অধ্যায় ৩ : রাজনৈতিক সভার ঢেউ
মঞ্চের প্রস্তুতি
সূর্যটা অনেমি, অর্ধেক লুকিয়ে, অর্ধেক ক্লান্ত। শহরের বড় মাঠ—যে মাঠে সাধারণত নববর্ষে মেলা, দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হত—আজ রূপরেখা বদলে নিয়েছে। কাঁটা বাঁশ আর প্রায় ভাঙা ব্যানারের ভাঁজে বাজি-বিস্ফোরণের বদলে এখন বাজছে বিশাল স্পিকার, জেনারেটরের কাবার, আর মানুষের কদমচাপ—যা একযোগে একটা ভিন্নরকম উত্তেজনা তৈরি করছে।
রাতভর লোকেরা কাজ করেছে; এখন ভোরে কাজ চলছে শেষ মুঠোয়। ধুলোর মধ্যে জড়িয়ে আছে কফির কাহালি, তরুণ কর্মীদের উচ্চস্বরে নির্দেশ, এবং দূরে কোথাও দোকানির চিমটি ধরে চা-চক্র। এই চা-চক্রই আজকের রাজনীতির এক অদৃশ্য প্যারা—চায়ের কাপের ধোঁয়ায় ভাসমান আলোচনা, সূচনা-কথা, ও আশাব্যঞ্জক শোরগোল।
মঞ্চ বানানো হচ্ছে—বাঁশে বাঁধা ফ্রেম, প্ল্যাস্টিকের কাপড় টেনে দেয়া ব্যানার; ব্যানারে নেতার বিশাল মুখ, বড় অক্ষরে স্লোগান: “উন্নয়ন দিচ্ছি — আবার আমার কণ্ঠে অস্তিত্ব”, “জনতার শক্তি, জনহিত নিশ্চিত”—এগুলো যখন বাতাসে দোল খায় তখন শহরের স্বাভাবিক রূপটা একেবারে বদলে যায়। কাজ চলছে সুনির্দিষ্ট টাইমলাইনে—নিয়োজিত কর্মীরা দ্রুত কাজ করে, কেউ মাইক টেস্ট করে, কেউ ফ্লাডলাইট বসাচ্ছে, কেউ মঞ্চের পাশ-বতী স্থাপন করে।
আদর্শভাবে এটি এক মিলিত প্রয়াস—কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি সিদ্ধান্তে লুকিয়ে আছে এক ধরণের তীব্র প্রতিযোগিতা। কোথায় ব্যানার লাগবে, কার লোগো কোথায় বড় হবে—এই ছোটখাটো নকশা-চিন্তা অনেক সময় কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে দিতে পারে। অজস্র ত $(sic)$—ভিতরে একজন কাজের তালে বলে উঠল, “এই কোঠায় আমাদের নেতার নাম বড় লাগবে; ওরা একই জায়গায় তাঁদের লোগো দিলে চোখে পড়বে না।” কাজের ছন্দে অন্যজন ততক্ষণে ব্যাঙ্গ করে বলে, “নাম বড় হলে কি কাজ বাড়ে?”—এমন রসবোধ ধরে কাজ চলেই চলছে।
মাঠের পাশের পথ ধরে একটা ছোট দল দাঁড়িয়ে আছে—লোকাল সমরনী। তারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে উঠেছে, তাদের কপালে শুকনো পরিশ্রমের ছাপ; পালক মতো আঁটচাঁট পোশাক নয়, পরিহাসহীন কাজ। তাদের মধ্যে একটি মুখ—আরজন, কেবল উচ্ছ্বাসে ভরা। সে বড় করে বলে, “আজ আমাদের মিছিলটা যাতে ঠিকমতো দাঁড়ায়—সেই চিন্তা আছে।” পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ এক কথা বলে—“তোমরা তো জানো—মানুষকে এখানে এনে রাখা আর তাদের চোখে স্বচ্ছ আশা দেখানো দুই আলাদা কাজ। আশা দেখাও, কিন্তু কাজ হবে কি—সে আলাদা প্রশ্ন।” বৃদ্ধের কণ্ঠে আছে অভিজ্ঞতার তিক্ততা, এবং তরুণের চোখে আছে ভোরের মতো ভোরে জেগে থাকার জেদ।
