১. ছায়ার ঘেরাটোপ
কলকাতার এক পুরনো, ভিড়ভাট্টা গলির মাথায় ছোট্ট ফ্ল্যাট। জানালার ধারে বসে ইরা সেন ছেলেকে পড়াচ্ছিল। অর্ণব, সাত বছরের ছেলেটা, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অঙ্ক কষছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, ঘরের ভেতর নিঃশব্দ। পাঁচ বছর আগের এক ঝড়ে ইরার জীবন বদলে গিয়েছিল। স্বামী অরূপের আকস্মিক মৃত্যু, শ্বশুরবাড়ির অবহেলা, আত্মীয়স্বজনের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া—সব মিলিয়ে জীবনটা ছায়ার মতো ঘন হয়ে উঠেছিল।
ইরা পড়াশোনায় ভালো ছিল, কলেজে বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিভাগে পাশ করেছিল। স্বপ্ন ছিল গবেষণা করবে, বড় লেখক হবে। কিন্তু বিয়ের পর সংসার, শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব, সন্তানের জন্ম—সব মিলিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে গুটিয়ে ফেলতে হয়েছিল। অরূপের মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ি তাকে আর রাখতে চায়নি। “বউয়ের দায়িত্ব শেষ, এখন নিজের মতো চল,” বলে বের করে দিয়েছিল।
ইরা এক হাতে অর্ণবকে ধরে, অন্য হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। কলকাতার এক বন্ধুর সাহায্যে এই ছোট ফ্ল্যাটে ওঠে। তখন থেকেই শুরু হয় নতুন লড়াই।
২. সংগ্রামের দিনগুলো
স্কুলে চাকরি পেতে ইরাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অভিজ্ঞতা নেই, পরিচিতিও নেই। একের পর এক ইন্টারভিউ, কোথাও চাকরি হয় না। শেষে একটা ছোট প্রাইভেট স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কাজ পায়। বেতন কম, কাজ বেশি। সকাল থেকে বিকেল, ক্লাসের পরে বাড়ি ফিরে অর্ণবকে পড়ানো, রান্না, ঘরের কাজ—সব মিলিয়ে দিনগুলো কেমন যেন একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল।
তবু অর্ণবের হাসি, তার ছোট ছোট চাওয়া—মা, একটা গল্প শোনাও, মা, আমার জন্য পায়েস বানাবে?—এইসব ইরার ক্লান্তি ভুলিয়ে দিত। মাঝে মাঝে রাতে জানালার ধারে বসে ইরা ভাবত, তার জীবনটা কি সত্যিই শুধু এই পর্যন্ত? কোথাও কি আলো আছে?
৩. পুরনো শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা
একদিন স্কুলের ছুটি শেষে ইরা এক NGO-এর সেমিনারে যায়। সেখানে দেখা হয় তার কলেজের বাংলা শিক্ষিকা মৃণালিনী বসুর সঙ্গে। মৃণালিনীদি গ্রামের মেয়েদের পড়ান, নারী শিক্ষার প্রচার করেন। ইরাকে দেখে তিনি খুশি হন, “তুই তো দারুণ লিখতি! এখনো লেখাসোনা?”
ইরা মাথা নাড়ে, “সময় পাই না, দিদি। সংসার, স্কুল, অর্ণব—সব মিলিয়ে...”
মৃণালিনীদি বলেন, “তুই তো জানিস, লেখার জন্য সময় বের করে নিতে হয়। তোর গল্প, তোর কবিতা—এগুলো শুধু তোর নয়, আরও অনেক মেয়ের কথা। চেষ্টা কর, দেখবি পারবি।”
ইরা সেই রাতে বাড়ি ফিরে পুরনো ডায়েরি খুলে বসে। অর্ণব ঘুমিয়ে পড়লে সে নিজের গল্প লিখতে শুরু করে। প্রথমে দ্বিধা ছিল, কেউ পড়বে তো? কেউ বুঝবে তো?
৪. “সাঁঝের আলো” ব্লগের জন্ম
এক রাতে সাহস করে ইরা একটা ব্লগ খুলে ফেলে, নাম রাখে “সাঁঝের আলো”। প্রথম গল্পটা পোস্ট করে—এক বিধবা মায়ের সংগ্রামের গল্প, যার মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পায় ইরা।
প্রথম কিছুদিন কেউ পড়ে না। ইরা হতাশ হয়, আবার লেখে। স্কুলের গল্প, অর্ণবের ছোট ছোট দুষ্টুমি, নিজের মনের কথা, কবিতা—সব কিছুই সে ভাগ করে নিতে থাকে।
একদিন এক অচেনা পাঠক মন্তব্য করেন, “আপনার গল্প পড়ে মনে হল, আমার কথাগুলোও কেউ বুঝেছে।” সেই মন্তব্য ইরার মনে আশার আলো জাগায়। ধীরে ধীরে পাঠক বাড়ে, মেয়েরা তার গল্পে নিজেদের খুঁজে পায়। কেউ বলে, “আপনার মতো আমিও একা, সাহস পেলাম।”
৫. রোহিণী ধরের আগমন
একদিন ইরার ব্লগে মন্তব্য করেন রোহিণী ধর, কর্পোরেট অফিসের এক সফল নারী, ইরার স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্রী। রোহিণী লেখেন, “আপনার লেখা আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমি নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালাই। আপনি যদি চান, আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।”
ইরা দ্বিধায় পড়ে। কর্পোরেট জগত, উদ্যোক্তা—এসব তার চেনা নয়। কিন্তু রোহিণী ফোন করে বলেন, “আপনি নিজের গল্প দিয়ে অন্য নারীদের সাহস দেন। এবার নিজের জন্যও কিছু করুন।”
অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে ইরা রাজি হয়।
৬. প্রশিক্ষণের দিনগুলো
