রাত আটটা। বাইরে জোর বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এক মনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে রিতা।বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে হারিয়ে গেল অতীতে,
আজ থেকে আঠারো বছর আগে এরকমই এক ঝড় জলের রাতে দুই পরিবারের সম্মতিতে অগ্নি সাক্ষি রেখে সিঁথি তে সিঁদুর দিয়ে ওকে আপন করে নিয়েছিল নিলয়। কথা দিয়েছিল জীবনের সব পরিস্তিতি তে পাশে থাকবে। কথা টা মনে হতেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সে। না কথার খেলাপ করেনি নিলয়। দেড় বছর নিলয় একটুও বদলায় নি। সারা সপ্তাহ অফিস, সপ্তাহে একদিন লং ড্রাইভ, সিনেমা দেখা, মাঝে মাঝে শপিং... সবই চলছিল ঠিক ঠাক। সমস্যা হয় বা বলা ভালো নিলয় এর আসল রূপ ও দেখতে পায় ওদের বিয়ের দেড় বছর পর যখন রিতা র মা বাবা একইসাথে রোড আক্সিডেন্ট এ মারা যায়।
সেসময় রিতা খুব বেশি ভেঙে পড়ে ও চেয়ে ছিল তখন নিলয় এর হাত কে আকড়ে ধরতে, ওকে ভরসা করে বাঁচতে কিন্তু ওর এই স্বপ্ন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় শ্রাদ্ধের দিনই, বিকালে যখন নিলয় আর তার পরিবার সম্পত্তি র কথা তোলে আর জানতে পারে রিতার বাবা কোনো উইল করে যেতে না পারার জন্য সমস্ত সম্পত্তি রিতা র খুড়তুতো ভাই পাবে।
এটা শোনার পর থেকে বদলে যায় নিলয় আর তার পরিবারের আচরণ। তারপর থেকে তারা রিতা র সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে, ধিরে ধিরেএই আচরণ এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে রিতা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্ত ঠিক এই সময় রিতা জানতে পারে ও মা হতে চলেছে। রিতা ভেবেছিল এই খবর জানার পর হয়তো সবাই খুশি হবে,কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আচরণ করে তারা , আর নিলয়? ও তো রিতা র চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেই সাথে রিতা র গর্ভে র সন্তান কে অস্বীকার করে জানায় কোনো চরিত্র হীন এর জায়গা ওর বাড়িতে নেই।
না সেদিন আর অপমান, সহ্য করে ও বাড়িতে সে থাকেনি, বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি ছেড়ে , নিজের বাড়িতে ও ফিরে যায়নি। গিয়ে ছিল ওর দূর সম্পর্কে র এক মাসির কাছে। উনি এন জি ও তে কাজ করতেন। ওখানে ই ও থাকতে শুরু করে। একটু চেষ্টা করতে ই স্থানীয় একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি ও পেয়ে যায়। তাই কোনো সমস্যা হয়নি। দেখতে দেখতে ওর ডেলিভারি র সময় চলে আসে। নিদিষ্ট দিনে হাসপাতালে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। রিতা ওর মাসির ইচ্ছা তে নাম দেয় রণজয়।
তারপর বছর তিনেক পর একদিন হঠাৎ ই হার্ট অ্যাটাক করে মাসি মারা যায়। না এবার আর ভেঙে পড়ে নি রিতা, ও শিখে গেছে যে কোন পরিস্তিতিতে কি ভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়। মাসির মৃত্যুর পর তিন বছরের ছেলে কে নিয়ে সে কলকাতা চলে আসে। এই সময় তার বদলি হওয়ায় তাকে আসতেই হয় এই অচেনা শহরে।