পুলিশের টহল মাঠের চারপাশ জুড়ে। ইনস্পেক্টর রায়—এক হাতে কিবর্ড, অন্য হাতে হালকা রেডিও—ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে লোকজনকে দেখছেন, অনুকরণীয় শান্তচিত্র। তিনি কয়েকবার বকাঝকা করেন—“সব সিট ভরে রাখো না, উদ্ধারপথ খোলা থাকতে হবে।” প্রশাসনিক তরুনদের দায়িত্ব হলো—ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে অশান্তি না হয়। কিন্তু পুলিশও জানে—ভোট মানেই আবেগ; আবেগ কিছুতেই প্রতিরোধ করা যায় না, সে শুধু পথচিহ্ন গঠন করে।
এদিকে সরবতা ছড়ানো হচ্ছে—এক টিম মাইক-টেস্টিং করছে। সঙ্গীতের সঙ্গে স্লোগান, স্লোগানের সঙ্গে হাস্যরস—সবকিছুই এখানে ঠিকঠাক হওয়া উচিত। সাউন্ড টেকনিশিয়ানরা মুদ্রা-ভাঙা মুহূর্তে ব্যস্ত—বড় মাইকের ভারসাম্য ঠিক করতে হবে, যাতে নেতার কথাগুলো একেক কণায় পৌঁছে যায়। তাদের চোখে ক্ষুদ্র উদ্বিগ্নতা—“বলে ফেলুন, ওরা কতক্ষণ বকবেন?”—ওদের উত্তর আসে বিদ্রুপমিশ্র হাসি দিয়ে।
মঞ্চের পিছনদিকে একটি ছোট গ্রুপ দাঁড়িয়ে আছে—ট্রান্সপোর্ট আয়োজকরা। ট্রাক, ভ্যান, অটো—সবকিছু সিঞ্চিত হয়েচাছে। একটি বাহন ব্যানার-ভর্তি হেডে দাঁড়িয়ে আছে; মালিক, অর্ণব নামে এক যুবক, বারবার চেক করছেন—ব্যান্ডার কাগজ ভেজা না হয়, রঙ ফেডে না যায়। সে বলে, “ভোরটা শুকনো থাকলে ভালো—গরমের সঙ্গে কালি ছিঁড়ে যায়।” তাঁর কণ্ঠে ব্যবসায়ীর হিসেব আছে—কীভাবে প্রচারণায় ব্যয় কমিয়ে কাজ নিকটস্থ করা যায়।
চায়ের দোকানগুলো ঠিক পাশেই; তরুণ কর্মীরা এক গ্লাস চা খেয়ে আবারও কাজে নেমে যায়। একটি বুথের কাছে মহিলা দল মিটিং করছে—রুমা, দলের এক অঙ্গনবাড়ি সংগঠক—তার চেহারায় এক অদ্ভুত স্থিরতা, হাতে তালিকা, তালিকায় আছে নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর। সে বারবার বলে, “বলে রাখো—আমরা ভোরেই বুথে পৌঁছাব; কেউ অনুপস্থিত থাকলেই ফোন করো।” তার কণ্ঠে আছে পরিকল্পিত কার্যকলাপের চামড়া—এটাই প্রত্যেক জনসভা সফল করার একটা নেপথ্যগত চাবিকাঠি।
কিন্তু সবটাই সুখস্মিত নয়। কাউকে নালিশ আছে—কেউ বলে মাইকে শব্দ কম পড়ছে, কেউ বলছে বড় ব্যানার অনেকটা “মুখোশ” লেগে যাচ্ছে—কিছুটা ব্যক্তিগত আঘাত লুকিয়ে রয়েছে। একটা ছোট মিটিং বসে—চেয়ারম্যান-শৈল্পিকরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কী কী ঐতিহাসিক রেফারেন্স মঞ্চে উত্থাপন হবে—কোন বক্তৃতায় কোন ঘটনা উল্লেখ হবে, কাকে কবে আনবো। নাট্যকারের মতোই মঞ্চ সাজানো হচ্ছে—রাজনৈতিক বক্তৃতা যেন নাটকীয় সুসংগঠিত কাহিনি।
মাঠের এক প্রান্তে সাংবাদিক আছেন—ছোটখাটো ক্যামেরা, নোটবুক হাতে তরুণ রিপোর্টাররা। তাদের চোখে ব্রেকিং নিউজের তৃষ্ণা। তাঁরা ভাবছেন—কী এমন ঘটতে পারে যা একটা শিরোনাম বানাবে? হয়তো নেতার তীক্ষ্ণ বক্তব্য, হয়তো কিছুকিছু অনির্বচনীয়—একটা স্লোগান যা ভাইরাল হবে। তাঁরা ফোনে বসে খোঁজ নিচ্ছেন—“কোন অস্বাভাবিকতা আছে কি?”—কথা চলছে। খবরের সরবরাহ আজকের সভার আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা—নেতার ভাষণে কি এমন কিছু টান আছে যা পাঠক-দর্শককে কাঁপিয়ে তুলবে?
