Read Love written in letters. by Prabhakar Bhangar in Bengali Detective stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

চিঠিতে লেখা প্রেম।

রোহান, এক শান্ত, মেধাবী অথচ কিছুটা আত্মবিশ্বাসীহীন ছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন তাকে শিখিয়েছিল জীবনের মূল্য। নিজের পড়ার খরচ চালাতে আর সংসারের পাশে দাঁড়াতে সে টিউশন পড়াতো। একদিন এক বন্ধুর মাধ্যমে সে সুযোগ পায় শহরের অন্যতম ধনী পরিবারের মেয়ে রিয়াকে পড়ানোর।
প্রথম পরিচয়েই রিয়া রোহানের গম্ভীর আর রাশভারী চেহারা দেখে একেবারেই হতাশ হয়েছিল। তার প্রাণবন্ত, উচ্ছল স্বভাবের সঙ্গে রোহানের নিরুত্তাপ ব্যক্তিত্বের কোনো মিল ছিল না। কিন্তু রোহানের সরলতা, নিষ্ঠা আর তার বিষণ্ণ চোখের গভীরতা ধীরে ধীরে রিয়ার মনে জায়গা করে নেয়। অঙ্ক শেখানোর ফাঁকেই তাদের গল্পের শুরু হতো – কখনও বইয়ের বাইরে জীবনের কথা, কখনও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কোচিং শেষে একসাথে ফিরতে ফিরতে রিয়া শোনাতো তার নিজের মতো বাঁচার স্বপ্নের কথা, আর রোহান বলতো তার একজন ভালো শিক্ষক হওয়ার আকুলতার কথা।
দেখতে দেখতেই এক অদৃশ্য বন্ধন গড়ে ওঠে তাদের মাঝে। রিয়া আবিষ্কার করে, রোহানের আত্মবিশ্বাসের অভাবটা আসলে তার ভেতরের অনুভূতির গভীরতারই প্রতিফলন। আর রোহান মুগ্ধ হয় রিয়ার বুদ্ধিমত্তা আর তার স্বাধীনচেতা মনোভাব দেখে। তাদের ভালোবাসা প্রস্ফুটিত হয় গোপনেই, অনেকটা বসন্তের লুকানো ফুলের মতো।
একদিন মেঘলা বিকেলে, বৃষ্টিভেজা রিয়াকে দেখে রোহান সাহস করে বলেই ফেলে, "আমি তোমাকে ভালোবাসি, রিয়া।" রিয়া প্রথমে লজ্জায় হাসে, তারপর ধীরে ধীরে তার মাথা রোহানের কাঁধে এলিয়ে দেয়। তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়, একে অপরের নিঃশ্বাসে খুঁজে পায় পরম শান্তি। তারা জানতো না, এই সুখের আয়ু খুব বেশিদিনের নয়।
রিয়ার বাবা-মা তাদের একমাত্র মেয়ের জন্য অভিজিৎ নামের এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে পছন্দ করেন। অভিজিৎ শুধু বিত্তশালীই নয়, বাস্তববাদী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষীও। রিয়ার বাবা-মা যখন তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অভিজিতের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং রোহানের সাথে সম্পর্ক না ছাড়লে তার জীবন জটিল হয়ে যাবে, তখন রিয়া নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানতো, ক্ষমতার এই ভিন্নতার কাছে রোহান কতটা অসহায়। সামাজিক এই অদৃশ্য দেওয়াল ভাঙার ক্ষমতা রোহানের নেই, আর রিয়ারও নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না।
একদিন হঠাৎ করেই রিয়া রোহানকে জানায়, "আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আমরা যা ছিলাম, ছিলাম... এখন আর কিছু নেই।" রোহানের পৃথিবী যেন এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তার চোখে তখন শুধু রিয়ার চলে যাওয়ার ছবি। সে আর কোচিং সেন্টারে যায় না, কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। দিনরাত শুধু রিয়ার কথাই ভাবতো সে।
ধীরে ধীরে রোহান নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। মদ্যপানে সে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে রিয়ার নামে চিৎকার করে, দেওয়ালে তার নাম লেখে, আর অসংখ্য চিঠি লেখে, যেগুলো কোনোদিনও রিয়ার কাছে পৌঁছায় না। সেই চিঠিগুলো তার ডায়েরির পাতায় বন্দী হয়ে থাকে, তার অব্যক্ত ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে। রিয়ার বিয়ে হয়ে যায়, আর সে পাড়ি জমায় সুদূর বিদেশে। রোহান থেকে যায় তার অতীতের জালে বন্দি।

