পর্ব ১ *একটা চেনা মুখ
সকালবেলা কলেজ গেটের ঠিক সামনে তানিয়ার চোখ থমকে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়িয়ে... রাফি। চার বছর পর, হঠাৎ!
চোখাচোখি—চোখ নামিয়ে নিল তানিয়া। রাফি শুধু তাকিয়ে রইল। কোনো কথা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই। তানিয়ার মনে চলতে লাগল চার বছর আগের সেই শেষ কথাগুলো: "তুই চলে যা রাফি, আর কখনও আমাকে খুঁজিস না...
কিন্তু আজ... সে ফিরে এসেছে। কেন?
তানিয়া সেদিনের সন্ধ্যায় নিজের ডায়েরি খুলল। পাতাগুলো এখনো ভিজে যেন পুরনো অশ্রুতে। লেখা ছিল— “রাফি আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু নিজের মতো করে। আর আমি চেয়েছিলাম, কেউ আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসুক।”
আজ হঠাৎ সেই রাফিকে দেখে বুকটা ভার হয়ে উঠেছে। আসলে আমরা যাদের দূরে পাঠাই, তারা কি সত্যিই দূরে যায়?
রাফি এখনো চুপচাপ। সে শুধু প্রতিদিন তানিয়ার ক্লাস শেষ হলে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। তানিয়া বোঝে, কিছু বলার আছে। কিন্তু কিছু না বলাটাও একটা কথা।
বন্ধুরা বলে, “তুই ওকে ইগনোর করিস না। হয়তো অনেক কিছু বলার আছে ওর।” তানিয়া হাসে, বলে— “সে শুধু থাকলেই চলতো না… একটু বুঝলেই হতো।
একদিন রাফি তানিয়াকে হঠাৎ বলে বসল— “তুই কি একটুও জানিস না, আমি কেন ফিরে এসেছি?” তানিয়া কিছু না বলে হেঁটে যায়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার চোখও কথা বলে।
রাফি অপেক্ষা করে… দিন যায়। তানিয়া তার মনের দরজা খুলবে কি?
তানিয়া এবার নিজেকে প্রশ্ন করে— "আমি কি ওকে ফের চাই?" জীবনে তো এগিয়ে যাচ্ছিল… তবু কেন এই ফিরে দেখা?
সেই রাতে ডায়েরির নতুন পাতায় লেখা হল
তানিয়ার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা পুরনো একটা খাম আজ হঠাৎ খোলা হল। লেখা ছিল— "যদি কোনোদিন আবার দেখা হয়, তবে তুমি শুধু তাকিয়ে থাকবে। আমি বলব—আমি এখনো তোর।"
চিঠিটার নিচে ছিল রাফির সই। তানিয়ার হাত কেঁপে উঠল।
সে জানত না, ভালবাসা কখনও কোথাও লুকিয়ে থাকে। তবে আজ মনে হল—ভালোবাসা তো নিজের চিঠিই নিজেই ফেরত পাঠায়… সময়ের ডাকের ঘরে
তানিয়া এবার সিদ্ধান্ত নেয়—রাফির মুখোমুখি হবে। সে রাফিকে বলে— "তুই কেন ফিরে এলি?"
রাফি চুপ। কিছুক্ষণ পর বলে— "কারণ, তোকে ছাড়া আমার সবকিছু থাকলেও কিছুই ছিল না।"
তানিয়া তাকিয়ে রইল। এই প্রথমবার, রাফির চোখে সত্যির মতো কিছু ছিল
কলেজের বারান্দায় বসে তানিয়া আর রাফি দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ রাফি বলে— "তুই এখনো কফিতে চিনি দিস না?"
তানিয়া হেসে বলে— "তুই এখনো খালি কাপ নিয়ে গল্প করিস?"
দুজনেই হেসে ফেলে। সেই পুরনো দিনের মতো।
হাসির মধ্যে জমে থাকা অভিমানের বরফ একটু একটু করে গলতে শুরু করে
রাফি এবার তানিয়াকে বলল— "তুই যদি আরেকবার বলিস, আমি সব শুরু করতে পারি আবার।"
তানিয়া চুপ করে থাকে। তার চোখে জল। সে বলে না কিছুই, শুধু ভাবে— "ভালোবাসা কখনো ফুরোয় না… সে শুধু সময়ের অপেক্ষায় থাকে, কেউ সাহস করে ডাকলে ফিরে আসে।
তানিয়া নিজের ডায়েরিতে আজ লিখল—
“সব কথা বলা যায় না, কিছু অনুভব বোঝানো যায় না।
কিন্তু কেউ কেউ এমন হয়, যাদের সামনে চুপ করে থাকাটাই যেন সবচেয়ে বড় ভাষা।”
আজ তানিয়া নিজেকে প্রশ্ন করে—
সে কি আরেকবার শুরু করবে?