এখানে এসে প্রথমে সে ইস্কুলে র হোস্টেলে থাকা শুরু করে তবে একজন অফিস কলিগের সহায়তায় দুই কামরার এই ফ্ল্যাটটা প্রায় জলের দামে পেয়ে গেছিল। তারপর থেকে আর খুব বেশি ভাবতে হয়নি ওকে। কালের প্রবাহে সময় এগিয়ে গিয়েছে, সেই সাথে জীবন ও। একমাত্র সন্তান কে ও মনে র মতো করে বড়ো করছে, সুশিক্ষিত করে তুলছে, তার ছোট ছোট বিষয়ে খেয়াল রেখেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে সকল আবদার কে। নিজের শত কষ্ট সহ্য করে ও হাসি মুখে ও সন্তান কে বড়ো করে তুলেছে।
তবে তার এই পথচলায় জয়ও যথেষ্ট স্যাক্রিফাইস করেছে। ও কখনো ই এমন কোনো আবদার করে নি যা রিতা রাখতে পারবে না, দিনের পর দিন বাড়িতে একা থেকে ও কখনো কোনো অভিযোগ করে নি। বরং এটা কে সে তার অভ্যাসে পরিনত করেছে।
রিতা র এই ভাবনায় ছেদ ঘটালো মোবাইলে র যান্ত্রিক ধ্বনি। ফোন টা হাতে নিয়ে রিতা দেখল স্কিনের উপর জ্বলজ্বল করছে জয় নামটা। রিতা আর এক মুহূর্ত ও দেরি না করে কল টা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল অত্যন্ত সুমধুর এক পুরুষালি কণ্ঠ্যস্বর ,"মা তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ফোন রিসিভ করছিলেনা কেন? তুমি ঠিক আছো তো?"
রিতা হেসে উত্তর দিল ,"হ্যাঁ বাবু, আমি ঠিক আছি, কিন্তু তুই কোথায় আছিস? এত বৃষ্টি হচ্ছে ভিজছো না তো? "
আবারো সেই সুমধুর কণ্ঠে ভেসে এল , "না মা, আমি আবিদ দের বাড়িতে আছি আর বলছিলাম যে এত বৃষ্টির মধ্যে আন্টি কিছুতেই যেতে দিচ্ছেন না তাই আজ রাত টা কি আমি এখানেই থেকে যেতে পারি? যদি তুমি পারমিশন দাও তাহলেই........... "
জয় ওরফে রণজয় কথা শেষ করার আগেই রিতা বলল,"ঠিক আছে এই বৃষ্টির মধ্যে তোকে আর বাড়িতে আসতে হবে না আজ ওখানে ই থেকে যা। এখন রাখছি তাহলে..... ।"
"ওকে মাম এন্ড থ্যাংক ইউ"....... এই বলে রণ ফোন রেখে দিল আর রিতা ও ভাবনার জগতে চলে গেলো তবে ওর মনটা এখন বিষাদাচ্ছন্ন। ও অতীত ছেড়ে এবার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করল,
রৌণক এর বয়স এখন ১৬। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১১ এ ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনা তে খুবই ভালো। আর মা কেও খুব ভালো বাসে। তবে রিতা ভাবছে অন্য কথা। রণর ছোটো থেকে ই ইচ্ছা ডাক্তারি পড়ার।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাই রণ হয়তো মেডিকেল এই ভর্তি হবে। তখন ওকে হোস্টেলে থাকতেই হবে, রিতা র সাথে সপ্তাহে একদিন হয়তো দেখা হবে...আচ্ছা রিতা কি তখন রণ কে ছাড়া থাকতে পারবে?
রণ কে ছাড়া থাকতে হবে এটা ভাবতেই রিতা র বুকটা টনটন করে উঠল। অজস্র ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে গত ১৬ বছর ধরে ওকে যে ও বড় করেছে, এক রাতে র জন্য ও যে ছেলে কে কাছ ছাড়া করেনি, তাকে ছেড়ে দিনের পর দিন কাটাতে হবে ভেবেই ওর দু চোখ জলে ভরে উঠল আর ঠিক এই সময় রিতা র মনে পড়ল আজ রাতে ও তো রণ বাড়িতে নেই.......... ।
--------সমাপ্ত--------