১২৯৫ সনের ৩০শে ভাদ্র, তৎকালীন পূর্ব বাংলার পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রাম।
সকালের শান্ত আকাশ, পদ্মার ঢেউ খেলানো জলে ব্যস্ত ছিল গ্রামের জেলেরা। হঠাৎ তারা দেখল— গ্রামের সকলের শ্রদ্ধেয় শিবচন্দ্র চক্রবর্তী মশাইয়ের বাড়িটি এক অদ্ভুত আলোয় দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে।
প্রথমে সকলেই ভেবেছিল, হয়তো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ! সবাই মাছধরা ফেলে ছুটে এলো। কিন্তু কাছে এসে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল— কোথায় আগুন ! এ যে দ্যুতির সাগর, এক অলৌকিক আলোকছটা !
সেই দিব্য মুহূর্তে শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর ঘরে, মাতা মনমোহিনী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন এক দেবোপম শিশু। তাঁর মুণ্ডিত মস্তক, আজানুলম্বিত বাহু, আর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত অঙ্গজ্যোতি সমস্ত গৃহকে পরিণত করল যেন বৈকুণ্ঠধামে।
জন্মের ক্ষণেই তিনি বার্তা দিলেন—
তিনি এসেছেন অন্ধকারের গহ্বর বিদীর্ণ করে আলোর ঝর্ণাধারা হয়ে,
তিমিরের বুকে প্রজ্জ্বলিত করতে প্রেম, সত্য আর মানবতার অমৃত প্রদীপ।
তিনি আর কেউ নন— আমাদের প্রাণের ঠাকুর, পরম প্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
আজ তাঁর শুভ জন্ম দিবস। তাঁর শ্রীপাদপদ্মে, হৃদয়ভরা শ্রদ্ধা ও সীমাহীন ভক্তি নিবেদন করে আজকের দিনে এমন একটি বিষয় নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই, যে বিষয়টি এখনকার জেনারেশন প্রায় জানে না বললেই চলে। সেই বিষয়টি হচ্ছে— দেশভাগের প্রাক্কালে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পূর্ব বাংলার পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রম ছেড়ে বিহারের দেওঘরে চলে গিয়েছিলেন কেন ?
অনেকেই প্রকৃত ঘটনা না জেনে সামাজিক মাধ্যমে এই বলে অভিযোগ করেন যে, শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নাকি মুসলমানদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যান ! সমালোচকরা তো এই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রী ঠাকুরের ধর্মীয় ভাবনাকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে ছাড়েন না। শ্রীশ্রী ঠাকুর সবসময়ই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জয়গান গেয়েছেন। অথচ তাঁর সমালোচকরা পাবনা ছাড়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ঠাকুরের এই অসাম্প্রদায়িক ভাবনার ভিত্তিটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা।
আসুন জেনে নিই শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কোন পরিস্থিতিতে এবং কী কারণে দেশভাগের প্রাক্কালে পাবনা ছেড়ে দেওঘরে চলে এসেছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে আমরা সাধারণত একজন আধ্যাত্মিক গুরু, সাধক কিংবা মহামানব হিসেবেই জানি। কিন্তু তাঁর জীবনের এক অজানা অধ্যায়ে তিনি ছিলেন দেশভাগ প্রতিরোধের একজন নীরব কিন্তু অক্লান্ত সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের সেই অধ্যায় আজও অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। অনেকে ভুল করে হোক বা দুরভিসন্ধি নিয়েই হোক, বলে বেড়ায় যে, দেশভাগের ভয়েই ঠাকুর পাবনা ছেড়ে দেওঘরে চলে যান। অথচ আসল সত্য একেবারেই ভিন্ন। তিনি পালিয়ে যাননি, বরং বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য দেশভাগের দাবি ওঠার অনেক আগে থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি।
১৯৪০ সালের গোড়াতেই তিনি তৎকালীন হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সতর্ক করে বলেছিলেন— ভবিষ্যতে স্বাধীনতা আসবেই, কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল পরিষ্কার: পূর্ব বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের অনুপাত যেন অন্তত ৫০–৫০ হয়। এজন্য তিনি বারবার আবেদন জানান— ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হতদরিদ্র হিন্দু পরিবারগুলোকে এনে পূর্ব বাংলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। তিনি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ডঃ নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা) প্রমুখ নেতাদের কাছে সরাসরি অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল স্পষ্ট— “স্বাধীনতা কেবল কাগজে থাকবে না, টিকে থাকতে হলে দরকার মানুষের শক্তি, সংগঠন ও সংখ্যাগত ভারসাম্য।”
কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা তাঁর দূরদৃষ্টি বোঝেননি। যখন তিনি এসব বলছিলেন, তখন দেশভাগ নিয়ে কোনোরূপ আলোচনা ছিল না। তাই তাঁর কথার ভবিষ্যৎ গুরুত্বের বিষয়টি সম্পর্কে কেউ ভাবতেই পারেনি। ফলে তাঁর অনুরোধকে অগ্রাহ্য করা হলো। অথচ সময়ের সাথে সাথে দেখা গেল, তিনি কতটা বাস্তববাদী ছিলেন।
শ্রীশ্রী ঠাকুর যখন বুঝতে পারলেন, পুরো পূর্ব বাংলাকে হয়তো আর রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু অন্তত পাবনা জেলাটাকে যদি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখা যায় তাহলে সেটি ভারতবর্ষের অংশ হিসেবেই থাকতে পারবে। তাই তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু দরিদ্র পরিবারকে এনে হেমায়েতপুরে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে তাদের জন্য তৈরি হলো আশ্রয়, জীবিকা, শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার পথ। তাঁর ভাবনা ছিল— জনসংখ্যার শক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা গড়ে তোলা।
কিন্তু স্বার্থপর জমিদার শ্রেণী এতে ভয় পেল। বসন্ত সাহা চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী জমিদাররা আশঙ্কা করলেন, ঠাকুরের প্রতি আনুগত্য পরায়ণ হিন্দুরা যদি পাবনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে, তাহলে ঠাকুরের প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পাবে। আর ঠাকুরের প্রভাব বাড়লে তাদের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। তারা মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উস্কে দিয়ে প্রচার করল— “ঠাকুর হিন্দুদের সংখ্যা বাড়িয়ে মুসলমানদের প্রভাব কমাতে চাইছেন।” ফলস্বরূপ একাধিকবার সৎসঙ্গ আশ্রমে হামলা হলো, আশ্রমবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে লাগলেন। শ্মশানে শবদাহের কাজে বাধা সৃষ্টি করা শুরু হলো। এমনকি আশ্রমের জনৈক আবাসিককে হত্যা করে ফেলা হলো।
বৃটিশরা মগ্ন তাদের ডিভাইড এন্ড রোল পলিসি নিয়ে। মুসলিম লীগ মগ্ন দেশভাগের দাবি নিয়ে। স্থানীয় হিন্দু জমিদার শ্রেণী শুরু করলো নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র। এই সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেও কোনো কার্যকর সহায়তা পাওয়া গেল না। ফলে ঠাকুর কার্যত একা হয়ে পড়লেন। সমস্ত চাপ, ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের ফলে তাঁর শরীর ভেঙে গেল। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ দেওঘরে রওনা হলেন বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস— তাঁর দেওঘরে অবস্থানকালেই দেশভাগ কার্যকর হলো এবং হেমায়েতপুর সৎসঙ্গ আশ্রম তথা পাবনা জেলাটিও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
তাই স্পষ্টভাবে বলা উচিত— শ্রীশ্রীঠাকুর দেশভাগের ভয়ে পালাননি। তিনি ছিলেন বাংলাকে অখণ্ড রাখার এক দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর দেওঘরে যাওয়া ছিল চিকিৎসার কারণে, নিরাপত্তার জন্য নয়। তিনি কেবল আধ্যাত্মিক গুরুই ছিলেন না, ছিলেন এক সমাজসংস্কারক, দরিদ্রের বন্ধু এবং দেশভাগ রোধে প্রাণপণ লড়াই করা এক নীরব যোদ্ধা।
যদি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা তাঁর পরামর্শ মেনে চলতেন, আজ হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো— অখণ্ড বাংলা ভারতের সঙ্গেই থাকত। শ্রীশ্রীঠাকুরের এই সংগ্রাম আজও যথাযথ মর্যাদা পায়নি। অথচ তাঁর আদর্শ আমাদের শেখায়— দূরদৃষ্টি, সাহস আর মানবিকতা মিলেই প্রকৃত জাতি গঠন সম্ভব।