প্রশিক্ষণে গিয়ে ইরা নতুন এক জগৎ দেখে। নানা বয়সের, নানা পেশার নারী এসেছে—কেউ হস্তশিল্প করেন, কেউ রান্না, কেউ লেখেন, কেউ ছবি আঁকেন। রোহিণী তাদের শেখান কীভাবে নিজের দক্ষতাকে ব্যবসায় রূপ দিতে হয়, কীভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হয়, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কাজ ছড়িয়ে দিতে হয়।
প্রশিক্ষণের শেষে ইরা বুঝতে পারে, তার লেখার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করা যায়। সে স্বপ্ন দেখে, বাংলার নানা প্রান্তের নারীদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে—যেখানে তারা নিজেদের গল্প, কবিতা, রান্না, হস্তশিল্প, সব কিছু শেয়ার ও বিক্রি করতে পারবে।
৭. প্রেম, সংগ্রাম ও প্রতিশোধ
প্রশিক্ষণে ইরার সঙ্গে পরিচয় হয় মধুমিতা নামে এক নারীর, যিনি স্বামী-সংসার ছেড়ে এসে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। মধুমিতার সাহস, সংগ্রাম ইরাকে আরও অনুপ্রাণিত করে।
এদিকে, ইরার শ্বশুরবাড়ি হঠাৎই তার জনপ্রিয়তা দেখে ফেরত নিতে চায়। তারা অর্ণবের অভিভাবকত্ব দাবি করে, “তুমি তো এখন বড় লেখিকা, আমাদের ছেলের দায়িত্ব আমাদের দাও।”
ইরা এবার আর ভয় পায় না। আইনি পথে লড়াই করে ছেলেকে নিজের কাছে রাখে। এই প্রতিশোধ শুধু শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে নয়, নিজের পুরোনো ভয়, হীনমন্যতার বিরুদ্ধেও।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন ইরার সঙ্গে পরিচয় হয় অরিন্দমের, একজন ওয়েব ডেভেলপার, যিনি তার প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে সাহায্য করেন। অরিন্দম তার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ইরা এবার নিজের পরিচয়, স্বপ্ন আর স্বাধীনতাকে সবার আগে রাখে।
৮. “আলোর মেলা”-র সূচনা
প্রশিক্ষণ শেষে ইরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে—“আলোর মেলা”। এখানে বাংলার নারীরা নিজেদের গল্প, কবিতা, রান্নার রেসিপি, হস্তশিল্প শেয়ার ও বিক্রি করতে পারে। অর্ণব মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট কাজে সাহায্য করে।
মৃণালিনীদি গ্রামের মেয়েদের এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করেন। গ্রামের মেয়েরা নিজেদের আঁকা আলপনা, পুতুল, রান্নার রেসিপি তুলে ধরে। শহরের মেয়েরা লেখে, ছবি আঁকে, কবিতা পাঠ করে।
ইরার জীবনে নতুন করে প্রেমও আসে—অরিন্দম তার পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু ইরা এবার কারও ছায়া হয়ে নয়, নিজের আলোয় বাঁচতে চায়।
৯. সাক্ষাৎকার ও উপসংহার
একদিন এক জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা ইরার সাক্ষাৎকার নিতে আসে। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কীভাবে এই অন্ধকার থেকে আলোয় এলেন?”
ইরা হাসে, বলে,
“আমি শুধু বাঁচিনি, বাঁচতে শিখেছি—নিজের জন্য, অন্য নারীদের জন্য। আমরা সবাই পারি, যদি আমরা একে অপরকে একটু আলো দেখাই। আমার গল্প শুধু আমার নয়, হাজারো নারীর—যারা ছায়া থেকে আলোয় আসতে চায়।”
সেই সাক্ষাৎকার পড়ে আরও অনেক নারী ইরার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কেউ বলে, “আপনার গল্প আমারও।” কেউ বলে, “আপনার প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চাই।”
১০. নতুন ভোর
“আলোর মেলা” ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়। ইরা এখন শুধু লেখিকা নয়, উদ্যোক্তা, অনুপ্রেরণা। অর্ণব মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বড় হতে শিখছে—সংগ্রাম আর সাহসের গল্প শুনে।
মৃণালিনীদি বলেন, “তুই শুধু নিজের জন্য নয়, গ্রামের মেয়েদের জন্যও আলো এনেছিস।” রোহিণী বলেন, “তুই প্রমাণ করেছিস—কঠিন সময়ের মধ্যেও আশার আলো থাকে।”
ইরা জানে, তার পথ এখনো শেষ হয়নি। সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ, আরও অনেক স্বপ্ন। কিন্তু এবার সে জানে, ছায়া যতই ঘন হোক, কোথাও না কোথাও আলো থাকে।
১১. শেষ কথা
এক সন্ধ্যায় ইরা জানালার ধারে বসে লেখে—
“আমরা সবাই পারি, যদি আমরা একে অপরকে একটু আলো দেখাই। প্রেম, সংগ্রাম, প্রতিশোধ—সব মিলিয়ে জীবন। ছায়া থেকে আলোয় আসার এই পথটা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়।”
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। অর্ণব এসে মায়ের পাশে বসে, “মা, গল্প শোনাবে?”
ইরা হাসে। জানে, তার গল্প এখন শুধু গল্প নয়—আলো ছড়ানোর গল্প, সাহসের গল্প, নতুন ভোরের গল্প।