বাড়ির ছাদটা সবসময় তার প্রিয় জায়গা ছিল। যতই ব্যস্ত থাকুক, দিনের শেষে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে পড়তো সে। ঠিক যেমন আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি। সময়টা ঠিক সেই পুরনো দিনগুলোর মতোই—সূর্য ডুবে যাচ্ছে, হালকা বাতাস বইছে, আর আমার বুকের ভেতর জমে থাকা অনুভূতিগুলো উথলে উঠছে।
ওর কথা খুব মনে পড়ে এই সময়টাতে। অথচ ওর তো এসব কিছুতেই কোনো দোষ ছিল না। দূরত্বটা সময়ের নয়, বোঝার অভাবের ছিল। হয়তো আমি বোঝাতে পারিনি, হয়তো ও বুঝতেও চায়নি।
ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই আকাশ তো একসময় আমাদের দুজনকেই দেখেছে, হাসতে, ঝগড়া করতে, মান-অভিমান মেটাতে। আজও সেই আকাশ আছে, কিন্তু ও নেই।
মনে হয়, যদি একবার বলতাম—
“তুই থাকলেই সব ঠিক হয়ে যেত না…
তুই একটু বুঝলে, আমি হয়তো বলতেই পারতাম— কী যন্ত্রণায় ভুগছিলাম!”
শুধু একটা কথার অভাব ছিল— "থেকো", বা "ফিরে এসো"…
আর আমি তা বলিনি, ও-ও আর ফিরে আসেনি।
আজও সেই স্মৃতির বারান্দা আমাকে তাড়া করে।
তাকে বলা হয়নি— কিন্তু বলা
দরকার ছিল।
ওর সাথে আমার সম্পর্কটা কখনোই খুব নিখুঁত ছিল না। ঝগড়া হতো, মান-অভিমান হতো, কাঁদতাম… কিন্তু আবার ঠিক হয়ে যেত। আমি ভাবতাম, এটাই হয়তো ভালোবাসা—সবচেয়ে কাছের মানুষটার সাথেই বারবার ভুল বোঝাবুঝি, আবার মুছে দেওয়া সব অভিমান।
কিন্তু একদিন বুঝলাম, ভালোবাসা শুধু “থাকা” না, “বোঝা”ও একটা দায়িত্ব। ও ছিল, পাশে ছিল, কিন্তু আমাকে বুঝত না। আমি চুপ করে থাকতাম, সে ব্যস্ত থাকতো নিজের দুনিয়ায়। আমি অপেক্ষা করতাম, সে হয়তো একদিন বুঝবে—আমি কী চাই।
একদিন বলেছিলাম,
“তুই আছিস, কিন্তু আমি একা বোধ করি।”
ও হেসেছিল। বুঝতে পারেনি আমি মজা করিনি।
ভালোবাসা কি শুধু ছায়ার মতো পাশে থাকা?
না কি সেই আলো, যা কষ্ট বুঝে এসে কাছে বসে?
আজ মনে হয়—থাকা যতটা না জরুরি,
তার চেয়েও বেশি দরকার “বুঝে থাকা”।
আর সেই জিনিসটাই আমাদের মধ্যে ছিল না।
তাইতো—তাকে বলা হয়নি…
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, একটা মেসেজ চেক করি—যেটা আর আসবে না, জানি। তারপর ফোনটা চুপ করে পড়ে থাকে বিছানায়, আর আমার চোখ চলে যায় সেই পুরনো চ্যাটের দিকে।
তুই এখন কারো জীবনে হয়তো নতুন, হয়তো কারো খুব আপন। আর আমি এখনো তোকে খুঁজি, প্রতিটি দিনযাপনের মাঝে।
চায়ের কাপে তোর প্রিয় সেই এলাচের গন্ধটা পেলেই, মনে হয় তুই পাশে বসে আছিস। রাস্তার মোড় ঘুরতেই যদি দেখি কারো হাঁটার স্টাইল তোর মতো—মাথা ঘুরিয়ে দেখি, কিন্তু ভুল।
ফেসবুকের পুরনো ছবি, ইনস্টাগ্রামের স্মৃতি—সব যেন তোর খোঁজেই জেগে থাকে।
আমি জানি, তোকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
তবু প্রতিদিন একরকম মিথ্যে আশায় বেঁচে থাকি—
তুই হঠাৎ কোনো একদিন বলবি, “ভুল করেছিলাম, ফিরতে চাই।”
তাকে বলা হয়নি—আমি আজও তার খোঁজেই বাঁচি।
রাত তিনটে বাজে। ঘুম নেই চোখে। ঘরের কোণে রাখা পুরোনো ডায়েরিটার পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎই চোখে পড়ে—তোমার হাতে লেখা একটা ছোট্ট চিরকুট। "ভুল বোঝো না, আমি কেবল চেয়েছিলাম পাশে থাকতে…"
হাসি পায়! তখন না বোঝার বয়স ছিল, আজ বোঝার কষ্টটা রয়ে গেছে। আমার হঠাৎ মনে হয়—তুমি হয়তো সত্যিই চেয়েছিলে থাকা, শুধু আমার অহংকারটাই বড় হয়ে গিয়েছিল।
সময় অনেক কিছুই বদলে দেয়, কিন্তু কিছু অনুভব… মুছে ফেলা যায় না।
আজ অনেকদিন পর এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে দেখি, সব কিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবে। আলো, হাসি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস। আমার মন অথচ কোথায় যেন স্থির, কোথাও আটকে আছে।
তুমি যদি আজ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াতে, আমি কী বলতাম? শুধু এইটুকু—"কেমন আছো?"
তুমি আমার জীবনে আজও আছো, ঠিক আগের মতোই। আমরা কেউ কাউকে হারাইনি, কেবল সময়ের এক প্রান্তে রেখে এসেছি…