Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

আধুনিক প্রেমের জটিল আখ্যান

কলমে: সৌরদীপ অধিকারী

বিশ্বাস করুন, এই গল্পটা লেখার সময় আমার হাত কাঁপছে। প্রতিটি অক্ষর যেন বুকের ভেতর থেকে ছিঁড়ে বের হচ্ছে। আমি জানি না, এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে কতটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি, যা অনুভব করেছি, তা কোনো কল্পনার ফানুস নয়, একদম চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক নির্মম সত্য। এ যেন এক আধুনিক প্রেমের প্রেক্ষাপটে সাজানো নাটক, যেখানে চরিত্রগুলো রক্ত-মাংসের মানুষ, যাদের প্রতিটি হাসি, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, প্রতিটি নীরবতা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।

শহরের ব্যস্ততম নিউটাউনের আকাশছোঁয়া এক ফাইভ-স্টার হোটেলের রুফটপ বারে প্রথম দেখা হয়েছিল রোহন আর মায়ার। সেদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল, আর নীচে নিয়ন আলোর মায়াজাল। রোহন, বছর তিরিশের এক সফল আইটি উদ্যোক্তা, তার চোখে ছিল দ্রুত বুদ্ধির ঝলক আর এক ধরনের চাপা অস্থিরতা। মায়া, ছাব্বিশ বছরের গ্রাফিক ডিজাইনার, দেখতে শান্ত, অথচ তার চোখের গভীরে ছিল এক দুর্বার আকর্ষণ, যার মধ্যে চাপা পড়েছিল এক গভীর সংবেদনশীল আত্মা। ওদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক কমন ফ্রেন্ড, বিক্রম। প্রথম দেখাতেই যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে গিয়েছিল ওরা। সেই রাতে সামান্য কিছু কথার আদান-প্রদান, এক-দু'বার চোখাচোখি, আর তার পরেই ওদের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের নিরবচ্ছিন্ন আনাগোনা। আধুনিক প্রেমের শুরুটা এভাবেই হয় বটে।

পরের কয়েকটা দিন কেটে গেল চ্যাট আর ভয়েস নোটে। একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, এমনকি ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতিও ভাগ করে নিল ওরা। রোহন ছিল কথার জাদুগর, মায়া ছিল ভালো শ্রোতা। কিন্তু মায়ার সেই নির্লিপ্ত শ্রোতা রূপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক বিশ্লেষণাত্মক মন, যা রোহনকেও মুগ্ধ করেছিল। ওরা দুজনেই শহরের দ্রুত জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে চলা মানুষ, অথচ ওদের ভেতরে ছিল এক আদিম আকাঙ্ক্ষা – গভীর, খাঁটি এক ভালোবাসার।

তৃতীয় সপ্তাহে ওদের আবার দেখা হলো, এক নিরিবিলি ক্যাফেতে। সেদিন আর কোনো বন্ধু ছিল না। শুধু ওরা দু'জন। টেবিলের ওপারে বসে মায়া যখন তার কফি কাপে চামচ ঘোরাচ্ছিল, রোহন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। মায়ার চুলগুলো কপালের ওপর আলতোভাবে এসে পড়েছিল, আর ওর হাসিতে ছিল এক অদ্ভুত মাদকতা।

"তুমি খুব হাসো," রোহন বলেছিল। মায়া মৃদু হেসেছিল। "সব কিছুর পেছনে কারণ খুঁজতে যাব না তো। কোনো কারণ ছাড়াই হাসিটা আসে।" "আমার মনে হয়, তুমি অনেক কিছু আড়াল করো হাসির আড়ালে," রোহন বলেছিল, ওর চোখ মায়ার চোখের গভীরে ডুবতে চাইছিল। মায়া কিছু বলেনি, শুধু ওর চাহনি আরো গভীর হয়েছিল। সেই চাহনিতে কী ছিল? সম্মতি? নাকি এক গভীর সত্যের ইঙ্গিত?