মাঠের উপরের অলাহদায় কেবল কাজ-চলার ছন্দ নয়, আছে মানুষের নিখুঁত সামান্য প্রকৃতি—এক বৃদ্ধা নারী এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে একটি ক্ষীণ কাগজের তালিকা—“আমার পরিবারের সকলের নাম এখানে আছে,” তিনি বলে উঠলেন; তাঁর কণ্ঠে কাঁটা—“আমার পুত্র বেকার, ক'দিন ধরে কোনো কাজ পায় না। যদি সত্যিই কাজ দেয়া হয়…” তাঁর বাক্য অর্ধেকেই স্তব্ধ হয়ে গেল। আশার ও হতাশার মিশ্রণ গড়ে ওঠা এই বাক্যগুলো মঞ্চের সাজে যেন খাপ খায় না। রাজনীতিবিদদের পোস্টারে লেখা বড় বড় প্রতিশ্রুতি তাঁর কানে এক ব্যথার ঢেউ তুলছে।
মাঠে পরিচিত ছোট ঘটনা ঘটছে—একটি ট্রাক ব্যানার নামাতে গিয়ে গীটারের মতো ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল; ব্যানারের লাইন ছিঁড়ে গেল। একদল কাজু-র মজুর ঝাঁপিয়ে পড়ল সমস্যাটা ঠিক করে দিল। এমন ছোট ঘটনাগুলো মঞ্চে বড় নাটকের প্রস্তুতির ক্ষুদ্র ব্যস্ততা। রোগে-শরীরের মতোই, মঞ্চও সাহচর্য ও সমস্যা নিয়েই কর্মরত।
প্রকাশনার কাজ শুরু হয়েছে—চালের গিটতি, লিফলেটের বোঝাই, ও প্রচার পুস্তিকা—সবকিছু সযত্নে সাজানো। তরুণরা লিফলেট বিলি-করা নিয়ে আলোচনা করছে—কিন্তু মাঝে মাঝে বিতর্ক চটেছে—কোনেকটি লিফলেট বড় করে এক নেতার ব্যক্তিগত প্রচার করে, এবং এক নেতা কড়া লাইন টেনে বলেছেন—“আমি ব্যক্তি নই, আমি আদর্শ।” আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব—এই দ্বৈততা রাজনীতির অন্তর্গত মূর্ছনায় বেজে উঠছে।
আবার, একটা বিন্দুতে টানাপোড়েন দেখা গেল—গ্রুপটি সিদ্ধান্ত নিলেও একটি ক্ষুদ্র সমিতি দাবি করল তাদের বুথগুলো “সরকারি” নম্বর থেকে বেশি দূরে দিয়েছি, যেখানে লোক আসবে না; তারা বলছে, বিরোধী দলের কর্মীরা ঐ বুথে ঢুকবে—এমন শুনতে পেয়ে ছোট একটি ধাক্কা-টানপোড়ন ঘটে। পুলিশ আবার আসে, কথা বলে, কড়া নোটিশ ঝুলিয়ে রাখে—“বিবাদ না বাড়াতে সবাই সচেতন থাকুন।”
মাঠ জুড়ে এখন সময় পাল্টাচ্ছে; সূর্য একটু একটু করে উঠে আসছে। মঞ্চ তৈরি, স্পিকার ঠিক, ব্যানার ঝোলানো—তবে একজন তরুণ কর্মীর চিবানো ঠোঁটই দিনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। সে বলে, “এবারের সভায় যদি ভিড় না হয়, তাহলে সমস্ত কষ্ট বৃথা।” আরেকজন বলে, “ভিড় হবে; মানুষ আশা নিয়ে আসে।” এই কথাগুলো একরকম হিমশীতল বাস্তববাদ ও উত্তেজিত আশার মিশ্রণ—শহরের হৃদয়ে আজ এমনই লড়াই চলছে।
শেষমেষ, মঞ্চের নীচে একটি ছোট দল কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আছে—তারা সবার সঙ্গে ছবি তুলছে, সেলফি নিচ্ছে, যেন আজকের দিনটি স্মৃতিচিহ্ন করা জরুরি। ইতিহাস লিখবে না কী, তা বলার উপায় নেই—কিন্তু প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে আজ সকালে গেঁথে আছে একটুকু আশা; হয়তো নেতার ভাষণ, হয়তো কর্তৃত্বের প্রতিশ্রুতি, হয়তো তাদের জীবনের সে ছোটখাটো বদল—এটুকুই প্রতি জনসভায় প্রত্যাশিত।
