মধুডাঙ্গা নামে একটি ছোট্ট গ্রামে সরকারী চাকরি করতাম।আমার বাড়ি বেলেপুকুর, বাড়ি থেকে মধুডাঙ্গা ট্রেনে করে যেতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগত, সকালে ৭ টায় ট্রেন ধরে ৮ টার সময় পৌঁছে যেতাম। ফেরার সময় সন্ধ্যে ৬:৩০ ট্রেন ধরে ৭:৩০ টায় বাড়ি পৌঁছাতাম। বেশি ট্রেনে দাড়াতো না দু চারটে ট্রেন ছাড়া। তাই আমি রোজ এই ভাবেই যাতায়াত করতাম। আমি দুটো বছর ওই অফিসে কাজ করেছি, কোনোদিনই এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এক দিনের এক ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
আজ সেই ঘটনা আপনাদের বলবো, আপনারা শুনে হয়তো বলবেন বানানো ঘটনা, বা কাল্পনিক ঘটনা।
আপনাদের আর দোষ কি? আমি নিজেই যখন এই ঘটনার কথা ভাবি তখন আমি নিজেই বুঝতে পারি না কল্পনা নাকি ভৌতিক? কিন্তু সেই রাতে আমি যেটা দেখেছিলাম বা অনুভব করেছিলাম তা তো কল্পনা হতে পারে না, আর স্টেশন মাস্টার যা বলেছিলো সেটাও তো কল্পনা হতে পারে না!
আপনারাই শুনে ঠিক করুন, কল্পনা নাকি সত্যি ভৌতিক?
আমি আগেই বলেছি, আমার বাড়ি থেকে অফিস যেতে ১ ঘন্টা লাগতো, সকালের ট্রেনে বেরিয়ে বিকালের ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম। শনিবার আর রবিবার ছুটি থাকতো। তেমনই এক শুক্রবারে রতন বললো, "দাদা, আজ একটা ছোটখাটো পিকনিক হলে কেমন হয়? কাল তো শনিবার ছুটি, তাড়াতাড়ি অফিস আসার ও কোনো তারা নেই।"
রতন হলো আমাদের অফিসের কেয়ারটেকার, খুব ভালো ছেলে। আমি বললাম, "ঠিক আছে, কিন্তু মধু দা?"
মধু দা হলেন আমাদের অফিসের সিনিয়ার অফিসার, আমার থেকে বয়সে বড়, কিন্তু উনি আমাকে 'স্যার' না বলে দাদা' বলে ডাকার পারমিশন দিয়েছিলেন।
রতন বললো, "তুমি যদি রাজি থাকো, তাহলে উনিও রাজি"।
আমাদের অফিসে বেশি কর্মচারী নেই, গ্রামের ছোট্ট সরকারি অফিস তো তাই, আমাকে নিয়ে মোট পাঁচজন হবে। বাকিদের কথা বলে লাভ নেই, তাহলে গল্প বড় হয়ে যাবে।
আসল কথায় আসা যাক। আমি বললাম, "সব তো ঠিক আছে, কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার কী হবে?"
রতন বললো, "কেন? ৯ টার লাস্ট ট্রেনে ফিরে যেও"।
আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, কাল শনিবার, অফিস ছুটি,ভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার চাপ নেই। আমি বললাম, "তাহলে পিকনিকের ব্যাবস্থা কর।"
রতনই সব বাজার করে সব ব্যবস্থা করলো। অফিস টাইম শেষ হওয়ার পর আমাদের রান্নাবান্না শুরু হলো। ভাত, ডাল, আলুভাজা, মুরগির মাংস আর চাটনি, আর শেষে একটা রসোগোল্লা।
রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ হলো তখন ৮:৩০ বেজে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি স্টেশনে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলাম, কারণ পায়ে হেঁটে স্টেশনে যেতে হবে, গ্রামে এত রাতে কিছু পাওয়া যাবে না। পায়ে হেঁটে স্টেশন ২০ মিনিটের পথ।
আমি যখন বেরোতে যাবো, তখনই মধু দা বলে উঠলেন, "পলাশ, এত রাতে তোমায় যেতে হবে না, তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে চলো, কাল ভোরের ট্রেনে চলে যাবে।"
আমি বললাম, "না মধু দা, আমাকে রাতে বাড়ি ফিরতেই হবে কারণ মা,বাবর শরীরটা ঠিক নেই।"
মধু দা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, "ঠিক আছে, তবে যাও, কিন্তু সাবধানে।"
আমি মধু দা আর রতনকে গুড নাইট বলে বেরিয়ে পড়লাম। রাতে গ্রামের রাস্তা অন্ধকার, ঠিক করে কিছু দেখা যায় না, মোবাইলের আলো যতটুকু দেখা যায়, আর পেট ভোরে খাওয়ার ফলে জোরে চলতেও পারছি না। যখন স্টেশনে পৌঁছলাম দেখি চারিদিক ফাঁকা শুনশান কোথাও কেও নেই, আমি তাড়াতাড়ি ঘড়িটা দেখি ৯.১৫ বাজছে।