সেই দিন থেকেই ওদের সম্পর্কটা অন্য মাত্রা পেয়েছিল। ডিজিটাল পর্দার ওপার থেকে এবার বাস্তবতার জমিনে পা রেখেছিল ওদের প্রেম। তীব্র আকর্ষণ আর গভীর বোঝাপড়ার এক অদ্ভুত মিশেল ছিল ওদের মাঝে। সিনেমা, লং ড্রাইভ, গ্যালারিতে আর্ট এক্সিবিশন দেখা, এমনকি ঘন্টার পর ঘন্টা কোনো কথা না বলেও শুধু পাশাপাশি বসে থাকা – ওরা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করত। রোহনের অ্যাপার্টমেন্টে মাঝরাতে হঠাৎ করে মায়ার চলে আসা, বা মায়ার অ্যাপার্টমেন্টে রোহনের সারা রাত থাকাটা খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ওদের শরীর ছুঁয়ে যাওয়া উষ্ণতা, একে অপরের নিঃশ্বাসে মিশে যাওয়া গভীর টান, সব যেন এক নতুন জগতের সৃষ্টি করেছিল ওদের জন্য। রোহনের দৃঢ় বাহুতে মায়া পেতো এক অদ্ভুত নিরাপত্তা, আর মায়ার কমনীয় স্পর্শে রোহন খুঁজে পেতো এক অনাবিল শান্তি। ওদের শরীরী ভাষা ছিল এক গভীর আবেগের প্রতিচ্ছবি, যা কোনো শব্দ ছাড়াই হাজারো কথা বলতো। অশ্লীলতা নয়, এ ছিল দুই সত্তার এক হয়ে যাওয়ার এক পবিত্র আকাঙ্ক্ষা।

রোহন মায়াকে প্রায়ই বলতো, "তোমার মতো করে কেউ আমাকে কখনো বুঝতেই পারেনি, মায়া। তোমার কাছে এলে মনে হয় সব কোলাহল শান্ত হয়ে যায়।" মায়া প্রত্যুত্তরে শুধু ওর বুকে মাথা রাখত, আর রোহনের নিশ্বাসের শব্দ শুনত। এইটুকুতেই যেন সব বলা হয়ে যেত। ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওরা তখনো স্পষ্ট কিছু ভাবেনি, কারণ ওদের বর্তমানটাই ছিল এক স্বপ্নীল দুনিয়া। ওরা দুজনেই জানতো, ওদের সম্পর্কের ভিত্তিটা দুর্বল নয়, বরং এক গভীর বিশ্বাস আর ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা।

কিন্তু সব স্বপ্নেরই একটা ভাঙন থাকে, থাকে একটা অপ্রত্যাশিত মোড়। আর আধুনিক প্রেমের গল্পগুলো যেন এই মোড়গুলোর জন্যই বিখ্যাত।

একদিন হঠাৎ করেই সব পাল্টে যেতে শুরু করল। রোহন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ব্যস্ত। ফোন কলগুলো যেন কেমন গোপনীয় হয়ে উঠছিল। রাত জেগে ল্যাপটপে কাজ করার অজুহাত, আবার কখনও 'আর্জেন্ট মিটিং'-এর কথা বলে রাত কাটিয়ে দেওয়া। মায়ার মনে প্রথমে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, কিন্তু সে রোহনকে বিশ্বাস করতে চাইত। "ও হয়তো সত্যিই খুব ব্যস্ত," নিজেকে বোঝাতো। কিন্তু ভেতর ভেতর একটা চাপা উদ্বেগ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ওর মন বলছিল, কিছু একটা ঠিক নেই।

এক রাতে ওরা ডিনারে গিয়েছিল। রোহন বারবার ফোন দেখছিল, মুখে এক ধরনের অস্থিরতা। মায়া যখন কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রোহন তাড়াতাড়ি বলেছিল, "সরি সোনা, একটা ডেডলাইন। খুব টেনশন হচ্ছে।" মায়া ওর হাত ধরেছিল, "ঠিক আছে, আমি বুঝি। কিন্তু এখন তো আমার সঙ্গে আছো? একটু রিল্যাক্স করো।" রোহন একটা যান্ত্রিক হাসি হেসেছিল, কিন্তু ওর চোখ দু'টো বারের অন্য প্রান্তে কোথাও যেন কিছু খুঁজছিল।

এর কিছুদিন পর, একদিন রোহনের ফোনটা মায়ার কাছে ছিল। রোহন শাওয়ারে গিয়েছিল। হঠাৎই একটা অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ এলো। মেসেজটা ছিল শুধু দুটো শব্দ: "রোহন, প্লিজ।"। মায়ার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। 'প্লিজ'। এই শব্দটার পেছনে লুকানো আকুতি মায়ার হৃদয়ে তীব্র আঘাত হানল। কে হতে পারে? কেন এমন অনুরোধ? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগল। সে ফোনটা দ্রুত নামিয়ে রাখল, যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ না হয়।

সেই রাতটা মায়ার কাছে নরকের মতো ছিল। রোহন তার পাশে ঘুমচ্ছিল, অথচ মায়া জেগেছিল সম্পূর্ণ রাত। তার চোখে ঘুম ছিল না, ছিল শুধু উদ্বেগ আর এক অজানা ভয়ের কালো ছায়া। পরদিন সকালে, রোহন যখন অফিসে চলে গেল, মায়া ওর ফোনটা নিয়ে দেখল। সেই মেসেজটা ডিলিট করা হয়েছে। মায়ার সন্দেহ এবার বিশ্বাসে পরিণত হলো। এর পেছনে অবশ্যই কিছু আছে।