মাঠ যখন পুরোপুরি সাজে ফেলল, তখন অনেকে সংযমে দাঁড়িয়ে এক প্রশ্ন করে—এই মঞ্চ কি কেবল কাগজ-রঙের অলংকার নাকি সত্যি কি কোন মানুষের জীবনে নতুন আরম্ভ আনবে? আকাশে ব্যানারের প্রান্ত দোল খায়; মঞ্চের পিছনে রুমা তালিকা চেপে দাঁড়িয়ে আছে; ইনস্পেক্টর রায় ব্যারিকেডে চোখ রেখে আছেন—সবাই যেন অপেক্ষা করছে, যে মুহূর্তে মঞ্চ হেঁটে উঠবে নেতাদের পদক্ষেপ, আর সভার ঢেউ পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
জনতার ঢল
ভোরের প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর শহরের বড় মাঠে যেন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে এল। চারপাশের রাস্তাগুলো তখন একের পর এক মানুষে ভরে উঠছে। দূর গ্রামের দিক থেকে ট্রাক ভর্তি লোক এসে নামছে—কেউ মাথায় গামছা, কেউ হাতে লাঠি, কেউ আবার ঝোলায় জলভরা বোতল। ট্রাকের গায়ে ঝোলানো দড়ি ধরে তারা লাফিয়ে নামছে, তারপর হাঁকডাক করতে করতে মিছিলের মতো করে মাঠের দিকে এগিয়ে আসছে।
রাস্তার দু’পাশে তখন পতাকা উড়ছে। লাল, সবুজ, নীল, হলুদ—বিভিন্ন রঙের মিশ্রণে শহরের দৃশ্যপট যেন এক বিশাল কোলাজ হয়ে গেছে। একটা দলতালিকা যেন চোখের সামনে: প্রতিটি পতাকা বলছে—“আমরা আছি”, প্রতিটি স্লোগান ধ্বনিত করছে—“আমরাই জিতব।”
মাঠের গেটে পৌঁছেই শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু ভিড় এমন যে একেবারে ঢেউয়ের মতো সামনে ঠেলে দিচ্ছে সবাইকে। কনস্টেবলদের মুখ লাল হয়ে উঠছে, ঘামে ভিজে যাচ্ছে ইউনিফর্ম। একজন অফিসার লাউডস্পিকারে বলে চলেছেন—
—“একসাথে ভেতরে ঢুকবেন না, ধীরে ধীরে আসুন। ভিড় করলে দুর্ঘটনা ঘটবে।”
কিন্তু জনতার উচ্ছ্বাসে কে শোনে কথা!
চা-ওয়ালার দোকানের সামনে তখন ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনা শুরু। কয়েকজন যুবক গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলছে—
—“আজকের সভা ইতিহাস গড়বে। এত ভিড় আমি আগে কখনও দেখিনি।”
পাশের এক বৃদ্ধ সিগারেট টানতে টানতে হেসে উত্তর দিলেন—
—“বাপু, ভিড় তো প্রতি ভোটেই হয়। ইতিহাস গড়া হয় মানুষের জীবনে, মাঠে নয়।”
তর্কে উত্তাপ বাড়ল, আবার হঠাৎ করেই থেমে গেল। কারণ রাস্তা ধরে আসছে আরেক দল মিছিল। হাতে ঢাক, বাজনা, স্লোগান। তারা আসতেই চারদিক যেন কেঁপে উঠল—
“আমাদের নেতা, আমাদের আশা!”
“পরিবর্তন চাই, এবার চাই!”
শহরের পথঘাট তখন এক বিশাল মঞ্চে পরিণত হয়েছে। যে যেদিকে তাকায়, কেবল মানুষ। কেউ মাথার উপর পতাকা উড়াচ্ছে, কেউ ঢোল পেটাচ্ছে, কেউ গান গাইছে।
মাঠের ভেতরে ঢুকেই মানুষের ভিড় জমে উঠছে ঢেউয়ের মতো। চারদিকের গ্যালারিগুলো ভরে যাচ্ছে। মঞ্চ থেকে যতদূর চোখ যায়, কেবল মাথার পর মাথা। কিশোররা গাছে উঠে গেছে, কেউ লাইটপোস্টে উঠেছে, কেউ আবার ব্যারিকেডের উপরে বসেছে।
এক কোণে দেখা গেল দু’জন রিকশাওয়ালা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে—
—“বাবা রে, এত মানুষ! আজ কামাইও গেল।”
—“কামাই গেলেও লোকটা যদি আমাদের দিকে একটু নজর দেয়, তাহলে মন্দ কি!”
