Read Jharapata - 5 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 5

ঝরাপাতা

পর্ব - ৫

🌵🏜🌵🏜🌵🏜🌵

রনিকে ঘিরে ধরে যখন বোঝানো হচ্ছে, মিলিকে বিয়ে করে ফেলতে, ঠিক তখন মিলিকেও একই ভাবে বোঝানো চলছে, রনিকে বিয়ে করতে। মিলিকে অবশ্য ওর কাকা কাকিমা বেশ ধমকেই বলছেন। ওদের বোনেদের জন্য যদি তাঁর দাদার একটা কিছু হয়ে যায় ! অর্থাৎ, লিলির অন্যায়ের অর্ধেক দায়ভার ইতিমধ্যেই মিলির ঘাড়ে চেপে গেছে। এক্ষুণি বিয়েতে হ্যাঁ না বললে, সম্পূর্ণ ওর দোষ হয়ে যাবে। 

মাও সেভাবেই চাপ দিয়েই বলছে, "তোদের এত স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ করলাম, যখন যা চেয়েছিস, তাই দিয়েছি, তার ফল তো একজন হাতে নাতে দিয়ে গেছে। তুইই বা বাকি থাকিস কেন। তুই এখন বিয়ে করবি না বলে আমাদের যেটুকু মান বাঁচত সেটাও শেষ কর।"

ওর মেসোমশাই কেবল সবাইকে একরকম ধমকে শান্ত করে। মেসো মনোজই ও বাড়িতে এভাবে ধমকেই গোপার কান্না থামিয়েছে। নিজে ভাল করে মিলিকে বলে, "তোর কি ইচ্ছে বল? ঘর, বর সবকিছুর কথাই তো তুই জানিস। আর এখানে বিয়ে হলে তোর কিছুই অসুবিধাও নেই। একরকম বাবা মায়ের কাছে বাড়িতেই থাকবি। কি রে?"

গোপাও এবার মনোজের দেখাদেখি শান্ত হয়ে, মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "তুই রাজি হবি না মিলি? তোর বাবা....... " বাবা যে মিলির প্রাণ, মিলি মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, "ওমা, তোমরা যা বলবে আমি করব। আমি তো তোমার সব কথা শুনি। এবারও সব শুনব মা, তুমি ভয় পেও না, আমি সবকথা শুনব।"

রনিকে নিয়ে সবাই মণিকার সামনে এসে দাঁড়ায়। মণিকা পিঠ খাড়া করে সোজা হয়ে বসেছে এদের দেখে। মায়ের টেনশনে ভরা মুখটা দেখেই রনি ঠিক করে, আর কোনো আপত্তি করবে না। 

মণিকা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রনি বলে, "মা তোমার কি ইচ্ছে বলো। তুমি যা চাও তাই হবে।"

- "রনি, তুই তো জানিস, তোর পিসিরা কি অপমান করেছে আমাকে সারাজীবন। তারপর বনির এত ভাল বিয়ে হল বলে ওদের গা জ্বলে। তোরও ভাল বিয়ে হবে শুনে হাজার নাটক করে ফেলল। এখন বিয়ে না হলে যে আমার আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।" মণিকা আবার কেঁদে ফেলে। 

- "মা তুমি কেন কাঁদছ? আমি তো তোমার কথামতোই চলব। আমি শুধু তোমার মত জানতে চেয়েছি। তুমি কি চাও মিলিকে বিয়ে করি?"

- "আর কি করব এখন? মিলি ছাড়া কাকে পাব? উপায় থাকলে ওদের মেয়েকে কক্ষণো এ বাড়িতে ঢুকতে দিতাম না। বরং ওদের চোখের সামনে তোর বিয়ে দিতাম। এখন ঐ এক মিলিই আছে। তুই ওকেই বিয়ে কর রনি।" 

