অধ্যায় ২: শহরের পোস্টার
ভোরের আলো ফুটতেই কলকাতার শহর যেন নতুন এক সাজে সেজে উঠতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশার আবরণ সরে গেলে চোখে পড়ে বাড়ির দেওয়াল জুড়ে নতুন রং-এর আঁচড়। লাল, সবুজ, নীল, গেরুয়া – যত রঙের খেলা সম্ভব, সব যেন মিশে আছে সেই দেওয়ালে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কে বেশি পোস্টার লাগাতে পারে, কার ব্যানার বেশি উঁচুতে উড়তে পারে, কার পতাকার রং বেশি ঝলমল করতে পারে।
শহরের মূল সড়ক থেকে সরু গলিপথ—কোথাও ফাঁকা নেই। বিদ্যুতের খুঁটি থেকে শুরু করে মোড়ের দোকানের টিনের ছাউনি পর্যন্ত ভরে গেছে কাগজে ছাপানো মুখ, হাসিমুখে হাত নেড়ে চলেছে প্রার্থী, সাথে বড় বড় অক্ষরে স্লোগান— “পরিবর্তনের অঙ্গীকার”, “উন্নয়নের পথে বাংলা”, “নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন” ইত্যাদি।
কলকাতার একটি সাধারণ দিনেও ভিড় থাকে, কিন্তু ভোটের সময় যেন শহরটা এক অদ্ভুত উৎসবে মেতে ওঠে। রিকশাওয়ালা গাড়ির হুডে ছোট ছোট পতাকা লাগিয়ে ঘুরছে। ট্যাক্সির পিছনে লাগানো পোস্টার গলির ভেতর গড়গড় করে ঢুকে পড়ছে। চায়ের দোকানে বসে থাকা শ্রমিক, ছাত্র, দোকানি—সবাইকে ঘিরে ভোটের আলাপ।
শহরের প্রতিটি দেওয়াল যেন হয়ে উঠেছে এক একটি ক্যানভাস। রাতভর রঙের বালতি হাতে কাজ করেছে রাজনৈতিক কর্মীরা। কারো হাতে ব্রাশ, কারো হাতে রোলার। কেউ স্লোগান লিখছে—
“আমরা মানুষের পাশে”,
“বাংলা চায় উন্নয়ন”,
“গরিবের সরকার”…
ভোর হলে সেই লেখা শুকিয়ে যায়, আর মানুষ অফিস যাওয়ার পথে থেমে দু’একবার পড়ে নেয়। অনেকেই হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
—“এবার বুঝি আবার বিনামূল্যে চাল দেওয়া হবে।”
আবার কেউ চোখ পাকিয়ে বলে,
—“শুধু দেওয়ালে লিখলেই কি হবে? কাজ কোথায়?”
এই দেওয়ালই যেন মানুষের মনোভাবের আয়না। কারো চোখে আশা, কারো চোখে অবিশ্বাস।
দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়ালে বোঝা যায় শহরের আসল চেহারা। রাস্তার ডিভাইডারের ধারে বাঁশ পুঁতে বিশাল ব্যানার টাঙানো। হাসিমুখে এক প্রার্থী দুই হাত তুলে ভোট চাইছেন। তার পাশেই আরেক দলের প্রার্থীর বিশাল মুখ—গম্ভীর ভঙ্গি, নিচে লেখা—“আমরা আছি, আমরা থাকব।”
একই মোড়ে পাশাপাশি তিন-চারটি বড় ব্যানার বাতাসে উড়তে থাকে। মনে হয় যেন কাগজের সেই মুখগুলোও একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ? তারা সেই মুখগুলোর দিকে তাকিয়েও আবার ব্যস্ত রোজকার জীবনে। বাস ধরতে হবে, স্কুলে বাচ্চাকে পৌঁছে দিতে হবে, দোকান খোলা রাখতে হবে। তবে চোখের কোণে থেকে যায় রঙিন সেই পোস্টারের ছাপ।
ব্যালগঞ্জের এক গলিতে রাতভর কাজ করেছে কিছু যুবক। সাদা কাগজে প্রিন্ট করা শত শত পোস্টার তারা একসাথে আটকে দিচ্ছিলো দেওয়ালে। হাতে ব্রাশ, গাম, কাগজের রোল। হাসি-ঠাট্টা করতে করতে কাজ চলছিল।
একজন বলল,
—“এবার যদি আমাদের দল না জেতে, তাহলে শপথ করছি আমি আর কোনোদিন পোস্টার লাগাতে নামব না।”
আরেকজন হেসে উত্তর দিল,
—“তাহলে তোদের জন্য সরকার চাকরি আনবেই না!”