রিকশাওয়ালাদের চোখে আশা, কিন্তু সেই আশা কেমন অচেনা। তারা জানে, প্রতিশ্রুতি অনেকবার শোনা হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে ক’বার? তবু মানুষের মন চায়—হয়তো এবার কিছু বদল হবে।
এদিকে মাঠের একদম মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একদল ছাত্র। তাদের হাতে ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড—“শিক্ষা চাই”, “কাজ চাই”, “বেকারত্ব হ্রাস করো।” কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও তাদের চোখে আছে এক অদ্ভুত সংশয়। পাশের এক বৃদ্ধা এসে হেসে বললেন—
—“বাবারা, প্ল্যাকার্ড ধরে থাকো, হয়তো চোখে পড়বে।”
তরুণদের একজন বলল—
—“চোখে পড়ুক বা না পড়ুক, আমাদের দাবি আমাদেরই বলতে হবে।”
এই দৃশ্য যেন শহরের চিত্রকল্প—প্রতিটি কোণে মানুষের দাবি, প্রতিটি মুখে আলাদা আলাদা আশা।
মাঠের বাইরে দোকানিরা সুযোগ নিতে ভোলেনি। ভাজা পেঁয়াজি, ঘুগনি, গরম চা, বাদাম—সবকিছুই চলছে বিক্রির ধুম। বাচ্চারা লাফাচ্ছে, নারীরা হাত ধরে চলছে, বৃদ্ধরা সিঁড়ির ধাপে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। সভা যেন একদিকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, অন্যদিকে এক বিশাল মেলা।
হঠাৎই কোথাও থেকে ভেসে এলো স্লোগান—
“আমাদের নেতা আসছে!”
চারদিকের মানুষ একসঙ্গে নড়েচড়ে উঠল। মাথার সমুদ্র তখন ঢেউ তুলল আরও তীব্রভাবে। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে সবার চোখ জ্বলজ্বল করছে।
এ যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুৎ—যা লাখো মানুষের ভিড়কে এক সুরে, এক আবেগে বেঁধে ফেলছে।
নেতাদের আগমন ও মঞ্চে উত্তেজনা
মাঠ তখন পুরোপুরি জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। যতদূর চোখ যায়, মাথার উপর মাথা, পতাকার নাচন, আর গলার হাহাকার। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই মাইক্রোফোন থেকে এক শব্দ ভেসে এল—
—“নেতা এসেছেন, দয়া করে সবাই শান্ত থাকুন।”
এক মুহূর্তে যেন শহরের বাতাস থমকে গেল। তারপরই গর্জন করে উঠল লাখো মানুষের গলা—
“জয়! জয়! জয়!”
দূর থেকে দেখা গেল এক লম্বা কনভয়ের গাড়ি ধীরে ধীরে মাঠের গেট দিয়ে প্রবেশ করছে। কালো কাচওয়ালা গাড়ি, সামনে-পেছনে পুলিশি এসকর্ট, সাইরেনের ঝকঝকে আলো। জনতার ঢল সামলাতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। একদিকে লোকজন সামনে এগোতে চাইছে, অন্যদিকে ব্যারিকেডের ভেতরে নিরাপত্তা কর্মীরা ঠেলে ঠেলে তাদের পিছনে সরাচ্ছে।
গাড়ি থেকে নামলেন প্রথমেই কয়েকজন স্থানীয় নেতা। তাদের পেছনে পেছনে জনতার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুখ—দলের রাজ্য সভাপতি। সাদা পাঞ্জাবি, ধবধবে ধুতি, কাঁধে গামছা, আর ঠোঁটে সেই চেনা হাসি। তিনি নামতেই চারদিক থেকে ভেসে এলো স্লোগানের ঝড়—
“আমাদের নেতা, আমাদের আশা!”
“আমরা আছি, আমরা থাকব!”
নেতার চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষ হাত নাড়ছে, কেউ ফুল ছুঁড়ছে, কেউ আবার ভিড়ের মধ্যে থেকে মোবাইল তুলে ছবি তুলছে।
মঞ্চে ওঠার জন্য তৈরি ছিল লাল কার্পেট পাতা সিঁড়ি। পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে, যাতে সাধারণ ভিড় সেখানে ঢুকতে না পারে। নেতা ধীরে ধীরে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। তার সঙ্গে দলের অন্যান্য বড় নেতারা, যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভক্তগোষ্ঠী রয়েছে।
মঞ্চে উঠেই নেতা দু’হাত তুলে অভিবাদন জানালেন। ভিড় তখন যেন একসঙ্গে গর্জে উঠল। স্পিকারে ভেসে এল স্লোগান, ঢাকের আওয়াজ, আর ভিড়ের অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।
এদিকে মঞ্চের ভেতরে সাংবাদিকরা দ্রুত তাদের ক্যামেরা ঠিক করছে। ফটো সাংবাদিকরা ঝুঁকে ঝুঁকে ছবি তুলছে, কেউ মঞ্চের একদম সামনের সারিতে, কেউ আবার গ্যালারির উপরে উঠে গেছে। তাদের লেন্সে ধরা পড়ছে নেতা-জনতার সংযোগের সেই প্রথম মুহূর্ত।
মাঠের ভেতরে তখন উত্তেজনা চরমে। এক বৃদ্ধা মেয়েকে কাঁধে তুলে ধরে বলছেন—
—“দেখো মা, এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ।”
তরুণদের একটি দল শিস দিয়ে স্লোগান তুলছে—
—“আমাদের দাবি, এবার পূরণ হোক!”