দু বাড়িতেই খবর পৌঁছয়, বিয়েটা হচ্ছে। সবাই ঝেড়েঝুড়ে উঠে, যার যা দায়িত্ব ছিল, সেগুলোর হাল ধরে। কেউ খাবারের ব্যবস্থা দেখে তো কেউ গাড়ি সাজানো। অবশ্য রনি ওর ঘরেই চলে যায়। এর মধ্যে ওর কজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এসেছে, তারা সঙ্গে যায়। বন্ধুদের মুখেও এই ঘটনারই নানান দিক। রনি হুঁ হ্যাঁ করে শুনছে। 

ওর এক মামাতো বোন একবার চা মিষ্টি দিয়ে গেছে সবাইকে, পিউ পাঠিয়েছে বলে। বেলা বারোটা নাগাদ পিউ এসে ডাকে, গায়ে হলুদ হবে। 

- "গায়ে হলুদ মানে? এখন আমাকে গায়ে হলুদও করতে হবে?" রনি ভুরু কুঁচকে তাকায়। 

- "তা বিয়ে যখন হচ্ছে, যতটা সম্ভব নিয়মগুলো ঠিক করে করি। তোমার একটা মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপার আছে তো। যা হয়েছে তা হয়েছে। ও মেয়ে একদম সময়মতো বিদায় হয়েছে। এখন সব নিয়ম হবে, আর সেগুলো মিলির জন্যই হবে।" ছোটমামী বলে। 

পিউ তাল দেয়, "ঠিক বলেছ মামী। বিয়ের কথা হয়েছিল, নিয়ম রীতি কিছু তো হয়নি। এখন ভাইয়ের গায়ে হলুদ হবে। সেই হলুদ মিলির গায়ে লাগবে। ব্যস, নিয়ম মেনেই বিয়ে হবে।" 

রনির অসহ্য লাগছে ভাবতে, মিলির সঙ্গে ওর জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। বিয়ে মানে শুধু বিয়েটুকুই হত, না এরা তো সর্বস্ব করাবে ওকে দিয়ে ! 

বিয়ে করতে বসে রনি টের পায়, বিয়ে মানে কখনোই শুধু বিয়েটুকু না। মিলির সঙ্গে যেন সাত জন্মের বন্ধন তৈরি হয়, সেভাবেই বিয়ের নিয়ম রীতি সাজানো। বরণের সময় থেকে দাদা ওর পাশে গঁদের আঠার মতো চিপকে আছে আর গলা নামিয়ে বলে যাচ্ছে, "মুখটা এত কালো করে রাখিস না। সবাই দেখছে, আরও কথা বাড়বে। এমন হাবভাব দেখা যেন কিছু হয়নি।"

তাই করার চেষ্টা করছিল রনি। শুভ দৃষ্টির সময় মিলির দিকে তাকিয়েও ছিল। মিলি একে তাকায় না, যাও বা পাড়ার বৌদের হাসিঠাট্টা চেষ্টায় মুখ তুললো, ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাথা নিচু। যেন ও সাধ করে বিয়ে করতে এসেছে, ও সাধ করে মিলির দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর যন্ত্রের মতো রনি যে যা বলছে সমস্ত নিয়ম পালন করে গেল। মুখে রাগ, দুঃখ, আপত্তি কোনো ভাবই নেই। এমনকি টুকাই আনন্দ করছে, হাততালি দিচ্ছে, কাকাইয়ের সঙ্গে ছবি তুলছে, রনি নির্বিকার ওর দাবী মিটিয়ে গেল। 

বাসরঘরেও সবাই জমিয়ে বসেছিল, এর ভাই, ওর বোন, বন্ধুবান্ধব। রনিকে জামাকাপড় ছাড়াতে নিয়ে গেছিল বনি। ও এসেই আড়চোখে দেখে নিয়েছে মিলি উপস্থিত। প্রথমেই পিউর খোঁজ করে শুনল, পিউ বাড়ি গেছে। মা আর বড়মাইমা বাড়িতে। ওদের সঙ্গে দেখা করে, টুকাইকে ঠামের কাছে রেখে, জামাকাপড় ছেড়ে আসছে। বনি আনতে গেছে। 