হাসির রোল উঠলো। আসলে এই উন্মাদনা শুধু রাজনৈতিক নয়, একধরনের উৎসবও। ভোট মানেই কাজের সুযোগ, সামান্য কিছু টাকা রোজগার, আবার একাত্মতার অনুভূতিও।
কিন্তু সব সময় এতটা সহজ নয়। একদল রাতভর পোস্টার লাগালে, ভোরের দিকে আরেক দল এসে তার উপর নিজেদের পোস্টার সেঁটে দেয়। আবার কোথাও দেখা যায়, আগের পোস্টারের মাঝখানটা ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। দেওয়ালের গায়ে দুই দলের রঙ মিশে গিয়ে যেন তৈরি করেছে এক নতুন কোলাজ—রাজনীতির বিশৃঙ্খল সৌন্দর্য।
এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া বাঁধে। অনেক সময় গলির ভেতর দু’দলের কর্মীরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গাড়ি আসে, একটু চেঁচামেচি হয়, তারপর আবার থেমে যায়। কিন্তু দেওয়ালে লেখা শব্দগুলো মুছে যায় না—সেগুলো থেকেই যায় শহরের বুকজুড়ে।
শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা প্রায়ই বিরক্ত হয়ে বলেন,
—“এই পোস্টারের জ্বালায় দেওয়ালের সৌন্দর্য গেল।”
তাদের কারো নতুন রঙ করা বাড়ি এক রাতেই ভরে গেছে কাগজের স্তরে।
আবার তরুণ প্রজন্ম কেউ কেউ মজা খুঁজে পায়। তারা মোবাইলে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে—“শহরের সবচেয়ে বড় মুখ কার?” বা “আজকের ব্যানার যুদ্ধ!”
একজন কবি টাইপ মানুষ হয়তো সেই দেওয়াল দেখে লিখে ফেলেন—
“রঙিন দেওয়ালের আড়ালে কত স্বপ্ন চাপা পড়ে থাকে।”
সূর্য যখন পুরোপুরি উঠে যায়, তখন সেই পোস্টারগুলো আরও স্পষ্ট হয়। বাজারের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ একবার তাকিয়ে দেখে। অটোচালক গাড়ির কাঁচে টাঙিয়ে রেখেছে ছোট্ট এক স্টিকার—যাতে তার পছন্দের দলের প্রতীক। দোকানের সামনে কাগজের পতাকা উড়ছে হাওয়ায়।
মনে হয় শহরের শিরা-উপশিরায় ভোটের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতার প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি রাস্তা যেন এখন রাজনৈতিক রঙে আঁকা। শহরের পোস্টার শুধু কাগজ নয়—এটি শহরের মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি, স্বপ্ন, আশঙ্কা আর ভবিষ্যতের পথের এক অদ্ভুত দলিল।
শহরের সকাল যত এগোতে থাকে, ততই পোস্টারগুলোর চারপাশে জমতে থাকে আলোচনা। রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডে—যেখানেই মানুষ কিছুটা থামে, সেখানেই ভোট আর রাজনীতির কথা।
কলেজ স্ট্রিটের চেনা চিত্রটা এসময় বদলে যায়। বইয়ের দোকানগুলির শাটারের গায়ে একটার পর একটা পোস্টার। কোথাও শাসকদলের তরুণ প্রার্থীর হাসিমুখ, কোথাও বিরোধীদলের লড়াকু স্লোগান। বই কিনতে আসা ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই থেমে দু’একটা পোস্টার মন দিয়ে পড়ে নেয়।
একজন ছাত্র তার বন্ধুকে বলে,
—“শোন, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ, কিন্তু কাজের জায়গা কোথায়? আমাদের তো ডিগ্রি হাতে নিয়েও বেকার বসে থাকতে হচ্ছে।”
বন্ধুটি হেসে উত্তর দেয়,
—“তাহলে এবার ভোটটা কাকে দেবে?”