পাশেই আবার একদল মানুষ চাপা গলায় বলছে—
—“প্রতিশ্রুতি তো আগেও দিয়েছিল, এবার কী আলাদা হবে?”
মঞ্চে বসার আসনগুলো ভরে গেছে। সামনের সারিতে বিশিষ্টরা, বড় নেতারা, সাংসদ-মন্ত্রী। মাঝখানে রাখা হলো সেই বিশেষ আসন—যেখানে মূল বক্তা বসবেন। তার সামনে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস, মাইক সাজানো, আর একপাশে রাখা মোটা ফাইল—যাতে লেখা বক্তৃতার খসড়া।
নেতা বসতেই ভিড় আবার গর্জে উঠল। মঞ্চে বসা নেতারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে—কে কোন অংশে কথা বলবেন, কে কোন প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করবেন।
হঠাৎই এক স্লোগান বাতাসে ছুটে এলো—
“কাজ চাই, কাজ চাই!”
ভিড়ের এক কোণ থেকে আসছিল কণ্ঠস্বর। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মঞ্চে এক অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই দলের কর্মীরা স্লোগানের ঢেউয়ে ঢেকে দিল—
“জয়! জয়! জয়!”
স্পষ্ট বোঝা গেল—এই জনসভা শুধু বক্তৃতার নয়, আবেগেরও যুদ্ধক্ষেত্র। নেতারা জানেন, প্রতিটি চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, প্রতিটি কান অপেক্ষা করছে নতুন প্রতিশ্রুতির জন্য।
মঞ্চ তখন একেবারে প্রস্তুত। ভিড় সামলাতে পুলিশ ঘেমে-নেয়ে একসা। সাংবাদিকরা কলম চালাতে শুরু করেছে। নেতারা মাইকের সামনে দাঁড়ানোর অপেক্ষায়। আর মাঠের জনতা নিঃশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করছে—কি বলবেন তাদের নেতা, কোন স্বপ্ন দেখাবেন এবার?
বক্তৃতার ঝড় ও প্রতিশ্রুতির বন্যা
মঞ্চ প্রস্তুত। জনতা গর্জন করছে, আর নেতা দু’হাত তুলে চারদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। মুহূর্তেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল—যেন হাজার হাজার মানুষ একসাথে শ্বাস আটকে রেখেছে।
মাইকের শব্দ হালকা কেঁপে উঠল—
—“ভাই ও বোনেরা…”
কথাটা শেষ হতেই মাঠ কেঁপে উঠল হাততালিতে। স্লোগান আবার গর্জে উঠল, যেন বজ্রপাত। নেতা দু’হাত তুলে জনতাকে শান্ত হতে বললেন। তারপর তিনি শুরু করলেন তার ভাষণ।
“আপনারা জানেন, এত বছর ধরে আমি আপনাদের পাশে আছি। এই মাটি, এই মানুষই আমার শক্তি। আমি রাজনীতি করি না ক্ষমতার জন্য, রাজনীতি করি আপনাদের জীবনের উন্নতির জন্য।”
মাঠ থেকে শোনা গেল—“জয়!” “আমাদের নেতা!”
নেতা কণ্ঠ উঁচু করে বললেন—
“শহরে আজ যেসব সমস্যা—বেকারত্ব, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, হাসপাতালের অভাব—সবকিছু আমরা বদলাবো। এই শহরের প্রতিটি ছেলে-মেয়ের হাতে আমরা চাকরি তুলে দেব। প্রতিটি পরিবারকে আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা দেব। এই মাটিতে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না, কেউ বেকার থাকবে না!”
প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গে ভিড় যেন পাগল হয়ে উঠল। স্লোগানের শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল। কারও চোখে স্বপ্ন, কারও চোখে সংশয়।
মঞ্চের অন্য নেতারা চেয়ারে বসে হাততালি দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন। সাংবাদিকদের কলম ও ক্যামেরা থামছেই না। প্রতিটি বাক্য যেন শিরোনাম হয়ে উঠছে।
এরপর নেতা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ শুরু করলেন—
“যারা এতদিন এই শহর শাসন করেছে, তারা আপনাদের কী দিয়েছে? রাস্তা? কাজ? নাকি শুধু প্রতিশ্রুতি? আমি আপনাদের কাছে মিথ্যা কথা বলব না। আমি যা বলি, তা করি।”
মাঠের এক কোণ থেকে আবার শোনা গেল—“হ্যাঁ, ঠিক বলছেন!”