কয়েকদিন পর। মায়া যখন নিজের অফিসের কাজ করছিল, হঠাৎ বিক্রমের ফোন এলো। "কিরে মায়া, রোহনের কী খবর? ও কি এখনো নিহার সাথে... মানে, ও কি এখনো ওর সাথে যোগাযোগ রাখে?" বিক্রমের গলার স্বরে কেমন একটা দ্বিধা ছিল। মায়ার মাথাটা পুরো ঘুরে গেল। "নিহা? কে নিহা, বিক্রম? আর যোগাযোগ রাখা মানে কী?" বিক্রম যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। "ওহ, সরি। আমি তো ভাবলাম তুমি জানো। নিহা ছিল রোহনের ফার্স্ট লাভ। স্কুল ফ্রেন্ড। ওদের ব্রেকআপটা খুব খারাপ ভাবে হয়েছিল। রোহন নাকি এখনো ওর জন্য কেমন পাগলের মতো ছিল, মানে ছিল আর কি, এখন হয়তো নেই। অনেক বছর আগের কথা। বাদ দে এসব…।" বিক্রমের কথাগুলো মায়ার কানে যেন তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিঁধছিল। নিহা! ফার্স্ট লাভ! রোহন তাকে নিহার কথা কখনো বলেনি। কেন বলেনি?

সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল এক তীব্র মানসিক টানাপোড়েন আর উদ্বেগের মধ্যে। রোহনের কাছে আমি বারবার জানতে চেয়েছিলাম ওর অতীতের কথা। ও শুধু বলতো, "আমার জীবনে তুমিই প্রথম। বাকি সব অতীত।" কিন্তু এই নিহা নামের মেয়েটা যে শুধু অতীত নয়, বরং বর্তমানের এক অদৃশ্য অংশ, তা মায়া তখনও জানত না।

একদিন বিকেলে, মায়া আর রোহন এক নামী রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। রোহন তখনও তার ফোনে ব্যস্ত ছিল। বারবার বাথরুমে যাওয়ার নাম করে ফোন করছিল। মায়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। রোহন ফিরে এসে যখন খেতে বসেছে, মায়া শান্ত গলায় বলল, "নিহা কে?"

রোহনের হাত থেকে কাঁটাচামচটা প্লেটে পড়ে গেল। ওর মুখের দিকে দেখলাম আমি, ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল মুহূর্তে যেন সব রক্ত সরে গেছে। "কে নিহা? তুমি কী বলছ, মায়া?" রোহন ইতস্তত করতে করতে বলল। "বিক্রম বলল, নিহা তোমার ফার্স্ট লাভ। তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ, রোহন?" মায়ার গলায় ছিল চাপা অভিমান আর এক তীব্র যন্ত্রণা। রোহন মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "নিহা... হ্যাঁ, ও আমার জীবনে ছিল। অনেক আগে। আমাদের ব্রেকআপটা খুব বাজেভাবে হয়েছিল। আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি অনেক বছর।"

"তাহলে এখন কেন রাখছো? ফোন কেন ডিলিট করছো? আর বিক্রম কেন বলল তুমি এখনো ওর জন্য..." মায়ার চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। "সেটা অন্য ব্যাপার, মায়া। নিহা এখন খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ওর হাজব্যান্ড ওকে ডিভোর্স দিয়েছে। ও একা হয়ে পড়েছে। খুব ডিপ্রেশনে আছে। আমি শুধু একটা বন্ধু হিসেবে ওকে সাপোর্ট দিচ্ছি।" রোহন বোঝানোর চেষ্টা করল। "বন্ধু হিসেবে? মাঝরাতে ফোন? মেসেজ ডিলিট করা? এসব কি বন্ধুর লক্ষণ, রোহন? তোমার কাছে কি আমার কোনো মূল্য নেই? আমার অনুভূতিগুলো কি তোমার কাছে এতটাই সস্তা?" মায়ার গলার স্বর এবার কঠোর হলো। "প্লিজ মায়া, ভুল বুঝো না। আমার তোমাকে হারানোর ভয় হয়। তাই বলতে পারিনি।" রোহন মায়ার হাত ধরতে চাইল। মায়া হাতটা সরিয়ে নিল। "হারানোর ভয়? তুমি তো হারাচ্ছ। প্রতি মুহূর্তে। আমাদের সম্পর্কটা কি খেলনা, রোহন? যখন যেখানে খুশি ব্যবহার করবে?"