—“দেখি, এবার কার পোস্টার সবচেয়ে বিশ্বাস জাগায়।”
পোস্টার কেবল কাগজ নয়, তরুণ প্রজন্মের কাছে সেটাই আলোচনার সূচনা।
শহরের প্রাণভোমরা হলো চায়ের দোকান। গড়িয়াহাট মোড়ের এক দোকানে সকাল থেকেই ভিড়। বেঞ্চিতে বসা চারজন লোক পোস্টার দেখে গরম চা খেতে খেতে আলাপ করছে।
একজন বৃদ্ধ বললেন,
—“আমাদের সময়ে দেওয়াল লিখনেই নির্বাচন হতো। তখন কালি-কলম দিয়ে গলির গলির দেওয়ালে লিখত। এখন তো প্রিন্টিং প্রেসে রঙিন পোস্টার বেরিয়ে আসছে।”
একজন যুবক হেসে বলল,
—“কাকু, তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। এখন পোস্টার মানে শুধু দেওয়াল নয়, ফেসবুকেও স্লোগান ঝড়ে।”
আরেকজন যোগ করল,
—“কিন্তু চায়ের দোকানের গরম গপ্পোর মতো জায়গা কোথায় আর আছে? ভোটের আসল রং তো এখানেই।”
চায়ের দোকানগুলো যেন শহরের ছোট সংসদ, আর পোস্টারগুলো সেই সংসদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
শহরের নির্মাণ শ্রমিকেরা সকালে কাজে যাওয়ার সময় পথের ধারে টাঙানো পোস্টারের দিকে তাকায়। ধুলোবালির মধ্যে ঘামে ভিজে থাকা তাদের শরীরে যেন একটু স্বপ্ন জাগে।
একজন শ্রমিক তার সহকর্মীকে বলল,
—“দেখেছিস? ওই প্রার্থী বলছে সস্তা বাড়ি করে দেবে। যদি সত্যিই হয়, তাহলে বস্তির কষ্ট থেকে মুক্তি পাব।”
অন্যজন মাথা নেড়ে বলে,
—“কথা তো অনেকেই বলে রে ভাই। কাজটা কতজন করে?”
তাদের চোখে পোস্টার মানে আশা আর সংশয়ের মিশ্র রং।
দুপুর নাগাদ শহরের রাস্তায় নামল এক রাজনৈতিক মিছিল। হাতে ব্যানার, মাথায় দলীয় টুপি, গলায় স্লোগান। পোস্টারগুলো সেই মিছিলের পাশে যেন দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। হুইসেল বাজছে, ঢাকের শব্দ, আর হাজার কণ্ঠের একসাথে চিৎকার—“আমাদের প্রার্থীকে চাই!”
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধা বললেন,
—“এত লোকের ভিড়! কিন্তু শেষমেশ তো আমাদের চাল-ডালের দামটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
মিছিল আর পোস্টার একসাথে শহরকে রঙিন করে তোলে, আবার বিভক্তও করে ফেলে।
কলকাতার আর্ট কলেজের ছাত্ররা এবারের ভোটে নতুন মাত্রা এনেছে। তারা সাধারণ প্রিন্টেড পোস্টারের পাশাপাশি তৈরি করেছে বিশাল দেওয়ালচিত্র। রঙিন ব্রাশের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলছে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন—একজন কৃষক, একজন শ্রমিক, একজন শিক্ষক, একজন ছাত্র—সবাই হাত ধরে এগোচ্ছে আলোর দিকে।
কেউ লিখে রেখেছে—“ভোট মানে শুধু দল নয়, নিজের ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়া।”
এই শিল্পীসুলভ দেওয়ালচিত্র দেখে পথচারীরা থেমে যায়। কেউ ছবি তোলে, কেউ করতালি দেয়। পোস্টারের ভিড়ে এই শিল্পকর্মগুলো এক অন্যরকম আবেদন তৈরি করে।
সন্ধের দিকে গলির মাঠে বাচ্চারা খেলা করতে করতে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে হাসে। তাদের কাছে এগুলো রঙিন কাগজের ছবি মাত্র। কেউ বলে,
—“দেখ, ওই কাকু হাসছে, আবার ওই কাকু খুব গম্ভীর!”
