্বেষার গলায়ও সেই রকম একটা তিল আছে।
"তুমি বুঝতে পেরেছ, অন্বেষা?"
পেছনে দাঁড়িয়ে ইশান। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে নীল আলোয়।
"কী চাও তুমি?" জিজ্ঞাসা করল অন্বেষা, গলা শুকিয়ে কাঠ।
"তোমাকে। শত বছর ধরে অপেক্ষা করছি," ইশানের হাত বাড়ালো। স্পর্শমাত্রই বিদ্যুতের ঝাঁকুনি খেল গায়ে।
হঠাৎ করিডোরের দেয়াল ফেটে বেরিয়ে এল রক্তের স্রোত! অন্বেষা চিৎকার করে উঠতেই ইশান তাকে টেনে নিয়ে ছুটল বাগানের দিকে।
অধ্যায় ৩: অভিশপ্ত ডায়েরির রহস্য
পরদিন সকাল, রাজবাড়ির লাইব্রেরি
ধুলোয় মোড়া কক্ষে অন্বেষা খুঁজে পেল রুদ্রনীলের ডায়েরি। পাতার পর পাতা জুড়ে লেখা—
"১৫ জুন, ১৯০১: আজ মেঘলাকে প্রথম দেখলাম। নদীতে স্নান করছিল, চুলগুলো ভিজে কাঁধে ছড়িয়ে। ওর দিকে তাকাতেই বুঝলাম, এটা শুধু আকর্ষণ নয়... নিয়তি।
"২ মার্চ, ১৯০২
আজ মেঘলার সঙ্গে নদীর ধারে দেখা। গোধূলির আলোয় ওর মুখটা যেন দেবীর মতো জ্বলছিল। আমি দূর থেকে দেখছিলাম—ওর হাসি, ওর চুলে বাতাসের খেলা।
হঠাৎ ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছিল, এই চোখ দুটো চিরকাল আমার চেনা।
মেঘলা বলল, ‘আপনি কে? এত চুপচাপ নদীর ধারে বসে থাকেন কেন?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘তোমার জন্য।’
ও হেসে বলল, ‘সবাই বলে, রাজবাড়ির ছেলেরা নাকি খুব অহংকারী।’
আমি বললাম, ‘তুমি কি আমার অহংকার ভাঙতে পারবে, মেঘলা?’
ওর চোখে তখন অদ্ভুত এক দীপ্তি। মনে হল, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব কিছু থেমে গেছে—শুধু আমরা দু’জন আছি, আর আছে নদীর ঢেউয়ের শব্দ।
সেদিন বুঝলাম, আমার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। মেঘলা আমার রক্তে মিশে গেছে।"**
অধ্যায় ৩: অভিশপ্ত ডায়েরির রহস্য (চলমান)
অন্বেষা ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে যেতে যেতে অনুভব করল, যেন সে নিজেই সেই সময়ে চলে যাচ্ছে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আর দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ।
ডায়েরির পাতায় পাতায় শুধু মেঘলার কথা, তাদের গোপন দেখা, নদীর ধারে প্রেম, আর সমাজের চোখ রাঙানি।
একটি পাতায় লেখা—
"পূণিমার রাতে আমরা পালিয়ে যাব। এই অভিশপ্ত রাজবাড়ি আর সহ্য হয় না।"
অন্বেষার বুক কেঁপে উঠল। সে জানে, এই রাতই ছিল সেই কালরাত্রি—যেদিন মেঘলা খুন হয়েছিল।
হঠাৎ ঘরের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেল। জানালার কাঁচে ছায়া নড়ল।
"অন্বেষা... তুমি কি আমার কথা পড়ছো?"
কণ্ঠস্বরটা যেন বাতাসে ভেসে এলো।
অন্বেষা চমকে তাকাল—আয়নায় ইশানের মুখ, চোখে অশ্রু।
"তুমি কি জানো, আমি কত বছর ধরে অপেক্ষা করছি?"
অন্বেষা ডায়েরি বুকের কাছে চেপে ধরল।
"তুমি কে?"
ইশান ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
"আমি রুদ্রনীল। আর তুমি... তুমি আমার মেঘলা।"
অধ্যায় ৪: ছায়ার আবেশ
রাত বাড়ে। রাজবাড়ির প্রতিটি করিডোর যেন অতীতের কান্নায় কেঁপে ওঠে।
অন্বেষা জানে, সে পালাতে পারবে না।
বাইরে পূর্ণিমার আলোয় লেকের জলে ভেসে উঠেছে এক নারীর ছায়া—চুল ছড়ানো, চোখে অশ্রু।
বাঁশির সুরে মিশে আছে শত বছরের বেদনা।
অন্বেষা জানে, আজ রাতেই সবকিছু বদলে যাবে।
সে কি পারবে অভিশাপ ভাঙতে? নাকি সেই একই চক্রে আটকে যাবে চিরকাল?