সেই দিন রাতেই মায়া ওর ব্যাগ গুছিয়ে রোহনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। রোহন ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মায়ার কানে তখন কোনো শব্দ পৌঁছাচ্ছিল না। ওর মনে হচ্ছিল যেন ওর ভালোবাসার পৃথিবীটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।

পরের কয়েকটা দিন কেটেছিল এক অবর্ণনীয় মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। ফোন কল, মেসেজ, রোহনের বারংবার অনুরোধ, "প্লিজ ফিরে এসো, মায়া। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।" মায়া রোহনকে ভালোবাসত, খুব ভালোবাসত। কিন্তু ওর মনে সেই নিহার উপস্থিতি কাঁটার মতো বিঁধছিল। সে জানতো না কী করবে। তার মন বলছিল, রোহন তাকে এখনো ভালোবাসে, কিন্তু তার হৃদয় বলছিল, রোহনের জীবনে এমন একজনের ছায়া রয়েছে, যাকে সে কখনো ভুলতে পারেনি।

একদিন সন্ধ্যায়, মায়া যখন নিজের বাড়িতে একা বসে কাঁদছিল, দরজায় বেল বাজল। খুলে দেখল, রোহন। ওর চোখে জল, মুখটা কেমন শুকনো। "মায়া, প্লিজ আমাকে আর একবার সুযোগ দাও। আমি নিহার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দেব। আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।" রোহন মায়ার হাত জড়িয়ে ধরল। মায়ার মনটা গলে যাচ্ছিল। সে রোহনকে বিশ্বাস করতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক তখনই, রোহনের ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল সেই অচেনা নম্বর। নিহা।

মায়া রোহনের দিকে তাকাল, ওর চোখে ছিল এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। রোহন ফোনটা রিসিভ করল না। কিন্তু মায়া বুঝে গেল, রোহন এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। সে হয়তো নিহাকে ছাড়তে পারবে না, কারণ পুরোনো টানটা ছিল অনেক গভীর। আর সেই টানের কাছে মায়ার বর্তমান প্রেমটা হয়তো হার মেনে যাচ্ছিল।

"রোহন, তুমি কেন মিথ্যে বলছো? তুমি ওকে ছাড়তে পারবে না। আর আমি তোমার জীবনে এমন একজনকে নিয়ে থাকতে পারব না যাকে তুমি পুরোপুরি ভুলতে পারোনি," মায়া শান্ত, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল। "না, মায়া! আমি পারব। বিশ্বাস করো..." রোহন মিনতি করতে লাগল। "তুমি হয়তো পারবে, কিন্তু আমি পারবো না। আমি তোমার প্রতি অবিচার করতে পারবো না। তুমি না পারলেও আমি বুঝতে পারছি, নিহা তোমার জীবনে কতটা মূল্যবান। আর আমার সাথে থাকলে তুমি ওকে কখনো ভুলতে পারবে না। আমি তোমার জীবনে সেই প্রাচীর হতে চাই না, রোহন।" মায়া রোহনের হাত ছেড়ে দিল। "তুমি তোমার জীবনে ওর পাশে থাকো। আমি আমার পথ খুঁজে নেব।"

রোহন মায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, ওর চোখে ছিল অসহায়ত্ব। সে আর কিছু বলতে পারল না। নীরবে দরজা থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া দরজা বন্ধ করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া প্রতিটি অশ্রুবিন্দু যেন এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা করছিল।

কয়েক মাস কেটে গেছে। রোহন আর মায়ার আর দেখা হয়নি। শুনেছি, রোহন নাকি নিহার পাশে দাঁড়িয়েছে। ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। আর মায়া? মায়া নিজের জীবন নতুন করে শুরু করেছে। কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে রাতের বেলা যখন একা বসে থাকে, তখন ওর মনে পড়ে রোহনের স্পর্শ, ওর উষ্ণতা, ওর বলা সেই কথাগুলো – "তোমার মতো করে কেউ আমাকে কখনো বুঝতেই পারেনি"। তখন ওর বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে।

আধুনিক প্রেম এমনই জটিল। এখানে আবেগ, নির্ভরতা, টান আর পুরোনো ক্ষত সব একাকার হয়ে যায়। কিছু সম্পর্ক পরিণতি পায়, কিছু সম্পর্ক কেবলই এক অচেনা টানে আটকে থাকে। এই গল্পটা শেষ হলো না, কারণ কিছু গল্প আসলে শেষ হয় না। তারা শুধু তাদের পথ পাল্টে নেয়, আর রেখে যায় এক গভীর বিষাদের ছাপ। এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মায়া বুঝতে পারছিল – প্রেম মানে শুধু কাছে আসা নয়, কখনো কখনো ছেড়ে দেওয়াও। আর সেই ছেড়ে দেওয়ার মাঝেই লুকিয়ে থাকে এক কঠিনতম আত্মত্যাগ। এই ছিল এক আধুনিক প্রেমের জটিল আখ্যান, যেখানে ভালোবাসা আর বিচ্ছেদ উভয়ই সমানভাবে বাস্তব এবং নির্মম।