এক ঝড়-বৃষ্টির দিনে, যখন বিদ্যুতের ঝলক আর মেঘের গর্জন আকাশের বুক চিরে যাচ্ছিল, রোহান একা বসে ছিল কোচিং সেন্টারের ভেজা সিঁড়িতে। তার হাতে ধরা ছিল একটি চিঠি, বৃষ্টির ছাঁটে যার অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছিল। সে জানতো রিয়া আর কখনও ফিরে আসবে না, তবুও চিঠিটা তার জন্য, তার অপ্রকাশিত অনুভূতির শেষ আশ্রয়।
চিঠিতে লেখা ছিল:
"তুই চলে গেছিস, কিন্তু আমার মনে তুই আছিস – সেই প্রথমদিনের মতোই, যখন তোকে বলেছিলাম – অঙ্ক শেখাব, আর তুই আমায় ভালোবাসতে শেখাবি।"
বৃষ্টিতে চিঠির অক্ষরগুলো পুরোপুরি ধুয়ে যায়, ঠিক যেমন রোহানের জীবনের সব রঙ, সব স্বপ্ন এই কঠিন বাস্তবতার কাছে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। তার ভালোবাসা শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কাছে পরাজিত হয়েছিল, আর সেই পরাজয় তাকে ঠেলে দিয়েছিল এক অনন্ত পাগলামির সীমানায়।

 নীরব প্রেমের বিয়োগান্তক পরিণতি। এটি শুধুমাত্র দুটি মানুষের ভালোবাসার গল্প নয়, এটি সমাজের শ্রেণীগত বিভেদ, পারিবারিক চাপ এবং ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও বাস্তবতার দ্বন্দের একটি চিত্র। রোহান ও রিয়ার প্রেম সেইসব ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি যা সমাজের অদৃশ্য বেড়া টপকাতে পারে না। রিয়ার নীরব আত্মসমর্পণ এবং রোহানের মানসিক অবক্ষয়, উভয়ই সেই কঠিন বাস্তবের ফল যেখানে ভালোবাসা শুধুমাত্র আবেগের উপর নির্ভর করে না, বরং ক্ষমতা, সম্পদ এবং সামাজিক অবস্থানের মতো বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এই গল্পটি আমাদের সমাজের এক কঠিন সত্য তুলে ধরে। রোহান ও রিয়ার ভালোবাসা বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ হলেও, তা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের সামনে তুচ্ছ হয়ে যায়। রিয়া চাইলেও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারে না, কারণ সে জানে এই লড়াইয়ে তার ভালোবাসার কোনো ক্ষমতা নেই। এই নীরব আত্মসমর্পণ রিয়ার অসহায়তাকে ফুটিয়ে তোলে। অন্যদিকে, রোহানের পরিণতি আরও মর্মান্তিক। ভালোবাসা হারানোর বেদনা তাকে এমন এক অন্ধকার পথে ঠেলে দেয় যেখানে সে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। তার চিঠি লেখা, দেওয়ালে নাম লেখা – এগুলি সবই তার গভীর ভালোবাসার প্রকাশ যা সমাজ মেনে নিতে পারেনি, তাই তা এক পাগলামিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
 ভালোবাসা যদি শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সামনে পড়ে, তা কখনো কখনো প্রেমকে পাগলামির সীমায় ঠেলে দেয় – এটি রোহানের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়। সমাজের নির্মম বাস্তবতা কীভাবে একটি সুন্দর সম্পর্ককে ভেঙে দিতে পারে এবং একজন মানুষকে কতটা একা করে দিতে পারে, এই গল্প তারই এক আবেগঘন দৃষ্টান্ত। এটি পাঠককে ভাবতে শেখায় ভালোবাসা, সমাজ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে।