ঈশার ভোরটা অদ্ভুত নীরবতায় শুরু হয়েছিল।
জানলার বাইরে কুয়াশার মতো সকাল, কিন্তু তার বুকের ভেতর ঝড়।
গত রাতের সেই স্বপ্ন—একটা পুরোনো চিঠি, যার লেখা অস্পষ্ট, আর অভ্রর চোখের সেই রহস্যময় দৃষ্টি।
হাতের কাছে রাখা ডায়েরির ওপর আঙুল বুলিয়ে সে চুপ করে বসে ছিল। কলম হাতে নিলেও কিছু লিখতে পারছিল না। শব্দ যেন আটকে গেছে কোথাও।
শেষ পর্যন্ত ছোট্ট করে লিখল—
"আজও আমার মন কেবল প্রশ্নে ভরা। অভ্রর চোখে যে ছায়া দেখি, সেটা কি কেবল কল্পনা? নাকি সত্যিই কিছু আছে, যা আমি জানি না?"
---
কলেজে পৌঁছে ঈশা দেখল—সব কিছু যেন আগের মতোই। ক্লাসে ঢুকতেই বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। কিন্তু তার মন আলাদা। চোখে বারবার ভেসে উঠছে অভ্রর মুখ।
ক্লাস শুরু হতেই সে বই খুলল, কিন্তু মন বসছে না। শব্দগুলো চোখের সামনে ভাসছে, তবু বোঝা যাচ্ছে না।
ঠিক তখনই দরজা খুলে অভ্র ঢুকল। তার গিটার কেসটা হাতে, আর চোখে সেই অদ্ভুত শান্তি।
সে সরাসরি ঈশার দিকে তাকাল।
“আজও মন তোমার কোথায়?” — ঠোঁটে মৃদু হাসি।
ঈশা একটু থমকাল, তারপর জবাব দিল,
“আমার মন সবসময় নিজের মধ্যে থাকে।”
অভ্র হেসে পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। যেন দুজনেই একে অপরের নিঃশ্বাস শুনছে।
তারপর হঠাৎ অভ্র বলল—
“কিছু সত্যি আছে, যা সময়ের আগে প্রকাশ পায় না। কিন্তু তার মানে কখনও হারায় না।”
ঈশার বুকের মধ্যে কেমন কেঁপে উঠল।
মনে হলো, অভ্রর কথার ভিতরে লুকিয়ে আছে কোনো গল্প।
সে জানতে চাইল, কিন্তু প্রশ্ন করল না।
---
ক্লাস শেষে অভ্র হঠাৎ বলল,
“চল, ক্যাফেটেরিয়াতে চা খাই?”
ঈশা একটু অবাক হলো। সাধারণত সে সোজা লাইব্রেরি চলে যায়।
প্রথমে মাথা নাড়ল, “না।”
কিন্তু ভেতরের কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে গেল।
ক্যাফেটেরিয়ার কোণে একটা টেবিলে বসে দুজন।
চায়ের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠছে।
অভ্রর চোখে যেন কিছু খেলা করছে।
সে ধীরে বলল—
“আজ আবার তোমাকে দেখলাম। মনে হচ্ছে সবই কাকতালীয় নয়। কেউ যেন আমাদের দেখা করাচ্ছে।”
ঈশা কিছু না বলে চা ফুঁকতে থাকল।
তার বুকের ভিতর ঢেউ খেলছে।
মনে হলো—এই মুহূর্তে সে অদ্ভুতভাবে বাঁধা পড়ছে অভ্রর কাছে।
---
কিছুক্ষণ পর অভ্র তার গিটার কেসের দিকে ইশারা করল।
“তুমি জানো? এই কেসে কেবল সুর নেই।”
ঈশার চোখ বড় হয়ে গেল।
“মানে?”
অভ্র হালকা হেসে বলল—
“কিছু আছে, যা আমি আজও তোমাকে দেখাইনি। এমন কিছু যা আমার অতীতের সাথে জড়িয়ে আছে।”
ঈশা অবাক।
“তুমি আমাকে দেখাবে?”
অভ্র মাথা নাড়ল,
“একদিন। কিন্তু আজ তোমাকে কিছু দেখাতে চাই। চলবে?”
ঈশা চুপ করে রইল।
ভেতরে কৌতূহল এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, সে রাজি না হয়ে পারল না।
---
দুজন ধীরে ধীরে কলেজের গেট পেরিয়ে বাইরে বেরোল।
পথের ধারে হাওয়া বইছে, গাছের পাতা দুলছে।
অভ্র ধীরে হাঁটছে, আর ঈশা তার পাশে।
মনে হচ্ছিল, এক অদৃশ্য পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
হাঁটতে হাঁটতে অভ্র বলল—
“তুমি কি ভয় পাবে না?”
ঈশা অবাক,
“ভয়? কেন?”
“কারণ আমি তোমাকে এমন কিছু দেখাবো যা হয়তো তোমাকে কাঁপিয়ে দেবে।”
ঈশার বুক ধুকপুক করতে লাগল।
তবু সে বলল—
“আমি ভয় পাব না। দেখাও।”
---
একটা পুরোনো পার্কে ঢুকল তারা।
পার্কটা প্রায় ফাঁকা।
দূরে কিছু বাচ্চা খেলছে, কিন্তু সেই বেঞ্চের কাছে কেমন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
অভ্র গিটার কেস নামিয়ে বেঞ্চে রাখল। ধীরে ধীরে খুলল।
সুরের বদলে বের করল একটা ছোট বাক্স।
বাক্সের ভেতর থেকে বেরোল একটা পুরোনো চিঠি।
চিঠির কাগজ হলদে, কোণে দাগ, মনে হলো বহুদিনের পুরোনো।
লেখা খানিকটা মুছে গেছে, কিন্তু হাওয়ায় গন্ধ—পুরোনো স্মৃতির মতো।
অভ্র ধীরে বলল—
“এই চিঠি আমার অতীতের।
কিন্তু তুমি এটা পড়বে না, অন্তত আজ নয়।
আমি চাই তুমি শুধু জানো—আমার জীবনে সবকিছু সরল নয়।”
ঈশা হাত বাড়িয়ে নিল চিঠি।
“কেন আমাকে দেখালে যদি পড়তে না দাও?”
অভ্র তার হাত থামাল।
“কারণ আমি চাই তুমি প্রস্তুত হও।
এই গল্পের ভেতর অনেক ব্যথা আছে।
আমি চাই না তুমি হঠাৎ করে সব শুনে আঘাত পাও।”
ঈশার চোখে জল জমল।
“তুমি কি মনে করো আমি দুর্বল?”
অভ্র মৃদু হেসে মাথা নাড়ল।
“না। আমি জানি তুমি সাহসী।
কিন্তু সত্যি শোনার জন্য কেবল সাহস নয়, সময়ও দরকার।”
---
ঈশা কিছু না বলে চুপ করে রইল।
তার বুকের ভেতর যেন ঢেউ উঠছে।
মনে হলো—ভালোবাসা শুধু হাসি-খুশি নয়, সেখানে ভয়ও আছে, অন্ধকারও আছে।
কিন্তু সেই অন্ধকারের সামনে দাঁড়ানোই তো সত্যিকারের ভালোবাসা।
দুজন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকল।
পাখির ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে।
মনে হচ্ছিল যেন সময় থেমে গেছে।
---
সন্ধ্যায় ঈশা বাড়ি ফিরে ডায়েরি খুলল।
কলম হাতে নিল।
লিখতে লাগল—
"আজ আমি এক চিঠি দেখেছি। যে চিঠি আমি পড়তে পারিনি।
কিন্তু আমার ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি জন্মেছে।
অভ্রর চোখে কিছু লুকোনো যন্ত্রণা দেখেছি।
হয়তো তার হাসির আড়ালে এমন কিছু আছে যা আমাকে একদিন কাঁদাবে।
আমি জানি না আমি প্রস্তুত কিনা, তবু মনে হচ্ছে আমি তার সঙ্গে সেই অন্ধকারেও হাঁটতে পারব।"
---
ঠিক তখনই ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল।
একটা নতুন নোটিফিকেশন।
প্রেরক—অজানা পাঠক।
বার্তায় লেখা—
"প্রথম ইঙ্গিত পেয়েছ।
সব সত্যি ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
ধৈর্য ধরো।"
ঈশার বুক কেঁপে উঠল।
সে জানত—এটা কেবল গল্প নয়।
এটা তার জীবন।
ভালোবাসা, রহস্য, ভাগ্য—সব একসাথে মিলছে।
রাতের দিকে ঘুমোতে গেলেও তার চোখ বন্ধ হচ্ছিল না।
মনে হচ্ছিল—প্রতিটি দিনই একেকটা পরীক্ষা।
প্রতিটি মুহূর্ত তাকে নিয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত ভবিষ্যতের দিকে।
অভ্র, চিঠি আর অজানা পাঠক—সব মিলিয়ে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।
---
Next part is coming......