তাদের কাছে রাজনীতি কোনো জটিল ব্যাপার নয়—শুধু বড় বড় মুখ আর চমকপ্রদ রং।
শহরের প্রতিটি মানুষের কাছে পোস্টার ভিন্ন অর্থ বহন করে। কারো কাছে তা আশা, কারো কাছে বিরক্তি, কারো কাছে কেবল রঙিন ছবি। কিন্তু একটা কথা সবাই মানে—ভোটের সময় কলকাতা অন্যরকম হয়ে ওঠে, আর সেই অন্যরকম চেহারার কেন্দ্রে থাকে এই পোস্টারগুলোই।
শহরের দিন শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হয় অন্য এক ব্যস্ততা। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর, যখন অফিস ফেরা মানুষরা বাস ধরতে হুড়োহুড়ি করছে, তখনই রাজনৈতিক কর্মীরা গোপনে বেরিয়ে আসে হাতে রঙের বালতি, গাম আর পোস্টারের রোল নিয়ে। শহরের রাত যেন নতুন এক মঞ্চ, যেখানে দেওয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি নিয়ে লড়াই শুরু হয়।
বৌবাজারের সরু গলিতে রাত দশটার পর টের পাওয়া গেল চার-পাঁচজন যুবক পোস্টার লাগাচ্ছে। হাতে মোটা ব্রাশ, বালতিতে গাম। কেউ একজন পোস্টার ধরে দেয়, আরেকজন ঝটপট সেটি দেওয়ালে আটকে দেয়।
একজন বলল,
—“তাড়াতাড়ি কর, কাল ভোরের আগে এগুলো শুকিয়ে গেলে ভালো থাকবে।”
অন্যজন যোগ করল,
—“হ্যাঁ, না হলে ভোরেই প্রতিপক্ষ এসে এর উপর তাদের পোস্টার লাগিয়ে দেবে।”
এই প্রতিযোগিতা শহরের প্রতিটি দেওয়ালে চলে। কার মুখ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে, কার স্লোগান সবচেয়ে বড় হবে—সেই হিসেবেই রাতভর যুদ্ধ চলে যায় কাগজ আর আঠার মধ্যে।
কিন্তু সব সময় এত সহজে শেষ হয় না। মাঝেমাঝি প্রায়ই একদল কর্মী এসে দেখে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর পোস্টার দেওয়ালে ঠাঁই নিয়েছে। আর তখনই শুরু হয় ঝগড়া।
একবার মানিকতলায় দুই দলের মধ্যে বড়সড় সংঘর্ষ বাঁধল। একদল পোস্টার লাগাচ্ছিল, হঠাৎই অন্য দল এসে চিৎকার শুরু করল—
—“এই দেওয়াল আমাদের এলাকার, এখানে তোমরা কিছু লাগাতে পারবে না!”
কথা থেকে কথা বাড়ল, হাতে থাকা বাঁশ, লাঠি নিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তে চারপাশে হট্টগোল, পাশের বাসিন্দারা জানালা খুলে আতঙ্কে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়ি এসে সাইরেন বাজিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিল।
পুলিশ সবাইকে সতর্ক করল—“পোস্টার লাগাতে হলে অনুমতি নিতে হবে, নইলে কড়া ব্যবস্থা।”
কিন্তু সবাই জানে, ভোটের সময় এসব নিয়ম কাগজেই থাকে, বাস্তবে দেওয়াল মানেই প্রতিযোগিতা।
রাতের শহরে পুলিশের টহল বাড়ে। অনেক জায়গায় তারা দাঁড়িয়ে নজর রাখে, যাতে অশান্তি না হয়। লালবাজার থেকে বারবার বার্তা যায়—“ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।”
তবুও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা জানে কিভাবে পুলিশকে এড়িয়ে চলতে হয়। যেখানে পুলিশ নেই, সেখানেই দ্রুত কাজ শেষ করে ফেলে তারা। অনেক সময় আবার পুলিশকেও রাজনৈতিক চাপে নির্দিষ্ট দলকে সহ্য করতে হয়। ফলে দেওয়ালের লড়াই থেমে থাকে না।
এই পোস্টার যুদ্ধের প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ঘুমের ওপরও। টালিগঞ্জের এক বৃদ্ধা রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে দেখলেন বাড়ির দেওয়ালে কাগজ চেপে লাগানো হচ্ছে। তিনি জানালা খুলে চেঁচিয়ে বললেন,
—“এই কী করছেন? ঘুমোতে দিচ্ছেন না তো!”
একজন কর্মী হেসে উত্তর দিল,
—“কাকিমা, এটা তো সবার মঙ্গলের কাজ, ভোটের কাজ।”
বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে বললেন,
—“আমার দেওয়ালটাই তো গেল মঙ্গলে!”
এই ছোট ছোট ঘটনাই শহরের ভোট-আবহে হাসি-কান্নার মিশ্র চিত্র তুলে ধরে।
রাত বাড়তে থাকে। রাস্তার বাতির আলোয় চকচক করে নতুন সেঁটে দেওয়া পোস্টার। কোথাও কাগজের উপর ভেজা আঠা শুকোয়নি, বাতাসে উড়ে কাগজের কোণা নাচছে। অটো, ট্যাক্সি, বাইকের হেডলাইট পড়তেই মনে হয় দেওয়ালের মুখগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে—কেউ হাসছে, কেউ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে।
শহরের রাত তাই শুধু নিস্তব্ধ অন্ধকার নয়, বরং রাজনৈতিক উন্মাদনার রঙিন ক্যানভাস।
সকালে অফিসযাত্রী মানুষ নতুন পোস্টার দেখে অবাক হয়। গতকাল যেখানে অন্য দলের স্লোগান ছিল, আজ সেখানে নতুন মুখ। অনেকে মুচকি হেসে বলে ওঠে—
—“আহা, এ তো আসল দেওয়াল যুদ্ধ!”
শহরের প্রতিটি দেওয়ালই যেন আজকে সংবাদপত্র। প্রতিটি ছবি, প্রতিটি শব্দ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—ক’দিন পরেই বড় সিদ্ধান্তের দিন।
রাতের দেওয়াল যুদ্ধ শেষে ভোরের আলো ফুটতেই শহর আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এবার শহরের রঙিন পোস্টার ছড়িয়ে পড়ে কেবল দেওয়ালে নয়—মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে। বাজার, ট্রাম, বাস, অটো—যেখানেই চোখ যায়, ভোট আর পোস্টারের প্রতিচ্ছবি যেন ভেসে ওঠে।
শহরের সকাল মানেই বাজারের কোলাহল। শ্যামবাজারের হাটে ভিড় জমেছে। মাছের গন্ধ, সবজির ডাক, ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষির মাঝেও সবার চোখে পড়ছে নতুন টাঙানো পোস্টার। বাজারের গেটের গায়ে একদিকে শাসকদলের রঙিন ব্যানার, অন্যদিকে বিরোধীর ঝলমলে পোস্টার।
একজন সবজি বিক্রেতা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“এই পোস্টারে কত টাকা খরচ হয় জানেন? যদি তার অর্ধেকটা দুধ-ডিম সস্তা করতে খরচ করত, তাহলে মানুষের উপকার হতো।”
পাশ থেকে এক ক্রেতা হাসতে হাসতে উত্তর দিল,
—“তা ঠিক, কিন্তু ভোটের আগে এসব রং না ছড়ালে মানুষ ভোট দিতে যাবে কেন?”
বাজারের ভিড়ে কথার ঝলকানি চলতেই থাকে। পোস্টার যেন এখানেও মূল আলোচনার কেন্দ্র।
কলকাতার পুরোনো ট্রামও ভোটের সময় রঙিন হয়ে ওঠে। জানালার পাশে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে দেওয়ালের সারি সারি পোস্টার। ভেতরে বসে থাকা যাত্রীরাও আলোচনা চালায়।
একজন স্কুলশিক্ষক তার সহযাত্রীকে বললেন,
—“দেখুন, প্রতিদিন নতুন নতুন মুখের পোস্টার দেখি। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়াতে কি কেউ কথা বলে?”