আরেক কোণ থেকে আবার চাপা গলায়—“আগেরবারও তো এসবই বলেছিলেন।”
নেতা এবার স্বর আরও উঁচু করলেন—
“আমরা ক্ষমতায় এলে প্রতিটি গ্রামে স্কুল হবে, হাসপাতালে থাকবে ওষুধ, শহরে থাকবে আধুনিক রাস্তা আর আলো। কৃষকদের ফসলের দাম বাড়ানো হবে, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা—এই মাটিতে আর কেউ অবহেলিত থাকবে না।”
ভিড় উত্তাল হয়ে উঠল। কেউ শিস দিচ্ছে, কেউ হাত তুলে ‘জয়’ স্লোগান দিচ্ছে। এক তরুণ দলের পতাকা হাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বলছে—“এবার পরিবর্তন হবেই!”
এবার মঞ্চে এলেন দলের অন্য নেতারা। তারা একে একে মাইকের সামনে এসে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। কেউ বললেন নারীশিক্ষার কথা, কেউ বললেন নতুন শিল্পের কথা, কেউ আবার প্রতিশ্রুতি দিলেন পুরনো ট্যাক্স কমিয়ে সাধারণ মানুষের উপর চাপ কমানোর।
প্রতিটি বক্তৃতার পর মাঠে হাততালি, স্লোগান, পতাকার নাচন। মাঝে মাঝে ভিড় এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল যে পুলিশকে হুঁশিয়ারি সাইরেন বাজাতে হচ্ছিল।
একজন প্রবীণ নেতা মঞ্চে উঠে বললেন—
“আজকের এই সভা শুধু রাজনৈতিক নয়, আজকের সভা ভবিষ্যতের স্বপ্ন।”
এই এক লাইনেই জনতার ভেতরে যেন ঢেউ খেলে গেল। বৃদ্ধা-মহিলা, তরুণ-তরুণী, শ্রমিক, দোকানদার—সবাই যেন মনে মনে এক অদৃশ্য ছবির খসড়া আঁকতে শুরু করল।
কিন্তু ভিড়ের ভেতরে আরেক ছবি। কিছু মানুষের চোখে অবিশ্বাস। কেউ বলছে—
—“এই সব শুধু ভোটের আগে হয়, পরে সব ভুলে যায়।”
আবার কেউ পাল্টা উত্তর দিচ্ছে—
—“না, এবার হয়তো সত্যিই কিছু পরিবর্তন হবে।”
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল এই বক্তৃতার ঝড়। প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে গেল মাঠ। নেতা প্রতিটি বাক্যের শেষে জনতার আবেগকে আরও বাড়িয়ে তুলছিলেন।
শেষে নেতা আবার দু’হাত তুললেন—
“আমার শহর, আমার মানুষ—আপনারাই আমার শক্তি। এবার আমাদের হাতে একটাই অস্ত্র, ভোট। আপনারা যদি আমাদের বিশ্বাস করেন, এই শহর বদলে যাবে। আপনাদের হাতেই রয়েছে সেই ক্ষমতা।”
ভিড় একযোগে চিৎকার করে উঠল—
“আমরা আছি! আমরা আছি!”
মাঠ তখন বিদ্যুতের মতো উত্তেজনায় ভরে উঠেছে। বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ মানুষের মনে একেকটা আশার আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আবার কারও মনে সন্দেহের কালো মেঘও জমছে।
কিন্তু সত্যি বলতে কী—সেদিন সেই জনসভায়, মঞ্চের ঝলক, প্রতিশ্রুতির বন্যা আর ভিড়ের আবেগ—সবকিছু মিলিয়ে শহরের রাজনীতিতে এক নতুন ঢেউ বয়ে গেল
জনতার প্রতিক্রিয়া ও সভার সমাপ্তি
বক্তৃতার ঝড় শেষ হয়েছে। মঞ্চে নেতা শেষবারের মতো হাত নাড়লেন, জনতার দিকে একরাশ হাসি ছুঁড়ে দিলেন। মাইকে ভেসে এল দলের স্লোগান-সংগীত। ভিড় তখনও গমগম করছে। কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করেছে, যেন এক অদ্ভুত আবেশ থেকে সরে এসে বাস্তবে ফিরে আসছে।
হাজার হাজার মানুষ মাঠ থেকে বেরোতে শুরু করল। কেউ হাতে পতাকা নাড়ছে, কেউ আবার স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে গেল।
– “দেখিস, এবারে আসল পরিবর্তন হবে।”
– “না রে, সব আগের মতোই চলবে।”
এই দুই ধরনের কণ্ঠ একসাথে ভাসছিল বাতাসে।
একজন তরুণী, যিনি কলেজে পড়েন, বলছিলেন তার বান্ধবীকে—
– “চাকরির প্রতিশ্রুতি যদি সত্যি হয়, তবে ভালোই। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।”
তার বান্ধবী একটু আশাবাদী স্বরে জবাব দিল—
– “অত সন্দেহ করিস না। বড় নেতারা এভাবে খালি কথা বলে না।”
কোথাও আবার ভিড়ের মধ্যে গোপনে ফিসফিসানি—
– “এরা তো আগেরবারও রাস্তা মেরামতের কথা বলেছিল, কই, কিছু হলো?”