বড়মামার ছেলে সাত্যকি আর মেয়ে সুবর্ণ ছিল, ওদের বলে জল এনে দিতে। ঘরেই জলের বোতল ছিল, সাত্যকি এগিয়ে দেয়। প্রায় একবোতল জল খেয়ে ফেলে বাসরঘরের জন্য যে ঢালাও বিছানা করা হয়েছে, সেটার একধারে একটা তাকিয়া মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে। সাত্যকি আর কয়েকজন চেঁচামেচি করে, আজ শুয়ে পড়লে হবে না। রনি এত গম্ভীর ভাবে মাথা ধরেছে বলে, বাকিরাও কথা বন্ধ করে বসে থাকে। 

পিউ আর বনি ফিরে এসে শুনে বলে, ওকে বিরক্ত না করতে, একটু বিশ্রাম নিক। মিলি এইসব দেখে চুপ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওকে তুতো বোনেরা ডেকে নিয়ে যায় আরেক ঘরে। সাজানো বাসরঘরে বনি, রনি আর ওদের কাজিন, বন্ধুরা শুয়ে পড়ে। কারও ঘুম আসে, কেউ সারারাত জেগে থাকে, যেমন রনি।

অত্যন্ত সাদামাটাভাবে বিয়ের জন্য ভাড়া করা বাড়ি মিলি থেকে স্বামীগৃহে রওনা দেয়। বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার পর এই অনুষ্ঠান হয়। 

সারাদিন রনি বন্ধুদের সঙ্গে সেঁটে ছিল, বনির সঙ্গেও খুব একটা কথাবার্তা বলেনি। অবশ্য কারণও ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবে চা নিয়ে বসেছে ছেলেরা, মিলির মাসি আর কাকিমা, সঙ্গে আরও দুজন প্রতিবেশী মহিলা এসে রনিকে বলে, বাসী বিয়ের সময়ের আগে স্নান সেরে বিয়ের জোড়টাই আবার পরে নিতে। দুই প্রতিবেশী হঠাৎ নিজেদের মধ্যে বলে বসে, এইটুকু নিয়ম হলেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, ব্যস ঝামেলা চুকবে। কথাটা হয়ত সমস্ত সমস্যা মিটে আগামীতে ভালই হবে অর্থেই বলা, রনির মুহূর্তে মনে পড়ে, ওকে আর ওর পরিবারকে এই ঝামেলায় পড়ে পুঁচকে একটা মেয়েকে আচমকা বিয়ে করতে হল। 

সেই বিগড়োনো মুড রনির আর ঠিক হয়নি। বরং বাড়ি ভর্তি লোক, এই অপছন্দের বিয়েতে আচার অনুষ্ঠানের হিড়িক, তার ফাঁকে ফাঁকে কুৎসিত ঘটনাটা নিয়ে থেকে থেকেই কারও না কারও মন্তব্য ক্রমশ বিরক্তি বাড়ায়। প্রথম যখন বাধ্য হয়ে হলেও মিলিকে বিয়ে করলে এই সংকট কাটবে ভেবে এগিয়েছিল, মাকে কথা দিয়েছিল মিলিকে বিয়ে করবে, সেই সময়ে বরং মানসিক শান্তি ফিরে পেয়েছিল রনি। আর বৌভাতের সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের পর খারাপ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা দূরে থাক, বিয়ের সিদ্ধান্তের পরের শান্তিটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। 

মিলির দিকে তো কেউ ফিরেও তাকায়নি। যে দু একটা নিয়ম পিউর বেলায় বাদ ছিল, সবাই হৈচৈ করেছে, আরে ছাড়ো ছাড়ো, ওসব এক মুঠো চাল দিয়ে ঋণশোধ হচ্ছে মানুষকে অপমান করা, তারা সবাই চুপ করে ছিল। আর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে প্রত্যেকটি নিয়ম পালন করে গেছে মিলি। সকলে লোকজন, অতিথি আপ্যায়ন, তাদের বাঁকা কথার উত্তর দিতে ব্যস্ত। মিলি কি খাবে, পরবে, কোথায় একটু বিশ্রাম করবে, কেউ দেখেনি। তাতেও বোধহয় লিলির পাপের পুরো প্রায়শ্চিত্ত করে উঠতে পারেনি বেচারি, আরও বাকি ছিল। 
 

চলবে