পাশে বসা এক কলেজছাত্রী বলে উঠল,
—“কথা তো সবাই বলবে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, আমাদের ভবিষ্যৎ কে গড়বে?”
ট্রামের ধীরে চলা গতি আর জানালার বাইরের দ্রুত পাল্টানো পোস্টার যেন মিলেমিশে তৈরি করে রাজনীতির অদ্ভুত ছন্দ।
বাসে চড়ে অফিসযাত্রী মানুষকে ঘিরে থাকে আরও সরব রাজনীতি। অনেক বাসের গায়েই দেখা যায় বড় বড় ব্যানার বাঁধা। বাসের ভেতরে হ্যান্ডেলে ছোট পতাকা ঝুলছে।
কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে উঠল,
—“সিটে উঠুন, সিটে উঠুন!”
কিন্তু সিটে বসা যাত্রীরা একদিকে জানালা দিয়ে পোস্টার পড়ছে, অন্যদিকে নিজেদের দলের পক্ষ নিয়ে তর্ক করছে।
একজন বলল,
—“আমাদের দলে যত উন্নয়ন হয়েছে, অন্য কেউ করতে পারত না।”
অন্যজন জবাব দিল,
—“উন্নয়ন হয়েছে? নাকি শুধু দেওয়াল ভরে পোস্টার হয়েছে?”
বাসের ভেতর হট্টগোল থামতে চায় না। মনে হয় শহর যেন প্রতিদিন রাস্তায় বেরিয়ে গণভোট করছে।
গড়িয়াহাট, শিয়ালদহ, ধর্মতলা—যেখানেই যান, মাইকের আওয়াজে ভরে গেছে চারদিক। পোস্টারের পাশাপাশি চলছে রেকর্ড করা গান ও স্লোগান।
“আমাদের দল মানেই মানুষের দল!”
“উন্নয়নের হাত ধরে চলুন সবাই!”
রাস্তার মোড়ে লাউডস্পিকারের আওয়াজ গড়গড় করে বেজে ওঠে। পোস্টার আর গান মিলে শহর যেন এক উৎসবে মেতে ওঠে।
কিন্তু এর মধ্যেই বিরক্তি জমতে থাকে। এক দোকানি চুপ করে বসে থেকে বলল,
—“সারাদিন এই আওয়াজে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ভোট তো ক’দিন পরেই, কিন্তু আমাদের শান্তি আজই উড়ে গেল।”
শহরের মধ্যবিত্ত মানুষদের মন সবচেয়ে বেশি দোলাচলে। অফিস ফেরার পথে তারা পোস্টার দেখে ভাবে—কাকে ভোট দেব? কেউই যেন পুরোপুরি ভরসা জাগাতে পারে না।
একজন ব্যাংককর্মী বাসায় ফেরার পথে বললেন,
—“শাসক দল অনেক কাজ করেছে, কিন্তু দুর্নীতিও হয়েছে।”
তার স্ত্রী উত্তর দিলেন,
—“তাহলে কি বিরোধীদের ভোট দেব?”
—“ওরা আবার ক্ষমতায় এলে কেমন হবে, তাও তো ভেবে দেখা দরকার।”
পোস্টারের ভিড় যেন তাদের মনে দ্বিধা তৈরি করে—কাকে বেছে নিলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে?
দিন শেষে বোঝা যায়, শহরের প্রতিটি কোণে টাঙানো পোস্টার শুধু প্রার্থীর ছবি নয়, বরং সমাজের মনের প্রতিচ্ছবি।
বাজারের কোলাহল, ট্রামের জানালা, বাসের হট্টগোল, রাস্তার গান, মধ্যবিত্তের চিন্তা—সবকিছুর মাঝেই পোস্টার এক অদ্ভুত সংলাপ চালিয়ে যায়।
এটা শুধু রাজনৈতিক কাগজ নয়, বরং শহরের মানুষের আশা, অভিমান, দ্বিধা আর স্বপ্নের রঙিন প্রতীক।