আরেকজন উত্তর দিলেন—
– “রাজনীতি মানেই তো প্রতিশ্রুতি। কিন্তু আমরাই বা কী করি? ভোট দিই আবার ভুলে যাই।”
সভাস্থলের পাশে থাকা চায়ের দোকান, পকোড়ার ঠেলাগাড়ি, বাদামওয়ালা—সবাই ভালো ব্যবসা করেছে। ভিড়ের জন্য তাদের আয় বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসার মাঝেই তারা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছে।
এক বাদামওয়ালা হাসতে হাসতে বলল—
– “ভাই, নেতা যা-ই বলুক, আমাদের তো বিক্রি হয়েছে, তাই আজকের দিনটা ভালো।”
চা-ওয়ালা আবার কড়া গলায় বলল—
– “আরে বাদাম বিক্রি হলেই হবে? কাল আবার একই কষ্ট। নেতা এলে আমাদের দোকানে আসে? আসে শুধু ভোট চাইতে।”
এই কথোপকথনে সাধারণ মানুষের সেই তিক্ত বাস্তব ফুটে উঠল—সভা চলে যায়, কিন্তু জীবনের সমস্যাগুলো থেকে যায়।
সভা চলাকালীন যেভাবে ব্যারিকেড, লাঠি আর বাঁশি নিয়ে তারা ভিড় সামলাচ্ছিল, সভার শেষে পুলিশদের মুখে একটু স্বস্তি ফুটল।
একজন কনস্টেবল বলল—
– “যাক, কোনো গোলমাল হলো না।”
অন্যজন হাসতে হাসতে জবাব দিল—
– “গোলমাল হয়েই বা কী? মানুষ প্রতিশ্রুতি শুনে মুগ্ধ হয়, কিন্তু বাড়ি ফিরলেই বুঝে যায়—জীবন একই।”
তাদের কথায় লুকিয়ে ছিল অভিজ্ঞতার ক্লান্তি।
মাঠ ছাড়ার আগেই সাংবাদিকরা ল্যাপটপ খুলে নিউজ লিখতে শুরু করল। শিরোনাম তৈরি হচ্ছিল—
“অতুলনীয় ভিড়, প্রতিশ্রুতির ঝড়ে কেঁপে উঠল শহর”
অথবা
“নেতার ভাষণে আশার সুর, সন্দেহের ছায়াও ঘনালো”
কেউ ছবি তুলছে, কেউ লাইভ করছে। রাজনীতি আর মিডিয়া যেন একই স্রোতে ভেসে চলল।
সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছে। আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে। ভিড়ের গর্জন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে শহরের রাস্তায়। পতাকা, পোস্টার, ফেলে দেওয়া জল বোতল, কাগজ, ধুলা—সব মিশে এক বিশৃঙ্খল ছবি তৈরি করল মাঠে।
কিন্তু সেই অগোছালো দৃশ্যের মধ্যেও ভেসে থাকল মানুষের আবেগ। কেউ নতুন ভোরের স্বপ্নে বাড়ি ফিরছে, কেউ আবার মনের ভেতরে ভরসার চেয়ে হতাশার বোঝা নিয়ে হাঁটছে।
একজন বৃদ্ধ কৃষক ধীরে ধীরে মাঠ থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন তার নাতিকে—
– “বাবা, কথায় পেট ভরে না। তবু মানুষ আশায় বাঁচে। তাই সবাই আবার শুনল।”
নাতি চুপচাপ মাথা নাড়ল।
মঞ্চে আলো নিভে গেল। পুলিশ ব্যারিকেড সরাতে শুরু করল। কর্মীরা পতাকা ও মাইকের তার গুটিয়ে নিচ্ছে। মাঠ ফাঁকা হতে লাগল।
কিন্তু শহরের বাতাসে রয়ে গেল সেই দিনের সভার প্রতিধ্বনি। মানুষ হয়তো আগামীকাল থেকে আবার তাদের পুরনো জীবনে ফিরবে—কাজ, চাষ, দোকান, অফিস। কিন্তু মনে জমে থাকবে আজকের প্রতিশ্রুতির প্রতিচ্ছবি।
সেই প্রতিশ্রুতির স্রোতই আগামী ভোটে মানুষের হাতকে প্রভাবিত করবে কি না—তা তখনও অজানা।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—
সভা শেষ হলেও রাজনৈতিক ঢেউ থেমে নেই। সেটি ধীরে ধীরে শহরের অলিগলিতে, গ্রামে, মানুষের চা-আড্ডায় ছড়িয়ে পড়বে, এবং তৈরি করবে নতুন উত্তেজনার পর্ব।