আমার বুঝতে একটুও দেরি হলো না যে, ট্রেন মিস করে ফেলেছি। এবার ভোর ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এবার বাকি রাতটা এই স্টেশনে কাটাতে হবে।
আমি একটা বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম, আর মধুদার কথা ভাবতে লাগলাম। মধু দা ঠিকই বলেছিলেন, ওনার সাথে ওনার বাড়িতে চলে গেলে ভালোই হতো। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ মেঘ ডাকার শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। চমকে উঠে দেখি চারিদিক নিস্তব্ধ অন্ধকার, এক-দুটো প্ল্যাটফর্মের লাইট জ্বলছে, তাতে ভালো করে কিছু দেখা যায় না। তার সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘ ডাকার আওয়াজ পরিবেশটা কেমন ভীতিকর করে তুলেছে,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজছে মানে এখনো অনেকটাই রাত বাকি আছে ভোর হতে। আমি ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের চারদিকে চোখ ঘোরাতে গিয়ে চমকে উঠি দেখি প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় একটা লোক স্যুট-বুট, আর মাথায় কালো টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার মনে হলো, আমি যখন প্ল্যাটফর্মে এসেছি তখন তো কাউকে দেখতে পাইনি, তাহলে এই লোকটা এলো কোথা থেকে? হয়তো আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তখন এসেছে। কিন্তু এই গ্রামে স্যুট-বুট পরা লোক! কে এই লোকটা?
এইসব ভাবতে ভাবতে যখন লোকটার দিকে আবার তাকিয়েছি, তখন আমার শরীর দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল।
দেখি লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে ঠিক ভালো করে কিছু দেখা না গেলেও লোকটার চোখের চাউনির যা তেজ, সেটা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগলো না। আমি দেখলাম, লোকটার দৃষ্টিতে কেমন যেন আগুন জ্বলছে, যেন প্রচুর রেগে আছে। আমি ভয়ে উঠে যেতে চাইলাম, কিন্তু উঠতে পারলাম না। মনে হলো কেউ যেন আমাকে ধরে রেখেছে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আর হাত-পা কাঁপছে,চিৎকারও করতে পারছি না, গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। আর চিৎকার করেও কোনো লাভ নেই,আমি আর ওই লোকটি ছাড়া এই তল্লাটে কেও নেই।
ঠিক তখনই দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ কানে এলো। মনে হচ্ছে কোনো ট্রেন আসছে স্টেশনের দিকে। এতে আমি একটু সাহস ফিরে পেলাম।
ট্রেনের দিকে চোখ ঘোরাতে দেখি ঝড়ো গতিতে একটা মালগাড়ি ধেয়ে আসছে প্ল্যাটফর্মের দিকে।
আমি ইঞ্জিনের আলোতে লোকটাকে ভালো করে দেখবো বলে যেই তাকিয়েছি, অমনি দেখলাম লোকটা এক দৌড়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিল।
ওই দেখা মাত্রই আমার আর কোনো জ্ঞান ছিল না।
যখন জ্ঞান হলো, তখন দেখি স্টেশন মাস্টারের ঘরে শুয়ে আছি, আর সামনে স্টেশন মাস্টার আর লাইনম্যান দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে চোখ খুলতে দেখে বললো, "কী বাবু, আপনি রাতে স্টেশনে কী করছিলেন?" আমি আস্তে আস্তে পুরো ঘটনাটা জানালাম। তখন আমার সব কথা শুনে স্টেশন মাস্টার বললেন, "আপনি তাহলে ওনার দেখা পেয়েছেন।"
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, "ওনার দেখা মানে?"
তখন স্টেশন মাস্টার বলে উঠলেন, "আরে, অনেক বছর আগে এই স্টেশনে এক সাহেব স্টেশন মাস্টার ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে সুইসাইড করেছিলেন। ওনাকে নাকি রাতে দেখা যায় ট্রেনের সামনে ঝাঁপাতে।" আমি শুনে তো কিছু না বলে চুপচাপ ট্রেনে চেপে বাড়ি চলে আসি।
তারপর থেকে এই ঘটনা যখনই মনে পড়ে বুঝতে পারি না, আমার মনের ভুল, না সত্যিই ভৌতিক?
এরপর অনেক চেষ্টা করে আমি অন্য জায়গায় ট্রান্সফার নিয়ে নি।